somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার ছাত্রশিবির জীবন-6

৩০ শে মে, ২০০৬ সকাল ৭:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নিজ ধর্মের প্রতি কৌতুহল থাকা স্বাভাবিক। ইসলামকে আরো ভালোভাবে জানার আগ্রহেই আমি ছাত্রশিবিরের কর্মকান্ডে জড়িয়ে যাই। কিন্তু ছাত্রশিবিরের কর্মকান্ড বলতে নামাজ আর জেহাদের ট্রেনিং বুঝায় না। নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে নতুনদের আকর্ষণ করা হতো ছাত্রশিবিরের দিকে। স্কুলে সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতার আয়োজন ও পুরষ্কার বিতরণ ছিল একটি। স্কুলের অন্যান্য পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কর্মকান্ডগুলোর নেতৃত্ব ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরাই তুলে নিত। ঝামেলা মনে করে অন্যান্যরা এগুলো এড়িয়ে যেত। কিন্তু নতুন ছাত্রদের আকর্ষণ করার সুবিধা আছে বলে তারা এই দায়িত্ব পালনে আগ্রহ দেখাতো বরাবর। জেহাদ বা ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েমের জন্য শারীরিক সক্ষমতাও দরকার। সুতরাং স্কুল শেষে বিকালবেলায় আমরা স্কুলের মাঠে একত্রিত হতাম নানা খেলাধূলা করতে। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সবচে বেশি পুরষ্কার অর্জনও একটি টার্গেট ছিল এর। আমাদের নেতৃত্ব দিতেন গাজী ভাই। খুব ভয় পেতাম এমন একটি খেলা আমি তার কাছ থেকেই শিখেছিলাম। জ্যাভেলিন থ্রো বা বর্শা ছোঁড়া।

তবে শিবিরে ঢুকে পড়ছিলাম আমি আমার কবিতা-প্রীতির কারণে। স্কুলের দেয়াল পত্রিকা 'উৎস'-এ কবিতা দিতে গিয়েই গাজী ভাইয়ের সাথে পরিচয়। তারপর উৎস প্রকাশনার সাথে জড়িয়ে যাওয়া। কীভাবে বড় আর্টপেপারটিকে বিভিন্ন কলামে ভাগ করে লেখাগুলোর জন্য জায়গা তৈরি করতে হয়। কীভাবে শূন্যস্থানগুলো অলংকরণ করে ভরিয়ে দিতে হয়। কীভাবে সাইনপেন দিয়ে লাইন সোজা রেখে গল্প-কবিতাগুলো পত্রিকায় লিখতে হয়। সবই তখন শেখা। অলংকরণের কাজ করতো বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদের ছেলে আলতাফ। ও অবশ্য ছাত্রশিবির করতো না। কয়েক সংখ্যা পর উৎসের দায়িত্ব আমার কাঁধেই এসে পড়লো। গাজীভাই তখন এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে সম্পাদক হিসেবে নাম যেত গাজী ভাইয়েরই। আমাদের এক সহপাঠী সেলিনাও লিখতো গল্প-কবিতা। যখন গাজীভাইদের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল তখন উৎসের নতুন সম্পাদক বানানো হলো। গাজীভাই আমাদেরকে জানালেন যে নতুন সম্পাদক হবে সেলিনা আক্তার। আমি ও আলতাফ খুব অবাক হলাম। গাজীভাই আমাদেরকে কি যেন বুঝাতে চেষ্টা করলেন। বললেন, তোমরাই সব কাজ করবে, তবে মেয়েদেরকেও সুযোগ দেয়া উচিত, নতুবা স্কুলে সমালোচনা হবে।

সেলিনা আমার ভালো বন্ধু ছিলো, ইসলামী ছাত্রী সংস্থাও করতো ও, তবে খুব গোপনে। সুতরাং ওর সম্পাদক হওয়াতে আমার তেমন কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু এই রহস্যময় নিয়োগের সূত্র ধরতে পারছিলাম না। অনেক অনেক পরে অবশ্য একটা তথ্য জেনেছিলাম। জানি না এর সাথে সেলিনার সম্পাদক হওয়ার কোনো যোগাযোগ ছিলো কিনা। সেলিনা যখন এইচএসসি পাশ করে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে পড়ছে তখন গাজী ভাই'র পোস্টিং ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্টে। ময়মনসিংহেই তাদের দুজনের বিয়ে হয়। প্রেমটা স্কুল জমানার কিনা আমি নিশ্চিত না। হবে হয়তো। তবে অবাক হয়েছি যখন শুনেছি মাথায় স্কার্ফ দেয়া ইসলামী ছাত্রী সংস্থার একদা কর্মী সেলিনা এখন স্লিভলেস ব্লাউস পরে। গাজী ভাইও নাকি দাঁড়ি চেঁছে ভিন্নরূপ নিয়েছেন। ওদের এই পরিবর্তনের কারণ অবশ্য আমি জানি না।

