ভারতীয় চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে ২০০৪ সালের শেষভাগে। দিল্লিস্থ স্টেলার পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ৩১০ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির নাম 'অলওয়েজ বিইং বর্ন'। ইংরেজি থেকে অনূদিত নির্বাচিত অংশটিতে মৃণাল সেন দেশভাগ, কলকাতা গমন, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে নিজের পুরনো বাড়ি পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা, কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ইত্যাকার বিষয় সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন।
...
আমার পিতা-মাতা কখনোই ভাবেননি তাদের প্রিয় স্বদেশ ছাড়তে হবে। কিন্তু নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিল এবং পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটলো। পরিস্থিতির ফেরে বাধ্য হয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিলেন সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে দেশত্যাগ করবেন। জলের দরে সব বিক্রি করে দিয়ে তারা সপরিবারে কলকাতায় উপস্থিত হলেন, 'উদ্বাস্তু' পরিচয়ে। বাড়ি ছাড়ার পূর্বে যিনি আমাদের সম্পত্তি ক্রয় করেছিলেন তার কাছে বাবা ছোট্ট একটা অনুরোধ করেন: 'আপনাকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে না ... কিন্তু চেষ্টা করে দেখবেন ... যদি সম্ভব হয় ... পুকুরের পাশে যে-ছোট্ট স্মৃতিস্তম্ভটি আছে, তা যেন রক্ষা পায়।'
স্মৃতিস্তম্ভটি হলো আমাদের ছোট বোন রেবার। সে পাঁচ বছর বয়সে মারা যায়। সে পা পিছলে পুকুরে পড়ে যায় এবং ডুবে মারা যায়।
রেবা আমাদের সব ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল। সাত ভাই ও পাঁচ বোনের বিরাট পরিবারে সে বড়ো হচ্ছিল। আমি ভাইদের মধ্যে ষষ্ঠ ছিলাম এবং রেবা বোনদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিল। আর সে ছিল সবচাইতে আদরের, প্রতিবেশীরাও তাকে খুব ভালবাসতো। যতদূর মনে পড়ে সেই দুর্ভাগা দিনটি ছিল এক ছুটির দিন, আমরা সবাই দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম। রেবা ঘাটে গিয়েছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে ঘাটটি চমৎকার ছিল -- কয়েকটি ধাপ পুকুরের পানিতে নেমে গেছে; পানির কয়েক ইঞ্চি ওপরে ধাপের সঙ্গে বাঁশনির্মিত একটি মাচা -- পুকুরের এক-চতুর্থাংশ অঞ্চল মাচাটি অতিক্রম করে গেছে। আমরা সবাই বাঁশের মাচা ধরে হাঁটতে পছন্দ করতাম। হাঁটার সময়ে দুপাশে পানিকে অতিক্রম করে যেতাম, কখনো পানিতে পা ডুবিয়ে মাচায় বসতাম। রেবাও তাই করতো। আর সে মাচার একেবারে সামনের প্রান্তে বসে গুনগুন করে গান গাইতে পছন্দ করতো। কিন্তু সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল কেউ জানে না, কারণ কেউ সেখানে ছিল না। আমরা সবাই পরে ধরে নিই মাচার একেবারে সামনে গিয়ে পানিতে পা ডুবিয়ে সে বসেছিল এবং হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল। এক পর্যায়ে আমরা তাকে অনেকণ ধরে দেখছিলাম না, প্রতিবেশীদের বাড়িতে তাকে খোঁজা হলো এবং পাওয়া গেলনা; অবশেষে মেজদা, আমার সাঁতারু দাদা, পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন -- অল্পক্ষণের মধ্যেই তাকে উদ্ধার করলেন, মৃত অবস্থায়। পানির নিচেই তার মৃত্যু হয়েছিল।
