somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি ময়ূরাক্ষী, একজন হিমু! (দ্বিতীয় পর্ব)

০১ লা জুলাই, ২০১৫ সকাল ১০:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি মিসেস নাহারের চেম্বার থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে আসলাম। বেলা ১২ টার মতো বেজে গেছে মনে হয়। ভদ্রমহিলা এত সহজে আমাকে ছেড়ে দেবেন এটা ভাবিনি। এত বড় একজন সাইকাইট্রিস্ট তার সাথে আবার বড় খালার বান্ধবী, তিনি আমাকে নিয়ে এত তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দেবেন! নাহ! মহিলার সাথে আরেকদিন দেখা করতে হবে। তাছাড়াও চা খাওয়াটা পাওনা আছে। আমার মনে হয় উনি সহজে আমকে ভুলবেন না। এখন মনে হচ্ছে বেচারীকে হঠাৎ ভড়কে দেয়া ঠিক হয়নি। হুমায়ুন আহমেদের মুলি বাঁশের দাবড়ানি আর বিকট স্বরের খাইয়াল্বাম বাদে ময়ূরাক্ষীর কথা কিন্তু সম্পূর্ণ সত্য ছিল।
আপনারা হয়তো এখনো আমার সব কথা বুঝতে পারছেন না। না বোঝাটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে যারা বই পড়ে, তারা যেমন সব্বাই হুমায়ুন আহমেদকে চেনে, ঠিক তেমনি যারা হুমায়ুন আহমেদকে চেনে তারা হিমুকে না চিনে থাকতে পারে না। আমিও অনেকটা সেরকম লেভেলেরই পাঠক ছিলাম।
হুমায়ূন স্যার যেদিন মারা গেলেন ঠিক সেদিন রাতেই ঘুমের মাঝে আমি স্যারকে দেখি। আমি দেখলাম অনেক সুন্দর একটা নদী। কাঁচের মতো স্বচ্ছ পানি। নদীর দুই পাড়ে যতদূর চোখ যায় শুধু মাঝারী ঘাসের বিছানা। আর আমি যে পাড়ে দাঁড়িয়ে সেইখানে একটা পাকুড় গাছ। পাকুড় গাছটার নিচে কে যেন বসা, আমাকে দূর থেকে ইশারায় কাছে ডাকছে। আমি ধীরে ধীরে কাছে গেলাম। কাছে যাবার পর দেখি হুমায়ূন স্যার। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন। আমি হাসির কারণ বুঝতে পারলাম না। আমাকে কাছে নিয়ে আদর করে বসালেন। এরপর নদী থেকে একমুঠো পানি নিয়ে আমার হাতে গুঁজে দিলেন। বললেন, বুঝলে হিমু আজ থেকে আমার এই নদীটা তোমার। আমার নাম হিমু না, তারপরও আমি সুবোধ বালকের মতো করে মাথা নাড়লাম। আমি হাতের মুঠোয় দেখলাম ময়ূরাক্ষীর পানি টলটল করছে কিন্তু এক ফোঁটাও পড়ে যাচ্ছে না। স্বপ্নের মাঝেই আমি হাতের মুঠোয় প্রচণ্ড শীতলতা অনুভব করলাম। এরপর ঘুম ভাঙার আগ পর্যন্ত আমি স্যারের সাথে নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে বসে ছিলাম। কিন্তু এ সময়টুকুতে আমাদের আর কোন কথা হয়েছে বলে মনে পড়ে না।
সমস্যাটা এইখানে নয়, সমস্যাটা হয় তখন যখন আমি সেইদিন দুপুরে বেলা ভার্সিটিতে ক্লাসে বসে ছিলাম। দিন সাতেক আগের ঘটনা। আমি মাস্টার্স করছিলাম। করছিলাম বলতে এখন আর করছি না। সব বন্ধ। এখন আমি একজন পেশাদার হন্টক। কাগজে কলমে এই পেশায় আমার সাত দিনের বাস্তব অভিজ্ঞতা। ক্লাসেই বসে ছিলাম। গরমের দিন। পাঁচ মিনিট আগে ল্যাব ইন্সট্রাকটর এসে বলে গেছে স্যারের একটা কনফারেন্স আছে তাই আসতে পারবেন না। বাইরেও যেতে ইচ্ছে করছিল না। হঠাৎ মনে পড়ে গেল রাতের স্বপ্নের কথা। ভাবলাম, দেখি নদীটাকে আনা