খোলা বারান্দায় একটা পুরনো কাঠের চৌকির উপরে বসে শীতের রোদ্দুর পোহাছিলেন অশীতিপর বৃদ্ধ। গেট খোলার শব্দ শুনে আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন। আমি গুটি গুটি পায়ে তাঁর কাছে গেলাম। স্থানীয় পত্রিকার জন্য একটা সাক্ষাৎকার চাই বলতেই একগাল হেসে পাশে বসতে বললেন। বিশিষ্ট দার্শনিক মানবদরদি ভাবনার রূপকার অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম।
তখন বেলা ১২টা বাজে। তাঁর নাওয়াখাওয়ার সময়। সে সব ভুলে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললেন। কথা যেন ফুরোতেই চায় না। কথা যখন ফুরোল, তখন ঘড়িতে পাঁচটা বাজে। তাঁর দুপুরের খাবার থাকল পড়ে। মাঝে অবশ্য দু’তিন বার বললেন, ‘একটু চা খাও বাপু।’ তিনি ছিলেন অকৃতদার, সংসারে এক নির্লিপ্ত সন্ন্যাসী।
১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বহরমপুর গার্লস কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। মাঝে কলকাতার ব্যাঙ্কশাল কোর্ট, আলিপুর কোর্ট এবং বহরমপুর কোর্ট এবং বহরমপুর কোর্টে ওকালতি করেছেন। ‘গণরাজ’ নামের একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক ছিলেন। সাংবাদিকতা করেছেন ‘নবযুগ’ পত্রিকা সহ অন্যান্য পত্রিকায়। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামাতে গিয়ে মারাত্মক ভাবে জখম হয়েছিলেন। পা খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল।
সারা জীবন সেই শারীরিক কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল তাঁকে। ১৯৮৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাঁকে সাম্মানিক ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২০টি। নিজে যেহেতু সাংবাদিক ছিলেন, সেহেতু সাংবাদিকতা বিষয়ে ড. রেজাউল করিম সাহেব সে-দিন বলেছিলেন, ‘লেখায় নিজের মতামত নয়, মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাঁদের অভাব অভিযোগের কথা সহজ সরল ভাষায় লিখতে হবে। মানুষের কাছে যেতে হবে। ঘরে বসে সাংবাদিকতা হয় না।’
-তুষার ভট্টাচার্য
......................
নৌকা তৈরির পীঠস্থান বলাগড় আমার বাসস্থান হওয়ায় এবং ফ্রি-লান্স সাংবাদিকতার সূত্রে নৌকা নিয়ে লেখালেখি ও তথ্যচিত্র বানিয়ে একটা ধারণা হয়েছিল, বলাগড়ের নৌকা সম্পর্কে আমার থেকে বেশি বা ভাল তথ্য কেউ দিতে পারবে না।
এই সময় এক দিন দুপুরে খবর পেলাম এক বিখ্যাত সাংবাদিক কাম চিত্রপরিচালক এসেছেন, বলাগড়ের নৌকা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে। কৌতূহলী হয়ে নৌকা কারখানায় যেতেই কারখানার মালিক আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার থেকে প্রায় ১৪-১৫ বছরের বড় সেই ভদ্রলোক শিক্ষানবিশের মতো সব জানলেন শুনলেন, আমার কাছ থেকে। সত্যি কথা বলতে কী, মাস্টারি করার সুযোগ পেয়ে মনে মনে বেশ গর্বিত হচ্ছিলাম। এর পর তাঁর অনুরোধে অন্যান্য কারখানাতেও ঘুরলাম। লক্ষ করলাম, বড় কারখানাগুলোর থেকে ছোট ছোট এবং শ্রমিক-কাম-মালিকের ঘরোয়া কারখানাগুলিতে বেশি গুরুত্ব দিয়ে খবরাখবর নিলেন। এক শ্রমিক তাঁর বাড়ির উঠোনে নিজেই নৌকা বানিয়ে, নৌকার চোখ আঁকছিলেন বাটালির নিপুণ দক্ষতায়। ভদ্রলোক তন্ময় হয়ে দেখছিলেন। এক সময় বললেন, ‘নৌকার চোখ বড্ড ছলছলে তাই না?’ শ্রমিকটিও রসিকতায় জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ বাবু, আমাদের মতোই অবস্থা আমাদের নৌকারও।’ এর কিছু দিন পরেই প্রথম শ্রেণির একটি দৈনিক সংবাদপত্রের কোনও এক হেডলাইনে চোখ আটকে গেল।
‘বলাগড়ে নৌকার চোখে জল।’ লেখাটা পড়ে ফেললাম একনিশ্বাসে। আমার এত দিনের অহংকার মুহূর্তে চুরমার হয়ে গেল। আমার লেখালেখি এবং তথ্যচিত্রে দেখানো বলাগড় নৌ-শিল্পের ঐতিহ্য, মহিমা, আধিপত্য সব ম্লান মনে হতে লাগল। অসাধারণ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন দরদি লেখাটি পড়ে, মহান শিল্পী- কবি- সাংবাদিক- চিত্রপরিচালক পূর্ণেন্দু পত্রীর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এল।
-তপন পাল
...................
