মহান আল্লাহ সর্বজ্ঞানী। তাঁর ইচ্ছা এবং তিনি যা কিছু সংঘটিত করতে চান, সেসকল বিষয়ে তিনিই সম্যক অবগত। তিনি সর্বাধিক জ্ঞানী এবং সর্বাধিক অবহিত তাঁর ব্যবস্থাপনা ও কৌশল সম্পর্কে। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে সতর্ক করার জন্য বিভিন্ন প্রকারের নিদর্শন সৃষ্টি করেন এবং কখনো কখনো তা তাঁর বান্দার উপর প্রেরণ করেন, যাতে করে তারা মহান আল্লাহ কর্তৃক তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন ও ভীত হয়। বান্দারা মহান আল্লাহর সাথে যেসব শিরকে লিপ্ত হয় বা অসৌজন্যমূলক আচরণ করে এবং তিনি যা করতে নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকার জন্য তিনি এই নিদর্শনসমূহ প্রেরণ করেন, যাতে করে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে, তাদের বোধদয় হয় এবং একমাত্র তারা তাদের রবের দিকেই একনিষ্ঠভাবে প্রত্যাবর্তন করে।
মহান আল্লাহ বলেন- ‘(আসলে) আমি সতর্ক করার জন্যই (তাদের কাছে আযাবের) নিদর্শন পাঠাই।’ {সূরা ১৭ বনি ইসরাইল, আয়াত-৫৯} মহান আল্লাহ আরো ঘোষণা করেন- ‘অচিরেই আমি আমার (কুদরতের) নিদর্শনসমূহ দিগন্ত বলয়ে প্রদর্শন করবো এবং তাদের নিজেদের মধ্যেও (তা আমি দেখিয়ে দেব) যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের উপর পরিস্কার হয়ে যায় যে, এই (কুরআনই মূলত) সত্য; এ কথা কি যথেষ্ট নয় যে, তোমার মালিক সবকিছু সম্পর্কে অবহিত?’ {সূরা ৪১ হা মীম সিজদা, আয়াত-৫৩}
আল্লাহর সতর্ককরণ ধরণ-ধারণে, আকার-আকৃতিতে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপে আপতিত হয়। কখনো ব্যাপক বিধ্বংসী ঘুর্ণিঝড়ের আকৃতিতে, কখনো দুর্দমনীয় বন্যার আকারে, কখনোবা যুদ্ধের আকারে, কখনো আবার প্রচন্ড বা মৃদু ভূমিকম্পের আকারে। কারণ, তিনি চান না যে, মানুষ অবাধ্য হয়ে তার বিধি-বিধানের প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে প্রবৃত্তি চালিত হয়ে জীবন-যাপন করুক, যার ভয়াবহ পরিণাম হবে পরকালের দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক জীবন, জাহান্নাম।
মহান আল্লাহ আরো ঘোষণা করেন- ‘বল! আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে) অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে আযাব পাঠাতে সক্ষম, অথবা তিনি তোমাদেরকে দল-উপদলে বিভক্ত করে একদলকে আরেক দলের শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাতেও সম্পূর্ণরূপে সক্ষম।’ {সূরা ৬ আনআম, আয়াত-৬৫} উল্লেখিত আয়াতে পায়ের নীচ থেকে আযাব পাঠানোর ব্যাখ্যায় মুফাসসিরীনে কেরাম বর্ণনা করেন, ভূমিকম্প এবং ভূমিধ্বসের মাধ্যমে মাটির অভ্যন্তরে ঢুকে যাওয়ার মত আযাব। নিঃসন্দেহে বর্তমানে যে সকল ভূমিকম্প দেশে-বিদেশে ঘটছে, তা মহান আল্লাহর প্রেরিত সতর্ককারী নিদর্শনগুলোর একটি, যা দিয়ে তিনি তাঁর বান্দাদের ভয় দেখিয়ে থাকেন। এই ভূমিকম্প এবং অন্যান্য সকল দূর্যোগ সংঘঠিত হওয়ার ফলে অনেক ক্ষতি হচ্ছে। অনেকে মারা যাচ্ছে এবং আহত হচ্ছে। এই দূর্যোগগুলো আসার অন্যতম কারণ হচ্ছে মানুষের গুনাহ। এ ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ বলেন- ‘(হে মানুষ!) যে বিপদ আপদই তোমাদের উপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই এবং (তা সত্ত্বেও) আল্লাহ তাআলা তোমাদের অনেক অপরাধ ক্ষমা করে দেন।’ {সূরা ৪২ আশ-শুরা, আয়াত-৩০}
