ছবি: ইন্সটা থেকে সংগৃহিত
তো একদিন কিউ কে হলে ইলিশ মাছ রাঁধা হলো। এমন না যে ইলিশ মাছ রাঁধা হয় না। সপ্তাহ ঘুরিয়ে গরু, ফর্মের মুরগীর সাথে মাছ হিসেবে কার্প আবার মাসে এক কি দু বার ইলিশের পিছ পাওয়া যায় তবে স্বাদ একটু অন্যরকম থাকতো, এই যা। স্বাদ যাই থাকুক আমাদের তখন এমন অবস্থা ছিলো সামনে খালি ঘি এর বোতল রেখে দিলে সেই গন্ধ শুকেই পুরো দু প্লেট ভাত শেষ করে দিতাম। তো তখন পিএল চলছিলো। যারা পাবলিক ইউনির এই সিস্টেমটা জানেন না যে তাদেরকে বলা পিএল হলো সেমিস্টার ফাইনাল শুরু হবার পুর্বের ১৭ দিন। তখন ক্লাশ সাসপেন্ডেড থাকে। এই ১৭ দিন ছেলে পেলে খেয়ে না খেয়ে, ঘুমিয়ে জেগে চোখ নাক বন্ধ করে পুরো সেমিস্টারের পড়া পড়ে। এর পর তিন দিনের ডিএল। এই তিনদিন শুধু নির্দিস্ট বিষয়ের রিভিশন। প্রত্যেক পরীক্ষার আগে তিনদিনের ডিএল।
সেবার হলো কি ডাইনিং এ খেতে গিয়ে শুনি ইলিশ মাছ। তার ওপর আবার পুই শাক। পুই শাক দু টাকা, ইলিশ মাছ ৯ টাকা। ভাত ডাল সবসময়ই ফ্রী থাকতেো আমাদের হলে। কোনো কথা নেই, এক বাটি পুই শাক আর দুটো ইলিশের বাটি কিনে ডাইনিং এ অপেক্ষায় ছিলাম কখন সীট খালি হবে। পুরো ডাইনিং রুম ছিলো রমরমা। কিছুক্ষন পরেই অবশ্য একটা সীট খালি হয়ে গেলো। এদিকে ইলিশ মাছের তরকারীর ধোয়া ততক্ষনে মিইয়ে আসছিলো, আর ঘ্রানে পেটের মধ্যে সকল ইদূর গুলো পুরো ডাম্বেল মেরে ছারখার করে দিচ্ছিলো। সীট খালি পেতেই টপ করে বসে প্লেটে ভাত ডাল শাক তরকারী এক যোগে ঢাললাম। যদিও চাটগাইয়া খাবার স্টাইল হলো আগে ডাল দিয়ে খাবে তারা তারপর বাকি সব। আমি সেটাকে আপগ্রেড করে সব এক সাথে প্লেটে নাও, তারপর কব্জী ডুবিয়ে খাও। খাওয়া শুরু করার কিছুক্ষন পর দেখি পাশের সীটে ম্যাকানিকালের গাঞ্জা জাহিদ আসলো। চেহারা চিকন চাকন, চেইন স্মোকার, কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্সের বস: দেখলেই মিস নেই,"কিরে গান্জা, মান্জা মাইরা কই যাস?" এমন সময় চোখ লাল করে টক টক করে তাকিয়ে থাকতো আর আমি পেট দুম করে হাসতাম। যদিও ছেলেটা চুয়েট ছাত্রসংসদের একজন নেতা টাইপের ছিলো, কিন্তু আমার র্যাগিং থেকে কারো মুক্তি ছিলো না। ব্যাচমেটদের র্যাগিং করা আমার দৈনিককার কাজ ছিলো।
