somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীর একরাত - ১

২১ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১২:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


জেমস বন্ড নিয়ে তার কোন মাথাব্যাথা ছিলনা, অবশ্য আমার 'বন্ড এডিকশান' এর কথা তার অজানা ছিলনা। তাই দেশ ছাড়ার আগে ব্যাগ গোছানোর সময় এক সেট ডিভিডি উপহার পেয়েছিলাম। 'ডঃ নো' থেকে 'কোয়ান্টাম অব সোলাস'; পুরো বাইশটাই! প্রগলভ হয়ে সে যখন জানতে চেয়েছিল যে, আমিকি আদৌ কোন শান্তিরক্ষা মিশনে যাচ্ছি, নাকি সাফারি তে? আমি রহস্যময় একটা দেঁতো হাসি দিয়েছিলাম আর তাতে সে কপট রাগে গাল ফুলিয়েছিল। হটাত দূর দিগন্তে আবছা নড়াচড়া টের পেয়ে মুহুর্তেই স্মৃতি রোমন্থন থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম। নিজেকে মনে করিয়ে দিলাম যে, যদিও এইমুহুর্তে একটা সাভান্নাহতেই বসে আছি, কিন্তু উপলক্ষ্যটা আর যাই হোক, সাফারি না। কিছুক্ষনের মধ্যেই সেন্ট্রি নিশ্চিত করল, ক্রিস্মাসের পার্টি শেষে কোনএক মাতাল বাড়ি ফিরছে। এতোটাই গিলেছে যে, চলতে চলতে পেটমোটা এম আই-৮ হেলিকপ্টারের দেয়াল ধরে হর হর করে একগাদা বমি করল, তারপর 'মেরি ক্রিস্মাস' বলতে বলতে কোন জিজ্ঞাসা ছাড়াই অন্ধকারে হারিয়ে গেল।


পরদিন ছিল ক্রিস্মাসের ছুটি, তাই 'ইয়ারমুখের যুদ্ধ' এর উপর লেখাটা শেষ করতে সারারত জেগে বাইজান্টাইন আর্মি, খেলাফায়ে রাশেদিন আর খালিদ বিন ওয়ালিদ এর উপর গুগল করেছি। তাই একটা লম্বা ঘুম পাওনা ছিল। ঘুমটা আরেকটু লম্বা হতে পারত। কিন্তু বিকেল সাড়ে চারটার দিকে কোম্পানি কমান্ডারের ডাক পরল। তিনি জানতে চাইলেন, এক্ষুনি একটা ফোর্স প্রটেকশন পেট্রল নিয়ে বেরুতে হবে, পারব কিনা? সম্মতি জানাতেই বললেন, 'হারি আপ।' এসাইনমেন্ট পাবার পর অফিসাররা এমনিতেই যথেস্ট 'হারি' তে থাকে। উপরন্তু 'হারি আপ' বলা মানে ব্যাপার গুরুতর, এবং দ্রুততম রেস্পন্স কাংখিত। তাই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে রুমের বাইরে এসে দেখি জীপ সমেত কোম্পানি কমান্ডার নিজেই উপস্থিত। উঠে বসতেই জীপ ছুটে চলল জুবা মুভকন (অস্থায়ী বিমানবন্দর) এর দিকে। জানলাম আমার জন্য একটা হেলিকপ্টার অপেক্ষা করছে!

জীপে যেতে যেতেই জেনে নিলাম কেন, কোথায়, কিভাবে আর কতজন নিয়ে যেতে হবে। ঘটনা হল, ইউ এন এর একটা হেলিকপ্টার ইস্টার্ন ইকোটরিয়ার লাফোন এলাকায় নস্ট হয়ে পরে আছে। হেলিকপ্টারটা দক্ষিন সুদানের জন্য আসন্ন গনভোটের পর্যবেক্ষকদের নিয়ে সুদান চষে বেড়াতে বেরাতে লাফোনে গিয়ে আর স্টার্ট নিচ্ছেনা। বেলা পরে গেছে আজ, তাই জুবা থেকে একটা হেলিকপ্টারে করে আমরা ফোর্স প্রোটেকশন নিয়ে যাব রাত জেগে ঐ নস্ট হেলিকপ্টারটা পাহারা দিতে আর এই হেলিকপ্টারে করে আটকে পড়া পর্যবেক্ষক আর নস্ট হেলিকপ্টারের ক্রুরা জুবা ফিরে আসবে।

