ভ্যালেন্টাইনস ডে চলে গেল। গেল তো গেল, দেশ ভালবাসায় ভাসিয়ে দিয়ে গেল। যেদিকেই তাকাই একেবারে ভালবাসার তুফান বইছে। ডানে ভালবাসা, বামে ভালবাসা। রাস্তায় ভালবাসা, বাসার ছাদেও ভালবাসা। মাঠে ময়দানে যেমন, রিকশা গাড়িতেও ভালবাসার বান। ফাল্গুনের রঙে মুখ-চোখ লাল তরুণী আর শহীদ মিনার কাটিং চুল আর হলুদ পাণ্ঞ্জাবী তরুণের গা বেয়ে পড়ছে ভালবাসা। লাল গোলাপ বেচে লালে লাল শাহবাগের ফুল ব্যবসায়ী, ওদিকে খাবারের দোকানে চোখে চোখে তাকানোর ফাঁকে হাজার হাজার টাকা হয়ে উড়ে যাচ্ছে ভালবাসা। টিএসসিতে আর চারুকলায় ধুম, ঢাকার রাস্তা পক্ষাঘাতের রোগী দু'দিনের জন্য, ১৫ মিনিটের রাস্তা যেতে দেড় ঘণ্টা, কিন্তু ভালবাসার কমতি নেই কারো তাতে, ফকিন্নি আর চোরাকারবারির পোলাপান, ভাল ছেলে আর বখাটে, গার্মেন্টস কর্মী আর ফেরারী গাড়ির মালিক, যার কাছে যা আছে সব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ময়দানে, এই দিনে প্রমাণ করেই ছাড়বে, যুদ্ধ আর ভালবাসার মাঝে কোন পার্থক্য নেই।
ভালবাসার অত্যাচারের আরেক দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে আন্তর্জালে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস, কারো ভালবাসা উথলে পড়ে ঘর ভেসে যাচ্ছে, তো কারো ভালবাসার কেউ নেই বলে কেঁদে দু'কুল উপচে যাচ্ছে। অত্যাচার এখানে শেষ হলে কথা ছিল, ফেসবুকের ওয়ালে হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস ডে, মেসেন্ঞ্জারে ভালবাসা দিবসের শুভেচ্ছা, ক্লাসে গেলে ভ্যালেন্টাইনস ডে'র পরিকল্পনা শুনিয়ে কান ঝালাপালা। যাকে বলে, ভালবাসা বিলালে বেড়ে যায়, কাজেই অন্যকে জোর করে গিলিয়ে হলেও সেটা বাড়াতে হবে। এই ভালবাসার অত্যাচারে তিতিবিরক্ত হয়ে গতবার এক বন্ধু ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে রেখেছিল--- "পয়লা ফাল্গুন, বইয়া বইয়া বাল গুন, সবাইরে হ্যাপি বাল-এ-টান ডে।" আপাত অশ্লীল কথাটা খারাপ কাজে দেয়নি, অন্তত তাকে কেউ ভালবাসা জানাতে আসেনি।
