* মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১: বাঙালী নারীদের উপর পাকবাহিনীর নির্যাতন
ড. সুকুমার বিশ্বাস, স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের অন্যতম গবেষক। বাংলা একাডেমীতে কর্মরত অবস্থায় ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত তিনি সারা দেশে ঘুরেছেন এবং একাত্তরের বধ্যভূমি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী এবং ক্ষতিগ্রস্থদের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁর সংগৃহীত বধ্যভূমির তথ্য-উপাত্ত ভিত্তিক কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় এবং স্বাধীণতা যুদ্ধের দলিল পত্রে। একাত্তরের বধ্যভূমি সম্পর্কে তার প্রকাশিতব্য গ্রন্থ থেকে রাজশাহীর বধ্যভূমির বিবরণ জানাবো আজ।
১৯৭১ সালে পুরো রাজশাহী বিভাগ জুড়েই পাকবাহিনী নারকীয় হত্যাকান্ড, ধর্ষণ, নির্যাতন এর মতো জঘন্য অপরাধ করেছে। রাজশাহী মহানগরীর প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে একটি বধ্যভূমি। এই বধ্যভূমি পাকবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগী আলবদর-রাজাকারদের সৃষ্ট। বোয়ালিয়া থানার ২৫ গজ দূরে ঠিকাদার মুসলিম শাহ’র দ্বিতল বাড়ির পেছনে রয়েছে এই বধ্যভূমি। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুসলিম শাহ সপরিবারে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। এই সুযোগে তার বিরাট বাড়িটি আলবদররা দখলে নিয়ে সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে অসংখ্য নারী-পুরুষকে ধরে এনে এই ক্যাম্পে নির্যাতন চালায় আলবদররা। নির্যাতন-ধর্ষণের পর ক্যাম্পের পেছনে দেয়াল ঘেরা জঙ্গলে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হত তাদের।
ছবি: ১৯৭১ সালের নয়টি মাস পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের দোসরদের মদদে , রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই জায়গাটিতে ( বুধপাড়া বধ্যভূমী ) অসংখ্য নর-নারীকে ধরে এনে নৃশংস ভাবে হত্যা করে পুঁতে রাখে ।
বিজয়ের পর ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে এই বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করা হয় কয়েকশ নারী-পুরুষের হাড় ও কঙ্কাল। রাজশাহীর বোয়ালিয়া, কাটাসুর, শিয়ালবাড়ি এবং গোদনাইলের পাশ দিয়ে সমান্তরাল ভাবে সংযোজিত হয়েছে এই বোয়ালিয়া। এই স্থানটিতে আরো একটি বধ্যভূমির সন্ধান মিলেছে। এই বধ্যভূমি-গণকবরেই পাওয়া যায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এ জেড শওকত রেজার লাল। শওকত রেজার নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারী ‘দৈনিক বাংলায়’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়:
‘বিগত ৯ই ডিসেম্বর ফ্যাসিস্ট জামাতে ইসলামীর কুখ্যাত আলবদরের ১৪/১৫ জন সশস্ত্র সদস্য এবং রাজশাহী টাউন থানার ওসি অতর্কিতে ছাত্রাবাসে ঢুকে শওকত রেজা ও অন্য চারজনকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে একজন পালিয়ে এসে পরে অন্য দু’জন আলবদরকে সনাক্ত করে। ওসির নাম শামসুল আলম। আলবদরের দু’জন সদস্য হচ্ছে আবদুল হাই ফারুকী, সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অপর জন মাযহারুল ইসলাম, পিতা মো: আনিছুর রহমান, সে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। চোখ বেঁধে রেজাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয় তা প্রথমে কেউ অনুমান করতে পারে নাই। তবে তিন/চারদিন তারা একটি অন্ধকার কক্ষে আবদ্ধ থাকে। রেজার সহপাঠী সাহাবউদ্দিন আহমদ পালিয়ে আসতে সমর্থ হয়।’
ছবি: রাজশাহীর শ্রীরামপুর বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করা শহীদদের গলিত বিকৃত লাশ।
পাকসেনারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলকে প্রায় গোটা ৯ মাস ক্যান্টনমেন্ট হিসাবে ব্যবহার করেছিলো। এই হলের পেছনে দীর্ঘ ১ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে ছিলো বধ্যভূমি। এই বধ্যভূমিতে হাজার হাজার নারী-পুরুষকে পাকসেনা ও তাদের দোসররা নিয়ে হত্যা করতো। এই ছাত্রাবাস থেকে আধ মাইল দূরে পূর্বকোণে ১৯৭২ সালের ২৩শে এপ্রিল আবিষ্কৃত হয় একটি গণকবর। এ সময় এই এলাকাটিতে ইট কাটার কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু গণকবর আছে এই সংবাদে মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম এবং কন্ট্রাক্টর জেবর মিয়ার নেতৃত্বে সমাধি এলাকাটি খনন করা হয়। খননের ফলে বেরিয়ে আসে মাথার খুলি, নরকংকাল। এই কবর থেকেই ৫টি ঘড়ি, ৫টি কলম, দুটি টুপি, ১ ও ১০ টাকার নোট মিলিয়ে মোট ৩শ টাকা, একটি চাবির রিং, দুটি সাইকেলের চাবি, দুটি কানের দুল, ৩টি সিগারেট লাইটার, একটি মানিব্যাগ, একটি কাজলের টিউব, ওড়না, পাথর বসানো আংটি, চিরুনি, মহিলাদের কার্ডিগান, জুতা ইত্যাদি উদ্ধার করা হয়।
ছবি: পাকিস্তানী সৈন্যরা অকথ্য অত্যাচারের পর এখানে ১৭ জনকে বালির নিচে জীবন্ত কবর দেয়।
পার্শ্ববর্তী মোহনপুর গ্রামের জনগণ জানিয়েছিলেন- ৭১ এর ৫ ও ৬ই মে হানাদাররা ট্রাক ও জীপে করে এসব হতভাগ্য নারী-পুরুষকে এখানে নিয়ে এসে হত্যা করে। প্রতিদিনই অগণিত নারী-পুরুষকে হাত বাঁধা অবস্থায় জোহা হলের এই বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করা হত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিণ পাশে নরকংকাল ভর্তি বহু গর্তের সন্ধান পাওয়া গেছে। দৈনিক আজাদ প্রতিনিধি ও রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারী মোহাম্মদ আবু সাঈদের লাশও এখানকার একটি গর্ত থেকে উদ্ধার করা হয়। সাংবাদিক মোহাম্মদ আবু সাঈদসহসহ ২৮ জনকে পাকিস্থানি দালালরা ধরে নিয়ে যায়। সাঈদকে প্রথমে সার্কিট হাউসে এবং সেখান থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের বাড়িতে নিয়ে প্রায় এক সপ্তাহ আটক রাখা হয়। এসময় তার উপর অমানুষিক দৈহিক নির্যাতন চালানো হয়। এরপর ৫ই জুলাই অপর ১৫ জনের সঙ্গে সাঈদকেও জোহা হলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের সামনেই দিনাজপুরের জনৈক রেলওয়ে কর্মচারীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সাঈদসহ ১৫ জনের এই বন্দী দলটিকে বাধ্য করা হয় মৃতদেহটি রেলওয়ে স্টেশনের দিকে বয়ে নিয়ে যেতে। স্টেশনের পাশেই একটি বাবলা গাছে নিচে তাদের সামনেই গর্ত করা হল। সকলকে জোর করে গর্তের মধ্যে ফেলে দিয়ে বেয়োনেট দিয়ে খোঁচানো শুরু হলো এবং একই সাথে তাদের উপর মাটিচাপা দেয়া শুরু হয়। আর এভাবেই অর্ধমৃত মানুষ গুলোকে মাটিচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। কিন্তু না, সবাই মরেনি। এই গর্ত থেকে পিওন আবদুল কাদের এবং শ্যামপুরের রূপভান মিয়া পরস্পরের সাহায্যে এই মৃত্যুকুপ থেকে উঠে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো। স্বাধীণতার পর এরাই এই লোমহর্ষক করুণ কাহিনীর কথা জানিয়েছিলেন।
মলয় ভৌমিক লিখেছেন, ‘জোহা হল ক্যাম্পে ধরে এনে নির্যাতনের পর যাদের হত্যা করা হয় তাদের কোন রকমে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিলো হর্টিকালচারের উত্তরের বধ্যভূমিতে। এখানে মাটি খোঁড়ার পর উঠে আসে নাম না জানা প্রায় এক সহস্র শহীদের হাড়-কংকাল।’
[চলতে থাকবে.....]
এই পোস্টের ২য় পর্ব:
* মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১: রাজশাহীর বধ্যভূমি (২য় পর্ব), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পুরোটাই যেন বধ্যভূমি!
