ঠোঁট দিয়ে কতগুলো পিন আঁটকে ধরে মিসেস সিমন্স বললেন, ‘ জুডি, একদম নড়াচড়া করো না’। তিনি জুডির পোশাকের কোমরের দিককার ত্রিশতম দড়িটি শক্ত করে বাঁধলেন এবং বললেন, ‘এখন ওদিকে যাও এবং আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াও’।
জুডির বলনাচের প্রথম এই পোশাকটি বেশ দীর্ঘ। সাদা মিহি কাপড়ের উপর সুন্দর কারুকাজ করা এবং তার গোল বাদামী কাঁধ জুড়ে কুচি দেয়া। স্কার্টের নিচের দিকটা যেন বাটারফ্লাই ইফেক্টে ঝর্ণাধারার মত নেমে গেছে। বল নাচের অভিষেকের আজকেই এই দিনটিই জুডির আশৈশব লালিত স্বপ্ন ছিল, তবুও অসংখ্যবার পোশাক ঠিক করা এবং ছোটখাট সব বিষয়ে লক্ষ্য রেখে নিজেকে প্রস্তুত করা – তাকে অসহ্য যন্ত্রণা দিচ্ছে। তার চিন্তাজুড়ে কেবল বল নাচের অনুষ্ঠানটিই আবর্তিত হচ্ছে।
‘আমি তোমাকে আস্তে আস্তে ঘুরতে বলেছি!’ মিসেস সিমন্স-এর কালো কৌণিক মুখটা সবসময়ই ভয়াবহভাবে রসকষহীন হলেও - এখন সেটা যেন একদম শুকনো খেজুরের মত লাগছে। জুডি আড়ষ্টভাবে এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করল।
তার মা তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বললেন, ‘ নাহ, এখনো ঠিক হয়নি। কোমরের দিকটা আরো একটু আলগা করে দিতে হবে’।
‘আহ, মা !’ - জুডির ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে গেল, ‘এত ছোটখাট জিনিস কেউই খেয়াল করবে না’।
‘অবশ্যই খেয়াল করবে। সবাই প্রতি মুহূর্তেই তোমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে, এবং চেষ্টা করবে কিছু না কিছু খুঁত ধরার। আমি চাই তোমাকে সবচেয়ে সুন্দর লাগুক। তোমার মাথায় কি এটা ঢুকেছে?’ – মিসেস সিমন্স এর কন্ঠে হতাশার সুর বেজে ওঠে, ‘তোমার উচিত এসব নিজের তাগিদেই নিজেকে ঠিক করে নেয়া। আমি তো আর সারাজীবন তোমাকে সাহায্য করতে পারব না। এখন সোজা হয়ে ঘুরে দাঁড়াও’।
জুডির চোখ দুটো হঠাৎ জলে টলমল করে উঠলেও, তার পা দুটো নাচের জন্যে অধীর হয়ে আছে। সে বলল, ‘আহ, মা ! আমি আর সহ্য করতে পারছি না !’
‘কী বললে ! তুমি আর সহ্য করতে পারছ না?’- মিসেস সিমন্স তীক্ষ্ণ স্বরে চীৎকার করে উঠলেন, ‘তোমার কি মনে হয় আমার খুব ভালো লাগছে ?’