যায় কিনা। চোখ বন্ধ করার তিন মিনিটের মাঝেই আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম সেই ময়ূরাক্ষী। সেই কাঁচের মতো ঝকঝকে স্বচ্ছ পানি। পানি বয়ে চলার শব্দ আমি শুনছিলাম। কোন ভুল ছিলনা তাতে। এই নদীটা এসেছে সন্ধ্যা বেলায়। হিমুর কাছেও একই নদী আসতো, শুধু থাকতো সময়ের ভিন্নতা। আজকের ময়ূরাক্ষীর পানিতে সূর্য ডোবার রঙ মিশে গেছে। আমি অবাক হয়ে দেখছি। হঠাৎ চোখ পড়ে গেল আমার গায়ের জামার উপর। আমি দেখলাম আমার পরনে একটা হলুদ পাঞ্জাবী। আমি হিমু ভক্ত হলেও কোনদিন হলুদ পাঞ্জাবী গায়ে দেই নাই। আমি নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে বসে পড়লাম। মৃদু একটা বাতাস আমি পুরো শরীর দিয়ে অনুভব করছিলাম। স্পষ্ট শুনছিলাম ময়ূরাক্ষী পাড়ের পাকুড় গাছ থেকে একটা ঘুঘুর বিষণ্ণ ডাক। যখন চোখ খুললাম তখন দেখি ক্লাসে কেউ নেই। হাতঘড়িতে দেখলাম আমি মোটামুটি ৫০ মিনিট পার করে ফেলেছি ময়ূরাক্ষীর তীরে। ময়ূরাক্ষীর একটা জিনিস আমি এই প্রথম জানলাম যেটা হিমু কখনও বলেনি। এই নদীতে সময় স্থির থাকে। যখন যে অবস্থায় আসে সে সময়টা কখনও বদলায় না। আজ এই ৫০ মিনিটের মতো সময়ে সূর্যটা ঠিক একইভাবে ছিল। ময়ূরাক্ষীর তীরে আজ নেমেছিল স্থির এক সন্ধ্যা।
সেদিন থেকেই ক্লাস পরীক্ষা সব বাদ দিয়ে দিলাম। আমার কি হয়েছিল কিছুই জানিনা। আমি থাকতাম বড় খালার বাসায়। ওইখান থেকেই বিএসসি করেছি। বাবা মা দুজনের কেউ নেই। মারা গেছেন খুব ছোটতেই। এরপর বড় হয়েছি ফুপুদের কাছে। ঢাকা চলে আসার পর থেকে থাকি বড় খালার বাসায়। সেদিন ক্লাস থেকে বের হয়েই আমি হলুদ পাঞ্জাবী বানাতে চলে গেলাম। গুলিস্তান থেকে সস্তা দামের একটা কাপড় কিনে চলে গেলাম দর্জির দোকানে। পরিচিত একজন দর্জি ছিল। নাম মনসুর। বাড়ি ময়মনসিংহ। আমার ধারণা কাপড় সেলাইয়ে নোবেল প্রাইজ থাকলে এই লোকটাকে দিয়ে দেয়া যেত। আমি অনেকদিন বসে থেকে এক মনে তার কাপড় সেলাই করা দেখেছি। এই কাজটাকে সে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
মনসুর ভাই, একটা পাঞ্জাবী বানাতে হবে। কালকে ডেলিভারি দিতে হবে। আর্জেন্ট!
এইডা কি কালার কিনচুইন! কুনু প্রগাম আচে নি।
নাহ। এমনি, শখ হয়েছে। আপনি যে করেই হোক এইটা কালকে দেবেন। আর শোনেন, পাঞ্জাবীর কিন্তু কোন পকেট থাকবে না।
ভাই সত্যি কইরা কইন চে, আপনে এইডা দিয়া কি করবাইন। এই কালার তো আপনের গায়ের রঙয়ের সাথেও যায় না।
আমি মুচকি হাসি দিয়ে চলে আসলাম।
পরদিন বিকেল বেলা মনসুরের দোকানে গিয়ে পাঞ্জাবীটা নিয়ে সাথে সাথে গায়ে দিয়ে ফেললাম। আমার পরনের টি শার্টটা খুলে মনসুরকে দিয়ে বললাম, ‘কাউকে দিয়ে দিয়েন’ এরপর পায়ের স্যান্ডেলজোড়া খুলে একইভাবে দিয়ে বললাম, ‘এইটাও দিয়ে দিয়েন’ মনসুর হা করে তাকিয়ে আমার কর্মকাণ্ড দেখছিল। সবশেষে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে মনসুরের হাতে দিয়ে বললাম, ‘আপনার মজুরি রেখে বাকি টাকা আমাকে দিয়ে দেন’
আপনের মানিব্যাগ থিকা আপনে ট্যাকা দিবেন। আমি নিতাম ক্যারে?
