একসময় অভিনেতা হাসান মাসুদের একটা সংলাপ বেশ পরিচিতি পেয়েছিল, "আমি যখন হিলস এ ছিলাম... ।" পেশাগতকারনে আমাদের অনেককেই এই "হিলস" এ (পার্বত্য চট্টগ্রাম) যেতে হয়, থাকতে হয়। আমার পেশাজীবনের শুরুটাই হয়েছিল এই হিলস থেকে। ঝকঝকে মিলিটারি একাডেমি থেকে বেরিয়ে ইউনিটের চৌহদ্দিতে পা রেখেই কিছুটা পোতায়া গেলাম। ছোট-বড় পাহাড়ের ওপর কিছু টিনশেড কুঁড়েঘর। ব্যস, এই হল ইউনিট। ব্যারাক বলতে বাঁশের বেড়ার লম্বা একটা ঘর। হাঁটু সমান উঁচু বাঁশের চাটাই পাতা। তার ওপর পাশাপাশি অনেকগুলো বিছানা পাতা। ঘরের একেবারে কোনায় আমার বিছানা। রেজিমেন্টেশনি অফিসারের প্রাইভেসি নিশ্চিত করতে, একপাশে বুক সমান উঁচু একটা চাটাই দিয়ে ঘেরা। দিনশেষে হামাগুরি দিয়ে আমাকে ঐ বাঁশের গুহায় ঢুকতে হত।
প্রত্যেক অফিসারেরই নিজস্ব রেজিমেন্টেশন অভিজ্ঞতা থাকে, আর তাই এজাতীয় অভিজ্ঞতা গুলো স্বভাবতই স্বতন্ত্র আর বিচিত্র। সবকিছু মিলায়া তব্দা খাওয়া আমি কিছু সামলে উঠার আগেই এডজুট্যান্টের ডাক পড়ল। ইতোমধ্যে পাহাড়ী সন্ধ্যা গড়িয়ে চারপাশে নিকষ আঁধার জেঁকে বসেছে। প্রাথমিক ধামাকা শেষে এডজুট্যান্ট যা বললেন তা হল, এক্ষুনি আমাকে একটা পেট্রোল নিয়ে পাশের ক্যাম্পে যেতে হবে। তখনো আমার ইউনিফর্ম ইস্যু হয়নি, সেইটা একটা সমস্যা বটে। কিন্তু তাতে কি? বরং রেজিমেন্টেশনি অফিসার সিভিস পরে গেলেই ভাল, রাতের আধারেও চিনতে সুবিধা হবে।
অগত্যা সিভিসের সাথে একজোড়া বুট পায়ে বেরিয়ে এসে দেখি সার্জেন্ট দাউদ দশ জনের একটা দল আর আমার জন্য একটা এসএমজি নিয়ে অপেক্ষা করছে। এসএমজি হাতে নিয়ে দেখি ম্যাগাজিন খালি। কারন জিজ্ঞেস করতেই সার্জেন্ট দাউদ মধুর একটা হাসি দিয়ে যে ব্যাখ্যাটা দিল, তার মোদ্দাকথা হল, লাইভ বুলেট হ্যান্ডেল করার সময় আপনার এখনও হয় নাই। ব্যাপারটারে স্ট্যান্ডার্ড প্রসিডিউর ভেবে পেট্রোল নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ। ভোঁতা জ্যোৎস্নায় চারপাশটা আরো ভুতুরে লাগছিলো। খটকা লাগছিল প্রথম থেকেই, সবকিছু কেমন যেন তালগোল পাকানো আজকে। রাতের পেট্রোলিং এ ম্যান-টু-ম্যান গ্যাপ আরো কম হবার কথা, এরা দিনের গ্যাপে এগুচ্ছে। চলাফেরাও কেমন যেন গা ছাড়া আর সবাই কমবেশি শব্দ করে এগুচ্ছে। কোথাও একটা ঘাপলা আছে বুজতেছি, কিন্তু ধরতে পারার আগেই যা হবার হয়ে গেল।
হটাত আমি আবিস্কার করলাম যে আমি একাই হাটছি। সামনে স্কাউটরা উধাও আর পেছনেও কারো টিকিটির দেখা নেই। কিংকর্তব্যবিমুঢ় কথাটার সংজ্ঞা আজ ক্লিয়ার হয়ে গেল। হতভম্ব গলায় ডাকলাম, 'সার্জেন্ট দাউদ...