somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ।। -(প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ)

১৫ ই আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৫:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যোগাযোগমন্ত্রী সালাহউদ্দিন খান ভুলু সাহেবের দুপুরে কিছুক্ষণ ঘুমানোর অভ্যাস। মন্ত্রীর কঠিন দায়িত্ব পালনের সময়ও তিনি এই অভ্যাস বহাল রেখেছেন। একটু উনিশ-বিশ অবশ্য হচ্ছে; আগে ঘুমানোর সময় একজন গায়ের ঘামাচি মেরে দিত, এখন সেটা সম্ভব হচ্ছে না। প্রায়ই ভাবেন, পলিটিক্যাল পিএসকে ঘামাচি মারতে বলবেন। সে আগ্রহ নিয়ে কাজটা করবে। একটাই ভয়, কোনো পত্রিকায় যদি নিউজ চলে যায়! পত্রিকাগুলো চলে গেছে দুষ্টুদের দখলে। তারা সম্মানিত মন্ত্রীদের ওপর টেলিস্কোপ ফিট করে রেখেছে। আরাম করে ১০ মিনিট ঘুমানোর উপায়ও নেই।

সালাহউদ্দিন খান ভুলু দিবানিদ্রা সেরে উঠেছেন। মন-মেজাজ এখনো ধাতস্থ হয়নি। তিনি কয়েকবার হাই তুললেন। এই সময় তাঁর পিএস (সরকারি) ঢুকলেন। বিনীত গলায় বললেন, স্যারের ঘুম ভালো হয়েছে?
মন্ত্রী বললেন, আমি আপনাকে অনেকবার বলেছি, দুপুরে আমি ঘুমাই না। চোখ বন্ধ করে একধরনের যোগব্যায়াম করি। ‘শবাসন’ এই ব্যায়ামের নাম। এতে টেনশন কমে।

পিএস বললেন, স্যার, সরি। আমি যোগব্যায়ামের ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি। আপনার নাক ডাকার শব্দে বিভ্রান্ত হয়েছি।
আর বিভ্রান্ত হবেন না। নাক ডাকা না। দ্রুত নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ফেলা যোগব্যায়ামেরই অংশ। আমার নাকে পলিপ আছে বলে দ্রুত নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সময় নাক ডাকার মতো শব্দ হয়। এখন ক্লিয়ার হয়েছে?
অবশ্যই, স্যার।
কোনো কাজে এসেছেন?
একটা রোড অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। মাইক্রোবাস ভেঙে গুঁড়া হয়ে গেছে। পাঁচজন মারা গেছে।
অ্যাকসিডেন্ট হলে মানুষ মারা যাবে, এটা নতুন কী? এই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আপনি আমার কাছে এসেছেন?
অনেকেই আপনাকে দুষছে। রাস্তাঘাট ভাঙা, খানাখন্দে ভরা। এই কারণেই অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে।
এটা কী মাস?
ভাদ্র মাসের শুরু।
বৃষ্টি হচ্ছে না?
রোজ বৃষ্টি হচ্ছে।
এই বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট ঠিক থাকে?
থাকে না, স্যার।
বাস্তবতা বুঝতে হবে। তুচ্ছ বিষয়ে মন্ত্রীকে দুষলে হবে না। বুঝেছেন?
জি স্যার।
খরা মৌসুম আসুক, রাস্তাঘাট ঠিক হবে।
সাংবাদিকেরা আপনার কাছ থেকে শুনতে চায়।
শুনতে চাইলেই আমি শোনাব না। আপনি বলে দিন, গতবারের সরকারের যোগাযোগ খাতে সীমাহীন দুর্নীতির কারণে রাস্তাঘাটের আজ এমন বেহাল দশা। একটা স্টেটমেন্ট দিয়ে দিন।
জি স্যার। স্টেটমেন্টের ব্যবস্থা করছি। তবে আপনাকে একটু কষ্ট করে হাসপাতালে যেতে হবে।
কেন?

মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় কিছু বিখ্যাত মানুষ মারা গেছেন। যাঁরা আহত, তাঁদের দেখতে যাওয়া উচিত।
বিখ্যাত মানুষ কে মারা গেল?
পিএস বিখ্যাত মানুষদের তালিকা বললেন।
মন্ত্রী বিরক্ত গলায় বললেন, এরা বিখ্যাত হলো কবে? আমি তো নামও শুনি নাই। মিডিয়া এদের বিখ্যাত বানিয়েছে। সব মিডিয়ার কারসাজি। দেশটাকে নষ্ট করে দিচ্ছে মিডিয়া।
যথার্থ বলেছেন। তবে মিডিয়াকে অগ্রাহ্য করা ঠিক হবে না।
হাসপাতালে গিয়ে কী বলব, ঠিক করে এনেছেন? উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলতে পারি। মুডি মানুষ তো, মুডের ওপর চলি।
পিএস বললেন, আমি দুই ধরনের বক্তব্য তৈরি করে এনেছি, যেটা আপনার পছন্দ। আপনি বলবেন, আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে, আমাদের কী করার আছে?
মন্ত্রী বললেন, ভালো বক্তব্য। আল্লাহর ওপর কোনো কথা নেই। ধর্মভিত্তিক দল আমার এই বক্তব্য পছন্দ করবে।
অথবা আপনি বলবেন, মাইক্রোবাসের চালকের অদক্ষতাই দুর্ঘটনার কারণ। সে ওভারটেক করতে গিয়েই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। এতে দোষটা ওদের ঘাড়ে গিয়েই পড়বে।
মন্ত্রী বললেন, এটাও খারাপ না। আমি বরং দুটো একত্র করে বলি। প্রথম বলি, মাইক্রোবাস চালকের ভুল। তারপর বলি, আল্লাহর মাল আল্লায় নিয়েছে। বুদ্ধিটা কেমন বের করেছি?
অসাধারণ। আপনার চিন্তাধারাই বৈপ্লবিক।

আমাদের এই মুডি মন্ত্রী নানা ধরনের কথাবার্তা বলা শুরু করলেন। মিডিয়া তাঁকে নিয়ে কিছু কাজকর্ম করল। মন্ত্রী যখন গাড়ি নিয়ে রাস্তার বেহাল দশা দেখতে গেলেন, তখন বদগুলো তাঁর হাসিমুখের ছবি ছাপাল। রাস্তায় বিশাল এক গর্তের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি হাসছেন—এ রকম ছবি। এই অপরাধ ক্ষমা করা যায়, কিন্তু তাঁর পদত্যাগ চেয়ে প্রতিবেদন ক্ষমা করা যায় না। বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো কোনো মন্ত্রী পদত্যাগ করেছে? মন্ত্রীরা হলেন কচ্ছপ। কচ্ছপের মতো কামড় দিয়ে তাঁরা মন্ত্রিত্ব ধরে রাখবেন। এটাই নিয়ম।
মন্ত্রী তাঁর রাজনৈতিক সচিবের পরামর্শে কিছু জটিল পদক্ষেপ নিয়ে নিলেন। একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। একটা ছোট্ট সমস্যা তাতে হলো; দেখা গেল, সবাই দুর্নীতিবাজ। রসুনের বোঁটা অবস্থা। একজনকে শাস্তি দিলে বাকিরা খেপে যাবে। ওদের গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। কাজেই অনেক ঝামেলা করে একজন সৎ কর্মচারী খুঁজে তাঁকে বরখাস্ত করা হলো।

মন্ত্রী মহোদয় সব পত্রিকায় তাঁর একটি ছবি পাঠালেন। সেই ছবিতে তিনি কোদাল হাতে ভাঙা রাস্তার পাশে দাঁড়ানো। নিচে লেখা, ‘মন্ত্রী মহোদয় নিজেই রাস্তা মেরামতে নেমে পড়েছেন’।