ভালবাসা দিবস নিয়ে এমনতরো বিরক্তি প্রকাশে অনেকেই আবার মহাখাপ্পা। আরে ব্যাটা আমি ভালবাসা দেখাবো তোর কি? পান না তাই খান না? আমার পয়সা খরচ করে আমি যদি প্রেমিকা নিয়ে ঢলাঢলি করি তোর গা জ্বলে কেন রে? আবার অনেকে এতটা রূঢ় নন, তারা হাজির করেন সুশীল যুক্তি, আরে ভাই ভালবাসা যদিও সারা বছরের জিনিস, তাও মাঝে মাঝে প্রকাশ করা ভাল, বছরের একদিন করলে ক্ষতি কি? জবাবে বলি, তো সেটা নির্দিষ্ট একদিন করে দুনিয়ার লোককে জানান দিয়েই কেন করতে হবে বাপ? আসল ভালবাসা যদি কিছু থেকেও থাকে, সেটার থেকে লোককে দেখানোই তো বড় হয়ে যাচ্ছে, লোকের তাকানোর ঠেলায় ভালবাসার তো জানালা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার যোগার।
এসব পাল্টা যুক্তিতে অবশ্য প্রেমিক হৃদয়ের বাঙ্গালিকে টলানো সম্ভব না, টলবে এমন আশাও করি না, কেউ যদি নিজের ঘরের ভালবাসা দিয়ে বিশ্বচরাচর ভাসিয়ে দিতে চায় তাতেও বাধা দেয়ার কোন কারণ দেখি না। বিরক্তিটা তখনই লাগে যখন ভালবাসা দিবসের ভালবাসার জ্যামে পড়ে ১২ মিনিটের রাস্তা যেতে মাত্র ১ ঘণ্টা ১২ মিনিট লাগে আর জরুরী ক্লাসের প্রায় পুরোটাই পার হয়ে যায়। আরো বিরক্ত লাগে যখন যতটা না ভালবাসা তারচেয়েও বেশি রাস্তার লোককে গায়ে পড়ে দেখানোর চেষ্টাকে। দ্যাখ ব্যাটা, আমি কত আগে, পশ্চিমারাও লজ্জা পাবে, তুই পারবি? এদিকে পোলাপানের মাথা হয়েছে গরম, স্কুলের বাচ্চারাও নেমে গেছে মাঠে প্রেমিক-প্রেমিকা, বা ওদের ভাষায়, বিএফ জিএফ খুঁজতে। লাভের লাভ, মোবাইল কোম্পানির পোয়া বারো, আর বাপ-মায়ের মাথা গরম। রাস্তায় পা ফেলা যায় না, কুঁচো চিংড়ির বয়সী জোড়ারা গায়ে এসে পড়ে, ,রেস্টুরেন্টে খাবার জায়গা নেই, ৩ দিন আগে থেকে নাকি সব বড় রেস্টুরেন্টের টেবিল সংরক্ষিত। নিজের না থাকলে বাপের পকেট কাটো, কিন্ত বিএফ জিএফকে ইমপ্রেস করা কিন্তু চাই। সত্যিকারের প্রেমিক-প্রেমিকারাও এই বাবদে বিপদে, সব লোক ভ্যালেন্টাইন ডে তে ঘুরতে যায়, আমরা না গেলে কেমন হয়? কাজেই আবারো সময় আর পয়সার শ্রাদ্ধ। ওদিকে ডিজুস জেনারেশনের বছর বছর নতুন ভ্যালেন্টাইন, সাথে ডিজে পার্টি, ফুর্তিই ফুর্তি, মূল্যবোধ চুলোয় যাক, সাথে একজন হাইক্লাস না থাকলে আর সবাইকে দেখাতে না পারলে দাম আছে নাকি?