যাই হোউক, জাহিদ প্লেটে ভাত নিয়ে তরকারীর বাটিটা প্লেটে ঢালতেই দেখি একটা ইদুরের বাচ্চা কিউট হয়ে শুয়ে আছে মৃত। আমি কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলাম,"এইডা কি ইন্দুর না চামচিকা?" জাহিদ বিড়বিড় করে গালি দিয়ে প্লেটের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। এমনেই পিএল চলে, এসময় পোলাপানের মাথা আর মেজাজ কই কোথায় থাকে তার নাই ঠিক। আমি ভাতের লোকমা মুখে দিতে দিতে অপেক্ষা করছিলাম কখন রড হাতে নিয়ে পিডাপিডি শুরু হয়। দেখলাম জাহিদ খাবারের কাউন্টারে গিয়ে প্লেট রাখলো। ওরা দেখলো। তারপর আরেক বাটি ইলিশের বাটি দিলো। সে ওটা নিয়েই চলে আসলো। পাশে বসতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম,"দুস্ত গ্যান্জাম করলি না? আমি তোর সাথে ছিলাম!" কিছুক্ষন আমার দিকে তাকালো, ভাবলো নিজে তো কুন্দাই কুন্দাই গিলতেছি আবার গ্যাঞ্জাম করার জন্য আরেকজনকে উপদেশ দিতেছি,"এখনো হিটের (থার্মোডিনামিক্স) পুরা সিলেবাস বাকি। পরীক্ষা শেষ হোউক, তারপর ওরে গেটে নিয়া সাইজ করুম নে।" গাঞ্জা জাহিদের সেই পরীক্ষা আর শেষ হয়নি, সাইজও করা হয়নি। এভাবেই আমরা ৪ বছরের কোর্স দু বছরের সেশন জট সহকারে সর্বোমোট ৬ বছরে শেষ করি হেসে খেলে।
অনেকেই বলেন যে তাদের সুইসাইডাল ট্যান্ডেন্সী আছে, তারা জীবন নিয়ে হতাশ। এত সংগ্রামের পরও কোনো আশার আলো নেই, অথবা প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে লাইফটা কেমন যেনো তেচপাতার জীবন হয়ে গেলো তখন মনে হয় ৬ বছর ইন্দুর মরা তরকারী আর রাইতের বেলা লোহার খাটে শুইয়া পিঠ ব্যাথা নিয়ে কেউ যদি বুঝতো হতাশা কাকে বলে। পাশ করার পর যে আসল স্ট্রাগল শুরু হতো সেটা তো বাদই দিলাম।
ছেলেদের মধ্যে একটা ট্যান্ডেন্সী থাকে একটু বয়স্ক মহিলার প্রেমে পড়া, তার ওপর বাঙ্গালী ছেলেদের তো কার্ভি বয়স্ক মহিলার শাড়ীর আচলের ফাঁকে ফাঁকে প্রেম উছলে পড়ে। এখন আবহাওয়া জনিত কারনেই বা অন্য কোনো কারনে (অন্য কোনো কারন বলতে গবেষনায় দেখা গেছে মেয়েরা খোলামেলা পোশাক পছন্দ করে কারন তাদের প্রজনন করার ক্ষমতা একটা নির্দিস্ট সময় পরে আর থাকবে না। তাই সময় মতো যদি একজন যোগ্য সঙ্গি না পাওয়া যায় তার সেই প্রাকৃতিক কাজটি অপূর্ন থেকে যাবে। এটা একটা বিবর্তনবাদীয় মনস্তত্ব।সেক্ষেত্রে একজন পুরুষের প্রজনন করার সক্ষমতা দীর্ঘতর এবং তাদের টার্ন অন খুব দ্রূত ও ঘন। তাই তারা ধীরে সুস্থে স্যাটেল হতে চায় এবং তারা পোশাকের ব্যাপারে একটু শালীন থাকতে চায়।) সব জায়গার মেয়েরাই একটু খোলামেলা আবেদনময়ী থাকতে পছন্দ করে। যদিও সামাজিক বিধিনিষেধ পুরুষতান্ত্রিক হবার কারনেই সেটাতে বাধা প্রদান করা হয় এবং অনেকসময় কঠোরতার কারনে সেই সোশাল স্টিগমা একটা হতাশার সৃষ্টি করে।
