somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

“খালিদের ইয়ারমুখের যুদ্ধ” কিস্তিঃ এক

১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৫:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



খলিফা আবু বকর খেলাফতের দায়িত্ব নেবার পর পরই কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখে পরেছিলেন; মহানবী (সাঃ) এর মৃত্যুর পর আরব গোত্র গুলোর ঐক্যে দ্রুত ফাটল ধরল, আর জায়গায় জায়গায় নতুন নতুন সব ভন্ড নবী-রাসুল উদয় হতে লাগল। এদের থামাতে আর দমাতে গিয়ে শুরু হল রিদ্দা ওয়ারস। নব নিযুক্ত সেনাপ্রধান খালিদ বিন ওয়ালিদ ইয়ামামার যুদ্ধে ভন্ড নবী মুসাইলিমাহকে পরাস্ত করে মধ্য আরব জুড়ে খেলাফতের কর্তৃত্ব সমুন্নত রাখলেন। এরপর আবু বকর খালিদকে পাঠালেন ইরাক ফ্রন্টে পার্সিয়ানদের দমাতে।

পার্সিয়ান ইনভেশনের শেষ দিকে ফিরাজের যুদ্ধে বাইজান্টাইন রোমান, সাসানিদ পার্সিয়ান আর খ্রিস্টান আরবদের যৌথবাহিনীকে পরাস্ত করে খালিদ যখন কাদিশিয়াহ অভিযানের পথে তখন তিনি খলিফা আবু বকরের আদেশ পেলেন সিরিয়ান ইনভেশনের কমান্ডার আবু উবায়দাকে রিইনফোর্স করার। সিরিয়ান ফ্রন্টে প্যালেস্টাইনের আজনাদাইনে আবু উবায়দার ছোট্ট সেনাবাহিনীকে বাইজাইন্টাইন রোমানরা প্রায় ঘিরে ফেলেছিল। যুদ্ধের এই ক্রিটিক্যাল জাঙ্কচারে খালিদের বিকল্প ছিলনা, তাই আজনাদাই ক্রাইসিস সলভের পর সাবসিকোয়েন্ট সিরিয়ান ইনভেশন কন্টিনিউ করার জন্য আবু বকর তখনো ইরাক ফ্রন্টে থাকা খালিদকে সিরিয়ান ফ্রন্টের নতুন কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে রি ইনফোর্সমেন্ট সমেত ইরাক ছেড়ে সিরিয়া আসতে নির্দেশ দিলেন।

নির্দেশ পেয়েই খালিদ তার বাহিনীর কিছু উটকে দুইদিন পর্যন্ত পানি না খাইয়ে রাখার নির্দেশ দিলেন। ইরাক থেকে সিরিয়া যাবার পথ ছিল দুইটা আর সংগত কারনেই সেই দুই পথে বাইজান্টাইন এম্বুশ থাকার কথা। তাই খালিদ সিরিয়ান ডেজার্ট হয়ে ইরাক থেকে সিরিয়া যাবার প্ল্যান করলেন। আর্মি নিয়ে কেউ এই মরুভুমি পারি দেবার কথা চিন্তাও করতে পারেনি কখনও। কিন্তু খালিদ তো খালিদই! যাত্রা শুরুর আগে খালিদ দুই দিনের তৃষ্ণার্ত উট গুলোকে গলা অবধি পানি খাইয়ে নিলেন। তারপর টানা দুই দিন হেটে সিরিয়ান ডেজার্ট অতিক্রম করলেন। পথে তার সৈন্যদের পানির চাহিদা পূরন করলেন সেই গলা পর্যন্ত পানি গেলা উট জবাই করে পানি বের করে নিয়ে।