সাধারনত দিনের রুটিন ফোর্স প্রোটেকশন পেট্রলগুলো জেসিও এনসিও রাই লিড করে থাকেন। কিন্তু মেইন বেইজ থেকে এতোটা দূরে গিয়ে রাতে ফোর্স প্রোটেকশন দেয়ার কথা ভেবে শেষমুহুর্তে একজন অফিসার পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হল। যেকোন জরুরী পরিস্থিতির মজার বিষয় হল অনেক রুটিন ফর্মালিটিজ স্কিপ করা যায়। আজ যেমন উটকো ইমিগ্রেশন ফর্মালিটিজ ছাড়াই সোজা রানওয়েতে পৌছে দেখি দশজনের একটা পেট্রল ইতোমধ্যে অপেক্ষায় আছে। সবাই আমার মতই ঘুম থেকে উঠেই এসেছে বলে মনে হল। সবারই ছুটির দিনটা মাটি হচ্ছে! সবচে বিমর্ষ দেখাচ্ছে দুজন মিলিটারি অবজারভারকে। থেমে থেমে এরা আমাকে জিজ্ঞেস করছে, 'হোয়াই আস?'

রাতে উড়ার উপযোগি এই রাশান হেলিকপ্টারটা দেখলাম কিছুটা অন্যরকম। আরদশটার চেয়ে কিছুটা ভারী মনে হল। অনেকক্ষন ধরে রোটর ঘুরছে। কান তালা লেগে যাবার উপক্রম। অবশেষে চড়ে বসার সিগন্যাল এল। চড়ে বসতেই পাইলট বলল অন্তত দুইজনকে নেমে যেতে হবে। পেট্রলের অস্ত্র-গোলাবারুদ সহ ওজন সম্ভবত বেশি হয়ে গেছে। মুহুর্তের ভেতর মিলিটারি অবজারভার দুইজন কেটে পড়ল।

৪৫ মিনিটের আকাশ যাত্রা শেষে লাফোনের আকাশে পৌছে গেলাম। ইতোমধ্যে চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাটি ছুঁইছুঁই অবস্থায় হেলিকপ্টারটা চারপাশে ধুলার মেঘ বানিয়ে ভাসতে থাকল। আমরা একে একে নেমে যেতেই, টপাটপ আটকে পড়া পর্যবেক্ষক আর নস্ট হেলিকপ্টারের ক্রুরা উঠে বসে গেল। মাটিতে পা দিয়ে ধাতস্ত হবার আগেই চারপাশের ধুলার মেঘটাকে আরো গাঢ় করে দিয়ে হুশ করে হেলিকপ্টারটা উড়ে গেল। ধুলার টর্নেডোটা কেটে যেতেই তারার আলোয় কিছুদুরে অলস পড়ে থাকা নস্ট হেলিকপ্টারের অবয়বটা চোখে পড়ল। পকেট থেকে স্যাটেলাইট ফোনটা বের করে জুবায় জানিয়ে দিলাম যে নিরাপদেই এসে পৌছেছি।

যাবার আগে রাশান পাইলটরা হেলিকপ্টাররের দরজা লক করে গেছে। উপরে চাঁদ হীন তারা ভরা আকাশ। চারপাশে যতদুর দেখা যায় ছোট ছোট কাটা ঝোপের প্রান্তর। বড় কোন গাছ নেই। দিগন্ত জুড়ে ইস্টার্ন ইকোটরিয়ার পর্বতের সারি আবছা চোখে পড়ে। দূরে কিছু বিক্ষিপ্ত আলো দেখে জনপদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়, আর ওদিক থেকেই ভেসে আসা ভোতা অস্পস্ট মিউজিকের শব্দে ঠাহর করে নেয়া যায়, ঐটাই লাফোন গ্রাম। গ্রাম বলতে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু কুড়েঘর, স্থানীয়রা বলে টুকুল। আন্দাজে বলে দিতে পারি, আজ ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে সবাই জড়ো হয়ে চোলাই মদ গিলছে আর হৈ হল্লা করছে। মাঝরাতের পর এই আড্ডা ভাংবে হয়ত।

