সীতাকুণ্ড শিপ ইয়ার্ডে শ্রমিকদের মানবেতর জীবন যাপন জাহাজ ভাঙার দৈনিক মজুরি ঘন্টা ৮ থেকে ২০ টাকা মাত্র
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
‘আমি যদি কাজ করতে যাই তাহলে শুধু আমি একাই মারা যাবো। কিন্তু আমি যদি বাড়িতে থেকে যাই তাহলে এক সঙ্গে পাঁচজন মারা পড়বে’। ভাটিয়ারী গোল্ডেন শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে কর্মরত কাটার ম্যান শরিফুল ইসলামের করুন আর্তি এটি। জীবন-জীবিকার তাগিদে এমন পেশা এসব শ্রমিকরা বেছে নেয় যেখানে প্রতিনিয়ত মৃত্যু তাদের তাড়া করে ফেরে। র্দুঘটনা এসব ভাগ্যবিড়ম্বিত শ্রমিকের নিত্যসঙ্গী।
শফিকুল ইসলামের বয়স প্রায় ৪৫। ১৫বছর আগে সে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে কাজ করতে আসেন। বর্তমানে মোটামুটি ভালো অবস্থায় আছেন। কারণ শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে সবচেয়ে বেশি মজুরির পেশা কাটার ম্যান। প্রতিদিন ৮ ঘন্টা হিসাবে কাজ করেন। দিন ১৩২ টাকা। সে দুঃখ করে বলেন, তার অবস্থা এমন হওয়ার কথা ছিল না। এক সময় গ্রামের এক স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। তাদের বাড়ী ছিল বগুড়া জেলা সাড়িয়াকান্দি থানার কামালপুর গ্রামে। প্রায় ৩০-৪০ বিঘা জমির মালিক ছিলেন তার বাপ-চাচারা। এমন একটা সময় ছিল যখন তাদের বাড়ীতেই ১০-১২ জন লোক কাজ করত ধান উঠার মৌসুমে। কিন্তু সে সময় এখন মৃত। নদীর ভাঙ্গনে সব হারিয়ে তারা এখন নিঃস্ব প্রায়। শরিফুল একসময় চলে আসেন চট্টগ্রামে। তারপর কাটিং হেলপার হিসাবে কাজ শুরু করেন। এভাবে বছরের পর বছর কাজ করতে করতে দক্ষ হয়ে উঠেন শফিকুল। কাজের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, বাংলাদেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হচ্ছে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের কাজ। কেন ঝুঁকিপূর্ন জানতে চাইলে তিনি জানান, এখানে কোন প্রশিক্ষিত লোক নেই, যে যার মত কাজ করে। তাই প্রায় প্রতিদিনই ইয়ার্ডের ছোটখাট দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। যার অনেক তথ্যই ইয়ার্ডের বাহিরে যায় না। যদি তাদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা যেতো, নিরাপত্তার বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহ করা হতো, জাহাজে থাকা বিভিন্ন ক্ষতি কারক পদার্থ সম্পর্কে ধারনা দেওয়া হতো তবে দুর্ঘটনার হার অনেক কমে যেতো। তাদের অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় সেটাও তিনি বুঝতে পারেন। কিন্তু বাড়িতে ফিরে গেলে বেকার হয়ে বসে থাকতে হবে নতুবা অন্যের জমিতে কৃষি কাজ করতে হবে। তাই সব কষ্ট সহ্য করেও বছরের পর বছর নিরবে কাজ করে চলে শফিকুল। মালিকের সাথে কখনও দেখা হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, শিপ ব্রেকিং মালিকরা ইয়ার্ডে আসার তেমন প্রয়োজন বোধ করেন না। তাদের নিয়োগকৃত লোকজনই সব ম্যানেজ করে নেয়। যদি কখনো বড় ধরনের কোন দুর্ঘটনা হয় তখন হয়তো ইচ্ছা হলে আসেন। তারা শুধু জানে শিপ ব্রেকিং থেকে কিভাবে বেশি আয় করে নিয়ে যাবেন। তার শারিরীক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, প্রতিদিন গ্যাস দিয়ে কাজ করতে হয়, আগুনে ফুলকি এসে গায়ে পড়ে দাগ হয়ে গেছে। জাহাজের ভিতর অনেক সময় বিষাক্ত গ্যাস থাকে। ঐসব জায়গায় কাজ করার সময় মাঝে মাঝে শ্বাস কষ্ট হয়। তখন কিছুদিন কাজ বন্ধ করে বাসায় বসে থাকেন,পরে আবার একটু সুস্থ হলে বাধ্য হয়ে কাজে যান। শারিরীক এই অসুস্থতা ইয়ার্ডে যারা কাজ করেন তাদের প্রত্যেকেরই আছে বলে তিনি জানান। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর তথ্যদিয়ে তিনি জানান, ইয়ার্ড এলাকায় একটানা ২০-২৫ বছর কাজ করার পর অল্প বয়সে আসা উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ লোকগুলো তাদের কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে আবার গ্রামের বাড়ীতে ফিরে যায়। যাদের অধিকাংশই জীবনের মধ্য বয়সে মারা যায়।
