somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক অচেনা নতুন পৃথিবীর দ্বার

২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মঙ্গল অভিযান কেন শুরু করেছিল? আজ, একবিংশ শতকে তার অবস্থানই বা কোথায়? নতুনকে জানা, নিজের গণ্ডি ছাড়িয়ে নতুন পৃথিবীর সন্ধানের আকাঙ্ক্ষা মানুষের সহজাত, যা মানুষকে দিয়েছে ক্রমাগত নতুন দিগন্তের সন্ধান। স্যর আর্থার সি ক্লার্ক-এর মতে, পৃথিবীর ইতিহাসে আজ পর্যন্ত মানুষ তিন বার নতুন দিগন্তের সন্ধান পেয়েছে। প্রথম, ১৪৯২ সালে কলম্বাস-এর আমেরিকা ‘আবিষ্কার’ এবং দ্বিতীয়, ১৬০৯ সালে টেলিস্কোপের সাহায্যে গালিলেয়ো-র মহাকাশ দর্শন। তৃতীয় বার, ১৯৭২ সালে নাসা-র মেরিনার-৯ অরবিটার মঙ্গলযান মঙ্গলের অজস্র ছবি পাঠিয়ে আর এক অচেনা নতুন পৃথিবীর দ্বার উন্মোচিত করল।

এই আবিষ্কার এক অন্য সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিল। দেখা গেল, ‘মেরিনার-৯-এর দেখা নতুন পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের এই পুরনো পৃথিবীর অনেক মিল। মঙ্গলে দিন-রাত আছে, ঋতু পরিবর্তন আছে, আছে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু, খুব উঁচু পাহাড় আছে, বিরাট আগ্নেয়গিরি আছে, বিশাল নদীখাতও আছে, যা একদা সেখানে জল থাকার প্রমাণ দেয়। জল থাকার সম্ভাবনা প্রাণের সম্ভাবনার জন্ম দেয়। তা হলে কি মঙ্গলেও এক দিন প্রাণ ছিল?

দুটো কারণে মেরিনার-৯ মানুষের মঙ্গল অভিযানের যথার্থ সূচনা করল। প্রথমত, এই বিশাল সৌরজগতে যদি আর কোথাও প্রাণের সন্ধান পাওয়া যায়, জানা যাবে পৃথিবীতে আমরা একা নই। দ্বিতীয়ত, মঙ্গলে যদি জল ছিল, আবহাওয়া ছিল, তা ধ্বংস হল কেন? তা হলে, আমাদের পৃথিবীও তো এক দিন সে ভাবেই প্রাণহীন হতে পারে। তাই মঙ্গলগ্রহে বিপর্যয়ের কারণ জানলে পৃথিবীকে তেমন বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা যেতে পারে।

অতঃপর মঙ্গলে তিন রকম অভিযানের সূচনা হল। এক, ফ্লাই বাই (মঙ্গলের ‘পাশ’ দিয়ে চলে যাওয়া); দুই, অরবিটার (মঙ্গলের কক্ষপথে ঘোরা); তিন, ল্যান্ডার/ রোভার (মঙ্গলে অবতরণ ও সফর করা)।

নাসার মেরিনার-৯-এর পূর্ববর্তী মেরিনার-৪, ৬ ও ৭ ছিল ফ্লাই বাই অভিযান। ১৯৭৫-এ নাসার পাঠানো যমজ রোভার ভাইকিং-১ এবং ভাইকিং-২-এর পর মঙ্গল অভিযানের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়ে যায়।

দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় সতেরো বছর পর। ১৯৯২ সালে নাসা পাঠায় মার্স অবজার্ভার নামের অরবিটার, যা মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছনোর আগে রহস্যজনক ভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়। তার পর ১৯৯৬ থেকে এ পর্যন্ত মঙ্গলে যত সফল অভিযান হয়েছে, তাতে ইসা-র (ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি) মার্স এক্সপ্রেস ছাড়া বাকি সবই নাসার। সফল অভিযানের তালিকায় আছে চারটি অরবিটার: মার্স গ্লোবাল সার্ভেয়র, মার্স ওডিসি, মার্স রেকনেসাঁস ও ইসা-র মার্স এক্সপ্রেস; চারটি রোভার: পাথফাইন্ডার, স্পিরিট, অপরচুনিটি ও কিউরিয়সিটি; একটি ল্যান্ডার: ফিনিক্স। এরা নানা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্য প্রচুর যন্ত্রপাতি নিয়ে মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছেছে বা মঙ্গলে অবতরণ করেছে।

স্পিরিট, অপরচুনিটি ও কিউরিয়সিটি— তিনটি রোভার আগামী অভিযান ‘মার্স ২০২০’-এর পথ প্রশস্ত করেছে, যে অভিযান সেখানে প্রাণের উৎস সম্পর্কিত জৈব প্রমাণ খুঁজবে ও মঙ্গলে প্রাণধারণের জন্য অতি আবশ্যক অক্সিজেন তৈরি করবে। মঙ্গলে অপরচুনিটির কাজ করার কথা ছিল তিন মাস, সে আজ দশ বছরেরও বেশি সময় সক্ষম থেকে ও অরবিটারগুলির সঙ্গে সংযোগ রেখে কাজ করে প্রমাণ করেছে, এই গ্রহে যন্ত্রের স্থায়ী ভাবে কাজ করা সম্ভব।

