২০০৪ সালের শুরুর দিকে এই ঢাকা শহরে স্থায়ী ভাবে বসবাসের জন্য চলে আসি। থাকতাম এলাকার বড় ভাইদের সাথে ৬৮/ডি, গ্রীণরোডে। এত বড় শহরের বাসিন্দা হতে পেরে যারপরনাই আনন্দিত ছিলাম। একলা বের হয়ে পড়তাম রাজধানীর এ মাথা থেকে ও মাথা! ভর দুপুর কি সন্ধ্যা রাত যখন তখন বন্ধু-বান্ধব, ভাই-বিরাদারদের সাথে চলতো বিভিন্ন জায়গায় আড্ডা! একদিন খাড়া দুপুরে সাব্বির ভাইয়ের সাথে গেলাম ধানমণ্ডি লেকে। খুব নাকি বিখ্যাত জায়গা! ঘণ্টাখানেক লেকে ঘোরাঘুরি করে ময়লা পানি আর এখানে সেখানে কপোত-কপোতীর প্রেমলীলা ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলাম না! হতাশ নয়নে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেয়ে গেলো। সাব্বির ভাইকে ডেকে বললাম,
- ভাই, পিপাসা লেগেছে। ঠাণ্ডা কিছু খাই চলেন।
- ঠিক আছে, চলো তাহলে লাচ্চি খাই!
আমি পড়ে গেলাম মহা টেনশনে! এই গরমের মধ্যে লাচ্চি সেমাই খাওয়ার কি দরকার! কোক-পেপসি খেলেই হয়! না হলে মিনিমাম ঠাণ্ডা পানি! শহরে নতুন এসেছি বলে কি আমাকে মদন পেয়ে গেলো! মনে একগাদা কনফিউশন নিয়ে রওনা হলাম সাব্বির ভাইয়ের পিছু পিছু! একটা ফাস্টফুডে বসে ভাই দুই খান লাচ্চি অর্ডার দিয়ে বসলো। এবার অপেক্ষার পালা লাচ্চির জন্য। ৬-৭ মিনিট পর দেখি এক পিচ্চি দুইটা গ্লাস টেবিলের উপর এনে রাখলো, গ্লাসের মধ্যে আবার স্ট্র দেওয়া! আমি তো অবাক! সাথে কিছুটা বিরক্তও! লাচ্চি সেমাই কেউ গ্লাসে করে খায়! তাও আবার স্ট্র দিয়ে! আজিব শহররে বাবা, খাওয়া-দাওয়ার কি উদ্ভট নিয়ম! কিভাবে কি করবো মাথায় ঢুকছে না! সাব্বির ভাইকে দেখলাম স্ট্রতে মুখ লাগিয়ে চোঁ চোঁ করে খানিকটা লাচ্চি খেয়ে নিলো! আমিও আর দেরি না করে নাক মুখ কুঁচকে দিলাম লম্বা একটা টান! চোঁ চোঁ চোঁ চোঁ!
ওমা! এতো দেখি দৈ এর মতো! কোথায় লাচ্চি কোথায় সেমাই! সেমাইয়ের নাম-গন্ধও নাই এর ভেতরে! তবে খেতে কিন্তু মন্দ না! বাকি লাচ্চিটুকু আনন্দের সহিত খেয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
এক শুক্রবারে ঘুম থেকে উঠেই মনে সাধ জাগলো চিড়িয়াখানা দেখতে যাবো। সঙ্গী হিসাবে কাউকে যেতে রাজী করাতে পারলাম না। শেষে তহুর ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম কিভাবে যাবো,
- ভাই, চিড়িয়াখানা যাওয়ার জন্য কোন বাসে উঠবো?
- সোজা ফার্মগেট যেয়ে চিড়িয়াখানা-২ লেখা বাসে উঠে যাবা। বাস শেষে যেখানে যেয়ে থামবে সেটাই চিড়িয়াখানা।
- ঠিক আছে, এটা কোন ব্যাপারই না
ফার্মগেটে যেয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম বাসের জন্য। অবশেষে একটা বাস আসলো, কিন্তু সেরকম ভীড়! যতগুলো মানুষ নামলো উঠলো যেন তার দ্বিগুন! আমিও ঠেলাঠেলি করে ঢুকে পড়লাম মাঝামাঝি! একটা সময় কন্ডাক্টর মামা এসে ভাড়া চাইলো,
- মামা কৈ যাইবেন?
