somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নানাবাড়ি ডায়েরীজ

২৮ শে নভেম্বর, ২০১২ রাত ১২:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমি বড় হয়েছি শহরে। তবে গ্রামও খুব খাছ থেকে দেখা হয়েছে। শৃংখলিত জীবন থেকে ১৫-২০ দিন ছুটি মিলত বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে। ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া হত দাদাবাড়ি আর নানাবাড়ি। দাদাবাড়ি যাওয়া হত বেশি। সে এক যায়গা বটে, হদ্দগ্রাম! বিশাল হ্যাপা পার করে যেতে হত। দাদা মারা যাবার পর অবশ্য আর গ্রামে যাবার কোন কারণ ছিলো না। চাচারা সবাই শহরে থাকতেন, তাই আগের মত সেভাবে যাওয়া হত না। সেকথা আরেকদিন। আজ নানাবাড়ির কথা বলি। আমার নানাবাড়ি নাটোর শহরে।

মামাদের কোন ছেলে সন্তান নেই, খালারও নেই। গোটা বাড়িতে আমি একাই ছেলে, এজন্যে খাতির পেতাম অন্যরকম! আমার বড় কাজিনটা আমার চেয়ে ৫ বছরের বড়। তার চেয়ে ছোটজন ২ বছরের বড়। এরপর আমি। আমার ইমিডিয়েট ছোটজন আমার চেয়ে ২৬ দিনের ছোট! আর সবার ছোট বোনটা ২ বছরের ছোট। নানাবাড়ি গেলেই দারুণ মজা করতাম। যেহেতু আমার নিজের কোন ভাইবোন নেই, কাজিনগুলোকে পেলে আমি অন্য কেউ হয়ে যেতাম। আর বার্ষিক পরীক্ষার পর যেতাম যেহেতু, আনলিমিটেড ফুর্তি হত, কেউ মানাও করত না।

মাঝে মাঝে আমরা চাঁদা তুলে পিকনিক করতাম। রান্নাবাটি খেলার মত পিকনিক না কিন্তু। সত্যিকারের পিকনিক। রান্নাবান্নাও আমরাই করতাম। বড়রা সাহায্য করতে চাইলে আমরা নিজেরাই ঘেষতে দিতাম না! উঠানের এককোণে একটু জায়গা করে নিতাম আমরা, সুন্দর করে সাজাতামও কখনোও সখনো। নিজেরাই বাজার করে নিয়ে আসতাম। আসলে বেশি মুদি দোকান তো বেশি দূরে ছিলো না। ওখানেই সব পাওয়া যেত। এরপর আমরা দায়িত্ব ভাগ করে নিতাম। তারপর রান্না হত। শেষ হতে হতে বিকেল হয়ে যেত। তারপর দেখা যেত ভাতটা বোধহয় গলেনি, ডিমটা শক্তই আছে। মুরগীতে ঝাল বেশি হয়ে গেছে। তারপরো সেগুলো আমাদের কাছে অমৃতই মনে হত!

এখন তো শহরে ছেলেমেয়েরা আউটডোর গেমস সেভাবে চেনেই না। ওদের খেলা বলতে ক্রিকেট আর ব্যাডমিন্টন, কোথাও কোথাও বাস্কেটবল পর্যন্ত হয়তো। দেশী যে বহু রকমের খেলাধুলা আছে সেসব হয়তো ওরা কখনো জানবেই না! ছোটবেলা থেকেই আমার দৌড়াতে ভীষন অনীহা! তারপরো ওপেনটু বায়োস্কোপ, বদন, গোল্লাছুট, রুমালচুরি, ইত্যাদি সাত আটরকম খেলা নিয়মিত খেলা হতো নানুবাড়ি গেলেই। আরেকটা খেলা খেলতাম মনে আছে, সাত আটরকম পাতা জোগাড় করে নিজের নিজের বৃত্তের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে হত। একজন হতো চোর। তার কাজ ঐ পাতাগুলো খুঁজে বের করা। ঠিক ঠাক সবগুলো পাতা বের করে ফেলতে পারলে যার পাতা বের করা হলো সে পরের বারের জন্যে চোর। খেলার নামটা ঠিক মনে পড়ছে না! তবে ডাংগুলি খেলা হতো না। ডাংগুলি খেলা হতো দাদুবাড়ি গেলে। এগুলো তো গেলো দেশী খেলা। এছাড়া ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টনও বাদ যেত না। আমরা যখন ছোট ছিলাম, উঠান টা আমাদের খেলার পক্ষে প্রশস্তই ছিলো বলতে হবে! আসেপাশের বাসা থেকে কয়েকজন নিয়মিত আসতো আমাদের সাথে খেলতে। আমরা কখনোই ঘরে চুপচাপ বসে থাকতাম না! থাকলেও সেটা হতো দুটো কারণে। সারাদিন অতিরিক্ত দৌড়াদৌড়ির পর ক্লান্তি জনিত কারণে, অথবা সারাদিন অতিরিক্ত দৌড়াদৌড়ির কারণে বড়দের কারো বকা খেলে! ঘরে বসে থাকলেও খেলা থেমে থাকতো না। নামদেশ ফুলফল, লুকোচুরি তো চলতোই। একদম বসে থাকলেও গানের কলি চলতে থাকতে থাকতো।

শীতের দিনগুলোতে মানুষ লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমাতেই পছন্দ করে। আমরা উল্টোটা করতাম, সাতসকালে উঠতাম। আগের দিন ফ্যান্সি বেকারী থেকে কিনে আনা সিগারেট চুইংগামের সঠিক ব্যবহার করতে হবে না? সিগারেট চুইংগাম হচ্ছে সিগারেটের কাগজে জড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেটে প্যাক করা চুইংগাম, দেখতে অবিকল সিগারেট মনে হত। আগে পাওয়া যেত, এখন আর দেখিনা। আমরা ওগুলো মুখে নিয়ে সিগারেট ফোঁকার ভাব নিতাম! শীতের সকালে মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হয় বলে ব্যপারটা খুবই বাস্তবসম্মত হত! এই ভাবে আমরা পাড়া বেড়াতে বেরোতাম। একদিন তো এক মহিলা বলেই ফেললেন, দেশটা উচ্ছনে গেলো। এই বয়সের পোলাপানও সিগারেট ফুঁকে!