জুডি এবার সত্যিই লজ্জিত হল - এটা মনে করে যে, তার মা সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে শুধুমাত্র তারই জন্যে সেলাই মেশিনে কাজ করে নিজের আঙ্গুলকে সূচ ও পিনের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করেছে। এছাড়াও তার মনে পড়ল মিসেস সিমন্স-এর গত দু’বছরের বর্ননাতীত ত্যাগের কথা। আর এসবই সে করেছে যাতে করে তার মেয়ে জুডি বল নাচে অংশগ্রহণ করতে পারে।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার খুলে রাখ’- মিসেস সিমন্স বললেন, ‘আমি এটা রাস্তার ওপারে মিসেস লুবির কাছে নিয়ে যাব। সে আমাকে পোশাকটা ঠিক করতে সাহায্য করতে পারবে। এটা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে আমি কিছুতেই বাইরে পাঠাতে পারি না’।
জুডি নিষ্ফল আবেদনের সুরে বলল, ‘মা, এটা যেমন আছে তেমনই থাক না ! আমার তো মনে হচ্ছে, এটা একদম ঠিক আছে’।
পোশাকটা ভাঁজ করতে করতে মিসেস সিমন্স ভারী গলায় বললেন, ‘মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমি কিছুতেই তোমার মাথায় কিছু ঢোকাতে পারি না। রোজ গ্রিফিন কিংবা অন্য মেয়েরা যেমনতেমন হতে পারে; কিন্তু তুমি কখনই না। বুঝেছ? তোমাকে চেহারায় এবং আচরণে একদম ঠিকঠাক হতে হবে। তুমি সেখানে যেমন তেমনভাবে যেতে পারো না’।
নতুন স্ট্রেপলেস ব্রা এবং পুরোনো স্ন্যাগি পরা জুডি হঠাৎ শিহরিত হয়ে উঠল, ‘তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে – বল নাচে নয়, যেন আমি কোনো লড়াইয়ে যাচ্ছি’।
‘এটা অবশ্যই একটা লড়াই’ – জুডির মা দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘ আজ থেকে এটা শুরু হলো এবং সারাটাজীবন চলতেই থাকবে। এই লড়াইটা মাথাকে উঁচু রাখার, নিজের জন্যে জায়গা করে নেবার এবং কিছু একটা হয়ে ওঠার লড়াই। তোমার বাবা এবং আমি আমাদের সাধ্যমত সব করেছি। এখন তোমার নিজের লড়াই নিজেকেই শুরু করতে হবে’। তিনি জুডির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। তারপর নরম গলায় বললেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, দুশ্চিন্তা করো না। বিকেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিও। আর হ্যাঁ, চুলটা যেন কোনোভাবেই এলোমেলো না হয়’।
জুডি আন্যমনস্কভাবে বলল, ‘আচ্ছা মা, ঠিক আছে’।
জুডির সত্যিকার অর্থেই মনে হয়না আজ তার সাথে যা ঘটতে চলেছে তাতে তার বাবার কিছুমাত্র করার ছিল। আসলে এসবের পেছনে সব অবদানই তার মায়ের। যিনি অপেক্ষাকৃত সচ্ছ্বল, উজ্জ্বল বর্ণের মহিলাদের শত গঞ্জনার মধ্য দিয়ে, অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তাদের পোশাক তৈরি এবং রিপু করে, সভা সমাবেশে খাদ্যের সরবরাহ করে, অন্যান্যদের চেয়ে বেশি মেইল অ্যাড্রেস এবং টিকেট বিক্রি করে ‘গে চারমার’-এ তার অবস্থান অর্জন করেছিলেন। যদিও ক্লাব অনেক দিন ধরে তাকে আঁটকে রেখেছিল কিন্তু শেষমেশ তারা মিসেস সিমন্সকে সদস্যপদ দিতে বাধ্য হয়েছিল। কারণ তিনি কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। আর এসবই করেছিলেন তার মেয়ে জুডির জন্য, যাতে এ বছর বলনাচের তালিকায় তার জায়গা হয়।
জুডির বাবা শান্ত গোছের একজন কাঠমিস্ত্রি। বহুবছর আগেই সে অন্যকিছু হওয়ার বাসনা ত্যাগ করেছে। নিগ্রো সমাজ কিংবা জুডিকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে তার স্ত্রীর তীব্র ইচ্ছা – কোনোকিছু নিয়েই তার কোনো মাথাব্যথা নেই। তার মতে, ‘পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন এবং ভদ্র থাক। এটাই আসল কথা’।