তবে কলকাতার শিক্ষিত সমাজ সেই স্টিগমাকে অনেকটা অপাংক্তেয় করে নতুন নতুন ট্রেন্ড চালু করেছে যার ফলে পশ্চিমার মিশেলে প্রাচ্যের রক্ষনশীলতা ও লাজুক সংস্কৃতির একটা অনন্য ধারা তৈরী করেছে যার সেই আধুনিক সংস্করন বং ক্রাশ।
কোনো একবার শুনেছিলাম আমার এক স্কুল মেট, কোলকাতায় অনেক দিন ধরে স্যাটেল, তো বিশেষ কারনে বিয়ে নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। এমন না যে পাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। ভালো চাকুরে, দামী গাড়ী হাকাচ্ছে, এহেন পাত্রের পাত্রীর অভাব থাকার কথা না। সমস্যাটা তার অন্য জায়গায়। শেষবার যখন মেয়ে দেখতেে গেলো, তখন বেশ আতিথেয়তার সম্মুখীন হতে হলো তাদের। হুলস্থুল খাওয়া দাওয়া। বরপক্ষের সবার আক্কেলগুড়ুম এই ভেবে যে মেয়ে দেখানোতেই যে আপ্যায়ন বিয়ে আর তার পরে কি যে কি হবে। সবার ৫ আঙ্গুল যখন প্লেটে সুস্বাদু লুচি আর চচ্চড়ি ও মিস্টান্নে ডুবে ছিলো তখন বন্ধুটি খাওয়া শেষ করে কনে ভেবে বারান্দায় বলেই বসলো এক রূপসীকে,"আপনাকে দারুন লাগছে। শাড়িতে কাউকে এমন সুন্দর লাগতে পারে কখনো বুঝিনি!"
মেয়েটি মিটিমিটি হাসছিলো। সে শুরু করে দিলো আবৃত্তীর ছলে,"চুল তার কবেকার..... আসলে শাড়ি ছাড়া কোনো বাঙ্গালী নারী পূর্নতা পায় না। বিয়ের পর কিন্তু শাড়িই পরতে হবে। আপনার কি অন্য কিছু পছন্দ ঐ বিশেষ সময়ে?"
খাওয়া দাওয়া শেষ হবার পর শুরু হলো মেয়ে দেখার পালা। কিন্তু মেয়ে আর ঘরে ঢুকছে না। কনেপক্ষের মুখ বেজার। কিছুক্ষন পর বন্ধুটির বাবা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলো। এদিকে বন্ধুটির মাথা নস্ট। কোথায় কনে দেখে বিয়ের কথা পাকা করবে, অথচ তার নিজের বাবা খাওয়া খেয়ে এখন ফুটার প্লান করছে। মেয়েদের বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে বাবাকে চেপে ধরতেই বাবার খিস্তি,"কি একটা মিনসে পয়দা হয়েছে, এই বয়সে মেয়ে দেখলেই মাথা বিগড়ে যায়। বলি মেয়ের মাকে কেন শাড়ীর গুন নিয়ে এত কথা বললি? বিয়েটা হলে তোর হতো শ্বাশুড়ি! চেহারা দেখেও কি বুঝিসনি সে কোনো বয়সী....ছিঃ ছিঃ ছিঃ লজ্জার বলিহরি! ছেঃ..."
