দেশকে মায়ের সাথে তুলনা করে ভালোবাসার জন্য দেশের মানুষকে জ্ঞান দেয় যে প্রথম আলো গোষ্ঠী, তারা নিজেরা দেশ-মাতাকে বেশ্যা বানিয়ে বহুজাতিকের হাতে তুলে তো দেয়ার কাজ করছে অনেক দিন ধরেই, এখন আবার পত্রিকার প্রথম পাতায় হেড লাইন বানিয়ে দেশ-মাতার বাজারদর কমানোর লবিং করছে। টেলিকম বহুজাতিকের স্বার্থ রক্ষায় রীতিমত “অস্থির” হয়ে উঠেছে তারা। তাদের সেই নির্লজ্জ বেশ্যার দালালির নজির আজকের প্রথম আলোর লিড নিউজটি: “অস্থির টেলিকম খাত”।http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-04-21/news/148291
এই নিউজটির পাশেই আছে কালের কন্ঠের “হলুদ সাংবাদিকতা” নিয়া একটা নিউজ, মতিউর রহমানের কাজ কারবারের বিরুদ্ধে কালের কন্ঠের সাংবাদিকতা যদি “হলুদ সাংবাদিকতা” হয়, তাহলে প্রথম আলোর এই বহুজাতিক কোম্পানির কাছে দেশের টেলিকম খাত সস্তায় তুলে দেয়ার পক্ষের সাংবাদিকতার নাম কি? বেশ্যা সাংবাদিকতা? না, বেশ্যা তো নিজের শরীর বিক্রির নির্মম করুণ পেশায় জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়, এরা তো নিজের মা’কে বহুজাতিকের কাছে বিক্রির এবং সেই সাথে বিক্রয় মূল্য কমানোর প্রকাশ্য দালালি করছে, এটা কোন ধরণের দালালি?
বিশেষ প্রতিনিধি, কার প্রতিনিধি? কর্পোরেট লবিং এর চূড়ান্ত নজির এই রিপোর্টটি কে তৈরী করেছে তার নাম আমরা জানিনা, বলা হয়েছে “বিশেষ প্রতিনিধি”..। পুরো খবরটি পড়ে বোঝাই যাচ্ছে ইনি একজন “বিশেষ প্রতিনিধি” কিন্তু প্রশ্ন হলো উনি কার বিশেষ প্রতিনিধি? প্রথম আলোর একজন পাঠক যথার্থ প্রশ্ন তুলেছেন মন্তব্য অংশে:
“ভাই বিশেষ প্রতিনিধি; আপনি কি আমাদের প্রতিনিধি ? নাকি বিশেষ কারো প্রতিনিধি ? আপনার একতরফা লেখা পড়ে হতাস হইলাম। এত দিন উনারা কত টাকা বিনিয়োগ করে কত টাকা কামাইছেন ? ভিওআইপি করে, এক জনের সিম অপরজনকে দিয়ে কত টাকা কর ফাঁকি দিছে ? একটা কোম্পানি তো লাইসেন্স ছাড়া চলছিল । কিছু তো লিখেন নাই। "১৪ হাজার কোটি টাকা দিতে হলে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের জন্য তাদের হাতে আর অর্থ থাকবে না" এইটা কেমন কথা, উনারা কি কইয়ের তেল দিয়ে কই খাবেন ?, উদ্বিগ্ন বিশ্বব্যাংক !!! কিন্ত কেন ? সব জাগাতে দাদাগিরি !!!”