একটু বড় হবার পরের ঘটনা। আমি আবার কিছুটা বোকাসোকা ছিলাম ছোটবেলায়, এখনো আছি মনে হয়। সবাই মিলে টিভি দেখছি, খেয়াল করলাম ওরা হিন্দি ছবির কোন দৃশ্যের মাঝে হঠাৎই চ্যানেল পরিবর্তন করে ফেলে! পরে বুঝলাম বিশেষ দৃশ্যের সময় হলেই কাজটা করা হয়। রিমোট স্বভাবতই থাকত সবার বড় কাজিনের হাতে। আমরা লিডারশীপ মেনে চলতাম সবসময়ে, তাই এটা নিয়ে কারো কোন উচ্চবাচ্চ করার ছিলো না। আর সবার বড়টা ছোট গুলোকে সকল ভালগারিজম থেকে দূরে রাখার জন্যে এই মহান সেন্সর কর্মকান্ড চালিয়ে যেত।

একদিন আমার ইমিডিয়েট ছোট (২৬ দিনের) কাজিনটা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, naked মানে জানো? আমি তখন সত্যিই naked মানে জানতাম না, কিন্তু আইডিয়া ছিলো একটা ভাসা ভাসা। কিন্তু আমি কী আর স্বীকার করি! খুব ভাব টাব নিয়ে বললাম, সে জানবো না আবার! ও বললো, বলো তো কী জানো? আমি তখন ফেঁসে গেছি- আমতা আমতা করছি। আমার অবস্থা দেখে ও একচোট হাসলো খুব। তারপর ফিসফিস করে আমাকে মানেটা বুঝিয়ে বললো। ওর বোঝানোটাও একদম ঠিক ছিল না, তবে সেটা বুঝতে আমাকে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিলো।

মামারা ছিলো একান্নবর্তী পরিবার। আমার নানী মারা যান যখন আমার বয়স দুই। তাই নানীর আদর তেমন একটা পাওয়া হয়ে ওঠেনি আমার। খাতির যত্ন মামা-মামীরাই করতেন। বরং ভালোই করতেন অন্য অনেকের চেয়ে। আমি খাওয়া দাওয়ায় খুবই বাছবিচার করতাম। এখনো করি। আমি যতদিন থাকতাম, আমার পছন্দের খাবার দুবেলাই রান্না হতো।

নানী মারা যাবার পর সংসার বড় বলে বড়মামা আলাদা হয়ে গেলো। এরপর আস্তে আস্তে ছোটমামা, মেজমামাও। সবার বাসাতেই আলাদা রান্নাঘর, কমন বলতে শুধু আমাদের প্রিয় উঠানটা, যদিও বর্ধিত সংসারের যায়গার জোগান দিয়ে তাকে আরো সংকীর্ণ, আরো অপরিসর হয়ে যেতে হয়েছিল। নানাভাই কে সংসারের ভার টানার জন্যে আরেকটা বিয়ে করতে হলো। এসব আমাদের চোখে পড়ত, আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। কোন কারণে আমরা ভাইবোনরা একান্নবর্তী পরিবারটাই খুব বেশি পছন্দ করতাম।

আপরিসর হলেও তাই উঠানটাই আমাদের শেষ আশ্রয় ছিলো। এক কোণে একটা বড় কাঁঠালগাছ ছিলো উঠানে, নিজেরাই দড়ি আর কাঠের পিঁড়ি মিলিয়ে তাতে একটা দোলনা ঝুলিয়েছিলাম আমরা। জায়গার অভাবে কিছু কিছু খেলা যখন আর খেলা যেত না, রোজ বিকেলে পালা করে দোলনায় উঠতাম আমরা। প্রতিযোগীতা হত কে কাকে কত উঁচুতে তুলতে পারে। যে পারত, সে উঠত পরেরবার দোলনায়, আর আরেকজন চেষ্টা করত উচ্চতার রেকর্ড ভাঙ্গার। দোলনায় চড়ে যখন অনেক উঁচুতে উঠে যেতাম তখন মাঝে মাঝে মনে হতো, আকাশ টা এতই কাছে যে হাত বাড়ালেই মেঘ ছোঁয়া যাবে! আকাশ হয়ত ছুঁতেও চাইতাম তখন।

সন্ধ্যায় যখন সবাই বাড়ি ফিরে যেত, আমি তখনো দোলনাতেই চুপ করে বসে থাকতাম। দোলনাটা মৃদু বাতাসে অল্প অল্প দুলত, সাথে আমিও। এই বিষন্ন কিশোরের দোলনায় বসে লোক দেখানো মন খারাপের প্রগলভতা- এর কারণ কী মেঘ ছুঁতে না পারা, মানবসৃষ্ট কারণে উঠোনের সংকীর্ণতা ক্রমশ বেড়ে যাওয়া, না প্রিয় প্রাঙ্গনের অবসম্ভাবী পৃথকায়ন, কেউ কখনো জানতে চায়নি...
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০১৩ সকাল ১০:০৫
১৮টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×