সার্জেন্ট দাউদ।' পাহাড়ে আমার গলা প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এসে আমাকেই চমকে দিল। চমক কাটতে না কাটতে দেখি জনাদশেক দশাসই লোক আমাকে ঘিরে ফেলেছে। চেহারা বোঝার উপায় নেই, উদ্দেশ্যও পরিস্কার না। কিন্তু ওদের এগিয়ে আসার ধরনে ঘাড়ের রোম কাটা দিয়ে উঠল। খালি এসএমজি টা লাঠির মত করে চারপাশে ঘোরাতেই ক্রমশ ছোট হয়ে আসা বৃত্তটা চমকে বড় হয়ে গেল। কিন্তু পাশ থেকে একজন হ্যাচকা টানে এসএমজিটা নেবার চেস্টা করতেই সর্বশক্তিতে ওকে আঘাত করতে চাইলাম। কিন্তু অবিশ্বাস্য রিফ্লেক্সে সে বাউলি কেটে বেরিয়ে গেল। আমি ভারসাম্য ফিরে পাবার আগেই দেখি অরা আমাকে শুন্যে তুলে ফেলেছে। হাত-পা ছুড়ে লাভ হলনা। কিছুক্ষনের ভেতর চোখ-মুখ-হাত-পা সমেত কষে বেধে কাধে করে কোথায় যেন নিয়ে চলল।
প্রবল আতঙ্কের অভিজ্ঞতা আমার কখনই ছিল না। এবার হল। প্রবল আতঙ্কে মানুষ অসার বোধ করে। যখন আমার চিন্তাশক্তি ফিরে এল বুঝলাম কোনএকটা ঘরের মেঝেতে পরে আছি। পায়ের শব্দ পেলাম। কেউ একজন আমার মুখের বাধনটা খুলে নিল। থুতনির নিচে ধাতব কিছু ঠেকালো। গান মেটালের শীতল ছ্যাকা খেয়ে বুঝলাম, রাইফেলের নল। শুরু হল ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা ইংলিশ উপজাতীয় আর হিন্দিতে আযাইরা সব প্রশ্ন আর হুমকি ধামকি। ইতোমধ্যে মাথার ভেতর কোথাও দ্রুত কিছু ডীডাকশান ড্র হয়ে গেল। এরা ধারার সময় থেকে এখন পর্যন্ত আমাকে একবারও আঘাত করেনি, যৌক্তিক কিছু চাচ্ছেও না, আবার আমাকে নিয়ে কি করবে সে ব্যাপারেও কিছু ভাবছে না। হতাতই ধরে ফেললাম যে ব্যাপারটা আসলে রেজিমেন্টেশন ফান।
এইবার শুরু হইল আমার অভিনয়, হিন্দি বুজিনা আর কিচ্ছু জানিনা বইল্ল্যা কাবডা মাইরা পইরা থাকলাম। জেরাকারীরা হতোদ্যম হয়ে ফেলে রেখে চলে যেতেই সার্জেন্ট দাউদ দৃশ্যপটে প্রবেশ করল। কাছে ওর গলা শোনা গেল, 'স্যার, স্যার, স্যার কি আছেন?' সাড়া দিতেই দৌড়ে এসে আমাকে মুক্ত করল। বেচারার অভিনয় দেখে মায়া হল। ভাবলাম চলুকনা আরো কিছুক্ষন। মজাটা নস্ট করে লাভ কি? এসএমজির জন্য আমার দুশ্চিন্তা দেখে সার্জেন্ট দাউদ আমাকে আশ্বস্ত করল যে, এখানে কাচাবাজারেই এসএমজি কিনতে পাওয়া যায়। আমার কাজ হল ব্যাপারটা খালি গোপন রাখা, যেন সিও অথবা এডজুট্যান্ট বিষয়টা জানতে না পারেন আর হাজার তিনেক টাকা দেয়া যেন এসএমজিটা কাল সকাল সকাল গিয়ে কিনে আনা যায়। আমি বললাম তিন হাযার টাকা ব্যাপার না, কিন্তু বিষয়টা আমি গোপন করতে চাইনা। বরং এডজুট্যান্টকে এসএমজি হারানোর ঘটনাটা জানানো জরুরি আর তা আমি এখুনি করতে চাই। হতাশ কন্ঠে সার্জেন্ট দাউদ বলল, 'আপনে যা ভাল মনে করেন স্যার।' আমি তার অভিনয়ে মুগ্ধ হলাম। ফেরার পর এডজুট্যান্টের কাছে রিপোর্ট করার সাথে সাথে তিনি আর্তনাদ করার চেস্টা করলেন, "w-h-a-t !!! u lost your SMG...." আমি মনে মমে ভাবলাম, 'কিতনা বুরা অ্যাক্টিং।'
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১:৪৮