জুডির বাবার এমন কথা শুনে তার মা মিসেস সিমন্স সবসময় জ্বলে ওঠেন, ‘ যদি এটাই আসল কাজ হত, তাহলে আমাদেরকে এখনো অন্যের দয়ার উপর বেঁচে থাকতে হত’। বারবার কর্মহীন হয়ে পড়ার কারণে জুডির বাবা এসব কথার উত্তরে লজ্জায় নিভে যান। কারণ মিসেস সিমন্স এর কাজ এবং সেলাই – তাদেরকে এখনো টিকিয়ে রেখেছে। এখন জুডির বাবা নিয়মিত কাজ করলেও ওর মা কাজ ছেড়ে থাকতে সম্মত হয়নি। যদিও যে কোনো মুহুর্তে সে এটা ছেড়ে দেবারও ইচ্ছা রাখে। মিসেস সিমন্স এর বড় কালো চোখের মধ্যে যে গভীর শক্তি প্রজ্জ্বলিত থাকে তা যেন তার সত্তাকেই স্থায়ী বিদ্রূপ করে। সে রাত দিন কাজ এবং বুদ্ধি-পরিকল্পনা করে সময় অতিবাহিত করে। জুডি জানে যে, তার মায়ের নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছে যাই হোক, তাদের ব্যর্থতার জন্যে সে তার বাবা মি. সিমন্সকেই দায়ী করে। তবে এখন তার সব জল্পনা-কল্পনা তাদের একমাত্র সন্তান জুডিকে ঘিরেই।
জুডি জানালার দিকে গেল। দেখল, তার মা পোশকটা নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তাদের বাড়ির দুই দিকে যে উঁচু ইটের দেয়াল আছে – সেটার ওপাশে অদৃশ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত সে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর নিজের ঘরে আসল। সোয়েটার পরতে গিয়ে মাথার চুল নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে - সে পোশাক পরল না। যদিও জুডির কাছে সবকিছু ঠিক মনে হয়, তবুও সামান্যতম এদিকসেদিকও তার মায়ের চোখ এড়িয়ে যায় না। সামান্য পোশাক পরাও তাকে তার মায়ের সাথে বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ করতে পারে। সে একটা টুল নিয়ে জানালার কাছে গেল এবং বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল। সেখান থেকে বাইরে দেখার মত তেমন কিছু না থাকলেও – তার এই ঘরটাকে সে পছন্দ করে। পাশের দেয়ালটা গলির ওপাশের জনাকীর্ণ বসতবাড়িগুলোকে আড়াল করে রেখেছে। এই আড়াল কিংবা অবসাদ থেকেই জুডি নিজের ইচ্ছেমত কাল্পনিক চিত্র নির্মান করতে পারে। আর এভাবেই সে তার স্বপ্নমাখা কৈশোরের বেশিরভাগ অবসর সময় অতিবাহিত করে।
‘হ্যালো, আমি কি যেতে পারি?’ - গলিতে একটা বালকের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সেই সাথে আরেকটি ছেলের হাসির শব্দ শুনতে পেয়ে জুডি কথাবার্তার পরিচিত ধরণটা বুঝতে পারল – যদি তুমি বল ‘হ্যাঁ’ তখন তারা বলবে, ‘আমি কি তোমার সঙ্গে যেতে পারি?’ তাকেও এভাবে অনেকবার চেষ্টা করা হয়েছে। সেসময় সে মাথা সোজা রেখে দ্রুত হেঁটে এসেছে, যেন সে কিছুই শুনতে পায়নি। তার মা এরকমই করতে বলেছেন। যদি তারা বুঝতে পারে যে সে একজন লেডি, তাহলে তাকে আর জ্বালাতন করবে না। কিন্তু এখন ওপার থেকে একটা মেয়ের ঠান্ডা নিশ্চিত গলা তাকে আশ্বস্ত করল, ‘তুই যদি নিজেকে যথেষ্ট বড় মনে করিস– তাহলে আয়’।
এটা লুসি মে’র গলা। জুডি লুসিকে আঁটসাঁট পোশাক আর উজ্জ্বল নির্লজ্জ চোখ নিয়ে সেখানে দাঁড়ানো অবস্থাটা কল্পনা করে নিল।
ছেলেটা উত্তর করল, ‘তোমাকে একটা বাচ্চা উপহার দেবার মত বড় আমি’।
জুডির সাথে কোনো ছেলে কখনো এভাবে কথা বললে সে বোধহয় মরেই যেত; কিন্তু সে জানে - লুসি মে এসব সামলাতে পারে। লুসি সব ছেলেকেই সামলাতে পারে, তারা সংখ্যায় একাধিক হলেও। কারণ সে জন্ম থেকেই এমন কিছু শিখেছে যা অন্য মেয়েদেরকে একসময় না একসময় অবশ্যই শিখতে হয়।
সে ছেলেটিকে বলল, ‘অ্যাঁ, আমাকে শান্তি দেবার মত যথেষ্ট বড় এখনো তুই হস নি’।
‘এদিকে এসো, তোমাকে দেখাচ্ছি আমি কতো বড়’ ছেলেটি বলল।