নিজেদের দিকে নজর দিলাম এবার। দিনের আলো পাইনি তাই চারপাশটা দেখার সুযোগ হয়নি। এখন আর সম্ভবও না। দুষ্কৃতিকারীদের ভয় তো আছেই, সেই সাথে মাতাল গ্রামবাসীদেরও বিশ্বাস নেই। এরা জন্মগতভাবেই বেশ উগ্র। বাংলাদেশী শান্তীরক্ষীদের প্রতি যদিও এদের আলাদা কোন দ্বেষ নেই, তবে রাত বিরাতে হেলিকপ্টার ভাঙ্গার শখ হওয়াটা এদের জন্য বিচিত্র কিছু না। যুদ্ধ এবং শান্তিরক্ষার মধ্যে বিস্তর ফারাক। ইউএন শান্তিরক্ষিদের অবস্থান জানান দেবার একটা বাধ্যবাধকতা আছে। সাধারন যোদ্ধা প্রতিকুল এলাকায় নিজেকে লুকিয়ে রাখে। এখানে অবস্থা বিচিত্র। কেউ যদি আক্রমন করে বসে, ইউএন এর ঝান্ডা দেখিয়ে এই রাতের বেলা পার পাওয়া যাবেনা। রাতে মেরে কেটে মোরব্বা বানিয়ে সকালে যদি বলে অন্ধকারে ঠাহর করতে পারি নাই। ইউএন মাইন্ড করবে না এবং আমাদের আটটা লাশ সুন্দর কফিনে করে দেশে পাঠিয়ে দেবে সানন্দে।

অগত্যা আটজনে মিলেই ম্যানেজেবল একটা সিকিউরিটি পেরিমিটার দাড় করিয়ে ফেললাম। যে পরিমান ফায়ার পাওয়ার আছে তাতে আপাতত ট্যাঙ্ক নিয়ে না আসা পর্যন্ত কোন ভয় দেখিনা। তাছাড়া নিকটস্থ বাংলাদেশী ক্যাম্প টরিটের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। সমস্যা হলে ঘন্টা তিনেকের ভেতর পৌছে যাবে। বিষয়টা হল তিন ঘন্টা পর্যন্ত টিকে থাকা। কিন্তু কেউ যদি আহত হয় তাকে ট্রিট করার মত একটাও আড় নেই আশে পাশে। চোখ পড়ল হেলিকপ্টারটার ওপর। এম আই-৮ বেশ শক্ত ফড়িং বলেই জানতাম। রকেট লাঞ্চার ছাড়া এর চামরা ভেদ করা সাধারন বুলেটের সাধ্যি না। কিন্তু শালার রাশানরা সব দরজা লক করে গেছে যাবার আগে।

আমার ভাবনাটা টের পেয়েই দুজনকে দেখলাম টর্চের আলো ফেলে হেলিকপ্টারের চারপাশের হাতল টেনেটুনে দেখছে। হঠাত একটা হাতলে টান পড়তেই দেখি দরজাটা নড়ে উঠল। কাছে গিয়ে দেখি হাতলের নিচে ছোট করে ইংরেজিতে লেখা 'ইমার্জেন্সি'। দরজা খুলে আমাদের ভারী অয়্যারলেস সেট আর অন্যান্য বাড়তি জিনিসপত্র হেলিকপ্টারের পেটের ভেতর ঢুকিয়ে রেখে দিলাম। মাঝরাতের পর চাঁদ উঠল।

সবকটা পোস্ট আরেকবার ঘুরে এসে হেলিকপ্টারের ভেতর জানালার পাশে গিয়ে বসলাম। এখানকার আকাশ বাতাস এতোটাই পরিস্কার যে, এখানকার আকাশে আমি এমন অনেক তারা দেখেছি যা আগে কখনই দেশের আকাশে দেখতে পাইনি। এখানকার চাদটাকেও আমার দেখতে অনেকটা বড় আর উজ্জ্বল লাগে। নিরক্ষরেখার কাছে বলেই কি এমনটা হয়? কি জানি! ঢকঢক করে একবোতল পানি গিলে জানাল বাইরে সাভান্নাহ জুড়ে জ্যোৎস্নার জোয়ার দেখতে দেখতে ভাবি, 'ইউএন মিশনে আসছি, নাকি সাফারিতে?'

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:২৮
৫টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×