অধুনা সমাজে বিভিন্ন কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেড়ে যাচ্ছে ! এর একটা কারণ নিয়ে এ লেখা। আমাদের সমাজে আদিকাল থেকে প্রচলিত প্রথা, ছেলে বিয়ে করে বাবা মা ভাই, অবিবাহিত বোনের সাথে স্ত্রী সহ একই বাসায় বাস করে এবং এটিই সমাজে পছন্দনীয় । বাবা মা ও আশা করে ছেলের বৌ তাদের সাথে থেকে তাদের সেবা যত্ন করবে। বাসায় ছোট ভাই বোন থাকলে তাদের দেখা শুনা করাও বড় ভাইয়ের বৌয়ের দায়িত্ব হিসাবে আশা করা হয় । এ সকল দায়িত্বে অবহেলা হলে, বা পালনে কিছু কমতি হলে পরিবারে অশান্তি শুরু হয়, শাশুড়ি বৌএ মনোমালিন্য, একে অপরের নামে অভিযোগ, ঝগড়া ইত্যাদি তখন নিত্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় । এ অবস্থার অবনতি ঘটতে ঘটতে এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে একসময় পরিবার থেকে, বিশেষত মা বাবার পক্ষ থেকেও, অনেক সময় ছেলের উপর চাপ আসে অন্য পরিবার থেকে আসা বৌকে তালাক দিতে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে মাতাপিতার প্রতি বাধ্য থাকা এবং তাদের খুশি করার জন্য স্ত্রীর উপর অন্যায় তালাক চাপিয়ে দিয়ে তাকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়া হয়। স্বামী স্ত্রীর সংসারেও বিপর্যয় নেমে আসে, সে সাথে স্ত্রীর আপনজনের মাঝেও নেমে আসে মহা বিপর্যয় !
অথচ ইসলাম স্ত্রীকে যে সকল অধিকার দিয়েছে তার অন্যতম প্রধান অধিকার তাকে তার সন্তান সহ সতন্ত্র বাসস্থানের ব্যাবস্থা করা । এটি স্বামীর উপর স্ত্রীর অধিকার । বিয়ের পর তাকে আলাদা বাসায় রাখা স্বামীর অন্যতম কর্তব্য, অর্থনৈতিক কারণে অপারগ হলে যথা শীঘ্র তাকে আলাদা বাসস্থান করে দিতে যথা সম্ভব চেষ্টা করতে হবে । স্বামীর বাবা মারও উচিত, সামর্থ থাকলে, ছেলেকে তার সতন্ত্র বাসার ব্যাবস্থা করতে সহায়তা করা । যাতে ছেলে - ছেলের বৌ এর প্রাইভেসি, সম্ভ্রম বজায় রাখতে কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হতে না হয় ।
স্বামীর বাবা ইসলামিক শরীয়া মতে মাহরাম, কিন্তু স্বামীর প্রাপ্তবয়স্ক আপন ভাইও (দেবর) গায়ের মাহরাম, যার সাথে সম্পূর্ণ বাইরের একজনের সাথে যেমন পর্দা করা জরুরি ঠিক তেমনি পর্দা করা আবশ্যক। একই বাসায় থেকে এ পর্দা মেনে চলা অসম্ভব না হলেও অত্যন্ত কঠিন। আমাদের সমাজে দেবর ভাবীর সম্পর্ক যেভাবে নিরাপদ মধুর হিসাবে ধরা হয় তা ইসলামী শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। রাসূলুল্লাহ (স) যে কোনো গায়ের মাহরাম পুরুষকে কোনো মহিলার ঘরে যেতে নিষেধ করেছেন, তিনি বলেন, " মহিলাদের ঘরে ঢুকতে সাবধান”, একজন সাহাবী বললেন, "ইয়া রাসুল্লাহ, দেবরের বেলায় কি হবে ?" তিনি বললেন, " দেবর মৃত্যুতুল্য ।"(Reported by al-Bukhaari 5232, Muslim 2172, Fath al-Baari, 9/330)।
দুর্ভাগ্যবসত আমাদের দেশে অনেক বাড়িতেই, সবার জন্য রান্না করা, শাশুড়িকে দেখা শুনা করা, মায় কাপড় ধোয়া পর্যন্ত, বাড়ির সবার কাজ কর্ম ছেলের বৌ করবে এমনটা আশা করা হয়। অনেক সময় ছেলেকে বিয়েই করানো হয় অসুস্থ শাশুড়িকে দেখা শুনা করার জন্য! অথচ ইসলাম বিবাহিত নারীর দায়িত্ব স্বামী ও সন্তানের দেখ ভাল করার মাঝেই সীমাবদ্ধ রেখেছে । এমনকি বিয়ে হয়ে গেলে তার নিজের বাবা মার্ প্রতিও তার দায়িত্ব আর তেমন থাকেনা । তেমনি শশুর শাশুড়ির প্রতিও অন্য একজন অনাত্মীয় মুসলমানের প্রতি যে সাধারণ সহানুভূতিশীল ও মার্জিত আচরণ করা, বাসায় আসলে উপযুক্ত মেহমানদারী করা, তার অতিরিক্ত কোনো দায়ভার নেই। তবে বৌ যদি এর বাইরে তার শশুর শাশুড়ির দেখা শুনা বা সেবাযত্ন করে, সে তার অনুগ্রহ; তাতে তার স্বামী খুশি হবে এবং তার জন্য সে পরকালে পুরস্কার পাবে ।