আমার নিজের মতাদর্শের যে বিরাট পরিবর্তন হয়েছিল তাও আমি মনে করিনা। যখন ছাত্রশিবিরের কর্মী হিসেবে সংগঠনটির কর্মকান্ডে জড়িত ছিলাম তখনও আমি বিনাপ্রশ্নে সবকথা মেনে নেইনি। তখনও আমার স্বাভাবিক মূক্তমনস্ক বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আমি ঘুরে বেড়াতাম। টেবিল-টেনিস, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি খেলতাম। শালবনের ভেতরে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তাস পিটাতাম। অন্যদিকে রফিকের মারিফত দর্শন নিয়ে আগ্রহের কারণে তার সাথেও কাটাতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। রফিক আমাকে ইসলাম বা ধর্মের গূঢ়তম অর্থ ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করতো। কিন্তু খুব বেশি পড়ালেখা না থাকার কারণে ও আমাকে সব প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারতো না। তবে ওর পীরের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রসত্দাব দিয়েছিল। আমি রাজি হইনি। ও আমাকে ব্যাখ্যা করতে পারতো না কেন ছাত্রশিবিরের কর্মকান্ডে অংশ নিয়ে আমি ইসলামকে জানতে পারবো না। তবে আমি বুঝতে পারতাম ধর্মের আরো কিছু গভীর অর্থ ও বিষয় রয়েছে যা ঠিক বাহ্যিক অনুষ্ঠানাদির মধ্যে পাওয়া যায় না। কিন্তু ছাত্রশিবিরের কর্মকান্ডের নিন্দা করার কিছু আমি খুঁজে পেতাম না।

বড় কোনো এক ছুটিতে নানাবাড়িতে বেড়াতে এসে আমি পেলাম ভিন্ন ধারণা। বড়মামা যখন জানলেন আমি ছাত্রশিবিরের কর্মী হিসেবে কাজ করছি তখন এ বিষয়ে নানা গল্প হলো আমার সাথে। বড়মামা আমৃতু্য বেকার ছিলেন। তবে ছবি আঁকা, গান গাওয়া ইত্যাদি নানা কর্মকান্ডে তার দক্ষতা ছিল। নানা ইনফর্মাল নলেজ দিতেন তিনি। তিনি আমাকে ধরিয়ে দিলেন ইমাম গাজ্জালির কয়েকটি বই আর মুহম্মদ আব্দুল হাইয়ের বাংলা কোরআন। সেই ছুটি আমার গেলো এই বইগুলো পড়ে পড়ে। কোরআনের বাংলা অনুবাদটি ছিল অনেক সহজ সরল। আমি প্রতিদিন নানা আয়াত আবিষ্কার করতাম, আর বড়মামাকে দেখাতাম। গাজ্জালির বইগুলো পড়ে ধর্মের দর্শন সম্পর্কে আমার ধারণা বাড়তে লাগলো। আমি প্রাতিষ্ঠানিক, অনুষ্ঠান এসবের গভীরে ধর্মের যে গূঢ়ার্থ তা বুঝতে শুরম্ন করলাম।

ছুটি শেষে যখন ফিরে আসছি, তখন বড়মামা জানতে চাইলেন এইসব বই পড়ে আমার নতুন ধারণা কি হলো। আমি অনেক কথার মালা গেঁথে যে বক্তব্য দিলাম তার সারকথা ছিলো, ছাত্রশিবিরের ইসলামটি খন্ডিত ইসলাম। এটাকে খারাপ বা ভালো বলাটা নির্ভর করবে ধর্মের ব্যবহারকে কে কীভাবে দেখছে তার ওপর। রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের উদ্দেশ্যে কর্মী ও সমর্থক ও নেতৃত্ব তৈরির জন্য এতে বেছে বেছে পছন্দসই বিষয়গুলোর উপর জোর দেয়া হয়েছে। তাতে যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনী তৈরি সহজ হবে, যারা ধর্মের জন্য রক্তপাত ও রক্তদানে নির্ভীক থাকবে কিন্তু সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় নি:স্বার্থ, সত্যনিষ্ঠ, নীতিবান মানুষ পাওয়া যাবে না। আমার উত্তর শুনে বড় মামা মুচকি হাসলেন। বুঝলাম আমার নতুন ধারণা তার মানসিক সমর্থন পাচ্ছে। নানা বাড়িতে ছুটি কাটাতে এসে আমি এই নতুন ধ্যান-ধারণা নিয়ে ফিরে আসলাম স্কুলে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
১৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×