সম্ভবত সালটা ১৯৬১-৬২। আমাদের পাড়ায় (বখতিয়ার শাহ রোড)-এ একতলা গোলাপি রঙের বাড়িটা ভাড়া নিয়ে এলেন বাংলা সিনেমার এক জন উদীয়মান অভিনেতা দু’টি ফুটফুটে ছেলে ও সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে। পাড়ায় সঙ্গে সঙ্গে খবর হয়ে গেল, বেশ খানিক উত্তেজনা।
খবরটা জানতে পেরে অভিনেতাকে দেখব বলে ঘন ঘন ওই বাড়ির সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করতে লাগলাম। কিন্তু তাঁকে দেখতে পেতাম না।
মাসখানেক বাদে এক দিন দেখি পাজামা আর গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি পরা সুদর্শন অভিনেতা তাঁর বাড়ির রোয়াকে বসে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। পাড়ার বয়স্করা কিছু দিনের মধ্যেই তাঁর দাদা হয়ে গেলেন। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে ক্লাবঘরে গান গাইতে গিয়ে দেখলাম তিনি বসে গান শুনছেন।
আমাকে ডেকে বললেন, ‘বেশ ভাল গান গাইলি তো তুই, কার কাছে শিখিস?’ পর্দায় যাঁকে দেখি তিনি কী সহজে ডেকে কথা বললেন। একটু ভয়ে ভয়েই যেন বললাম, ‘সুরঙ্গমায়।’ এর পর বাবার সঙ্গে এক দিন সকালে ফিরছি। তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে, এত সকালে কোথা থেকে?’ প্রণাম করে বললাম, ‘আজ আমি কলেজে ভর্তি হলাম।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, ‘বাঃ, ভাল খবর। মন দিয়ে পড়াশোনা করবি আর বেশি সিনেমা দেখবি না।’ বলে হো হো করে হেসে উঠলেন। ছায়াছবির জগতের মানুষটিকে সে-দিন খুব আপনজন মনে হয়েছিল। বছর চারেক বাদে তিনি অন্য জায়গায় নিজের বাড়িতে চলে গেলেন।
অনেক যশস্বী পরিচালকের ছবিতে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে তাঁর সাবলীল অভিনয়, নিখুঁত চরিত্রচিত্রণ বাংলা ছবির জগতে তাঁকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। পোশাক চালচলন কথাবার্তায় সাধারণত্বটাই ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। তাঁর নাম অনিল চট্টোপাধ্যায়।
-গায়ত্রী সেন
....................