‘এই যে লুসি মে, আহা কি হচ্ছে ! এদিকে এসে আমাদেরকে বলো’ - অন্য একটি ছেলে বলে উঠল।
লুসি মে হাসল, ‘ আমি নিচের দিকে যা রেখেছি তা তোদের মত বাচ্চা ছেলেদের জন্যে সহ্য করা সম্ভব না’।
প্রথম ছেলেটি বলল, ‘এদিকে এসো বেবি, তোমার জন্যে একটা সিগারেট এনেছি’।
‘ও ! আমি তোর সিগেরেটটা তো দেখিনি’ লুসি জবাব দিল। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে আরও কাছে আসতে লাগল। যেন একেবারে জুডির নিচেই। সেখান থেকে একটা ধস্তাধস্তি ও লুসি মে’র হাসির শব্দ ভেসে এল। কথা বলার সময় লুসির কণ্ঠস্বর যেন হেয়ালিপূর্ণ মনে হল, ‘পারলে এদিকে আয় ! এটা খুলে আমাকে একটা সিগারেট দে’। আবারো ধস্তাধস্তির শব্দ পাওয়া গেল এবং একটা বিকট চড়ের আওয়াজও কানে এল। তারপর লুসি মে বলল, 'আমি এটা কাটতে বলেছি ! আর এখন সবগুলোই আমার’। লুসি মে হাই হিলের শব্দ করে পাশ দিয়ে চলে গেল। সাথে সাথে ছেলেগুলোও ছন্দহীন পদশব্দে তাকে অনুসরণ করল।
জুডি বুঝতে পারল যে, কিছুটা দূরে তিনজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। একজন বলল, ‘বাস্টার, ওকে যেতে দাও। ওকে এখন আর ধরতে পারবে না’।
‘ধুর শালা ! ও তো পুরো প্যাকেটটাই নিয়ে গেল’ - বাস্টার নামের ছেলেটি বলল।
‘এটা তোদের জন্যে শিক্ষা’ - দূরে রাস্তা থেকে লুসি মে’র কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘যা তোরা সামলাতে পারবি না, তা আর কখনো ঘাটাতে আসিস না’।
‘এই লুসি মে, এই ! আমি শুনেছি রুডি গ্রান্ট নাকি তোমাকে বেবি উপহার দিয়েছে’- দ্বিতীয় ছেলেটি চিৎকার করে বলল।
‘আচ্ছা, সত্যিই ?’ - সবচেয়ে ছোট ছেলেটাও জানতে চাইল।
কোনো উত্তর শোনা গেল না। সম্ভবত লুসি মে এরই মধ্যে অনেক দূরে - ব্লকের ওপাশে - চলে গেছে। কিছুক্ষণের জন্যে আড়ালের ছেলেগুলো চুপচাপ থাকল। তারপর ওদের মধ্যে একজন যেন ঠিক জুডির ঠিক নিচে এসেই অট্টহাসি হেসে উঠল। সেই সাথে অন্য দুজনও বিশ্রীরকম জোরে এবং মেয়েলিভাবে সে হাসিতে যোগ দিল।
এমন সময় বাস্টার অভিযোগের সুরে বলল, ‘ধুর শালা , কি নিয়ে এতো হাসছিস তোরা? মাগিটা আমার সব সিগারেট নিয়ে গেল ! লিরয়, তোর কাছে কি একটাও আছে?’
‘নাহ’ দ্বিতীয় ছেলেটি জানাল।
তৃতীয়জন বলল, ‘আমার কাছেও নেই’।
‘এখন কি করি ! আমার কাছে মাত্র পঞ্চাশ সেন্ট ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। ধ্যাত ! সিগারেটের বদলে আরো বেশি মজা চাই আমার’ - বাস্টার হতাশায় ঘানঘ্যানিতে উঠল, ‘ ধ্যাত্তারি বাল ! সিগারেটের বদলে একটা মাগি চাই’।
লিরয় নামের ছেলেটা বলল, ‘পরের বার পাবি ব্যাটা’।
‘মাগিটা একদম খাসা’ - বাস্টার বলল, ‘তুই তো জানিস ও দারুণ। আর শুনে রাখ - যদি এই পথে আবার ও আসে, আমরা ওর উপর ঝাপিয়ে পড়ব’।
লিরয় সম্মতি জানাল, ‘অবশ্যই । আমরা তিনজন মিলে ওকে ঠিকই বাগে আনতে পারব’।
সবচেয়ে ছোটজন বলল, ‘ আহ ! তখন আমাদের তিনজনেরই খুব মজা লাগবে’।
তার গলার স্বরে তাকে চৌদ্দ বছর বয়স্ক বলে মনে হল।
লিরয় বলল, ‘রোল্যান্ড আর জে টি’কেও আমাদের ধরা উচিত। একটা পুরো প্যাকেট সিগারেটের বিনিময়ে সে আমাদের পাঁচজনকেই আনন্দ দেবে’।
‘ধ্যাত্তারি, রোল্যান্ড আর জে টি’কে কেন?’ - সবচেয়ে ছোটজন ঘ্যানঘ্যানিয়ে উঠল, ‘ওরা এর মধ্যে কোত্থেকে এল। ওগুলো আমাদের সিগারেট’।
বাস্টার কর্তৃত্বের সুরে বলল, ‘ওগুলো আমার সিগারেট, সেটাই তো বলতে চাইছিস? আমি বাদ দেবার আগেই তোরা বরং মানে মানে কেটে পড়’।
‘ধুর শালা ! এমন করছিস কেন? আমরা তো তোর সাথেই’।
‘হ্যাঁ, বাস্টার, আমরা সবাই তো তোর দলেই। তুই আর আমরা কি আলাদা !’