এই প্রেক্ষাপটে আমাদের উচিত, খুবই আন্তরিকভাবে মহান আল্লাহর নিকট তাওবা করা, আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট একমাত্র দ্বীন ইসলামকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা এবং আল্লাহ তাআলা যেসব কাজ করতে আদেশ করেছেন এবং যা করতে নিষেধ করেছেন, তা খুব আন্তরিকভাবে মেনে চলা। যেমন, নামায পড়া, যাকাত আদায় করা, সুদ-ঘুষ না খাওয়া, মদ পান না করা, ব্যভিচার না করা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশা না করা, গান ও বাদ্যযন্ত্র না শোনা, হারাম কাজসমূহ থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি। এতে করে আসা করা যায়, মহান আল্লাহ তাদেরকে আযাব থেকে নিরাপদে রাখবেন এবং তাদের উপর রহমত বর্ষণ করবেন। মহান আল্লাহ বলেন- ‘অথচ যদি সেই জনপদের মানুষগুলো (আল্লাহ তাআলার উপর) ঈমান আনতো এবং (আল্লাহ তাআলাকে) ভয় করতো, তাহলে আমি তাদের উপর আসমান-যমীনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম, কিন্তু (তা না করে) তারা (আমার নবীকেই) মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো, সুতরাং তাদের কর্মকান্ডের জন্য আমি তাদের ভীষণভাবে পাকড়াও করলাম।’ {সূরা ৭ আল-আরাফ, আয়াত-৯৬}
ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানের আলোকে ভূপৃষ্ঠের নীচে একটি নির্দিষ্ট গভীরতায় রয়েছে কঠিন ভূত্বক। ভূত্বকের নীচে প্রায় ১০০ কি.মি. পূরু একটি শীতন কঠিন পদার্থের স্তর রয়েছে। একে লিথোস্ফেয়ার (Lithosphere) বা কঠিন শিলাত্বক নামে অভিহিত করা হয়। আমাদের পৃথিবী নামের এই গ্রহের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, কঠিন শিলাত্বক (লিথোস্ফেয়ার)সহ এর ভূপৃষ্ঠ বেশ কিছু সংখ্যক শক্ত শিলাত্বকের প্লেট (Plate) এর মধ্যে খন্ড খন্ড অবস্থায় অবস্থান করছে। ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানের আলোকে এই প্লেটের চ্যুতি বা নড়া-চড়ার দরুণ ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশে একের পর এক ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে গেলেও তা আমাদেরকে খুব একটা সচেতন করতে পারেনি। মহান আল্লাহ বলেন- ‘এ লোকালয়ের মানুষগুলো কি এতই নির্ভয় হয়ে গেছে (তারা মনে করে নিয়েছে), আমার আযব (নিঝুম) রাতে তাদের কাছে আসবে না, যখন তারা (গভীর) ঘুমে (বিভোর হয়ে) থাকবে! অথবা জনপদের মানুষগুলো কি নির্ভয় হয়ে ধরে নিয়েছে যে, আমার আযাব তাদের উপর মধ্য দিনে এসে পড়বে না- যখন তারা খেল-তামাশায় মত্ত থাকবে। কিংবা তারা কি আল্লাহ তাআলার কলা-কৌশল থেকেও নির্ভয় হয়ে গেছে, অথচ আল্লাহ তাআলার কলা-কৌশল থেকে ক্ষতিগ্রস্থ জাতি ছাড়া কেউই নিশ্চিত হতে পারে না।’ {সূরা ৭ আল-আরাফ, আয়াত-৯৯}
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, মহান আল্লাহ মাঝে মাঝে পৃথিবীকে জীবন্ত হয়ে উঠার অনুমতি দেন, যার ফলে তখন বড় ধরণের ভূমিকম্প অনুষ্ঠিত হয়। তখন এই ভূমিকম্প মানুষকে ভীত করে। তারা মহান আল্লাহর নিকট তাওবা করে, পাপ কর্ম ছেড়ে দেয়, আল্লাহর প্রতি ধাবিত হয় এবং তাদের কৃত পাপ কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে মুনাজাত করে। আগেকার যুগে যখন ভূমিকম্প হত, তখন সঠিক পথে পরিচালিত সৎকর্মশীল লোকেরা বলত, ‘মহান আল্লাহ আমাদেরকে সতর্ক করেছেন।’ মদীনায় যখন একবার ভূমিকম্প হয়েছিল, তখন হযরত ওমর রাযি. তার জনগণকে ভাষণে বলেছিলেন, ‘যদি আর একবার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়, তাহলে আমি এখানে তোমাদের সাথে থাকব না।’ হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে- ‘যখন কোথাও ভূমিকম্প সংঘটিত হয়, অথবা সূর্যগ্রহণ হয়, ঝড়োবাতাস বা বন্যা হয়, তখন মানুষের উচিত মহান আল্লাহর নিকট দ্রুত তাওবা করা। তাঁর নিকট নিরাপত্তার জন্য দুআ করা এবং তাকে অধিক হারে স্মরণ করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা। {মুসলিম শরীফ ২/৬২৮} বর্ণিত আছে যে, যখন কোন ভূমিকম্প সংঘটিত হত, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয রহ. তার গভর্ণরদেরকে দান করার কথা লিখে চিঠি লিখতেন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা মানুষকে আযাব থেকে নিরাপদ রাখবে, তা হল, যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, তাদের উচিত দ্রুততার সাথে সমাজে প্রচলিত অন্যায় থামিয়ে