আমি তখন কলকাতার একটি সংবাদপত্রে সদ্য ঢুকেছি। জীবনে প্রথম জ্যোতিবাবুর জনসভা ‘কভার’ করার সুযোগ পেয়েছি। উৎসাহ তুমুল।
সকাল সকাল পৌঁছে গেলাম দুর্গাপুরের সেচ বাংলোয়। যেখানে উঠেছেন মুখ্যমন্ত্রী। গেটে প্রহরায় থাকা পুলিশকর্মীদের নজর এড়িয়ে দোতলায় উঠে এলাম। কিন্তু কোন ঘরে আছেন তিনি? এ-দিক ও-দিক তাকাতেই নজরে পড়ল এক ঝাড়ুদার। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, কোথায়, ঠিক কোন ঘরে আছেন তিনি? ঝাড়ুদার একটা দরজার দিকে আঙ্গুল দেখালেন।
আমি ঘরটার দিকে এগোতে থাকলাম। বড় ইচ্ছে, একান্তে প্রবাদপ্রতীম নেতা কী করছেন, তার একটা এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট কাল বের করার। আলতো করে টোকা মারলাম দরজায়। খানিক অপেক্ষা। তার পরে দরজা খুলে উঁকি মারল যে মুখটি, গোটা বাংলা তাঁকে চেনে।
জ্যোতিবাবু বললেন, ‘বাথরুমে জল নেই। একটু জলের ব্যবস্থা করতে পারেন?’ আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, নিশ্চই। এক্ষুনি জল পাঠাচ্ছি। দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেটের পুলিশকর্মীদের বললাম, বাথরুমে জল নেই। সিএম দাঁড়িয়ে আছেন। এক্ষুনি জল পাঠান! আমার কথা শুনে পুলিশকর্মীরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শুরু হল দৌড়ঝাঁপ। শেষে এক পুলিশকর্মী বালতি ভর্তি জল নিয়ে ছুটলেন ওই ঘরের দিকে।
মন বলল, বাথরুমে জল বাড়ন্ত। সাংঘাতিক ঘটনা। নিশ্চয়ই অনেকের চাকরি যাবে। সেটাই হবে আমার বিশেষ প্রতিবেদন। সেই বিশেষ কপির আশায় সারাদিন পড়ে রইলাম ওই সেচ বাংলোয়। জ্যোতিবাবু স্নান করলেন। লাঞ্চ সারলেন। তার পর জনসভার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। বারবার খবর নিলাম, কী ঘটতে চলেছে। জ্যোতিবাবু জল না থাকা নিয়ে উচ্চবাচ্য পর্যন্ত করলেন না।
আমার এক্সক্লুসিভ রিপোর্টটা মাঠে মারা গেল।
-রানা সেনগুপ্ত
..............................
পঞ্চাশের দশকের কবিকুলের অন্যতম তিনি। বাংলা সাহিত্যে তোলপাড় করা লিটল ম্যাগাজিন, সেই ‘কৃত্তিবাস’-এর প্রায় সূচনা থেকেই পাঠকমহলের চোখ টেনেছিলেন নিজের দিকে। বাংলা কবিতায় (পড়ুন পদ্যে), তাঁর মতো শব্দকে নিয়ে তুমুল পরীক্ষানিরীক্ষা সম্ভবত তাঁর সমসাময়িক আর কেউ করেননি।
স্বভাবে দারুণ বোহেমিয়ান, সাধারণের চোখে আপাত এলোমেলো, অথচ সাহিত্যে স্থির, জীবদ্দশাতেই ভারতীয় কাব্য-সাহিত্যে লেজেণ্ড সেই তিনি, তাঁর সর্বগ্রাহ্য মান্যতা ভুলে অফিসে, টেবিলের নীচে ফেলে দেওয়া লেখা ও চিঠিপত্রের ধুলোমাখা ছেঁড়া খাম কুড়োচ্ছেন, ছেলেমানুষের মতো প্রায় হামাগুড়ির ভঙ্গিতে! আমরা তো অবাক! এমন হয় নাকি? হইহই করে উঠি তাই— এ কী করছেন? কিছু খুঁজছেন? পড়ে গেছে নাকি কিছু? সমবেত এমন সব প্রশ্নে হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে সটান হয়ে যান তিনি।
তার পর চেয়ারে বসতে বসতে বলেন, ‘কিছু না। তোমাদের দফতরে প্রত্যেক দিনই তো খামবন্দি কত লেখা আসছে ডাকে। এ বার থেকে লেখা বা চিঠিপত্র বার করে খামগুলো ফেলে দিও না। পারো তো, কোথাও গুছিয়ে রেখো।’
আমাদের কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন, কী হবে সে সব খাম নিয়ে। কিন্তু, তেমন কোনও প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে পর মুহূর্তেই তিনি জানান, ‘এদের গায়ের স্ট্যাম্পগুলো আমার দরকার হয়।’ স্ট্যাম্প! ডিপার্টমেন্টের প্রায় সকলেই সমবেত স্বরে বিস্ময় প্রকাশ করি। আর, তিনি, রাশভারী চেহারার, খ্যাতনামা দৈনিকের প্রাজ্ঞ সাংবাদিক, বিভাগীয়
সম্পাদকের টেবিলের উল্টো দিকের চেয়ারে নিষ্পাপ শিশুর মতো হাসতে হাসতে তাঁর গমগমে স্বরে জানান, ‘আরে, এ সব আমার জন্যে নয়, আমার জন্যে নয়, আমার ছেলের জন্যে। ও স্ট্যাম্প জমাতে খুব ভালবাসে কিনা।’ কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কথা নতুন করে আর কী বলার আছে! কিন্তু, তাঁর এই অপার পিতৃস্নেহের কথা আমরা জানি ক’জন?