যদিও বন্ধুটির বিয়ে হয়েছিলো তবে সে বিয়েটা সে একাই করেছিলো এবং যাকে করেছিলো সেও একবারের ডিভোর্সি, বয়সে বড়, শুনেছি আগের ঘরে একটা সন্তানও আছে।
ডিভোর্সি মেয়ে বিয়ে করাটা আমাদের সমাজে এখনো কেউ সোজা চোখে দেখে না, তবে পরিবর্তন হচ্ছে। হয়তো এর পেছনেও সেই বিবর্তনবাদী চিন্তাধারা মানুষের মনে কাজ করে। একটা ব্যাপার আমাকে অবাক করে, যে ধর্মে নবী মোহাম্মদ তার বয়সের ১৫ বছরের বড় একজনকে বিয়ে করার উদাহরন রেখে গেছে সেকানে বিয়ের ব্যাপারে বিবর্তনবাদী হয়ে যাওয়া ....বলতেই হয় জাতে মাতাল তালে ঠিক। এবং সে হুজুগের বিপরীতে শহুরে হোক বা গ্রামে তার সাথে যুক্ত হয়েছে বং ক্রাশ। আন্তঃধর্ম বিয়েটাও যে হচ্ছে না সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই কিন্তু একটু চুপে চাপে।
শেষ করি স্কুলে জীবনের আরেকটি গল্প দিয়ে। ক্লাশ সেভেনে উঠে অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করলাম আমাদের বয়েস স্কুলে হঠাৎ করে ম্যাডামরা ক্লাশ নেয়া শুরু করলো এবং আশ্চর্য্যের ব্যাপার হলো সেসব ম্যাডামরা ছিলো সেরকম রূপবতী। কেউ কেউ ঢাকা থেকে বনেদী ঘরের মেয়ে, কেউ কেউ ম্যারীড। কিন্তু যখন তারা ক্লাশে ঢুকতো তখন সবাই হা করে তাকিয়ে থাকতো। তো ক্লাশে তখন দু ধরনের পোলাপান পাওয়া গেলো, এক ধরনের পোলাপান যারা ইংলিশ বাংলা বিজ্ঞান অংক পড়ুক না পড়ুক সমাজ, ভুগোলে পুরা আপ টু ডেট কারন এসব ক্লাশ ম্যাডামরা নিতো। প্রতিটা পড়া হোম ওয়ার্ক মুখস্থ। আরেকদল হলো সব বিষয়ে টিপটপ কিন্তু ম্যাডামের পড়া সে কিছুতেই করবে না কারন ক্লাশে ম্যাডাম পড়া ধরলে সে পারবে না। না পারলে কাছে আসবে, বেতের বাড়ি অথবা গালের মধ্যে বন চটকানা। যেই ছেলেটা জীবনে মাইর খায় নাই, সে ম্যাডামের হাতে এক গালে বন চটকানা খেয়ে আরেক গাল পেতে দেয়।
একদিন ক্লাশ মেট রাসেলকে জিজ্ঞেস করলাম,"কিরে, কি সেন্ট মরছোস? ডেন্জারাস কড়া সেন্ট আসতেছে।" রাসেল একটু অবাক হইয়া জিজ্ঞেস করলো,"কস কি? আজকা সেন্ট মারতে ভুইলা গেছিলাম।" আমি একটু কাছে গিয়া গন্ধ শুকলাম,"দোস্ত, ভুল হইছে। এইটা সেন্ট না, অন্যরকম গন্ধ!" রাসেল একটা হাসি দিলো," সেরকমই হওনের কথা। গত সপ্তাহে ম্যাডাম এই গালে ছুইছিলো (থাপ্পড় মারছিলো ক্লাশে কথা বলার জন্য), তারপর থিকা আর গোসল করি না। ম্যাডামের হাতের স্পর্শ মুছে যাবে তাই!" উল্লেখ্য ম্যাডামটা ছিলো হিন্দু, মাঝ সিথিতে লম্বা সিদূর।
আমি তখন বুঝতাম না কাহিনীটা কি! তবে ম্যাডামকা দেখলে আমারো যে ক্লাশে কিছু হতো সেইটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আমার চে পোলাপান আরো বেশী ক্রেজী এই বং ক্রাশ নিয়া সেটা তখনই বুঝেছিলাম।
সবচে বড় কথা, লাইফ ইজ কুল!