শিপ ব্রেকিং সমিতি সুত্রে জানা যায়, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় বোমায় ক্ষতিগ্রস্থ একটি জাহাজকে পরবর্তীতে ভেঙ্গে বিক্রি করার মাধ্যমে এ অঞ্চলে শিপ ব্রেকিং শিল্পের গোড়া পত্তন ঘটে। বের হয়ে আসে এই শিল্পের অগণিত দিক। পরবর্তীতে অত্যন্ত লাভজনক এই ব্যবসায় এগিয়ে আসেন দেশের বহু শিল্পপতি। যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধাসহ নানা কারনে দেশের মধ্যে সীতাকুণ্ড উপজেলার সলিমপুর থেকে কুমিরা সমুদ্র উপকুলে গড়ে উঠে এই শিল্প। বর্তমানে প্রায় ৪৫টির মতো ইয়ার্ডে জাহাজ কাটার কাজ চলে। অচল হয়ে যাওয়া সমুদ্রগামী জাহাজগুলোকে কিনে এনে এসব ইয়ার্ডে কাটা হয় সাধারন শ্রমিক দিয়ে।
‘মরা হাতির দাম লাখ টাকা’- এই প্রবচনটি জাহাজ ভাঙা শিল্পের বেলায় আক্ষরিক অর্থেই সত্য। ভাঙা জাহাজের কোন কিছুই ফেলনা নয়। সবকিছু বিক্রি হয়। মালিকরা পান বিশাল মুনাফা। সরকার পায় ফিবছর প্রায় ৯শ’ কোটি টাকার রাজস্ব।
এই শিল্পে যারা শ্রম দেন তারা কেমন আছেন ? অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা সত্য, এখানকার শ্রমিকেরা দৈনিক মজুরি ঘন্টা ৮ থেকে ২০ টাকা মাত্র। জাহাজ ভাঙা শ্রমিকরা যেন ক্রীতদাস। পান নাম মাত্র মজুরি। ৭দিন কাজ করলে ৫দিনের টাকা পান। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম। সাপ্তাহিক ছুটি নেই। সরকারি ছুটি ভোগ করার অধিকার তাদের নেই। ঝুঁকিপূর্ণ এই পেশায় কাজ করতে গিয়ে আহত হলে বা মৃত্যু হলে এক পয়সাও ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় না।
এই বিশাল কর্মযজ্ঞ আর জাতীয় অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের অবস্থা খুবই নাজুক। মানবাধিকার, শ্রমাধিকার, ন্যূনতম পারিশ্রমিকের নিশ্চয়তা ইত্যাদি চাপা পড়ে আছে জাহাজ ভাঙার প্রচন্ড শব্দের নিচে। এই শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকরা আসে উওরাঞ্চলের অভাবী এলাকা বগুড়া, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নওগাঁর গ্রামগুলো থেকে। কর্মরত শ্রমিকদের বয়স ১৪ থেকে ৪৭ বছরের মধ্যে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, যেসব শ্রমিক জাহাজের ভেতরে কাজ করেন, তারা কাজ শুরু করেন সকাল ৭টায়। যারা ইয়ার্ডে কাজ করেন তাদের কাজ শুরু হয় সকাল ৮টা থেকে। একেক গ্র“পের কাজের মজুরী একেক রকম। সাধারণভাবে একজন শ্রমিককে এক দিনের মজুরী বাবদ গড়ে ঘন্টা ৮ থেকে ২০ টাকা দেয়া হয়। প্রতি ১৫দিন পরপর মজুরী দেয়া হয়। তবে ১৫দিন কাজ করলে ১০ দিনের মজুরী পাওয়া যায়, ৫ দিনের মজুরী জমা থাকে। পরিশ্রম সহ্য করতে না পেরে কেউ যাতে পালিয়ে না যায় তার জন্য এই ‘নিরাপত্তা’ ব্যবস্থা। শ্রমিকরা দুপুরে ১ ঘন্টা বিরতি পান। এই সময়ের মধ্যে গোসল আর দুপুরের খাবার সেরে নিতে হয়। এরপর টানা কাজ চলে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। তবে প্রত্যেক শ্রমিককে রাত ৮টা পর্যন্ত ওভারটাইম করতে হয়। সপ্তাহে একদিনও ছুটি নেই। শুক্রবার কাজ করতে হয় দিনের অর্ধেক সময় পর্যন্ত। সরকারি ছুটি তাদের জন্য নয়।