‘আচ্ছা। ঠিকাছে। সেই ভালো’।
সেখানে কিছুক্ষণের নীরবতা নেমে এল। তারপর সবচেয়ে ছোটজন বলল, ‘ বাস্টার, মেয়েটার সাথে আমরা কী করব?’
‘যখন ও এদিকে আসবে, আমরা ওর উপর ঝাপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরব। তারপর ওকে নিয়ে সব রকমভাবে আনন্দ করব’ – এক নিষ্ঠুর উল্লাসের সাথে বাস্টার কথাগুলো বারবার বলতে লাগল। সে উল্লাস কিছুক্ষণের মধ্যেই গোপণ ক্রুরহাসিতে বদলে গেল। মাঝে মাঝে জুডি শুনতে পাচ্ছিল ‘মেয়ে’ এবং মেয়ে শব্দটির পরিবর্তে তাদের ব্যবহৃত অন্য একটি শ্রবণের-অযোগ্য শব্দ। শেষোক্ত শব্দটি উচ্চারণের সময় অট্টহাসি শোনা যাচ্ছিল। তবে এটা ভেবে জুডি তার ভয়কে ঝেড়ে ফেলল যে, লুসি মে যথেষ্ট স্মার্ট এবং ওদেরকে আজ আবারো এড়িয়ে যেতে পেরেছে। আগেও জুডি এই গলির ছেলেদের নোংরা কথাবার্তা শুনেছে এবং সেও প্রত্যেকবারই সফলভাবে তাদেরকে উপেক্ষা করে গেছে। এগুলো ওর পর্যন্ত পৌছাতে পারে না; দেয়ালটা ওদের থেকে জুডিকে আলাদা করে রাখে। দেয়ালের ওপাশে যত নোংরামি আর তার এপাশে সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ।
ওদের বিশ্রী কথাবার্তা মন থেকে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলতে জুডি রেডিও অন করে শুনতে থাকল এবং মিষ্টি সংগীতের তালে তালে ‘ট্যাপেস্ট্রি’ সেলাই করতে লাগল। তার আকাঙ্ক্ষিত জায়গাগুলোর কথা মনে করার চেষ্টা করল যেগুলোতে সে ঘুরে আসতে চায়। তারপর সে তার বন্ধুদের মুখ মনে করল। রোজ গ্রিফিনের তীক্ষ্ণ – ইন্ডিয়ান চেহারা দেয়ালে ভেসে উঠল। তার গায়ের রঙও ইন্ডিয়ানদের মত। তার চুলগুলো কালো, সোজা এবং চকচকে। জুডির চুল সাধারণত এর কোনোটাই না। এজন্যই গত চারদিন ধরে তার চুল ঠকঠাক করে রাখা হয়েছে, যাতে করে আজ রাতে তা রোজে’র চুলের মতোই অকৃত্রিম এবং চকচকে দেখায়। কিন্তু আকর্ষণীয় দেখতে হলেও রোজ খুব বোকা – সে প্রায়ই উঁচু গলায় হেসে ওঠে। এবং ছেলেদের মধ্যে গেলে সে আরও বেশি বোকা ও ভীত হয়ে পড়ে।
আসলে ছেলেদের সঙ্গে কী রকম আচরণ করতে হয় - জুডি নিজেও সে ব্যাপারে নিশ্চিত না। ক্যাথলিক হাইস্কুলে সিস্টাররা ছেলে এবং মেয়েদেরকে আলাদা করে রেখেছিল। নিচুশ্রেণির ছেলেমেয়েদের থেকে দূরে রাখার জন্যে তার বাবা তাকে সে স্কুলে ভর্তি করেছিল। কিন্তু এখন সে অনুভব করল যে, সে একটা গোপন কৌশল জানে। আজ রাতে তার সুন্দর পোশাক, সুবেশিত চুল আর সকল সৌন্দর্য নিয়ে সে একজন রাজকুমারীতে পরিণত হবে। আজ রাতে কলেজের সব ছেলেগুলো - যাদের সম্বন্ধে তার মা খুব আলোচনা করত - তার সাথে নাচের জন্যে অধির হয়ে উঠবে। এবং তখন অজানা কোনো জায়গা থেকে একটি ছেলে আসবে। জুডি যার নাম জানে না। এমনকি সে কলেজে গিয়েছি কি যায়নি - তাও না। তবু সে কল্পনা করল যে, সে হবে ঠিক তার মতই শ্যামবর্ণ। এবং অত্যন্ত সম্মান ও সংশয়ের সাথে সে জুডির হাতে চুমু খাওয়ার জন্যে নত হবে ...
