ঢামেক থেকে চুরি যাওয়া রুনা আক্তারের সন্তানকে র্যাব উদ্ধার করেছে। হাসপাতাল থেকে নবজাতক সন্তান চুরি যাওয়া কিন্তু নতুন কোন ঘটনা না। এটা অহরই ঘটছে এবং সাবধান না থাকলে আপনার সাথেও ঘটতে পারে।
নিজের কথাই বলি। আমার জন্ম নাটোর মিশন হাসপাতালে। আমি কিন্তু জন্মের দুদিন পর চুরি হয়ে গিয়েছিলাম! মিশনের তখনকার সিস্টেম ছিলো নবজাতকদের মায়েদের ওয়ার্ড থেকে একটু দুরে পাশের ঘরে রাখা হত, শুধু খাবার সময় মায়েদের কাছে দেয়া হত। বাকী সব কাজ সিস্টাররা করতেন। আমার আম্মুর সিক্সথ সেন্স খুব সজাগ। তো জন্মের দুদিন পরে আম্মু সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার কান্না শুনতে পাচ্ছে না। সিস্টারদের ডেকে সাথে সাথে আম্মু বলেছে, আমার ছেলে কই? সিস্টাররা প্রথমে পাত্তা দেয়নি। কারণ তখনো পর্যন্ত নাটোর মিশন হসপিটালে এরকম ঘটনা ঘটেনি বা ঘটলেও কেউ জানতে পারেনি।
আম্মুর চেঁচামেচি বাড়লো। আমার বাচ্চা কই, আমি কান্না শুনিনা ক্যানো! সিস্টার রা অবাক! এতগুলা বাচ্চার মধ্যে আপনি আপনার বাচ্চার কান্না আলাদা করে বুঝতে পারছেন? আম্মু বললো- হ্যাঁ। আমি আমার বাচ্চার কান্না চিনি। আমার বাচ্চা কই আমার কাছে এনে দেন। সিস্টার আমাকে খুঁজতে এসে দেখলেন একটা বাচ্চা কম। আমি নাই!
সাথে সাথে খোঁজ পড়ে গেলো। গার্ড রা ব্যস্ত হয়ে পড়লো আমাকে খুজতে, সিস্টার রাও ছোটাছুটি করতে লাগলেন। আম্মুর সার্জন ডক্টর বারোজ এসে ছোটাছুটি করেন আর আম্মুকে সান্তনা দেন। দেড় ঘন্টা পার হয়ে গেলো এরমধ্যে।
প্রায় পৌনে দুই ঘন্টা পরে মিশনের শেষমাথায় নাইটশিফটের এক নার্সের স্বামীর কাছে আমাকে পাওয়া গেলো। সেও হাসপাতালের গার্ড। আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরছিলো। আম্মু খুব দ্রুত আমি নেই এটা ধরতে পারায় অন্য গার্ড আর সিস্টাররা সমস্ত মিশন খুঁজতে শুরু করেছিলো। এই কারণে ওই লোক অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও কোন দরজা দিয়ে বেরোতে পারছিলো না। পরে ধরা পড়ে যায়।
আমাকে সে চুরি করেছিলো কারণ ওরা ছিলো নিঃসন্তান। আমাকে দেখে লোভ সামলাতে পারেনি।
ওই লোকের ভাষ্যমতে ওর স্ত্রী জানত না যে সে চুরিটা করবে। ওকে পরে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিলো। আর সিস্টারটা আম্মুর কাছে অনেক ক্ষমা চেয়ে পরে চাকরিতে বহাল ছিলো।
আমি নাটোর মিশনের প্রথম নথিভুক্ত সন্তান চুরির ঘটনার শিকার। আমার মত সবার কপাল ভালো নাও হতে পারে। অনেক অনেক এমন ঘটনা প্রতিদিন- প্রত্যেক দিন ঘটছে। মিডিয়ায় এসেছে বলে আপনারা রুনা আক্তারের কথা জানেন, দেখতে পাচ্ছেন। চোখের আড়ালে আছে শতকরা ৯০ শতাংশ ঘটনা। বেশিরভাগ চুরি যায় গ্রাম থেকে আসা সাধারণ মানুষের নবজাতক, সঠিক জ্ঞানের অভাবে তারা কী করবে বুঝেও উঠতে পারেন না। কখনো খুজেও পাওয়া যায় না সেইসব বাচ্চাদের।