-প্রমোদ বসু
............................
একটি নামী কিশোর সংগঠনের বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে স্মারকপুস্তিকা প্রকাশিত হবে। তার জন্য বিভিন্ন লেখক-লেখিকার থেকে লেখা সংগ্রহের ভার পড়েছিল আমার ওপর।
এরই মধ্যে এক পরিচিতের পরামর্শে বিখ্যাত এক লেখিকার দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে এক দিন হাজির হলাম। ভয় ছিল, কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া আমার মতো অর্বাচীন কিশোরকে তিনি আমল দেবেন কি না।
কিন্তু আর্জি নিয়ে যখন তাঁর কাছে দাঁড়ালাম, তিনি সস্নেহে আমাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে এ-কথা সে-কথার পর একটা প্লেটে নিজ হাতে কিছু মিষ্টি এনে দিলেন। যেন অনেক কালের চেনা। এমন ভাবে বললেন, ‘বিজয়ার পর এসেছ, একটু মিষ্টিমুখ করো।’ মিষ্টি খাওয়া হলে একটি লেখা আমায় দিয়ে বললেন, ‘ভাল লাগলে এটা ছাপতে পারো।’
তাঁকে প্রণাম করে আমি বাইরের দিকে পা বাড়ালাম। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, স্মারকপুস্তিকা প্রকাশের দায়িত্বে যিনি ছিলেন, তাঁর অনবধানতার কারণে লেখাটি পুস্তিকায় সে যাত্রায় প্রকাশিত হল না।
যা-ই হোক, দিন কয়েক বাদে বোলপুরে আমাদের সম্মেলন চলাকালীন এক দিন দূর থেকে লক্ষ করলাম, ভিড়ের মধ্যে এক পাশে দাঁড়িয়ে সেই লেখিকা হাতে আমাদের স্মারকপুস্তিকার একটি কপি নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছেন। আমি আর থাকতে পারলাম না। তাড়াতাড়ি তাঁর কাছে গিয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে বললাম, কিছু মনে করবেন না, একটা ভুল হয়ে গিয়েছে, আপনার লেখাটা...। আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনি ক্ষমাসুন্দর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললেন, ‘তাতে কী হয়েছে, এ বার হল না, পরের বার না হয় ছাপিয়ো।’
ইনিই আশাপূর্ণা দেবী, বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য যিনি জ্ঞানপীঠ-সহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।
-সঞ্জীবকুমার ঘোষ
.............