এইটা আর এখন আমার না। হিমুদের মানিব্যাগ থাকে না।
ভাই কি হইছে আপনের। উল্টা পাল্টা কি কইতাছুইন!
ভাই আমার টাকাটা!
মনসুর ৩০০ টাকা রেখে বাকিটা আমার হাতে দিয়ে দিল।
এখন আমাকে এক কাপ চা খাওয়ান। আর একটা পিচ্চি টোকাই ধরে নিয়ে আসেন তো। তাড়াতাড়ি করেন আমার সময় কম।
টোকাই দিয়া কি করবাইন?
মাইকিং করাব। আমার বাজেট কম। তাই টোকাই দিয়েই কাজ চালাতে হবে।
কিসের মাইকিং?
রাস্তা প্রস্তুত করতে হবে। রাস্তাকে জানাতে হবে আজ থেকে হিমু হাঁটবে। সুতরাং সাবধান। নো ধানাই পানাই।
ভাই আপনের লক্ষন আমার ভালো ঠেকতাছে না। চা আনাই দিতাছি। খাইয়া বাসায় চইলা যান।
ঠিক আছে আনান চা।
চা খেতে খেতে আমি ভাবলাম আজ আর বাসায় যাব না। হিমুর প্রথম প্রহর হবে রাস্তায়। আমি কি আসলেই প্রস্তুত? হালকা ভয়ও লাগছিল। এই দুই দিনে যা করেছি তার এক বিন্দুতেও মগজের কোন অবদান নেই। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, আমি সম্পূর্ণ অন্য একটা মানুষ। যে মানুষ কক্ষনো এক সেকেন্ড পরের চিন্তা করে না। দুই দিন আগের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিরাট প্যাকেজ বহনকারী একটা মানুষ এই মুহূর্তে খুব সম্ভবত জগতের সবচে পরিকল্পনাবিহীনদের একজন।
চা শেষ করতেই একটা পিচ্চি টোকাই চোখে পড়ল। ঢাকা শহরে প্রাইভেট কার আর টোকাই না চাইলেও চোখে পড়বেই। ভালই হল আমার। ডাক দিয়ে নিয়ে আসলাম পিচ্চিটাকে।
নাম কি রে তোর?
শাতিল।
আমার মনে হল নামটা হবে শাকিল। এই ব্যাটা নিজের নাম বলতে ভিরমি খাচ্ছে, আমার নামের মাইকিং করবে কিভাবে!
শাতিল, জোরে করে বলতো হিমু।
হিমু.........
শাব্বাশ! তুই পারবি। এই নে ৫০০ টাকা। এখান থেকে যতদূর পারবি বলতে বলতে যাবি, ‘হিমু হাঁটবে, হিমু হাঁটবে’ জোরে জোরে বলবি যেন সব্বাই শুনতে পায়। পারবি না?
‘পারমু’ বলে নোটটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। হয়তো বুঝতে পারছে না ৫০০ টাকা আসলে কত টাকা!
তাড়াতাড়ি যা ব্যাটা! সন্ধ্যার আগে তোর মাইকিং শেষ করতে হবে।
শাতিল একবার আমার দিয়ে তাকিয়ে দিল ভোঁ দৌড়। আর চিৎকার করতে লাগলো, হিমু হাঁটপে, হিমু হাঁটপে।
আমার কেন জানি মনে হল ছেলেটা দৌড়ের কারনে ‘ট’ এর জায়গায় বারবার ‘গ’ বলে যাচ্ছে।
মনসুর পাশ থেকে এতক্ষন নির্বাক হয়ে সব কিছু দেখছিল। বেচারার মুখ মোটামুটি হা হয়ে আছে।
৫০০ ট্যাকা দিয়া দিলেন?
আমার হাতে আর একটা ৫০০ টাকার নোট ছিল। আমি মনসুরের সামনেই সেটাকে ছিঁড়ে দু’ভাগ করে ফেললাম। আমি এখন খাঁটি ময়মনসিংহের ভাষায় ‘ফইন্নির পুত’ মনসুরের দিকে তাকিয়ে হালকা একটা হাসি দিয়ে হাঁটা দিলাম।
পিছন থেকে মনসুর আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘হিমু ভাই, এহন কই যাইবাইন?’
আমি ঘাড় না ঘুড়িয়েই জবাব দিলাম, ‘ময়ূরাক্ষীর পাড়ে। আমার হিসাবের খাতাটা ওইখানেই রাখা আছে’ (চলবে********)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০১৫ সকাল ১০:২৯
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×