রেডিও থেকে একটি বিশেষ নৃত্যসংগীত ভেসে এল। জুডির ঘরের দেয়ালটি গোধূলির আলোয় নীলাভ আভা ধারণ করল এবং নৃত্যরত ছায়ামূর্তি নিয়ে যেন তা জীবন্ত হয়ে উঠল। জুডি উঠে দাঁড়াল এবং এতদিন ধরে নাচের যেসব মুদ্রা সে অনুশীলন করেছিল – সেগুলো প্র্যাকটিস করতে শুরু করল। মুখে ভদ্রতাসূচক একটা মেকি হাসি ধরে রেখে সে তার কাল্পনিক স্কার্টের পাশ হাতে ধরে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল। সামান্য পরিমাণও এদিক সেদিক করা ছাড়াই সে গানের তালে তালে ঘুরতে থাকল। রেডিওর মিউজিকের চেয়ে যেন সে নিজের অন্তর্গত কোনো সুরের দোলায় ক্রমান্বয়ে দ্রুত গতিতে কাল্পনিক সঙ্গীর সাথে নাচতে লাগল। সে তার অন্তর্গত সত্তাকে উজাড় করে নেচে চলছিল আর ভাবতে লাগল, আজ রাতে সারা বিশ্ব তা’ই দেখবে, যার জন্যে সে এত বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে।
‘এই যে পেয়েছি’ – বাইরে থেকে কেউ একজন এদিকে তাকিয়ে বলে উঠল। জুডি এটা গ্রাহ্যই করল না, ঠিক যেমন সে গ্রাহ্য করবে না বল নাচে যাওয়ার সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ভীড়কে।
‘আহা, থেমো না। চালিয়ে যাও’- বলে উঠল একজন। জুডি নিজেকে দ্রুত দেয়ালের নিরাপদ কোণে সরিয়ে নিয়ে গেল।
‘আমি এসে তোমার সাথে নাচতে পারি?’
এ কথা শুনে জুডি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওর মনে হলো ছেলেগুলো যেন দেয়ালের এদিকটায় চলে এসেছে, কিংবা হতে পারে - তার ঘরের মধ্যেই।
ছোট ছেলেটা বলল, ‘ এই শালা, দ্যাখ ! এখান থেকে দেখতে কত ভালো দেখা যাচ্ছে। এতদিন কেন যে এটা চোখে পড়ল না ? ’
বাস্টার বলল, ‘ আসলেই ! মেয়েটার পেছন দিকটাও একদম খাসা’।
জুডি একথা শোনামাত্রই যেন শিহরিত হয়ে উঠল এবং তড়িঘড়ি করে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিল।
‘এই যাহ, আলো নিভিয়ে দিল!’ - অনুযোগের সুরে কেউ একজন বলে উঠল।
‘আলোটা জ্বেলে দাও লক্ষ্মীটি, আমরা তোমার কিচ্ছুটি করব না’।
‘আরেকটু নেচে দ্যাখাও, সত্যিই তুমি পারবে’।
‘আহা, আমি নিশ্চিত সে গতর দুলিয়ে নাচতে পারবে’।
‘তুই ঠিকই বলেছিস, শালা’।
বাস্টার নরম গলায় কামনা জড়িয়ে বলল, ‘নিচে নেমে এসো লক্ষ্মীটি, তোমার জন্যে আমি একটা সিগারেট এনেছি’।