পড়ি রবীন্দ্রভারতীতে। থাকি সীতারাম ঘোষ ষ্ট্রিটের এক বোর্ডিং হাউসে। পথে পড়ে মুক্তারামবাবু ষ্ট্রিট। এক দিন সাহস করে ঢুকে পড়লাম শিবরাম চক্রবর্তীর মেসবাড়িতে। আলাপ হল। তার পর থেকে সেই মেসবাড়ি প্রায় টানতে লাগল।
এক দিন শিবরাম বললেন, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় খুব অসুস্থ। পুরনো বন্ধুকে দেখতে চান। কিন্তু একা এত দূর যাওয়া অসম্ভব তাঁর পক্ষে। এক দিন সকালে তাঁকে নিয়ে গেলাম টালা পার্কে। অসুস্থ বন্ধুর হাত ধরে শিবরাম বসে রইলেন কিছুক্ষণ। টুকটাক কথা। ফেরার পথে বললেন, ‘শৈলজাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে পারলে ভাল হত।’
শিবরামদার নির্দেশে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে একটা চিঠি লিখলাম। সেই চিঠিতে বিখ্যাত লেখকদের সই দরকার। আনন্দবাজারের সন্তোষকুমার ঘোষ অন্নদাশংকর রায়ের কাছে যেতে বললেন। প্রথম সই তাঁরই হবে। তার পর সই করলেন আরও অনেকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্যোগে সে চিঠি বক্স করে ছাপা হল আনন্দবাজার পত্রিকায়। কাজও হল। তথ্যমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় শৈলজানন্দকে নিয়ে এসে পিজি-র উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়ে দিলেন।
শিবরামের বড় বড় চোখে খুশির ঝিলিক। বললেন, ‘প্রেমেনকে এক বার খবর দিতে পারো! একটা দিন ঠিক করে তাকে হাসপাতালে আসতে বলো। আমিও যাব সে-দিন।’ প্রেমেন্দ্র মিত্র তখন চোখের অসুখে ভুগছেন। হরিশ চ্যাটার্জী ষ্ট্রিট থেকে তাঁকে নিয়ে এলাম ট্যাক্সি করে। শিবরামদাকে নিয়ে এল আমার এক বন্ধু। উডবার্ন ওয়ার্ডের একটি ঘরে জীবন্ত হয়ে উঠল বিশ শতকের তিরিশের দশক।
ব্যক্তিগত জীবন বলতে যাঁর কিছুই ছিল না, সেই শিবরাম চক্রবর্তীর সহৃদয়তার স্পর্শ পেয়েছি সেই এক বার এবং তার পর অনেক বার।
………….
১৯৬৮ সালের অক্টোবর নাগাদ সদ্য প্রকাশিত ‘বুলবুল’ পত্রিকার জন্য লেখা সংগ্রহের তাগিদে অগ্রজ প্রয়াত কবি আবু আতাহার-এর সঙ্গে টালা থেকে টালিগঞ্জ ছুটোছুটি করছি। এক দিন দু’জনেই টালা পার্কের কাছেই বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম কথাসাহিত্যিকের বাড়িতে হঠাৎই হাজির। উনি কিছু ক্ষণ পর এসে ওঁর জন্য রাখা চেয়ারে বসে বললেন, ‘কী করতে পারি বলো তোমাদের জন্য।’ পত্রিকার একটি কপি ওঁর হাতে দিয়ে বললাম, একটি লেখা চাই। পত্রিকাটা একটু উল্টেপাল্টে দেখে লেখা দেব বলেই একটি নির্দিষ্ট দিনের কথা বলে দিলেন।
নির্দিষ্ট সেই দিনে আবার ওঁর বাড়ি গেলাম এবং পূর্বের মতোই বসার ঘরে আমাদের বসিয়ে একটু পরেই লেখা হাতে আমাদের সামনে এসে তাঁর বসার চেয়ারে বসে বললেন, ‘তোমাদের লেখা তৈরি। তবে একটু পড়ে দিই।’ বলেই মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরে নিজের লেখাটি পড়ে শোনাতে লাগলেন। মন্ত্রমুগ্ধর মতো তাঁর জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনতে লাগলাম। পড়তে পড়তে লেখাটির এক জায়গায় এসে ভাইয়ে ভাইয়ে বাড়ি বখরার জন্য উদ্যোগ নিতে গিয়ে যখন পাথরের একটা টুকরোয় এক ভাইয়ের কপালে রক্ত ঝরতে শুরু করল এবং বড় ভাই তা দেখে সহ্য করতে না পেরে সহোদরকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, তোর লাগেনি তো? তখন দেখি স্বয়ং লেখক ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন এবং তাঁর চোখ থেকে নেমে আসছে অজস্র অশ্রুর ধারা। আমরা হতচকিত এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়। একটি লেখার সঙ্গে লেখকের কতটা অন্তরের যোগ থাকলে এটা ঘটে, তা ভেবে উঠতে না উঠতেই তিনি পড়া শেষ করে কান্না সংবরণ করে আমাদের হাতে লেখাটি তুলে দিয়ে বললেন, ‘বাবা, তোমরা ভাইয়ে ভাইয়ে যেন ঝগড়া কোরো না কখনও, মিলেমিশে থেকো।’ চোখ বুজলেই আজও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই কান্না এবং আর্তি শুনতে পাই।
-এস এম সিরাজুল ইসলাম
...................