ইয়ার্ড শ্রমিকরা জানান, জাহাজ ভাঙা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। প্রতিদিনই ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটছে। বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটলে প্রথমে স্থানীয় ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। বিফল হলে পাঠানো হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। যতদিন চিকিৎসাধীন থাকবে ততদিন ‘বিনা বেতনের ছুটি’। কোনো শ্রমিক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে গেলে যেনতেনভাবে চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়। দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে অবশ্য দাফনের খরচ মিলে। ক্ষতিপূরণ মিলে না।
সীতাকুণ্ড থানা ও ইয়ার্ড শ্রমিকদের সুত্র জানায়, গত নয় মাসে বিভিন্ন র্দূঘটনায় কেড়ে নিয়েছে ২৭ ব্যাক্তির জীবন। এসময় আহত হয়েছে প্রায় শতাধিক শ্রমিক। এদের অনেকেই জীবনের তরে পঙ্গু হয়ে গেছে।
সর্বশেষ চলতি বছরের ৭জানুয়ারী মাদামবিবির হাট নেভিগেইট এলাকার আব্দুর রহিম হাজীর মালিকানাধীন রহিম/ডায়মন্ড ষ্টিল শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে ‘এমটি এ গেইট’ নামক জাহাজের তেলের ট্যাংক কাটার সময় বিষ্ফোরণে ঘটনাস্থলেই ৪ শ্রমিক নিহত হওয়া ছাড়াও কমপক্ষে ২০ শ্রমিক আহত হয়।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসা’র প্রকল্প কর্মকর্তা (শিপ ব্রেকিং ক্যাম্পিং) মো. আলী শাহীন জানান, ইয়ার্ড মালিকদের গাফিলতির কারণেই প্রতিনিয়তই র্দূঘটনা ঘটছে। দূর্ঘটনার কোন শ্রমিক নিহত হলে তাঁকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় না। শুধুমাত্র শ্রমিকদের লাশ বাড়ীতে পাঠাতে সামান্য টাকা দেয়া হয়। অথচ একজন শ্রমিক নিহত হলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে ইয়ার্ড মালিকের পকেট থেকে বেরিয়ে যায় মোটা অংকের টাকা। আর এই অর্থ বাচাঁতে লাশগুমের প্রবণতা দেখা যায়।
জাহাজভাঙ্গা শিল্পের শ্রমিকদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক আবদুল সোবহান বলেন, সীতাকুণ্ডের শিপ ইয়ার্ডগুলোর পরিবেশ ছাড়পত্র নেয়ার বিধান থাকলেও তারা এ নিয়ম মানছে না। যার কারণে অদক্ষ শ্রমিকরা পুরোনো জাহাজ বিচিং করতে গিয়ে মারাত্বক দূর্ঘটনায় শিকার হতে হচ্ছে। পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়া জাহাজ না কাটার জন্য আদালতের নির্দেশ রয়েছে। বর্তমানে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
জাহাজ ভাঙ্গা শ্রমিকদের অদক্ষতার কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মোঃ জাফর আলম বলেন, যথাযথ নিয়ম মেনেই জাহাজ কাটা হয়। ইয়ার্ড মালিকরা সবসময় চেষ্টা করে যেন শ্রমিকরা নিরাপদে জাহাজ কাটতে পারে। তারপরও অসাবধানতাবশত কিছু র্দূঘটনা ঘটে যায়। দূর্ঘটনা ঘটলে শ্রমিকদের দ্রুত চিকিৎসা দেয়া হয়। শ্রমিকদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য ভাটিয়ারীতে ১০ কোটি টাকা ব্যায়ে হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে। শ্রমিকদের কম মজুরী প্রসঙ্গে তিনি জানান, কাটিং ঠিকাদাররাই শ্রমিক নিয়োগ করে। সেটা তাদের বিষয়।
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=
©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!
একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন
অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪
চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন
আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?
ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম
যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।