খালিদ রওয়ানা দিয়েছে শুনেই আবু উবায়দা বসরা নগর আক্রমনের জন্য সুরাবিলকে আদেশ দিলেন কিন্তু সুরাবিল যখন তার মাত্র চার হাজার সৈন্য নিয়ে বসরা নগরীর উপকন্ঠে পৌছালেন তখন বাইজান্টাইন আর খ্রিস্টান আরবদের বিশাল যৌথবাহিনী তাকে ঘিরে ফেলল। সুরাবিলের মুসলিম বাহিনীর পরাজয় আর এনিহিলেশন যখন কনফার্ম, ঠিক তখনি সিরিয়ান ডেজার্ট ফুঁড়ে প্রায় আশরীরী এক বাহিনীর মত খালিদের মোবাইল গার্ড যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করল এবং পেছন দিক দিয়ে বাইজান্টাইন রোমান আর্মির উপর আছড়ে পরল। বাইজান্টাইন এলাইড ফোর্স রনেভংগ দিয়ে বসরা নগরীর ভেতরে পালিয়ে গিয়ে নগরীর প্রধান দরজার খিল এঁটে দিল, আর আবু উবায়দা ছুটে এসে খালিদকে জড়িয়ে ধরে তার হাতে সিরিয়ান ফ্রন্টের কমান্ড তুলে দিল।

৬৩৪ সালের মধ্য জুলাইয়ের ভেতর বসরা নগরীর পতনের মধ্যদিয়ে ঘসানিদ ডাইন্যাস্টির পরিসমাপ্তি ঘটল আর খালিদ ৩০ জুলাই ৬৩৪ তারিখে আজনাদাইনের যুদ্ধে বাইজান্টাইনদের পরাজিত করে সিরিয়ার বুকে বাইজান্টাইন রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘন্টা বাজিয়ে দিলেন।

বাইজান্টাইন রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস এমেসায় বসে আজনাদাইনের ফলাফল জানলেন এবং প্রায় একই সাথে পরবর্তী বাইজান্টাইন শক্ত ঘাঁটি দামেস্ক নগরী থেকে রি ইনফোর্সমেন্টের তাগদা পেলেন। হিরাক্লিয়াসের মেয়ের জামাই টমাস ছিলেন তখন দামেস্কের দায়িত্বে। খালিদের বাহিনী এগিয়ে আসছে জেনে হিরাক্লিয়াসের কাছে রিইনফোর্সমেন্ট চেয়ে পাঠানোর পাশাপাশি তিনি দামেস্কের ডিফেন্স আরো শক্তিশালী করার নির্দেশ দিলেন। খালিদের অগ্রাভিযানের গতি কমিয়ে দিতে তিনি দুটো সেনাদল সামনে পাঠিয়ে দিলেন, কিন্তু তারা খালিদের ঝড়ো গতির অগ্রাভিযানের সামনে পাত্তাও পেলনা। হিরাক্লিয়াসের প্রথম দফা রিইনফোর্স্মেন্ট দামেস্ক পৌছাল ঠিকই কিন্তু ২০ আগস্ট ৬৩৪ তারিখে খালিদ দামেস্ক অবরোধ করে ফেললেন, আর ফার্দার রিইনফোর্সমেন্টের সব রুট বন্ধ করে দিলেন।

দামেস্ক অবরোধ চলাকালেই খলিফা আবু বকর ইন্তেকাল করলেন আর উমর বিন খাত্তাব খিলাফতের নতুন কর্নধার নির্বাচিত হলেন।

খলিফা উমর প্রথম সুযোগেই খালিদ বিন ওয়ালিদকে মুসলিম আর্মির কমান্ড থেকে সরিয়ে দিয়ে আবু উবায়দাকে নতুন সেনাপ্রধান ঘোষনা করলেন এবং খালিদকে আবু উবায়দার আন্ডারকমান্ড করে দিলেন। আবু উবায়দা নিঃসন্দেহে সেনাপ্রধান হবার যোগ্যই ছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনি সিরিয়ান ফ্রন্ট কমান্ড করছেন, কিন্তু তিনি নিজেও খুব ভাল করেই জানতেন যে অন্তত যুদ্ধক্ষেত্রের সেনাপতিত্বে মুসলিম আর্মিতে খালিদের সমকক্ষ কেউ নেই। তাই দামেস্ক অবরোধের পুরোটা সময় খলিফা উমরের এই পয়গাম তিনি গোপন রাখলেন। ১৮ই সেপ্টেম্বর ৬৩৪ তারিখে দামেস্কের পতন হলে আবু উবায়দা খলিফা উমরের ইচ্ছের কথা খালিদকে জানালেন এবং নিজে কমান্ড গ্রহনের পরপরই সেনাপ্রধানের ক্ষমতাবলে খালিদকে তার চিফ অব স্টাফ করে ফেললেন এবং মুসলিম আর্মির কাভ্যুল্রি (অশ্বারোহী বাহিনী) কমান্ডার ঘোষনা করলেন।

