somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধর্মব্যবসায়ীদের কথা

২১ শে জানুয়ারি, ২০০৮ বিকাল ৩:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লোকে ধার্মিক হলে দেশে নাকি শান্তি বজায় থাকে। কথাটা কতটা ঠিক সেটা তর্কসাপেক্ষ, কিন্তু আজকের দুনিয়াতে দাঁড়িয়ে আমার ধার্মিক দেশের কথা ভাবলেই ধর্মব্যবসার কথাই আগে মনে হয়। ধর্ম ব্যবসায়ীরা ধার্মিকদের ধর্মবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে বানানো বা ভুল তথ্য উপস্থাপনা করে তাদের একরকম বোকা বানিয়ে নিজেরা খ্যাতি অর্জন করে। আমাদের ধার্মিক দেশে কোনোকালেই ধর্মব্যবসায়ীর অভাব দেখা যায় না। সে পুরোনো আমলের তন্ত্র-মন্ত্র হোক বা আধুনিক যুগের বাস্তুশাস্ত্র - বিশ্বাসের নামে সবাই একদলে। ভাবখানা এমন যে - "এত লোকে যখন বিশ্বাস করে তখন ..."।

তা প্রথমে নজর দেওয়া যাক ভারতের আপাতত সফলতম ধর্মব্যবসায়ীর দিকে। তিনি হলেন বিশ্বশান্তির উদ্যোক্তা শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর। আর্ট অব লিভিং বলে একধরণের যোগক্রিয়ার কোর্সের উদ্ভাবক এই স্বনামধন্য গুরু হলেন কর্নাটকের লোক। আর্ট অব লিভিং একটি অদ্ভুত কোর্স যার মূল লক্ষ্য হল হতাশা দূর করা ও মানসিকভাবে মানুষকে চাঙ্গা করে তোলা। রবিশঙ্করের মূল দাবী - নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস হল মন আর শরীরের যোগসূত্র। সুদর্শন ক্রিয়া নামক একটি যোগক্রিয়ার মাধ্যমে উনি এই দাবীকেই জনসমক্ষে এনেছেন। আমেরিকায় একটি আর্ট অব লিভিং কোর্সের খরচা $৩৭৫। তবে শোনা যায় যে সংগৃহীত এই টাকার সবটাই জনকল্যাণে ব্যবহৃত হয়।

কতটা বড় রবিশঙ্করের বৃত্ত? ২০০৭ সালে ইরাকের জনগণের হতাশা দূর করতে উনি ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে ইরাকে গিয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সাথে দেখা করেন। ২০০৬ সালে আর্ট অব লিভিং-এর রজতজয়ন্তী বর্ষ উপলক্ষে উপস্থিত হয়েছিলেন ভারতের প্রেসিডেন্ট, হল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আর ঘানার রাজা।

এহেন রবিশঙ্করের উদ্ভাবিত সুদর্শন ক্রিয়া যতক্ষণ মানসিক সমস্যার বৃত্তে আবর্তিত হয় ততক্ষণ নাহয় তা গ্রহণযোগ্য থাকে, কিন্তু যখন তা দুরারোগ্য ক্যান্সার বা এইডসের মত রোগ নিরাময়ের আশ্বাস দেয় তখনই ধর্মব্যবসার স্বরূপ উন্মোচিত হয়। ভারতের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সের দাবীমতে, সুদর্শন ক্রিয়া হতাশা কাটানোর জন্য বড়জোড় ধ্যানের মত আরেকটি যোগক্রিয়া হিসাবে স্বীকৃতি পেতে পারে। তা কি ভাবে সেই এইডসের মত রোগ নিরাময় ঘটে? খুবই সহজ পদ্ধতি - রবিশঙ্করের মতে, আমরা জীবনে আমাদের ফুসফুসের ক্ষমতার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশমাত্র ব্যবহার করি। আর আমরা ফুসফুস যত ভাল ভাবে ব্যবহার করতে শিখব, তত আমাদের শরীরে অক্সিজেনের যোগান বাড়বে আর সেই বাড়তি অক্সিজেন শরীরের জীবাণুনাশক হিসাবে কাজ করবে (!!)। এই দাবীর ওপর ভিত্তি করে উনি জানিয়েছেন, এইডসের জীবাণুও নাকি এরকম অক্সিজেন-প্রধান শরীরে বেঁচে থাকতে পারে না। সুতরাং, এটাই এইডস নিরাময়ের আদর্শ পথ। একই কথা ক্যান্সারের জন্য প্রযোজ্য। এই দাবী অবশ্য ফুতকারে উড়িয়ে দিয়েছে আমেরিকার স্বাস্থ্য-বিভাগ। তাদের মতে যোগক্রিয়া হিসাবেও এই সুদর্শন ক্রিয়া খুব একটা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। আর প্রদত্ত প্রমাণাদি থেকে কোনো রোগ নিরাময়ের সাথেই এই যোগক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক সম্পর্কস্থাপন করা সম্ভব নয়। সম্প্রতি আরো ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এ নিয়ে, আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে আরো সত্য বেরিয়ে আসবে এ বিষয়ে।

