১. অনেকেই সাধারণত বলে এক্সেপেরিয়ান্স বা অভিজ্ঞতা মানুষের কাব্য প্রতিভা জাগ্রত করে। সে এক্সেপেরিয়েন্স হতে পারে ভ্রমন, প্রেম, বিচ্ছেদ ইত্যাদি। কিন্তু আমার কাছে মনেহয়, মানুষ কষ্ট থেকে সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করে। আর আমি হলফ করে বলতে পারি, কোন মানুষ যদি মৃত্যুর পর কাব্য লেখার সুযোগ পেত তাহলে সে পৃথিবীর শ্রেষ্ট কাব্যিক হতো। কষ্ট মানুষের কাব্য প্রতিভাকে জাগ্রত করে আর মৃত্যু হচ্ছে সেই কষ্টের শেষ সীমানা। আমি স্বীকার করছি যে আমি বহু বার-ই আমি সেই সীমানার কাছাকাছি গিয়েছি কিন্তু সীমানা অতিক্রম করতে পারিনি। ব্যার্থ হয়েছি। আর তাই নির্লজ্জের মতো নিজেকে কাব্যিক দাবী করার স্পর্ধা করতে পারিনা..….
২. শৈশবে রঙিন প্রজাপতির পেছনে ছুঁটে ছুটেঁ দু’হাতে ধরতে গিয়ে হোছট খেয়ে পড়ে উঠতেই আঁখি মেলে দেখি একটা তেলাপোকা। যে শৈশবে ছুঁটে বেড়িয়েছি বলগা হরিণের মতো আমি এখন তারই প্রান্তে, কৈশরে। এবার চোখে ধরা পড়লো বয়ো:সন্ধি, সস্তা প্রেম, বন্ধুত্ব-ঝগড়া-বিবাদ, অপর্যাপ্ত স্বাধীনতা হেন-তেন আরও কত কি….
কবিগুরু রবিঠাকুরের ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে’ এই চরণের কথা মনে রেখে কৈশরের অনেক সিঁড়ি মাড়িয়ে আমি এখন তারুণ্যের চূড়ায়। চোখের সামনে ঝলমল হাতছানি দিয়ে কি যেন ডাকছে আমায়! হয়তো কাঙ্খিত সেই যৌবন….!!
এদিকে তারুণ্যের চূড়া থেকেই আমি অবলোকন করছি- সারাদিন বাচাঁর লড়াই শেষে সাঝেঁর বেলায় পেটের বাচ্চা, দুধের শিশুকে আড়াল করে ঠোঁটে লাল লিপস্টিক আর মুখে গাঢ় মেকাপ মেখে এক নারী খদ্দেরের আশায় বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়….
সময়ের আশীর্বাদে জীবন সমুদ্রের তীরে উতলা বাতাসে আমার গায়ে আছড়ে পড়ছে যৌবনের ঢেউ। দু’হাত প্রশস্ত করে দু’চোখ মুদে গা জুড়াচ্ছি বাতাসে।
এবার সেই ঢেউয়ে ঝাপ দিতে গিয়ে আঁখি মেলতেই দেখি এইমাত্র ধর্ষিত কোন ষোড়শীর রক্তাক্ত লাশ। তারপর একান্ত নির্জনে নিরবে নিভৃতে নিজের অন্তর্নিহিত মানুষটার কবর রচনা করে নিজেকে নখ-দন্ত হীন হিংস্র-বন্য পশু রুপে প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া আর উপায় খুঁজে পাই নি…
৩. হৃদয় পতঁঙ্গ নাটাই ছিঁড়ে ভালবাসার আকাশে
ক্ষনিক ভেসে ভেসে, ফেসেঁছে এক উচুঁ বৃক্ষের শাখায়।
তারপর, কতক কিশোরী, তরুনী, যুবতী সেটাকে নামাতে ছুড়েছে ঢিল।
আমার এ হৃদয় পতঙ্গের সর্বাঙ্গে এখন অগনিত হোল….
৪. আমার এ ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ভারে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমার অনিবারণীয় মৃত্যু এগিয়ে আসছে আমার দিকে। কিন্তু তক্ষুনি মনে পড়লো, টিভি পর্দায় দেখেছি আমি- একটা চিতাবাঘ প্রচন্ড ক্ষুদায় আর প্রচন্ড লোভে, স্তন্যপানরত এক হরিণ শিশুকে ঘিরে ফেলেছে। কিন্তু যখনই সে কাছে গেলো আর ঘ্রাণ পেলো মাতৃদুগ্ধের- ঝাপিয়ে পড়লো না! যেন মাতৃদুগ্ধের ঘ্রাণ পোষ মানিয়েছে ঐ উন্মত্ত হিংস্র পশুকে! কিন্তু এই (আমাকে) পশুকে পোষ মানালো না কেউ…..
৫. আমার এ স্বীকারোক্তির সমাপ্তি টানবো নির্লজ্জের মতো নিজের একটা কবিতা দিয়ে,
যে কবিতার শিরোনামটাও হবে
স্বীকারোক্তি
আরোও শক্ত করে বাঁধো আমার হাত ও পায়ের বেড়ী
কথিত আইন আর নীতিমালার শেকলে।
কেড়ে নাও আমার হাতের কাগজ-কলম,
বালি গুজেঁ বন্ধ করে দাও আমার এই প্রতিবাদী মুখ।
তবে এ-ও জেনে রেখো-
দাবায়ে রাখার তোমাদের সকল চেষ্টাই যাবে বিফলে।
বিপ্লব- সে তো পান্তা ভাতে মেশানো নুন, চোখের আর্দ্রতা,
বিপ্লব- সে তো কবিতার ভাষা বুঝতে না পারা ছেলেটি’র-ও কবিতা,
আর সেই কবির হৃৎপিন্ড জুড়ে প্রবাহিত বিপ্লবী রক্তের নাম- কবিতা।
অত্যাচারীর নাকের ডগায়- নখ দর্পনে- চোখের তারায়
এমনকি চাপতির তীক্ষ্ণ ধারালো অংশেও কবিতা লেখা যায়।
কাঁদুনে গ্যাস পাইপের মুখে, হলুদ লাঠি’র তলদেশে দাঁড়িয়ে
আমার হাতে অদৃশ্য হাতকড়া পরে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের
শেকলের মধ্যেও আমি স্বীকার করছি:
আমার হৃদবৃক্ষের শাখা-প্রশাখায় সারাক্ষন বসে আছে ত্রিশ লক্ষ পাখি
-অবিরাম ওরা গেয়ে যাচ্ছে শেকল ভাঙার গান,
বিপ্লবের গান।
==============
পরিশেষে, আমার এ স্বীকারোক্তি অনেকের কাছে অনেকটা অস্ব:স্থিকর মনে হতে পারে।
একজন অবদমনকারীর ‘আপনাকে’ অবদমনের এই স্বীকারোক্তি….