প্রিয় রুবাইয়াত হোসেন,
যদিও সম্বোধনে ‘প্রিয়’ শব্দটা ব্যবহার করেছি চিঠির ‘চিঠিত্ব’ বজায় রাখতে; কিন্তু সত্যিকার অর্থে আপনাকে প্রিয় ব’লে ভাবতে আর মনে সায় দিচ্ছেনা!
বেশ কয়েকমাস আগে, যখন জানতে পারলাম নতুন একজন তরুণ চিত্রপরিচালক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি বানাতে যাচ্ছে তখন মনটা আনন্দে ভ’রে গিয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, যেকোন সৃষ্টিশীল মননশীল বাংলাদেশির উচিত তার প্রথম সৃষ্টিটা মুক্তিযুদ্ধ’র প্রতি উৎসর্গ করা। যাইহোক, দিনে দিনে জানতে পারলাম ঐ ছবিতে জয়া বচ্চন, ভিক্টর ব্যানার্জী’র মত শক্তিমান অভিনয়শিল্পী যুক্ত হচ্ছেন- তখন মনের ভেতরের আশা বেশ খানিকটা পোক্ত হয়েছিল যে, আমাদের প্রজন্মের কারুর চোখে মুক্তিযুদ্ধের চিত্রায়ণ দেখব। কিন্তু, হায়-এ কী করলেন আপনি! মুক্তিযুদ্ধের সময়কে সিনেমার ফ্রেমে ধরতে গিয়ে আপনি পাকিস্তানী চরিত্রকে নায়ক বানিয়ে বসলেন! আরো অবাক হ’য়ে লক্ষ্য করলাম, আপনি মন্দ মানুষ বানালেন মুক্তিযোদ্ধাদের! সত্যিই আপনার সাহসের তারিফ করতে হয়!
আপনার কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন আছে-
১. আপনার সিনেমার প্রতি মুহূর্তে একটা চেষ্টা লক্ষ্যণীয়-‘মুক্তিযুদ্ধ’ কে স্রেফ ‘যুদ্ধ’ ব’লে চালিয়ে নেয়া। ‘খারাপ মুক্তিযোদ্ধা’ বনাম ‘ভালো পাকিস্তানী/ বাংলাদেশবিরোধী’ –এই টানাপোড়েন ছাড়া অন্য কোন ভাবে কি প্রেমকে প্রকাশ করা যেত না?
২. ‘যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হ’য়ে ফিরে আসা’, ‘বিয়েপাগল’ কিংবা ‘অ্যাকশনে যাওয়ার জন্য ‘শান্তিপ্রিয়’ মুসলিম লীগার খাজাসাহেবের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা-ভীতু’ ছাড়া অন্য কোন ধরনের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ব’লে আপনার সিনেমা দেখে মনে হয়না। কেন?
৩. পাকিস্তানী সেনারা ভালো মানুষ ছিল, নারীর সম্ভ্রমের মূল্য তারাই সবচেয়ে ভাল বুঝত; আর মুক্তিযোদ্ধারা শুধুমাত্র প্রেমকে জোর ক’রে হাসিল করার জন্য তাদের মারতে চাইত-এসব মেসেজ নতুন প্রজন্মের কাছে পৌছানোর মত জঘন্য কাজ করার অনুপ্রেরণা, সাহস আপনি কোথায় পেলেন?
...এভাবে এগোতে থাকলে বেশ কতকগুলো প্রশ্ন আসবে; তা আর না বাড়িয়ে একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে-এই প্রজন্মের একজন আধুনিক ‘উচ্চ শিক্ষিত’ মানুষ হয়ে আপনি কোন্ বোধ থেকে এমন ছবি বানালেন যা আমাদের কচি প্রজন্মের মনের ভেতর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে বিরূপ আর পাকিস্তানীদের প্রতি অযাচিত মায়া সৃষ্টি করতে পারে? আপনার কি একটুও খারাপ লাগলো না ‘বীরাঙ্গনাদের প্রতি শ্রদ্ধা’, ‘যুদ্ধ ও প্রেমের ছবি’, ‘উপমহাদেশের ছবি’ এসবের আড়ালে পাকিস্তানপন্থী একটা ভ্রষ্ট সিনেমা বানাতে? সম্ভ্রমহারা নারী আর মুক্তিসেনাদের ছোট করার স্পর্ধা আপনি কোথায় পেলেন?
ধরে নেন, আপনার এই ছবিটা অস্কারে গেল; তখন সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আমাদের মুক্তিসেনাদের সম্পর্কে কী ধারণা হবে ? বীরাঙ্গনাদেরকে শুধুমাত্র যৌনময়ী হিসেবে দেখানোর প্রয়াস থেকে বিশ্ববাসী কী বুঝে নেবে? নাকি এসবে আপনার কিছু যায় আসেনা!
জানি, আপনি খুব প্রভাবশালী ব্যক্তির সন্তান; আপনার নিজেরও পড়াশোনা ঢের! তবু আমার মনে হচ্ছে আপনার সবকিছু ব্যর্থ হয়ে গেছে ভণ্ডামি আর কপটতার আড়ালে! খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে আপনাদের এই নষ্টচক্রের বিষবৃক্ষ কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত!
আপনি নিশ্চয়ই সামনে আরো ছবি বানাবেন। পরবর্তী ছবি বানানোর আগে আপনার মনোজগতে শুভবুদ্ধির উদয় হোক, এই কামনা করি।
ইতি-
মুক্তিযুদ্ধকে স্রেফ যুদ্ধ বা গণ্ডগোল না ভাবা আপনারই প্রজন্মের কেউ।