অনেক হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে এই সংক্রান্ত ব্যবসার সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। মূলত বহিরাগতরা নিয়ন্ত্রন করলেও অনেকখানেই নীতিভ্রষ্ট নার্স, গার্ড এমনকি কিছু ডাক্তার নামধারী পেশাজীবি শয়তানেরাও এখানে জড়িত। পূর্ণবয়স্ক বাচ্চার অ্যাবরশন করাতে এলে বাচ্চা বেঁচে থাকলেও মৃত বলে চালানো, ক্রিটিক্যাল বাচ্চাদের কে মৃত ঘোষণা করে বাবা মা এ লাশ পর্যন্ত দেখতে না দেয়া জাতীয় ঘটনা অহরহ ঘটছে। মিডিয়া তে এগুলো আসেনা বলে আমরা জানিনা।
বাচ্চাগুলোর সাথে কী হয়? প্রথমত সবচেয়ে ভালো ব্যবসা হচ্ছে কোন নিঃসন্তান দম্পতি কে বেচে দেয়া (দত্তক দেয়া না কিন্তু)। হাই সোসাইটির ফ্যামিলি গুলোতে এই ধরণের ব্যবসায়ীদের জানাশোনা থাকে। ওসব দম্পতিরা এভাবে বাচ্চা কিনেও নেন, ইলিগ্যাল জেনেও। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত কাউকে মুখ খুলতে দেখা যায় না। যেসব বাচ্চাদের শারীরিক অবস্থা সঙ্গিন থাকে, বা একটু অসুস্থ থাকে, বা শরীরে কোন বিকলাঙ্গতা থাকে, তাদেরকে লোকাল ভিক্ষুক নিয়ন্ত্রনকারী গডফাদার/মাদারদের কাছে তুলে দেয়া হয় কিছু অর্থের বিনিময়ে। এদেরকে পরবর্তীতে ভিক্ষুক বানানো হয়। কীভাবে বানানো হয় আশা করি জানেন। না জানলে স্লামডগ মিলিওনিয়ার দেখে নিলে একটু আইডিয়া পেতে পারেন।
সবচেয়ে করুণ ব্যাপারগুলো হয় এরকম চুরি যাওয়া সদ্যমৃত সন্তানগুলির সাথে। জ্বী, আপনার মৃত সন্তান ও চুরি হতে পারে! বাইরের দেশে নবজাতক শিশুর অর্গানের চাহিদা প্রচুর। দামও অনেক। চোরাইপথে দেশের বিভিন্ন ক্লিনিক থেকে এই নির্মম অর্গান বিক্রির ব্যবসা চলে। এই ব্যবসায় অবস্য রিস্ক প্রচুর আর সঠিকভাবে অর্গান প্রিজার্ভ করাও শ্রমসাধ্য।
এই বিশাল নেটওয়ার্ক কীভাবে গড়ে উঠেছে, কারা জড়িত এ সংক্রান্ত তথ্য গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আছে বলে মনে করি। বাচ্চা চুরির এই অপতৎপরতা রোধ করা সম্ভব হবে তখনই যখন এই নেটওয়ার্ক সমূলে উৎখাত করা সম্ভব হবে। আমার আপনার হাতে তা নেই। যাদের হাতে আছে, তারা উৎকোচ গ্রহণ করে এসব না দেখার ভান করছেন।
আমার আপনার হাতে যা আছে তা হলো, সচেতন হওয়া। না হলে আপনার সন্তানের সাথেও ঘটে যেতে পারে এরকম অমানবিক চুরির ঘটনা। সাবধান হোন এখনই। অপরিচিত কারো কাছে কোনমতেই একমিনিটের জন্যেও নিজের সন্তান দেবেন না। কেউ আগ বাড়িয়ে খাতির জমাতে আসলে সতর্ক হোন। নার্স বা সিস্টারদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখুন।
আপনার সন্তান থাকুক নিরাপদ ও সুস্থ্য, বেড়ে উঠুক ভাবনাহীন।
ছবি সূত্রঃ বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডট কম
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ১০:০৮