মাঝে ১৯৯৮ সালে পাঠানো জাপানের মঙ্গলযান নোজোমি মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়। ২০১১ সালে চিনের তৈরি মঙ্গলযান ইংহুয়ো-১ পৃথিবীর অভিকর্ষ ছাড়াতে ব্যর্থ হয়। এই প্রেক্ষিতে ভারতের মঙ্গল অভিযানের সূচনা। প্রায় একই সঙ্গে যাত্রা করেছে নাসার মাভেন, মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল কী ভাবে হারিয়ে গেল তার সন্ধানে। মাভেন সোমবার মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছে গেছে।

আমাদের মঙ্গলযান যাত্রা করেছে গত বছর ৫ নভেম্বর। উৎক্ষেপণ করেছে পিএসএলভি রকেট। প্রস্তুতিতে সময় লেগেছে ১৫ মাস। দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি মঙ্গলযান নিয়ে গিয়েছে ১৫ কেজি সায়েন্স পে-লোড। এটি মঙ্গলের পরিমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের খোঁজ করবে, টোপোগ্রাফি বা ভূ-সংস্থান দেখবে এবং মঙ্গলের দুই উপগ্রহ ফোবোস ও ডিমস-এর বিস্তারিত বিবরণ দেবে। এই অভিযানের খরচ ৪৫০ কোটি টাকা।

এই ধরনের অভিযানের প্রস্তুতিতে নাসা ও ইসার সময় লাগে সাধারণত ৩৬ থেকে ৪৮ মাস। এরা সায়েন্স পে-লোড নিয়ে যায় অনেক বেশি। ইসা-র মার্স এক্সপ্রেস নিয়ে গিয়েছে ১১৬ কেজি। মঙ্গল অভিযান যেহেতু সহজ নয়, তাই চেষ্টা করা হয় মহড়া অভিযান করে আসল অভিযান নিখুঁত করার ও মঙ্গলযানে যত দূর সম্ভব বেশি সায়েন্স পে-লোড দেওয়ার। তাতে খরচ বাড়ে। তাই ‘খরচ, সময় কমিয়ে নাসাকেও টেক্কা’ গোছের যে সব কথা ভারতে শোনা যাচ্ছে, তার খুব একটা মানে নেই।

মঙ্গলযান মঙ্গলে মিথেন গ্যাস খুঁজবে। নাসার কিউরিয়সিটি রোভার মঙ্গলে মিথেন পায়নি। রোভার যা পেল না, অনেক দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করা অরবিটার মঙ্গলযানের তা পাওয়া খুবই শক্ত। আবার মিথেনের সঙ্গে প্রাণের সম্ভাবনার যোগও স্পষ্ট নয়, আরও অনুসন্ধান জরুরি। তবুও বলব, মহাকাশ বিজ্ঞানে অঘটন ঘটেই থাকে। নাসার পাঁচ হাজার কোটি টাকার মার্স অবজার্ভার সম্পূর্ণ ব্যর্থ, এক হাজার কোটি টাকার মার্স পাথফাইন্ডার দারুণ সফল। অতএব কম খরচের অভিযানে সাফল্য আসতেই পারে।

মঙ্গলযান মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশ করে ইসরো নির্ধারিত কর্মসূচি পালনে সক্ষম হলে ও নতুন কিছু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান দিতে পারলে শুধু ভারত নয়, সমগ্র বিশ্ব উপকৃত হবে। যদি বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে নবতম সংযোজন না-ও হয়, অভিযানের জন্য ভারত কারিগরি দক্ষতায় কৃতিত্বের দাবিদার হবে, যে কৃতিত্ব এশিয়ার কোনও দেশ এ পর্যন্ত দাবি করতে পারেনি। অভাবনীয় উন্নতি হবে এয়ারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং ও রোবোটিক্স-এ। মহাকাশ বিজ্ঞান গবেষণায় অনুদান অনেক বেড়ে যাবে। ইসরো পরিগণিত হবে মহাকাশ যাত্রায় এলিট ক্লাব-এর চতুর্থ সদস্য হিসেবে, সোভিয়েত ইউনিয়ন, নাসা, ও ইসার পরেই।

শেষ কথা, সব দেশের সব মঙ্গল অভিযানের শেষ বা চূড়ান্ত লক্ষ্য: প্রাণের সন্ধান। মঙ্গলে একটা মাইক্রোবের সন্ধান পাওয়া গেলে আমরা মহাকাশকে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিতে দেখব। হয়তো তাকে বলা যাবে চতুর্থ দিগন্ত।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×