রোগ-নিরাময়ে সিউডো-সায়েন্সের প্রয়োগ এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর। মামুলী রোগ বা সাময়িক হতাশা নয়, উনি "ব্যক্তিগত বিজ্ঞানের" হাত লাগিয়েছেন সোজা দুরারোগ্য ব্যাধিতে। আর ধার্মিক দেশে অন্ধবিশ্বাসীদের প্রকোপে তার জনপ্রিয়তাও গগনচুম্বী।

জনপ্রিয়তার কথা যদি বলতেই হয় তবে আরেক ভারতীয়র নাম না বলে থাকা যায় না। উনি হলেন পিস টিভির প্রতিষ্ঠাতা জাকির নায়েক। ডাক্তারী পাশ করা এই শান্তি-প্রচারক ধর্মব্যবসায়ী বিভিন্ন মঞ্চে ইসলাম ও শারিয়া সম্পর্কে ভুল ধারণা দূর করেন। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তিনি যা তথ্য ব্যবহার করেন তার অধিকাংশই তার নিজস্ব।

কেমন তার তথ্যভান্ডার? একটু উদাহরণ দেওয়া যাক। এক জায়গায় দেখলাম পুরুষের বহুবিবাহের স্বপক্ষে উনি দাবী জানিয়েছেন পৃথিবীতে মহিলার সংখ্যা পুরুষের থেকে বেশী (দক্ষিণ এশিয়াতে ভ্রূণহত্যার কারণে ব্যাপারটা উলটো)। আমেরিকায় ওনার দাবী মতে পুরুষের সংখ্যা মহিলার তুলনায় সাড়ে সাত মিলিয়ন কম, রাশিয়ায় সংখ্যাটা নয় মিলিয়ন। কিন্তু আমেরিকার সরকারি (সি-আই-এ) তথ্যসূত্র থেকে দেখা যায় আমেরিকায় মহিলার সংখ্যা ৫ মিলিয়ন বেশী বটে কিন্তু তার জন্য দায়ী হল ৬৪ বছরের বেশী বৃদ্ধারা। ০-৬৪ বছর পর্যন্ত পুরুষের সংখ্যা বেশী (জন্মাবস্থায়ও তাই)। আর মহিলার সংখ্যা বেশী বয়সে বাড়ার কারণ তাদের গড় আয়ু পুরুষদের তুলনায় ৫ বছর বেশী। তাহলে কি ভাবে এই তথ্য বিবাহের কাজে ব্যবহার করা যায়, যেখানে বিশ্বে ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ব্যতিরেকে বাকি বিবাহ ৬৪ বছরের নিচেই সম্পন্ন হয়?

এরপরে আসা যাক শূকরের মাংসের (পর্ক) ব্যাপারে ওনার মতামত সম্পর্কে। ওনার দাবি হল শূকর প্রাণী হিসাবে অত্যন্ত নোংরা বলে তার মাংস খাওয়া নিষেধ - কিন্তু নোংরা জীবের মাংসও যে নোংরা হবে সে নিয়ে (এমনকি সেদ্ধ করার পরেও) কোনো বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ তার কাছে নেই। সবথেকে মারাত্মক তুলনা উনি শুরু করেছেন শেষ অনুচ্ছেদে গিয়ে। তার দাবী শূকরের মাংস খেলে নাকি মানুষ শূকরের মত ব্যবহার করে (পত্নী-পরিবর্তন করতে শুরু করে)। শুধু তাই নয় উনি এ বিষয়ে আমেরিকানদের শূকরের সাথে তুলনা করেছেন, যেটি শুধু জাতিবিদ্বেষ সৃষ্টিকারীই নয়, নিজের মত প্রচারের জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও বটে (লক্ষ্যণীয় সবথেকে বেশী পর্ক খাওয়া হয় চিনে, উনি চিন নিয়ে কিন্তু কিছু বলেননি)।

এছাড়াও উনি মুসলিমদের সুদ-লেনদেন করে এমন ব্যাঙ্কে কাজ করতে নিষেধ করেন, দত্তক সন্তানকে আপন সন্তানের মত সমানাধিকার দিতে বারণ করেন আর বিশেষ কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র ব্যতিরেকে গান বা সঙ্গীতচর্চা থেকে বিরত থাকতে বলেন।
এগুলোর যে কোনোটিই সাধারণ মানবাধিকারের সরাসরি পরিপন্থী এবং এর পক্ষে সমাজ বা বিজ্ঞানের দিক থেকে কোনো সায় নেই।

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা একটি মহান উদ্যোগ। তার জন্য নিজ নিজ পথও তারা বেছে নিতে স্বাধীন। কিন্তু বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা বা মানবমুক্তির জন্য এত মিথ্যার আশ্রয় কেন নিতে হবে সেটাই আমার প্রশ্ন।
(ছবি - উইকিপিডিয়া)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:৪১
২৯টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×