[আমি তুমুল ভাবের সাথে উত্তর দিলাম]
- চিড়িয়াখানা, ভাড়া কত?
- মামা এই বাস তো চিড়িয়াখানা যাবে না!
- চিড়িয়াখানা যাবে না মানে? এটা চিড়িয়াখানা-২ না?
- হ্যাঁ, এটা চিড়িয়াখানা-২। কিন্তু এটাতো যাবে বাবুবাজার!
- বাবুবাজার মানে? ফাইজলামী নাকি! চিড়িয়াখানার বাস চিড়িয়াখানা না যেয়ে বাবুবাজার যাবে কেন?
তুমুল ঝাড়ি খেয়ে কন্ডাক্টর মামা মুখ কাঁচুমাচু করে বললো,
- মামা, আপনি উল্টাদিকের বাসে উঠে গেছেন। এই বাস বাবুবাজার দিয়ে ঘুরে তারপর চিড়িয়াখানা যাবে। আপনি এখানেই নেমে যান, এটা শাহবাগ। রাস্তা পার হয়ে ঐদিক থেকে আসা চিড়িয়াখানা-২ এ উঠেন, তাইলে চিড়িয়াখানা যাইতে পারবেন!
ঘটনা উপলব্ধি করতে পেরে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে সুড় সুড় করে যেয়ে হাজির হলাম রাস্তাম ওপাশে।
সামনে ২০১৪ সাল, আর কয়েকটা দিন পার হলেই ঢাকা শহরে আমার ১০ বছর পূর্তি হয়ে যাবে। ভাবতে খুব অবাক লাগে! এই তো কদিন আগে ঢাউস একখান ব্যাগ নিয়ে কাক ডাকা ভোরে কল্যাণপুরে বাস থেকে নেমেছিলাম। তখন শহরটা ছিলো আমার কাছে আনকোরা মোড়কে মোড়া এক বিশাল সারপ্রাইজ! যা দেখতাম সেটাতেই অবাক হতাম! সংসদ ভবন, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, এয়ারপোর্ট, সোনারগাঁ হোটেল, শেরাটন হোটেল, জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক, নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, বঙ্গবাজার, রাইফেলস স্কয়ার এমনকি নির্মাণাধীন বসুন্ধরা সিটি যা দেখতাম মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। জ্যামে বসে আশেপাশের বাস, রিকশা আর প্রাইভেট কারে বসা মানুষগুলার কান্ডকীর্তি দেখে মজা পেতাম। বাসায় লোডশেডিং এর কারণে খুব গরম লাগলে ফার্মগেট থেকে ৬ টাকা দিয়ে সেঞ্চুরী এসি সার্ভিসের টিকিট কেটে এক ঘুমে চলে যেতাম আব্দুল্লাহপুর! তারপর আবার ৬ টাকার টিকিট কেটে ফার্মগেট হয়ে গ্রীণরোড ব্যাক! মোড়ের দোকানে একটাকার পুরি, আলুর চপ খাওয়া থেকে শুরু করে ক্যাফে রাজ এ সকাল বেলা চিকেন স্যুপ আর নান খাওয়া সবই ছিলো আনন্দে ভরপুর! আমার ঢাকা, আমার অন্যতম প্রিয় শহর, আমাদের রাজধানী!
হাজারো সীমাবদ্ধতা এবং সমস্যা থাকা শর্তেও ঢাকাকে আমি ভালোবাসি সেই আগের মতো করেই। সমস্যা থাকবেই, তাই বলে থেমে থাকলে চলবে না। সকলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা একত্রিক করে আমরা একদিন এগিয়ে যাবো বহুদুর! সবাইকে নতুন বছরের অগ্রীম শুভেচ্ছা, Happy New Year
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:০৬