কোনো পত্রিকা এই ছবি ছাপাল না, উল্টো এক বদ পত্রিকা এই ছবি নিয়ে কার্টুন বানিয়ে ছাপিয়ে ফেলল। কার্টুনে দেখা যাচ্ছে, রাক্ষস টাইপ চেহারার এক লোক খালি গায়ে খাকি হাফপ্যান্ট পরে বেলচা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ের এবং পায়ের বড় বড় লোম দেখা যাচ্ছে। কার্টুনের নিচে লেখা, ‘যোগাযোগমন্ত্রী বলেছেন, আমি একাই ৩৫০ কিলোমিটার রাস্তা মেরামত করব, ইনশাআল্লাহ।’
মন্ত্রী তাঁর পিএসকে ডেকে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, তিন কোটি টাকার একটা মানহানি মামলার ব্যবস্থা করুন। আমার ছবি বিকৃত করে ছেপে আমার মানহানি করেছে।

পিএস বললেন, বিকৃত করে তো ছাপে নাই, স্যার। কার্টুনে আপনাকে চেনা যায়।
আমাকে চেনা যায়?
জি স্যার।
আমার গা-ভর্তি লোম?
লোমের পয়েন্টে মামলা করতে পারেন। তবে এখন নতুন ঝামেলায় যাওয়া ঠিক হবে না। এরপর এরা নিউজ করে দেবে—কার্টুন ছবিতে মন্ত্রীর গায়ের লোম দেখানোয় এক কোটি টাকার মানহানির মামলা।
এক সকালবেলার কথা। মন্ত্রীর স্ত্রী সালমা বানু (বিশিষ্ট সমাজসেবী, পরিবেশ রক্ষাকর্মী, বিপন্ন হনুমান বাঁচাও আন্দোলনের সভানেত্রী) তাঁর স্বামীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আমাকে না জানিয়ে, আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে তুমি কী করে এই কাজ করলে?
মন্ত্রী বললেন, কী কাজ করলাম?
পদত্যাগ করেছ, আমাকে না জানিয়ে।
পদত্যাগ করব কোন দুঃখে?
পত্রিকায় নিউজ এসেছে। এই দেখো।
মন্ত্রী মহোদয় হতভম্ব হয়ে পড়লেন, ‘যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রী মহোদয় স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন।’

হতভম্ব মন্ত্রী তাঁর পিএসকে টেলিফোন করলেন। অনেকবার রিং হলো, পিএস ধরলেন না। তিনিও নিউজ পড়েছেন। এখন যে মন্ত্রী নন তাঁর টেলিফোন কেন ধরবেন! আমজনতার টেলিফোন ধরার কিছু নেই।
মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক পিএসকে টেলিফোন করলেন। পিএস তাঁর কোনো কথা না শুনেই বললেন, পদত্যাগ করে ভালো করেছেন। দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। আচ্ছা রাখি।
মন্ত্রী লাইন কেটে দেওয়ার পর অনেকবার চেষ্টা করলেন, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব টেলিফোন ধরলেন না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি লক্ষ করলেন, পত্রিকার এই বানোয়াট খবর সবাই বিশ্বাস করে বসে আছে। তাঁর নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সাব-ইন্সপেক্টর সিগারেট ফুঁকছিল, তাঁকে দেখে সিগারেট ফেলে না দিয়ে শুধু পেছনে আড়াল করল।

মন্ত্রী মহোদয় প্রধানমন্ত্রীকে ধরার অনেক চেষ্টা করলেন। তাঁর চেষ্টা দেখতে পেলে রবার্ট ব্রুসও লজ্জা পেত। একসময় চেষ্টা সফল হলো। প্রধানমন্ত্রী টেলিফোন ধরলেন এবং বললেন, আপনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে একটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। আপনাকে অভিনন্দন। মন্ত্রী না থেকেও জনগণের সেবা করা যায়।
জনগণের সেবা করুন।
প্রধানমন্ত্রী টেলিফোন রেখে দিলেন।

[গল্পের মোরাল: মন্ত্রীদের বুকে এবং পায়ে লোম না থাকা বাঞ্ছনীয়।]

বি.দ্র. এই গল্পের সাথে জীবিত, মৃত, অর্ধমৃত, স্বল্পমৃত কোনো ব্যক্তির মিল খুঁজিবেন না। ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:৫৬
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×