বি: দ্র: ০১: আলি আহসান মুজাহিদ ছিলো আল বদর বাহিনীর প্রেসিডেন্ট। রাজাকার বাহিনী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে, আর আল বদর বাহিনীর মূল কাজ ছিল সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক গণহত্যার মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে পাকিস্তান বিরোধী বুদ্ধজীবীদের হত্যা করাই ছিল এই বাহিনীর মূল লক্ষ্য।
বি: দ্র: ০২: আল-শামস পাকিস্তান সামরিক বাহিনী দ্বারা গঠিত আধা সামরিক মিলিশিয়া বাহিনী। এর সদস্য ছিল মূলত পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ (বর্তমান ইসলামী ছাত্র শিবির) এর সদস্যরা। মতিউর রহমান নিজামী ছিলো ততকালীন ছাত্র সংঘের প্রধান। আল-শামস মুক্তিবাহিনীর সাথে লড়াই করা এবং বুদ্ধিজীবিদের হত্যার কাজে নিয়োজিত ছিলো। তবে হত্যাকান্ডে পারদর্শীতা থাকলেও যুদ্ধ ক্ষেত্রে এরা বেশীর ভাগ সময়ই পালিয়ে যেত।
বিস্তারিত জানতে এখান থেকে ঘুরে আসতে পারেন:
* পাক বাহিনী, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর, আল শামস এর গঠন ও কার্যপদ্ধতি
আমার আগের পোস্ট গুলোতেও আমি বার বার যে কথাটি বলেছি, ৭২ হাজার পাকসেনার পক্ষে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালীর উপর মাত্র ৯ মাসে এত ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন, ধর্ষণ করা সম্ভব হতো না যদি এদেশীয় রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসরা তাদের সহায়তা না করতো। সুতরাং এদের কোন ভাবেই ক্ষমা করা যাবে না।
একাত্তর পরবর্তী সময়ে এরা ধর্মের লেবাস পরে আবার আসন গাড়ে। আর আমাদের তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলোর অকার্যকর ভূমিকার কারণে এরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় এমনকি মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলো! এর দায়ভার আওয়ামীলীগ-বিএনপি কেউই এড়াতে পারবে না। ক্ষমতার লোভে পড়ে দুই দলই কোন না কোন সময় এদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। আর এখন যখন এই রাজাকার-আলবদরদের বিচারের প্রক্রিয়া চলছে তখন একদল ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে আরেক দল এদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে! আর এদের সমর্থক কিছু তরুণ-যুবক ফেইসবুক-ব্লগে হুদাই আওয়ামীলিগ-বিএনপি কাদা ছোড়াছুড়ি করে মরছে! মাঝখান থেকে মিচকি মিচকি হাসছে সেই নরপশুরা! আমার বিশ্বাস ১৯৭১ সালে যত রাজাকার ছিলো এই ২০১৩ তে এসে তার সংখ্যা আরো বেড়ে গেছে!
আগে আমাদের বুঝতে হবে এটা আওয়ামীলিগ-বিএনপির লড়াই নয়। আপনারা যদি দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়তে একতাবদ্ধ না হতে পারেন তাহলে চুপচাপ বসে থাকেন। ব্লগে-ফেইসবুকে পোস্ট, স্ট্যাটাস, কমেন্ট আর কাদা ছোড়াছুড়ি করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন না। আমার আগের পোস্ট গুলোতে কমেন্ট করে প্রায় সবাই জানিয়েছেন যে তারা মুক্তিযুদ্ধের এই ইতিহাস গুলো জানেন না। কিন্তু আপনাদের মনে কি একবারো প্রশ্ন আসেনি কেন জানেন না? আওয়ামীলিগ-বিএনপি দুই দলই নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক হিসাবে দাবী করে! কিন্তু তাদের কথায় ও কাজে তার মিল খুজে পাওয়া দুষ্কর! এই দুই দলই দুই দুই বার ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু কেউ মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস তুলে ধরেনি। পারলে বিকৃত করেছে! মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়েও তারা রাজনীতি করতে ছাড়েনি! এভাবে চলতে থাকলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নামে যে জগা খিচুড়ী পাবে সেটা ভাবতেই অবাক লাগছে!
আমার পোস্টে অনেকে মন্তব্য করেছেন, ভাই এত বীভৎস ঘটনা পুরাটা পড়তে পারলাম না! কিন্তু একবারো কি ভেবে দেখেছেন, যে ঘটনার বর্ণনাই আপনারা পড়তে পারছেন না সে ঘটনার শিকার নারী-পুরুষরা কেমন করে সহ্য করেছিলো?
তাই সকলের উদ্দেশ্যে বলছি, আওয়ামীলিগ-বিএনপি পরে হবে। আগে দেশ বিরোধী রাজাকার, আলবদর, আলশামসের বর্তমান রূপ জামায়াত-শিবিরকে নির্মুল করতে আগে একতাবদ্ধ হন। আপনারা যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিই হন তাহলে আওয়ামী সাপোর্টাররা সরকারকে চাপ দিন ভন্ডামী ছেড়ে আরো কঠোর হতে, বিএনপি সাপোর্টাররা আপনাদের নেত্রীকে বলুন জামায়াতকে আঁচলের তলা থেকে বের করতে, তারপর আপনাদেরকে দেশ সেবার অনেক সুযোগ দেওয়া হবে। আর যদি না পারেন.....আল্লাহর দোহাই লাগে অফ যান! সাধারণ মানুষকে আর বিভ্রান্ত করবেন না!
[পোস্টের বিষয়বস্তুর বাইরে কেউ কোন মন্তব্য করবেন না। তর্কের খাতিরে, সম্পূর্ণ পোস্ট না পড়ে বা অহেতুক তেনা পেচানোর জন্য মন্তব্য করলে কঠোর ভাবে প্রতি উত্তর দেওয়া হবে। অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য মুছে ফেলতেও আপত্তি নাই]
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১:১৭