শ্রদ্ধেয়া বিপ্লবী বীণা দাশ আমাদের সঙ্গে কাজে যোগ দেওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর সস্নেহ ব্যবহার দিয়ে আমাদের সকলের মন জয় করে নেন। বিকেলে একসঙ্গে বাড়ি ফিরতাম। নানা বিষয়ে ওঁর সঙ্গে যেমন আলোচনা করতাম, তেমনই কখনও কখনও তর্কও জুড়তাম।
উনি খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়ে তর্কের সমাপ্তি টানতেন। এক দিন তর্ক জুড়েছিলাম গাঁধীজিকে নিয়ে। সে-দিন উনি একটু ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তবু স্বভাবসিদ্ধ মধুর ভাবেই বলেছিলেন, ‘এত বড় এক জন মানুষের বিচার এ ভাবে কোরো না।’ বলে গাঁধীজি সম্বন্ধে এমন অনেক কথা বললেন যে,
আমার মনে হল ভাল করে না জেনে আমরা কত ভুল ধারণা করে থাকি। অথচ গাঁধীজি আর ওঁর মত ও পথ ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত।
উনি ছিলেন নিঃসন্তান। কিন্তু প্রতি বছর পুজোর আগে দেখতাম জামাকাপড় কিনছেন। জিজ্ঞেস করলে হেসে বলতেন, ছেলেমেয়েদের জন্যই কেনা। পরে শুনেছিলাম, উনি ওগুলো ফুটপাথবাসী বাচ্চাদের দিতেন। আমি মাঝে মাঝে ওঁর বাড়ি যেতাম। উনি খুব খুশি হতেন। এ রকমই এক দিন ওঁর বাড়িতে গিয়েছি। উনি দরজা খুলেই অনাবিল হেসে বললেন, ‘আমি সয়াবিনের দুধ দিয়ে দই পেতেছি। কী ভাল হয়েছে! ভাবছিলাম, তুমি এলে খুব ভাল হয়।’ এমনই শিশুর মতো ব্যবহার ছিল তাঁর।
অবসর নেওয়ার পর সামান্য কারণে ওঁর পেনশনটা আটকে গেল। আমরা বহু চেষ্টা করেছি। তখন ওঁর আর্থিক অবস্থাও বিশেষ ভাল ছিল না। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বরাদ্দ ভাতাও উনি নিতেন না। এক দিন ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলাম, আপনি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বরাদ্দ ভাতা না নিয়ে ভুল করেছেন। এ দেশ ত্যাগের মর্যাদা দেয় না। বীণাদি বলেছিলেন, ‘এমন কথা আর বোলো না। কোনও প্রত্যাশা নিয়ে তো আমরা দেশসেবা করিনি।’ এ বছর এই মহান ব্যক্তিত্বের জন্মশতবর্ষ।
-মায়া ঘোষ
.........................
