"মৃত্যু, ছোট্ট একটি শব্দ অথচ কি অলীক ক্ষমতা , এক মুহূর্তে থমকে দাঁড়ায় জীবন যে ছিল প্রানবন্ত মুহূর্ত আগে। নিমিষেই তারা পরিনত হয় লাশে। তাদের আধবোজা চোখগুলো লালসার পৃথিবীকে ধিক্কার জানায় অথবা তাদের অবিরাম পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া শরীরগুলো সবুজ ঘাসের মাঝে শান্তির খোঁজে পড়ে থাকে। "
এরিক মারিয়া রেমারকের " আ টাইম টু লাভ এন্ড আ টাইম টু ডাই " উপন্যাসটির শুরু এভাবে। এক অসাধারন যুদ্ধবিরোধী এই উপন্যাসে দেখান হয়েছে কত সহজে, কত অবলীলায় ঝরে যাচ্ছে তরুন জার্মানদের প্রাণ। যুদ্ধে মৃত্যু কত স্বাভাবিক তাই বারবার দেখান হয়েছে।
সেটা ছিল দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধের সময়কাল। আর এর ৭০ বছর পর এসে আমার দেশের সাধারন মানুষের অবস্থা আর পরিনতি সেসব জার্মান সৈনিকদের সাথে যেন মিলে যাচ্ছে।
এক বছর আগে যখন রানা প্লাজা ধ্বসে পরে, তখন সেলিনা তার পুরো এক পা আর আরেকটি পা অর্ধেক হারিয়েছে। বিশ হাজার টাকা মিলেছে তার এ পর্যন্ত সাহায্য। রংপুরের অবারিত সবুজ ধানক্ষেত আর মমতাময়ী মাকে ছেড়ে সে শহরে এসেছিল দু'মুঠো ভাতের খোঁজে। ভাত কতটুকু পেয়েছিল তা না হয় থাক, তার আফসোস অন্যদের সাথে সে কেন সেদিন মারা গেল না। এখন তার স্বামীর চায়ের দোকানের অল্প আয়ে খাবার কেনা যাচ্ছে না, ওষুধ অনেক পরের ব্যাপার। আরেকজনের সাহায্যে এভাবে বেঁচে থাকতে কদিন পারবেন। অথবা জোর করে কদিন বাঁচা যায় ? সরকারি সাহায্যের কথা তিনি শুনেছেন কিন্তু তা এখন আর বিশ্বাস করেন না, আর যদি সাহায্য পৌছায় ততদিনে হয়ত তার তা প্রয়োজন নেই। তার দীর্ঘশ্বাস মিশে যাচ্ছে দুষিত শহরের দুষিত বাতাসে।
হোসেন আলীর এক হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে তাকে যা দিয়ে তিনি ফুটপাথে সবজি ফেরি করেন, কিন্তু এ দিয়ে দুবেলার চালের খরচ হচ্ছে না।হাত না থাকায় আগের কাজ করতে পারেন না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং একটি হাত না থাকা হোসেন আলী আর কীইবা করতে পারেন তার মেয়েকে আরেকটি নতুন জামা কিনে দিতে? তার চোখে এখন আর ঘৃণা নেই, সেখানে একটা অশনিসংকেত , এক ভারসাম্যহীন সমাজের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয় প্রতিনিয়ত। বলে, আমাদেরকে ফেলে তোমরা কতদুর যাবে? কতদুর যেতে চাও?
এগুলি কোন কল্পিত গল্প নয়, সেদিনের আহত-নিহত প্রতিটি পরিবারের গল্প এরকম বা কাছাকাছি।
প্রধান মন্ত্রীর তহবিলে ১২৭ কোটি টাকা পরে আছে , এখনো বণ্টন হয়নি। হবে, সে সম্ভাবনা অচিরেই দেখা যাচ্ছে না। গেব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজের সেই কর্নেলের মত সেসব আহত শ্রমিকদের এখন আর কেউ খোঁজ নেয় না। বহু আগে যুদ্ধফেরত কর্নেল প্রতিদিন খোঁজ নেন সরকারি সাহায্যের চিঠি এল কিনা, কিন্তু আসে না , তিনি বুড়ো হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী - কিন্তু সাহায্য পৌছায় না । তারা অনাহারে অর্ধমৃত পরে থাকে। জার্মান সৈনিকরা মরে গিয়েছিল। আর হাত -পা হারানো আমার দেশের ভাইবোনেরা আশায় বুক বাঁধতে বাঁধতে এখন মৃত্যু কামনা করে। তাদের দুবেলা খাবারের "ড্রিমল্যান্ড এক্সপ্রেস" আসে না। তারা বলে, তোমরা আরও "উন্নত" হও , আরও উপরে উঠে যাও, কিন্তু মনে রেখো , আমাদের অভিশাপ, দীর্ঘশ্বাস, কষ্টের প্রতিটি অনু-পরমানু তোমাদের প্রতিটি দামি ইটের আঁচরে আঁচরে লেগে থাকবে, তোমরা না চাইলেও থাকবে।
হায়, আমরা মেতে থাকি, সিনেপ্লেক্স, প্রতিবেশিদের নষ্ট সিনেমা, ক্ষমতা আর টাকার নোংরা ভাগাভাগি নিয়ে।