তথাকথিত মূল্যবোধের ফান্ডা করে দিতে একধাপ এগিয়ে আবার পত্রপত্রিকার ধান্দাবাজ সম্পাদক আর গর্দভ সাংবাদিকগুলো, পাল্লা দিয়ে চলছে টিভি চ্যানেলগুলোও। প্রথম আলো যেমন বদলে দেবার শপথ নিয়েই নেমেছে, কাজেই বিজয় দিবসে তারা লাল-সবুজ খাবারের মত পয়লা ফাল্গুনে বাসন্তী খাবার বানানোতে অবাক হইনা। সাথে থাকে ফাল্গুনের বিশেষ সাজগোজের উপর বিশেষ সংখ্যা, কোন জামাটা এবার না পরলে আর লোকে যুগের সাথে বদলাচ্ছেই না, কোথায় গিয়ে ফাল্গুনের দুপুরে লান্ঞ্চ না করলে প্রগতিশীল বলাই যাচ্ছে না, তার নানা খবর নিয়ে প্রতিদিনই আসছে বিশেষ প্রতিবেদন। আজকের প্রতিবেদনের শিরোনাম-- "যুগলরা কোথায় যাবেন?" হা খোদা, বাঙালির বদলে যাবার কি করুণ নমুনা, যুগলদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপারেও এখন যুগবদলের কারিগররা দিকনির্দেশনা দিয়ে দেয়, কর্পোরেট আগ্রাসনের কি ভয়াবহ চিত্র। নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, অমানুষগুলো জাতীয় শোক দিবস একুশে ফেব্রুয়ারির জন্যও বিশেষ ফ্যাশন সংখ্যা বের করবে, শিরোনামটা হয়তো হতে পারে--- "সাদা-কালোতে একুশের দুপুর"- যেখানে কোমর বাঁকিয়ে মোহময়ী ভঙ্গিমায় কোন বাংলা না জানা তরুণী অমর একুশের শহীদদের আত্মাকে নির্মম ব্যঙ্গ করে যাবে।
তবে এই কর্পোরেট আগ্রাসন আর গা ভাসানোর মাঝে এসব ফালতু বকবক করে বিশেষ একটা লাভ হয় না, বরং ক্ষেত্রবিশেষে গণধোলাই খাবার আশংকাটাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। আজকাল আবার সব"প্রাইভেট ম্যাটার", যার যার তার তার। এই যার যার পাওনা তার তার করে নেয়ার প্রতিযোগিতাতেই তাই ছুটছে সবাই, ওর আছে, কাজেই আমারো থাকতে হবে। ও দেখাচ্ছে, তাই আমাকে আরো বেশি দেখাতে হবে। সেটা জাঁকজমক আর বিলাসদ্রব্যের বেলায় যদি সত্যি হয়, ভালবাসার বেলায় কেন সত্যি নয়? কাজেই ভালবাসারও দেখাদেখি এবং দেখানো চলছে জোরেশোরে, মুখের হাসি বড় হচ্ছে মোবাইল কোম্পানির আর মিডিয়ার, ব্যবসাই ব্যবসা, লালে লাল। ভালবাসার খাবার, ভালবাসার পোশাক, ভালবাসার কার্ড, ভালবাসার চকলেট, ভালবাসার গাড়ি, ভালবাসার শাড়ি, এত পণ্যের ভালবাসার মাঝে শুধু হারিয়ে যাচ্ছে ভালবাসার এক মুহূর্তের চোখাচোখি হৃদয়ের সবটুকু ভালবাসা নিয়ে।কোটি কোটি টাকা একদিনেই বাতাসে উড়ছে, যে ছেলেটা দু'টাকা পকেট থেকে বের করে টিএসসির বাচ্চাটার কাছ থেকে চকলেট কিনতে গেলেও মাথায় রক্ত উঠে যায়, কখনো বা লাথিও মারতে চায়, প্রেমিকার চাঁদমুখের দিকে তাকিয়ে আজ তার পকেট থেকেই অনায়াসে বেরিয়ে আসে হাজার টাকার ৫ খানা নোট, ১০ খানাও হতে পারে। টিএসসিতে আবু বকরের মৃত্যুতে একটা মিছিলে যাবার সময় নেই যে ছেলের, নতুন জিএফের মান রাখতে শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে বেড়ায় সে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শহীদদের