৩৩ বছর আগে ‘শঙ্কর স্কোপ’ দেখে বাড়ি ফিরে একটা চিঠি লিখে তাঁর সাক্ষাৎকার প্রার্থী হয়েছিলাম। তখন ফুলিয়ায় থাকি। ‘সাহিত্য সৈকত’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন বের করি।
৮ দিনের মাথায় জবাব এল। ইংরেজিতে লেখা। বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়: ...আপনি হয়তো জানেন আমি হার্টের রোগী, অত্যন্ত নিয়মবদ্ধ জীবন যাপন করছি। বিশেষ প্রয়োজনীয় না হলে সাক্ষাৎকার দেওয়া চিকিৎসকেরও বারণ। তা সত্ত্বেও আগামী ১৩ অগস্ট ’৭৭
শনিবারে বেলা দুটোর সময় আপনার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ-পরিচয় ঘটলে খুশি হব। তা যদি ১৫ মিনিটের জন্য হয়। ভগবান আপনার মঙ্গল করুন। শ্রদ্ধাসহ— উদয়শঙ্কর।
চিঠিটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। উদয়শঙ্করের চিঠি, তাঁর ইন্টারভিউ এবং তা আগামী কালই! সারা রাত জেগে কিছু প্রশ্ন তৈরি করলাম।
পর দিন নির্দিষ্ট সময়ে তাঁর ম্যাণ্ডেভিল গার্ডেনস-এর ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির। কেয়ারটেকার দরজা খুলে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গিয়ে বসালেন। অল্প কিছু সময়ের মধ্যে আলখাল্লা পরিহিত, সৌম্যদর্শন অপরূপ সেই মানুষটি— যেন এক দেবদূত— অনেকটা দূর থেকে হাত তুলে নমস্কার জানাতে জানাতে আমার দিকে এগিয়ে এলেন।
দু’জনে মুখোমুখি বসলাম। নৃত্যের আনন্দ ও জীবনের সুখ-দুঃখের কত কথা। দুঃখ ও যন্ত্রণায় দিশেহারা উদয়শঙ্কর যে এক অন্ধকার ভোরে লণ্ডনের টেমস নদীর ব্রিজের উপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলেন, আর এক পুলিশ সার্জেন্ট তাঁকে ধরে ফেলে বাঁচিয়ে দিলেন, এ গল্প তাঁরই মুখে শোনা। ১৫ মিনিট কখন ৪৫ মিনিটে গড়িয়ে গেছে সে হিসেবও ছিল না কারও।
ফিরে আসছি। উনি লিফ্ট অবধি আমাকে এগিয়ে দিলেন। এর পর তিনি আর মাত্র ৪৪ দিন বেঁচে ছিলেন।
-মাধব ভট্টাচার্য
......................
পঁয়ত্রিশ বছর আগে লিটল ম্যাগাজিনে ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রির সঙ্কট নিয়ে উত্তমকুমারের ইন্টারভিউ দরকার ছিল।
এক রবিবার দুপুরে গিয়ে ধরলাম তাঁকে— ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রির সমস্যা নিয়ে একটা ইন্টারভিউ চাই। সাত-আট জন স্তাবক ছিলেন, তারা সমস্বরে বললেন, না না, ওই তো পুঁচকে কাগজ...। উত্তম একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আগামী রবিবারের পরের মঙ্গলবার সকাল ন’টায় বাড়িতে আসুন, পনেরো মিনিট পাবেন'।
উত্তম চলে গেলে সেই স্তাবকদেরই অন্য রূপ, দেখলেন কেমন স্মুদলি অ্যাভয়েড করল। আগামী রবিবারের পরের মঙ্গলবার ডায়েরিতে লেখা নয়, সেক্রেটারি নেই, দশ দিন পরে সকাল ন’টা, মনেই রাখবে না। আমিও বেশ সন্দেহাকুল হলেও গেলাম সেই নির্ধারিত দিনে সকাল ন’টায় ময়রা ষ্ট্রিটে।
পনেরো মিনিট নয়, দেড় ঘণ্টা আলোচনা হল। উত্তম দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনি যে আমার পার্সোনাল লাইফ, হিরোর ব্যাপার-স্যাপার জানতে না চেয়ে ইণ্ডাষ্ট্রি নিয়ে ভাবছেন, সেটা খুব ভাল লাগল। আবার আসবেন। রোববার সকালটা ফ্রি থাকি'।