একজন স্ত্রীর জন্য স্বামী ব্যাতিত শশুর শাশুড়ি বা শশুর বাড়ির অন্য কারো কথা, ছোট বা বড় যে কোনো বিষয়েই হোকনা কেন, মানতেই হবে ইসলাম তা বলে না, যদিনা তারা এমন বিষয়ে বলেন যা ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী অবশ্য পালনীয় ( যেমন নামাজ রোজা করতে বলা বা পর্দা করতে বলা ইত্যাদি ) অথবা এমন বিষয়ে নিষেধ করেন যা ইসলামে হারাম । পক্ষান্তরে, স্বামীর কথা মানা অবশ্য কর্তব্য যদিনা তা ইসলাম বিরোধী হয়।
বৌ কিভাবে রান্না করবে, কিভাবে কাপড় পরবে, কি কাজ করবে ইত্যাদি উপদেশ হিসাবে শশুর শাশুড়ির দিতে অসুবিধা নেই কিন্তু তাকে তা করতে বাধ্য করা যাবে না। বাপের বাড়ি যেতে হলে শাশুড়ির অনুমতি লাগবে না, স্বামীর অনুমতিই যথেষ্ট। স্বামী স্ত্রীর নিজস্ব একান্ত বিষয়ে কোনো অনুসন্ধান বা খবরদারি করার কোনো অধিকার শশুর শাশুড়ির নেই ।
স্বামী তার পিতা মাতা বা ভাই বোনদের প্রতি সদয় আচরণ করবেন, তাদের খোঁজ খবর নিবেন, প্রয়োজনে দেখতে যাবেন, সামর্থমত সাহায্য সহযোগিতা করবেন তাতে স্ত্রীর বাধা দেয়া উচিত নয় । পিতা মাতার প্রতি সদয় আচরণ, তাদের মনে কষ্ট না দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহ পাক কোরানে বিভিন্ন আয়াতে নির্দেশ দিয়েছেন । তাই বলে মাতাপিতার প্রতি বাধ্য থাকা এবং তাদের খুশি করার জন্য স্ত্রীর উপর অন্যায় অত্যাচার করাও ইসলাম বিরোধী । যে কোনো অন্যায় পরিহার করা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা ইসলামের দাবী। সূরা নিসায় ১৩৫ নং আয়াতে আল্লাহ পরিষ্কার ভাষায় নির্দেশ দিচ্ছেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُونُواْ قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاء لِلّهِ وَلَوْ عَلَى أَنفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالأَقْرَبِينَ إِن يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقَيرًا فَاللّهُ أَوْلَى بِهِمَا فَلاَ تَتَّبِعُواْ الْهَوَى أَن تَعْدِلُواْ وَإِن تَلْوُواْ أَوْ تُعْرِضُواْ فَإِنَّ اللّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا
"হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্নীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাঙ্খী তোমাদের চাইতে বেশী। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পর্কেই অবগত।"
আমরা সবাই যদি আমাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখি এবং সীমা অতিক্রম না করে তা মেনে চলতে যত্নবান হই তবে পারিবারিক কলহ থেকে বেঁচে থাকতে পারি এবং অনভিপ্রেত বিপর্যয় এড়াতে পারি ।
রেফারেন্স :
https://islamqa.info/en/answers/6388/to-what-extent-can-the-husbands-relatives-interfere-in-his-wifes-life
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৩১