জন্য ১৪ ফেব্রুয়ারির একমুঠো ভালবাসা মেলে না আমাদের বুকে, ভালবাসা মেলে শুধু প্রেমিকার রজনীগন্ধায়। ভালবাসা এখন বাজারী পণ্য, তাই ভবিষ্যতে যে ছেলেটা ভালবাসতেও পারতো, ছাত্ররাজনীতির সন্ত্রাসীদের আঘাতে মৃত সেই ছেলের জন্য তার ক্যাম্পাসের মানুষগুলো দু'দণ্ড ভালবেসে চোখের জল ফেলে না, দূরের এক গ্রামে বড় বেশি ভালবাসার মৃত ছেলেটার জন্য যে বাবা-মা চোখের জল ফেলেন, তাদের কথা ভাবার আমাদের সময় হয় না। অবাক চোখে দেখি যে ক্যাম্পাস এককালে জ্বলে উঠতো সামান্য অবিচারে আগুনের মত, সেখানে আজ এত বড় অবিচারের প্রতিকারের দাবীতে সামান্য একটা স্ফুলিঙ্গ নেই। নেতাদের ভালবেসে আজ আমরা মিছিল করি, দলকে ভালবেসে মিছিল করি, প্রেমিকাকে ভালবেসে জীবন দিতে অঙ্গীকার করি, অথচ প্রতিদিন যে ছেলেটা গুটি গুটি পায়ে ক্যাম্পাস দিয়ে হেঁটে যেত তার জন্য চোখের পলক ফেলি না, তার জন্য আমাদের বিশাল হৃদয়ের এক কণা জায়গাও বরাদ্দ নেই। থাকবে কিভাবে, এত্ত এত্ত ভালবাসা দিয়ে সব ভরাট হয়ে গেছে যে গো, আবর্জনার জায়গা কোথায় সেখানে?এসব নিয়ে যেসব অর্বাচীন হল্লা করে, কর্পোরেট ভালবাসার ঘোরলাগা চোখে আমরা তাদের বলি, দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর, ভালবাসিবারে দে মোরে অবসর।
এই ভ্যালেন্টাইন ডেতে তাই আমরা ভালবাসবো, আমরা হাসবো, আমরা ঘোরের মাঝে হারিয়ে যাবো, আমরা আনন্দে অবগাহন করবো ফাল্গুনের রঙে। আবু বকরের মাথার পেছনে আঘাত করে যে অমানুষ তার স্বপ্নকে থামিয়ে দিয়েছিল, আজ হয়তো সে-ও তার প্রেমিকার কোলে মাথা রাখবে, কোন একদিন এই আমরাই আবার তাকে ভালবেসে নেতা বানাবো, এমপি বানিয়ে সংসদে পাঠাবো, মন্ত্রী হয়ে তারা আবার ভালবেসেই আমাদের পশ্চাদ্দেশে বাঁশ ঢুকিয়ে সেই ভালবাসার প্রতিদান দেবেন, আমরা তখনো তাদের ভালবেসে ফুলের মালা পরাবো, এদেশ তো ভালবাসার দেশ, এখানে ঘৃণার স্থান কোথায়?
টিএসসি আজ ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে, বাসন্তী রঙে রঙিন হবে আমাদের কাপুরুষ হৃদয়, একে-অপরের চোখে তাকিয়ে আমরা স্বর্গ খুঁজবো, শুধু স্বর্গত মৃত সহপাঠীর কথা আজ আমরা ভাববো না, তার জন্য ভালবেসে আমরা একবারো চোখ ভেজাবো না, তার হত্যার বিচার চেয়ে আমরা আজ একটা কথাও বলবো না, বাজারিকরণের এই যুগে নিরীহ একটা অরাজনৈতিক ভালবাসার কোন দাম এখন আমাদের কাছে নেই। একটা যুদ্ধের কালে মায়ের জন্য ভালবাসায় যে জাতির মেরুদণ্ড ইস্পাতের চেয়েও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, মার্কেট ব্র্যান্ড ভালবাসায় স্বার্থপর শহরে আজ তা রাবারের চেয়েও নরম হয়ে গেছে।
ভালবাসার রসে আমরা বড় বেশি ভিজে গেছি, রসসিক্ত এই ভালবাসার ভিড়ে সামান্য বারুদ আমাদের খুব বেশি দরকার, বারুদের সেই ভালবাসায় বিশুদ্ধ হওয়া আমাদের অনেক বেশি প্রয়োজন।