‘হ্যাঁ, নেমে এসো। সিগেরেট ছাড়াও ওর কাছে তোমার জন্যে আরেকটা জিনিস আছে’ – কেউ একজন বিদ্রূপের স্বরে বলে উঠল।
জুডি যেন লজ্জায় তার ঘরের আলমারির দেয়ালের সাথে মিশে গেল। ধীরে ধীরে সে চীৎকার শক্তিও প্রায় হারিয়ে ফেলেছে। সে অনুভব করলো যে, তার পাগুলো থরথরিয়ে কাঁপছে। একটা বড় শ্বাস নিয়ে সে আলমারির দরজা খুলে একটা পোশাক বের করল। জানালার কাছে গিয়ে চীৎকার করে তার বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘আমি যা চাই তার কিছুই তোদের কাছে নেই। বুঝতে পেরেছিস’ - কিন্তু সে নিরস্ত হল। সে বুঝতে পারল এটা ছাড়াও তার আরও বেশি কিছু করার আছে।
চুলগুলোকে ঠিকঠাক রাখার জন্যে সে একটা প্লাস্টিকে মুড়ে নিল, তারপর দৌড়ে বাথটাবে গেল। তার মায়ের সবচেয়ে পছন্দের সুগন্ধির প্রায় অর্ধেকটাই সে ঢেলে দিল পানিতে। তারপর নিজেকে উন্মাদের মত ঘষতে লাগল। যখন সে বুঝতে পারল যে এর থেকে আর পরিস্কার হওয়া সম্ভব নয় তখন সে থামল। ভাবতে লাগল, অন্যেরা যাকিছু নোংরা মনে করে তা কখনোই ধুয়ে ফেলা যাবে না। যার জন্যে তারা ‘মেয়ে’ শব্দের পরিবর্তে অন্য কুৎসিত শব্দ গলির দেয়ালে লিখে রাখে, শরীরের সে অংশটা যেমন তার মায়ের আছে, রোজি গ্রিফিনের আছে, লুসি মে’র আছে; তেমনি তারও থাকবে। সে কিছুটা শান্ত হল এবং ভাবল, যে গলির এইসব ছেলেদের কাছে তাকে দেবার মত কিছুই নেই, অথচ তারা যা চায় তার সবকিছুই জুডির কাছে আছে। - এই উপলব্ধি তার লজ্জাকে এক ধরণের শক্তিতে বদলে দিল।
গোসল শেষে জুডি আরও কিছুটা সুগন্ধি শরীরে মেখে নিল এবং প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে মেকাপ করল। সে প্রায় ছয়বার তার ভ্রূ ঘষামাজা করে ঠিক করে - তারপরই সন্তুষ্ট হল। এরপর সে তার মায়ের ঘরে গিয়ে হ্যাঙ্গারে ঝোলানে বল নাচের পোশাকটা নিয়ে আসল এবং খুব যত্নের সাথে তা পরল ।
যখন মিসেস সিমন্স জুডিকে ঠিকঠাক করার জন্যে উপরের ঘরে আসলেন, তিনি দেখলেন আয়নার সামনের ঠিক যেন একেবারে রাণীর মত করে তার মেয়ে বসে আছে। খুব সজীব, আত্মবিশ্বাসী, শান্ত এবং পরিণত লাগছে তাকে।
মিসেস সিমন্স অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি নিজেই কেন পোশাক পরে ফেলেছ ?’