দেশপ্রেমের ইজারা নেয়া প্রথম আলো তার এই দালালির ক্ষেত্রে মুরুব্বি হিসেবে হাজির করেছে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ আর বহুজাতিকেরবিশ্বব্যাংক কে, যেন বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের ভালো ছাড়া মন্দ চাইতেই পারেনা(!), ফলে বিশ্ব ব্যাংক যেহেতু লাইসেন্স ফি নিয়ে “উদ্বিগ্নতা” পোষণ করেছে, যেহেতু অর্থমন্ত্রী মুহিতের কাছে চিঠি দিয়ে বলেছে: “লাইসেন্স নবায়নের খসড়া নীতিমালাটি বাস্তবায়িত হলে টেলিযোগাযোগ খাতে বাংলাদেশের অর্জন নষ্ট হয়ে যাবে এবং দেশটির অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”, ফলে এইটাই সহি, এইটাই আমাদেরকে মেনে নিতে হবে।শুধু নতুন লাইসেন্সের চার্জ কমানো না,পুরোনো লাইসেন্সের মেয়াদ বাড়ানোর অযাচিত সুপারিশও করার সুখবর(!) দিয়েছে প্রথম আলো: “টেলিযোগাযোগ খাতকে সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য চার মুঠোফোন কোম্পানির বিদ্যমান লাইসেন্সের মেয়াদ সাময়িকভাবে বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক।“
দেশপ্রেমিক প্রথম আলো “দেশের উন্নতির” জন্য বিদেশী বিনোয়েগের প্রেসক্রিপশান দেয় কারণ বাংলাদেশের নাকি মূল সমস্যা পুজির। আর এখন প্রথম আলোর মতে বিদেশী বিনিয়োগকারী টেলিকম কম্পানি গুলোর পুজির যোগানের ব্যাপারেও হিসেব নিকেশ করতে হবে বাংলাদেশকে, কারণ:
“এত টাকা কোথা থেকে আসবে তা নিয়েও রয়েছে নানা সমস্যা। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কনসোর্টিয়াম ভিত্তিতে (একাধিক ব্যাংক মিলে ঋণ দেওয়া) সর্বোচ্চ ঋণ নিয়েছে বিমান, ৮১৪ কোটি টাকা। আর ওরাসকম টেলিকম বন্ড ছেড়ে বাজার থেকে তুলেছে ৭০৭ কোটি টাকা। এ পরিস্থিতিতে চারটি কোম্পানিকে ১৪ হাজার কোটি টাকা কে দেবে তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা।“
বিদেশী কোম্পানি যদি বাংলাদেশের ব্যাংক কিংবা বন্ড বাজার থেকে পুজি সংগ্রহ করে ব্যাবসা করে তাহলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির এই কাজটি করতে সমস্যা কোথায়? কেন বিদেশী বিনিয়োগের নামে দেশের সম্পদ বিদেশেীদের হাতে তুলে দেয়া?
প্রথম আলো, ভারতের স্পেকট্রাম কেলেংকারির রেফারেন্স টেনে বলছে:
“ভারতে দ্বিতীয় প্রজন্মের মুঠোফোন সেবাদাতাদের লাইসেন্স দেওয়া নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির খবর এখনো আসছে। ভারতের এই টেলিকম-দুর্নীতির মূলে আছে কোনো স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে অনুমাননির্ভর ফ্রিকোয়েন্সি চার্জ নির্ধারণ।“
আসলে কি তাই, ভারতের টেলিকম কেলেংকারির মূল সমস্যা কি প্রথম আলো কথিত “অনুমান নির্ভর ফ্রিকোয়েন্সি চার্জ নির্ধারণ” নাকি ফ্রিকোয়েন্সির মূল্য কম নির্ধারণ করা? ভারতকে মোট ২৩ টি ইউনিফাইড সার্ভিস এরিয়া(ইউএসএ) তে ভাগ করে প্রতিটি সার্ভিস এরিয়ার জন্য ২০০১ সালের হারে প্রতিটি লাইসেন্স (৪.৪ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম সহ) ফি রাখা হয়েছিল ২০ বছরের জন্য ১৬৫৮ কোটি রুপি করে। কিন্তু ভারতের কম্প্রট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) বা মহাহিসাব রক্ষকের রিপোর্ট, এটিকে বর্তমান বাজার দর হিসেবে কয়েকগুণ অবমূল্যায়িত বলে আখ্যায়িত করে। রিপোর্ট টিতে ভারতের বাজারে মোবাইল টেলিকম লাইসেন্সের বর্তমান সম্ভাব্য মূল্য হিসেবে ৭,৭৫৮ কোটি থেকে ৯,১০০ কোটি রুপি অর্থাৎ ১২,০২৫ কোটি থেকে ১৪,১০৫ কোটি টাকা ধরা হয়।(সূত্র:অধ্যায় ৫, সিএজি রিপোর্ট, Click This Link Report.pdf)