আমি মুগ্ধ নয়, মন্ত্রমুগ্ধ। পত্রিকা বেরোল, প্রশংসিত হল।
তার পরে ছ’মাস কেটে গেছে। ‘স্ত্রী’ ছবির প্রি-রিলিজ শো হবে স্টুডিয়োর ছোট হলে। আমিও একটা পাস পেয়েছি। এমন সময় চার দিকে নীরব সাড়া ফেলে সাদা অ্যাম্বাসাডার থেকে নেমে এলেন উত্তম এবং সুপ্রিয়া। ওঁরা সোজা চলে গেলেন সৌমিত্রের দিকে। হঠাৎ দেখি উত্তম হাতের ইশারায় আমাদের দিকে কাউকে ডাকছেন। আমি তো প্রায় দৌড়ে গিয়ে হাজির। ভ্রু কুঁচকে রাগত মুখে উত্তম বললেন, ‘পত্রিকা তো কবেই বেরিয়েছে, কই আমাকে তো দিলেন না?’ আমি প্রতিবাদে উদ্যত হতেই হেসে ফেলে বললেন, ‘পেয়েছি এবং পড়েওছি। খুব ভাল হয়েছে। আরও লিখুন এই হতভাগ্য ইণ্ডাষ্ট্রিটাকে নিয়ে। আমি তো আছিই।’ স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
-সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়
...................
উত্তর এসেছিল পোস্টকার্ডে। দিল্লি থেকে লেখা। পর পর চারটি তারিখ উল্লেখ করে লেখা— আপনার সুবিধামত যে কোনও দিন নিমতৌড়ির স্মৃতিসৌধে এলে দেখা হতে পারে।
প্রথম তারিখটিকে বেছে নিয়েই নির্দিষ্ট সময়ে বিকাল ৪টায় স্মৃতিসৌধে পৌঁছে শুনতে পাই, রাইটার্সে একটা জরুরি মিটিংয়ে মন্ত্রী ডেকেছেন তাই চলে গেছেন। কখন ফিরবেন কিছু ঠিক নেই। হতাশই হলাম। স্মৃতিসৌধর ভেতরটা ঘুরে দেখতে লাগলাম। ঘড়িতে তখন ৫টা বেজে ৫ মিনিট।
আমি যাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী তিনি এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বারবার দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলেন। আমি কুণ্ঠিত হচ্ছিলাম। করজোড়ে নমস্কার জানাতে তিনি আমার হাত দু’টি টেনে ধরে বুকের কাছে নিয়ে বলতে লাগলেন, ‘আপনি আসবেন আমার মনে ছিল। রাইটার্সে মিটিং সেরে বাস ধরে আসতে দেরি হয়ে গেল।’
আমি বিস্মিত চোখে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার মতো এক জন অতি সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর এই আন্তরিক ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছিল। এই মানুষটিই হলেন সদ্য প্রয়াত সুশীলকুমার ধাড়া।
সে-দিন মুখোমুখি বসেছিলাম আমরা দু’জন। স্মৃতিসৌধ নির্মাণে তাঁর উদ্যোগ ও পরিকল্পনার কথা শুনেছিলাম। শুনেছিলাম বিয়াল্লিশের অন্দোলন, ব্রিটিশদের নির্যাতন, তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের পত্তন, বিদ্যুৎবাহিনীর কার্যকলাপ— এ সবের অজানা অনেক কথা। সে-দিন তিনি তাঁর লেখা আত্মজীবনীমূলক একটি বই ‘প্রবাহ’ যার পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়েছিল কলকাতার প্রেসিডেন্সি ও বহরমপুর জেলে বসে, সেটি স্বাক্ষর করে আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। নিমতৌড়ির সন্দেশ আনিয়ে খাইয়েছিলেন; রাতে তাঁর বাড়িতে থেকে যাওয়ার জন্য বারবার বলছিলেন।
থাকা হয়নি। ফিরে আসছি। হাঁটতে হাঁটতে বাসস্ট্যাণ্ড পর্যন্ত এসে আমাকে বাসে তুলে দিয়ে তবে ফিরে গেলেন।
-মাধব ভট্টাচার্য
…………………….
[আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে নেওয়া]
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১১ বিকাল ৫:১২