দেয়া, গুনাহমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা, শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করা, ভাল কাজের আদেশ এবং খারাপ কাজে নিষেধাজ্ঞা জারী করা। ভূমিকম্প বিষয়ে পবিত্র কুরআনুল কারীমে সূরায়ে ‘যিলযাল’ নামে একটি সূরাই নাযিল করা হয়েছে। মানুষ শুধু কোন ঘটনা ঘটার কার্যকারণ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয় এবং ভূতত্ত্ববিজ্ঞানও এই কার্যকারণ সম্পর্কেই আলোচনা করে থাকে। কিন্তু কুরআনুল কারীম একই সাথে কোন ঘটনা ঘটার কার্যকারণ বর্ণনার পাশাপাশি উক্ত ঘটনা থেকে শিক্ষনীয় বিষয় কি এবং এই ঘটনা থেকে অন্য আরো বড় কোন ঘটনা ঘটার সংশয়হীনতার প্রতি ইংগিত করে। ভূমিকম্প বিষয়ে কুরআনুল কারীমে দু’টি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। একটি হল ‘যিলযাল’, যার অর্থ হল একটি বস্ত্তর নরাচরায় অন্য আরেকটি বস্ত্ত নরে ওঠা। দ্বিতীয় শব্দটি হল ‘দাক্কা’, এর অর্থ হল প্রচন্ড কোন শব্দ বা আওয়াজের কারণে কোন কিছু নড়ে ওঠা বা ঝাঁকুনি খাওয়া। পৃথিবীতে বর্তমানে যেসব ভূমিকম্প ঘটছে, তা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে কঠিন শিলাত্বকে চ্যুতি বা স্থানান্তরের কারণে। কিয়ামতের দিন আরেকটি ভূমিকম্পে পৃথিবী টুকরো টুকরো হয়ে ধুলিকনায় পরিণত হবে এবং তা হবে হযরত ইসরাফিল আ.-এর সিংগায় ফুৎকারের কারণে, যাকে বলা হয় ‘দাক্কা’। যা হবে এক প্রচন্ড আওয়াজ।
পৃথিবীতে মাঝে মাঝে কঠিন শিলাত্বকের স্থানান্তরের কারণে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প আমাদেরকে এ কথার প্রতি ইংগিত করে যে, একদিন ঐ ‘দাক্কা’ সংঘটিত হবে, যার নাম কিয়ামত। তখন এই চাকচিক্যময় দুনিয়ার সবকিছুই ধ্বংসস্ত্তপে পরিণত হবে। মানুষ যেন কিয়ামতকে ভুলে না যায়, দুনিয়াকেই তার আসল ঠিকানা মনে না করে, তাই মাঝে মাঝে মহান আল্লাহ ভূমিকম্পসহ আরো অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগ দিয়ে মানুষকে সতর্ক করে থাকেন।ভূমিকম্পে প্রাণে রক্ষা পাওয়ার প্রস্ত্ততি গ্রহণ করা যেমন দরকার, তারচেয়েও বেশি দরকার মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করা। ভূমিকম্প বা অন্যান্য দূর্যোগ থেকে আমরা প্রাণে বেঁচে গেলেও একেবারে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে পারব না কখনোই। তাই সেই মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
অনেকেই মনে করতে পারেন, ভূমিকম্পের সঙ্গে এখানে আযাব-গযব বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে আলোচনার কি সম্পর্ক। আসলে ধর্মের সাথে মানুষের সম্পর্কটা হল জন্মগত, প্রকৃতিগত। যার উদাহরণ আমরা দেখেছি ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের সময়। তখন যে যার মত করে স্ব-স্ব ধর্ম অনুযায়ী স্রষ্টাকে স্মরণ করেছে। ভূমিকম্প বিষয়ে বিজ্ঞানের একটা ব্যাখ্যা আছে। তবে এই ব্যাখ্যাই শেষ কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা হল, এটি আল্লাহ কর্তৃক একটি নিদর্শন। যাতে করে মানুষ স্বীয় অপরাধ বুঝতে সক্ষম হয়। ফিরে আসে আল্লাহর পথে। মহান আল্লাহ অতীত জাতির উপর প্রেরিত আযাব সম্পর্কে বলেন- ‘অতঃপর এদের সবাইকে আমি (তাদের) নিজ নিজ গুনাহের কারণে পাকড়াও করেছি, এদের কারো উপর প্রচন্ড ঝড় পাঠিয়েছি (প্রচন্ড পাথরের বৃষ্টি) যেভাবে {লুত জাতির উপর প্রেরণ করা হয়েছিল}, কাউকে মহা গর্জন এসে আঘাত হেনেছে {যেমন শুয়াইব আ.-এর জাতির উপর আঘাত হেনেছিল} কাউকে আমি যমীনের নীচে গেড়ে দিয়েছি {যেভাবে কারুনের উপর এসেছিল} আবার কাউকে আমি (পানিতে) ডুবিয়ে দিয়েছি {নূহ আ.-এর জাতি এবং ফেরাউন ও তার লোকদেরকে যেভাবে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল}। মূলত আল্লাহ তাআলা এমন নন যে, তিনি এদের উপর জুলুম করেছেন, যুলুম তো বরং তারা নিজেরাই নিজেদের উপর করেছে।’ {সূরা ২৯ আনকাবুত, আয়াত-৪০}