বাংলাদেশে প্রতি মেগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সির চার্জ ১৫ বছরের জন্য ধরা হয়েছে ৯০০ মেগাহার্জের ক্ষেত্রে ৩০০ কোটি টাকা এবং ১৮০০ মেগাহার্জের ক্ষেত্রে ১৫০ কোটি টাকা এবং লাইসেন্স ফি ৫ কোটি টাকা। ভারতের হিসেবে এটা কম না বেশি? ভারতের ২০০১ সালের হিসেবের সাথে যদি বাংলাদেশের সাথে একটা তুলনা করা যাক। ২০০১ সালে ভারতের জনসংখ্যা ১০০ কোটি ধরে ২৩টি ইউনিফাইড সার্ভিস এরিয়া বা ইউএসএ’র প্রতিটির আওতায় জনসংখ্যা থাকে ৪.৩৪ কোটি। বাংলাদেশের ১৫/১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশ তাহলে ভারতের ৩/৪টি ইউএএসএ’র সমান। তাহলে বাংলাদেশের প্রতিমেগাহর্জ লাইসেন্স ফি অন্তত ভারতের ৩গুণ হওয়া উচিত। চলুন দেখা যাক বাস্তবে কত গুণ।
ভারতে ২০০১ সালে,৪.৪ মেগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সির দাম ২০ বছরের জন্য ছিল ১৬৫৮ কোটি রুপি বা ২৪৮৭ কোটি টাকা(১ রুপি=১.৫ টাকা ধরে)।
সুতরাং ১ মেগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সির দাম ১৫ বছরের জন্য হতে পারে ৪২৩.৯২ কোটি টাকা।
২০০১ সালের হিসেবে বাংলাদেশের চেয়ে তিন/চারগুন ছোট একটি এলাকার জন্য ভারতে প্রতিমেগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সির দাম ছিল ৪২৩.৯২ কোটি টাকা। সুতরাং ভারতের ২০০১ সালের হিসেবে, বাংলাদেশের মতো একটি দেশের ফ্রিকোয়েন্সির দাম হতে পারে ১২৭১.৭ কোটি টাকা। অথচ ২০১১ সালে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি মেগাহার্জের(৯০০ মেগাহার্জ) দাম ধরা হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা মাত্র। অর্থাত সেএজির হিসেবে, ভারতের অবমূল্যায়িত ফ্রিকোয়েন্সি মূল্যের চেয়েও ৪ গুণ কম দাম রাখা হয়েছে বিটি আরসির বর্তমান খসড়া লাইসেন্স নীতিমালায়।
সিএজির হিসেবে ভারতে বর্তমানে এক একটি ইউএএস এর জন্য ৪.৪. মেগাহার্জের লাইসেন্স ফি হওয়া উচিত অন্তত: ৯,১০০ কোটি রুপি অর্থাত ১৩,৬৫০ কোটি টাকা। বর্তমানে ভারতের জনসংখ্যা ১২০ কোটি ধরলে, এবং বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ধরলে, ২৩ টি ইউএএস’এর প্রতিটির ৩ গুণ জনসংখ্যা বাংলাদেশের আওতা ভুক্ত। তাহলে,
সিএজি’র হিসাব মতে, ৪.৪ মেগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সির দাম ২০ বছরের জন্য হওযা উচিত ১৩,৬৫০ কোটি রুপি।
সুতরাং ১ মেগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সির দাম ১৫ বছরের জন্য হতে পারে ২৩২৬.৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশের চেয়ে ৩ গুণ ছোট এলাকার এক একটি ইউএএস এর ফ্রিকোযেন্সির দাম ২৩২৬.৭ কোটি টাকা হলে বাংলাদেশের হিসেবে ফ্রিকোয়েন্সির দাম হবে ২৩২৬.৭*৩= ৬৯৮০.১১ কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশে প্রতিমেগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সির দাম ধরা হয়েছে মাত্র ৩০০ কোটি টাকা অর্থাত ভারতের সিএজি’র হিসেবের চেয়ে ২৩.২৬ গুণ কম!! আর প্রথম আলো বিশ্বব্যাংক কিংবা মোবাইল কোম্পানিগুলো বলছে এটা নাকি আন্তর্জাতিক বাজারের হিসেবে চড়া মূল্য রাখা হয়েছে, এবং এর মাধ্যমে নাকি মোবাইল কোম্পানিগুলোর উপর প্রথম আলোর ভাষায় “বিপুল অর্থের দায় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে”!!
প্রথম আলো, “স্বচ্ছ্বতা” ও “অনুমান নির্ভর” ফ্রিকোয়েন্সির কথা বলে স্পেকট্রাম ক্যালেংকারির মূল প্রসঙ্গটিই আড়াল করে দিল কি চমতকার!!কারণ সেক্ষেত্রে ভারতের টেলিকম সেক্টরে স্পেকট্রাম লুটপাটের ঘটনায় টেলিকম মন্ত্রী আন্ডিমুথ রাজার সাথে ভারতের কুখ্যাত কর্পোরেট লবিইস্ট নিরা রাদিয়ার এবং সংশ্লিষ্ট অনন্য কর্পোরেট যেমন রতন টাটা, কর্পোরেট মিডিয়ার সাংবাদিক বীর সাংভি বা বারখা দত্ত’র সম্পর্কের ও ততপরতার মুখে আনতে হয় এবং সেটা মুখে আনলে এই রিপোর্টের “বিশেষ প্রতিনিধি” কিংবা প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান সাহেবের ততপরতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে!!
আমরা সেই প্রশ্ন তুলতে চাই, আমরা জানতে চাই মতিউর রহমানের প্রথম আলো বহুজাতিক টেলিকম সেক্টরের হয়ে পত্রিকায় লিড নিউজ করার মাধ্যমে প্রকাশ্য দালালি করার স্পর্ধা পেল কোথায়?