মুতার যুদ্ধে বাইজান্টাইন রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে পরপর নয়টা তরবারি ভাঙ্গা খালিদ ইতোমধ্যে মহানবী (সাঃ) এর দেয়া উপাধি “সাইফুল্লাহ” বা “আল্লাহর তরবারি” নামের সার্থক প্রতিভূ। কোন যুদ্ধেই হার না মানার রেকর্ডধারী খালিদের যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিতি মানেই এক লক্ষ সৈনিকের রিইনফোর্সমেন্ট আর আসন্ন বিজয়ের গ্যারান্টি। তাই উমরের এমন সিদ্ধান্ত স্বভাবতই খালিদকে হতভম্ব করে দিল, কিন্তু তিনি তা সামলে নিয়ে বললেন, “যদি আবু বকর ইন্তেকাল করে থাকেন আর উমর নতুন খলিফা নির্বাচিত হয়ে থাকেন, তো আমাদের সবারই উচিত খলিফা উমরের প্রতি অনুগত থাকা এবং তার নির্দেশ মেনে চলা।“

ফিল্ড কমান্ডার হিসেবে আবু উবায়দা ছিলেন অনেক বেশি সাবধানী, তাই খালিদ পাশে থাকার পরও স্বভাবতই মুসলিম আর্মির অগ্রাভিযানের গতি অনেকটাই কমে গেল। আমর আর সুরাবিলকে তার অর্ধেক আর্মি সহ প্যালেস্টাইন দখলের মিশনে পাঠিয়ে দিয়ে উবায়দা খালিদকে সাথে নিয়ে সিরিয়ার আরো উত্তরে তার অগ্রাভিযান অব্যহত রাখলেন এবং মার্চ ৬৩৬ নাগাদ এমেসা পর্যন্ত দখল করে ফেললেন।
উপায়ান্তর না পেয়ে বাইজান্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াস অগত্যা তার রাজধানী এন্টিওখে দুই লাখ সৈন্যের এক বিশাল সেনাবাহিনী কনসেনট্রেট করলেন। তার পরিকল্পনা ছিল এই বিশাল বাইজান্টাইন বাহিনী দিয়ে প্যালেস্টাইন, মধ্য সিরিয়া আর উত্তর সিরিয়াজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অভিযানরত মুসলিম সেনাদলগুলোকে একের পর এক ধ্বংস করা।

৬৩৬ সালে জুন মাসের মাঝামাঝি একযোগে পাঁচ পাঁচটা বাইজান্টাইন আর্মি যখন তিন দিক দিয়ে এমেসার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করল, বিভ্রান্ত আবু উবায়দা তখন ফের খালিদের শরনাপন্ন হলেন। শাহী ফরমানের তোয়াক্কা না করেই তিনি খালিদের হাতে কমান্ড তুলে দিয়ে বাহিনীর প্রশাসনিক কার্যক্রম দেখাতে মনোযোগ দিলেন। বাইজান্টাইন আর্মির এগিয়ে আসার খবর পাবার পর থেকেই খালিদ মনে মনে এই কঠিন অবস্থা থেকে পরিত্রানের উপায় নিয়ে ভাবছিলেন এবং হঠাতই তার মাথায় আইডিয়াটা খেলে গেল। আইডিয়াটা এতোটাই যুগান্তকারী ছিল যে স্রেফ এই একটা আইডিয়ার কারনে পরে ইতিহাসের মোড় ঘুরে গিয়েছিল আর বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পতনের মধ্যদিয়ে ইসলামের ইউরোপ যাত্রার পথ খুলে গিয়েছিল। তাই কমান্ড ফিরে পাবার সাথে সাথে খালিদ একটা কনফারেন্স ডাকলেন এবং এভেইলেবেল সব অফিসারদের সেই কনফারেন্সে হাজির থাকার নির্দেশ দিলেন।

_______________________________________________(ক্রমশ...)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১:২৯
৮টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×