তার কণ্ঠস্বর শুনে জুডি খুব সতর্কতার সাথে অত্যন্ত ধীর পদক্ষেপে হেঁটে এগিয়ে এল - ঠিক যেন একটা ম্যানিকিনের মত।
জুডি তার জামার পেছন দিকটা দেখিয়ে বলল, ‘মা, আমার কাপড়ের এদিকটা এখনো ঠিক হয়নি, এটা ঠিক করে দাও’। তার মা বাধ্যগত মেয়ের মত হাটুগেড়ে বসে জুডির জামার পেছনটা দেখতে লাগলেন এবং বললেন, ‘এটা একদম ঠিক আছে’। তিনি সেখানে আরও কয়েকটি পিন বসিয়ে দিলেন।
জুডিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, এবার ঠিক আছে। এখন এটা পরা অবস্থায়ই তুমে সেলাই করে দাও। খুলতে গেলে আবার চুল নষ্ট হবে’।
মিসেস সিমন্স সেলাইয়ের সরঞ্জাম নিয়ে এসে মেয়েকে আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন এবং বললেন, ‘তুমি নিজেই নিজেকে খুব সুন্দর করে গুছিয়েছ। কোথাও এতটুকুও ভুলচুক হয়নি। তোমাকেও অন্য সবার মতই সুন্দরী দেখাবে’।
মিসেস সিমন্স সেলাই করার সময় জুডি বলল, ‘জানিনা কেন তুমি এত চিন্তা কর? অবশ্যই আমাকে ভালো দেখাবে’। জুডির আত্মবিশ্বাসের গোপন অনুভূতি অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে দৃঢ় হয়ে ফিরে এল। কিন্তু আসন্ন সন্ধ্যা তার কাছে আর বালিকাসুলভ কল্পনার প্রতিমূর্তি নয় বরং এখন সে একটি নির্দিষ্ট লক্ষের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সে বলনাচের মধ্যমনি হয়ে উঠবে কারণ সে এখন এমন কিছু জানে যা রোজ গ্রিফিন আর তার বোকাটে বন্ধুরাও জানে না। এমনকি তার মা কিংবা লুসি মে’র চেয়েও সে এখন বেশি সচেতন। আর সে এটাও জানে যে তার মূল্য সামান্য এক প্যাকেট সিগারেটের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।
সেলাইয়ের সুতো কেটে দিয়ে জুডির মা বলল, ‘এইতো হয়ে গেছে। আমি আশাই করিনি তুমি এতো তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে যাবে। আর্নেস্ট লি’র আসতে এখনো এক ঘন্টারও বেশি লাগবে’।
জুডি তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, ‘হাহ ! ওই বোকাটে আর্নেস্ট লি !’
আজ এই মুহূর্তের পূর্ব পর্যন্ত সে আর্নেস্ট লি’র সাথে নাচতে যেতে পেরেই জুডি খুশি ছিল। কিংবা আর্নেস্ট লি’ই হতে পারত তার স্বপ্নের রাজকুমার। লি শান্ত এবং শ্যামবর্ণ। ও কখনো কলেজে যায়নি। গে চার্মারস-এর কলেজ পড়ুয়া অন্যসব ছেলেরা তাদের সঙ্গী জুটিয়ে ফেললে, মিসেস সিমন্স নিতান্ত অনিচ্ছায় জুডির সাথে আর্নেস্ট লি’কে নাচের জন্যে নির্বাচন করেছেন। জুডি মৃদুস্বরে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, ‘ মা, তুমি দেখো – আমি প্রথম নাচের পরই লি’কে ছুড়ে ফেলব। আর কলেজপড়ুয়া কোনো ছেলেকে সাথে নিয়ে - তবেই বাড়ি ফিরব’।
এক ঘন্টা পরে আর্নেস্ট লি এলে তার দেয়া সাদা অর্কিড হাতে নিয়ে জুডি বলল, ‘ এগুলো খুব সুন্দর। তবে বেশ ছোট। যদি কিছু মনে না কর তাহলে এগুলো আমি হাতে করে রাখি?’
তারপর একটা হেয়ালিপূর্ণ মিষ্টি হাসিতে সে আর্নেস্ট লি’র দিকে তাকিয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেল, লি তখন বিভ্রান্তভাবে জুডির জন্যে দরজা খুলে দিতে - দরজার নব হাতড়াচ্ছিল।
জুডি আর আর্নেস্ট চলে গেল মিসেস সিমন্স তার স্বামীকে বলতে লাগলেন, ‘ শুনছো এডওয়ার্ড, জুডিকে নিয়ে আমার আর কোনো চিন্তা নেই’। তার কথায় মি. সিমন্স গুরুত্ব দিচ্ছেন না দেখে তিনি হঠাৎ কড়া গলায় বলে উঠলেন, ‘পেপার রেখে আমার কথা শোনো। সন্তানের প্রতি তোমার কি কোনো আগ্রহই নেই?’ পত্রিকা রেখে এডওয়ার্ড জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। মিসেস সিমন্স বললেন, ‘আমি বলছিলাম যে জুডিকে এতকাল যা আমি শেখাতে চেয়েছিলাম, আমার বিশ্বাস অবশেষে তা সে শিখে ফেলেছে’।
-------------------------------------
গল্পঃ Debut
মূল লেখকঃ Kristin Hunter
অনুবাদঃ এস এম মামুনুর রহমান [ ডি মুন ]
-------------------------------------
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১০:২৫