আজ হাসপাতাল থেকে ডিউটি শেষ করে বাসায় ফেরার পথে পা যেন আর চলছিল না। এমন না যে আজই প্রথম হাসপাতাল থেকে হেটে বাসায় ফিরছি, তবুও আজ অনেক ভয় আর শঙ্কা আমাকে তাড়িয়ে ফিরছিল। চিন্তার ভারে নিজেকে আর টেনে বাসায় আনতে পারছিলাম না। অন্য সময় বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে একটু পড়াশুনা করি। আজ হাতমুখ ধুয়ে না খেয়েই শুয়ে পড়লাম। সারারাত একটুও ঘুমাতে পারি নি। সেহরি করে মান্ধাতা আমলের কম্পিউটারটা অন করে ব্লগ লিখতে বসলাম।
এবার ভেবেছিলাম ঈদে আম্মুর জন্য মিরপুরের শাহ আলী প্লাজার প্রাইডের শোরুম আর ছোট দোকান না ঘুরে, নবরুপা অথবা আড়ং থেকে একটা ভালো শাড়ি কিনে দিবো। কিন্তু সেটা হয়তো
আর হবে না। আমার মায়ের নাকফুলটা কত বছর আগে হারিয়ে গেছে কে জানে! কখনো আম্মুকে জিজ্ঞাসা করি নাই। অনেক দিন, অনেক মাস ধরে কল্পনা করে সুখে ভাসতাম আম্মুকে ডাইমণ্ডের একটা নোস পিন কিনে দিবো। কিছুদিন আগে আল হাসান ডাইমণ্ড গ্যালারীর একটা বিজ্ঞাপনে দেখলাম ২২০০ টাকায় নোস পিন পাওয়া যাবে। কত্ত ভেবেছি, একটা নোস পিন কিনে আম্মুকে সারপ্রাইজ দিলে আম্মু কি বলবে আর আমি আম্মুর হাসিমাখা মুখ দেখব। সেটাও এখন কেনা হচ্ছে না সম্ভবত। আমাদের ২ রুমের ছোট্ট বাসায় দিনে ২-৩ বার মাত্র পানি ছাড়ে বাড়িওয়ালা।
আমার সাথে পাশ করা অনেক বন্ধুরা এপার্টমেন্ট বাসায় থাকে বাবা মাকে নিয়ে, যেখানে যেতে হলে নিচে উর্দি পরা দারোয়ানের কাছে নাম ঠিকানা লিখে অপেক্ষা করতে হয়। কত আকাশকুসুম কল্পনা করেছি, পুরাতন ছোট্ট বাসাটা ছেড়ে দিয়ে একটা ভালো কোন বাসায় উঠবো যেখানে আম্মুকে পানি ধরার চিন্তায় থাকতে হবে না। মাঝে মাঝে কল্পনা করতে ভালো লাগতো, আম্মুকে বলি তুমি হেটে হেটে নোংরা কাঁচাবাজারে না যেয়ে বাড়ির পাশের স্বপ্ন থেকে বাজার করে নিয়ে আসো। কল্পনাটা কবে যে বাস্তব হয়ে ধরা দিবে!
ছোট ভায়ের হাত ঘড়িটা অনেক মাস ধরে নষ্ট হয়ে ওর টেবিলের ড্রয়ারে পড়ে আছে, ভেবেছিলাম এই ঈদে ওকে একটা সুন্দর ভালো ঘড়ি কিনে দিবো, সেটা এবার দিতে পারবো না হয়তো। ওর ঘরে আর্মি খাটের পাশে ওর প্রিয় গীটারটা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। অনেকবার ভেবেছি ওকে নতুন একটা গীটার কিনে দিবো। এবার না পারি, পরে কোন একসময় ঠিকই দিবো। ছোট ভাইটা কখনো ভার্সিটির বাস মিস করলে লোকাল বাসে করে ক্লাশ করতে যায়, কতদিন ভেবেছি, ভাইটার হাতে অতিরিক্ত কিছু টাকা দিয়ে বলি লোকাল বাসে করে না যেয়ে বিকল্প পরিবহণে যা। হয়তো সেটা এত তাড়াতাড়ি বলতে পারবো না। আমার ভায়ের নোকিয়া ১১০০ মোবাইল সেটটা পাল্টে স্যামসাঙ গালাক্সি ওয়াই কেনার স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যাবে আরও কিছুদিন।
কতদিন ভেবেছি, আমার বিবর্ণ হিজাবটা পাল্টাব। মাস ছয়েক আগে এক বান্ধবীর সাথে বসুন্ধরা সিটির নিচতলার একটা নামকরা ব্র্যান্ডের শোরুমে একটা হিজাব পছন্দ হয়েছিলো। সেলসম্যান যখন ওটার দাম ১০০০ টাকা বলল, তখন বলেছিলাম হিজাবের রঙটা সুন্দর কিন্তু কাপড়টা কেমন যেন। কতদিন ভেবেছি, ঐ হিজাবটা কিনব। সেটাও কেনা হবে না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বাটার ছাড়ের জন্য অপেক্ষা না করে, পুরাতন চপ্পলটা পাল্টে আরেক জোড়া নতুন কিনে নিয়ে আসি। এখন দেকছি আরও কিছু দিন অথবা কয়েক মাস ঐটা আমাকে চালাতে হবে। বয়সের ভারে ক্লান্ত আমার চায়না নোকিয়া মোবাইল ফোনটা আরও কয়েকটা মাস হয়তো আমাকে চালাতে হবে। কতদিন ভেবেছি ৮ ঘণ্টার ডিউটি শেষ করে না হেটে, ২০ টাকা দিয়ে রিক্সা নিয়ে বাসায় ফিরব। ভাবনাটা ভাবনাই থেকে যায়।
আপনারা হয়তো ভাবছেন আমি বেকার তাই আমাকে আমার কষ্টগুলো বয়ে বেড়াতেই হবে। আসলে তা না। আমি একজন ডাক্তার। গত ২ বছরে আমি বর্তমানের টা বাদ দিয়ে আরও ২ টা হাসপাতালে (১মঃ মা ও শিশু হাসপাতাল; ২য়ঃ ল্যাবএইড) জব করেছি। বর্তমানে মিরপুরের একটা হাসপাতালে আছি। তবুও এত কষ্ট কেন? অভাব কেন? ডাক্তার মানেই তো হাজার হাজার লাখ লাখ টাকা। ডাক্তার মানেই তো গাড়ি বাড়ি। তবে আমার এই দুর্দশা কেন? আপনারা আপনাদের অনুমানটা বলুনতো, দেখি কেউ বলতে পারেন কিনা। আমার হাসপাতাল পরিবর্তনের কারণগুলো কেউ অনুমান করতে পারবেন?
উৎসর্গঃ সিনিয়র ব্লগার বিডি আইডল কে; যার ব্লগপোস্টগুলো আমি লগ ইন না করে পড়ি এবং ভয়ে কমেন্ট করি না।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০১২ ভোর ৫:২৪