রেবার মৃত্যুর খবর দ্রুত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সবাই দেখতে আসে, কারণ সবাই তাকে ভালবাসতো। কলকাতা থেকে আমাদের সবচেয়ে বড়ো ভাই শৈলেশদা আসলেন। তার সঙ্গে এলেন তার প্রিয় বন্ধু জসীমউদ্দীন। জসীমদার কাছে রেবা ছিল অনেক কিছু। জসীমদা আমাদের কারো কাছ থেকে একটা-দুটো কথা শুনলেন এবং সময় নষ্ট না করে ঘাতক-ঘাটের কাছে গেলেন। তাকে চা খেতে বলা হলো, তিনি রাজি হলেন না। দুপুরে তাকে খেতে দেয়া হলো, সামান্যই খেলেন। খুব সামান্য। বিকেলে তিনি আমার মাকে ডাকলেন। মা ঘাটের কাছে গেলেন এবং মাকে জড়িয়ে ধরে জসীমদা শিশুর মতো কেঁদে উঠলেন। তারা কিছুণ নীরব রইলেন এবং এরপর জসীমদা মাকে রেবার একটি অজানা কথা জানালেন। রেবার এরকম অনেক গোপন কথা ছিল যা কেবল জসীমদাই জানতেন। তিনি এক মাস আগে জসীমদাকে বলা রেবার একটি অজানা কথা মাকে জানালেন। তিনি জানালেন, রেবা তাকে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিল যে একবার তাকে সারারাত জাগার সুযোগ দিতে হবে এবং দেখতে দিতে হবে রাতের বেলা কীভাবে ফুল ফোটে।
অনেক পরে মা রেবা-সম্পর্কিত এইসব বিবিধ ঘটনা আমাদের শুনিয়েছিলেন।
জসীমদার যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়েন, তখন থেকেই তার মধ্যে একটা কবি-ভাব ছিল। বয়সকালে তিনি বিখ্যাত কবি হয়ে ওঠেন এবং রবীন্দ্রনাথও আমাদের জসীমউদ্দীনকে অনেক মূল্য দিতেন। তার অনেকগুলো কাসিক কাব্যোপন্যাসের মধ্যে নকশী কাঁথার মাঠ অবলম্বনে স¤প্রতি কলকাতায় একটি উঁচুমানের কাব্যনাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। তার সব কবিতা ও গান পল্লীর মাটি থেকে উৎসারিত হয়েছে।
সেইদিন সূর্যাস্তের পরে জসীমদা ঘাট থেকে ফিরে আসেন এবং আমাদের সঙ্গে কিছু সময় কাটান। আমাদের বাসা থেকে চার-পাঁচ মাইল দূরে গোবিন্দপুর গ্রামের পিতৃনিবাসে যাবার পূর্বে তিনি মার হাতে ঘাটে বসে থাকা অবস্থায় লিখিত দীর্ঘ একটি কবিতা দিয়ে যান। তিনি মাকে বলে যান সেটা কিছুতেই তিনি যেন প্রকাশ না করেন, কখনোই নয়। এটা কেবল তার কাছেই থাকবে। কবিতাটি ছিল রেবাকে নিয়ে।
১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মা কবিতাটি তার নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। এটা একটি খামে এতোবছর ধরে রতি ছিল। এমনকি যখন তিনি বাবার সঙ্গে দেশত্যাগ করছেন, তখনও তিনি সেটা সঙ্গে নিতে ভোলেননি। তার দাহের সঙ্গে সঙ্গে কবিতাটিও আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
সুদীর্ঘ সময় পরে, ১৯৯০ সালে, দেশত্যাগের ৪৭ বছর পার হয়ে যাবার পরে সেই ছোট শহরের সেই বাড়ির সামনে আমি আর আমার স্ত্রী দাঁড়াই। এটি এখন এক স্বাধীন রাষ্ট্র, নাম বাংলাদেশ। এ হলো সেই বাড়ি যেখানে আমি আমার শৈশব এবং বেড়ে ওঠার কাল কাটিয়েছি। ৪৭ বছরে মালিকবদল হয়েছে, কিন্তু মাত্র একবার। যে-ব্যক্তিটি আমার বাবার কাছ থেকে বাড়ি ও অন্যান্য সম্পত্তি কিনেছিলেন, নতুন ক্রেতার কাছে বিক্রির সময়ে তিনি বাবাকে দেয়া সেই ‘প্রতিজ্ঞা’র কথাটি জানাতে ভোলেননি। তিনি করাচি চলে যাবার পূর্বে নতুন ক্রেতাকে পুকুরপাড়ের সেই স্মৃতিস্তম্ভটি রা করার কথা বলে যান। এই ৪৭ বছরে, আশ্চর্য, আমি একবারও আমার দূর অতীতের কথা মনে করিনি। এটা কি এজন্য যে এই দীর্ঘ সময়ে আমি দেশবিভাগের সামান্যতম যন্ত্রণাও অনুভব করিনি। তাই যদি হয়, তবে এখন কেন? গত ১৫ বছরে ঢাকায় আমি এতোবার এসেছি, আমন্ত্রণ পেয়ে, কেন কোনোবারই আমার এখানে আসতে ইচ্ছে করেনি। কেন এসময়ে আমি প্রায় আধা ডজন বার আমার নিজস্ব শহরে যাবার আমন্ত্রণ উপো করেছি? ঢাকা থেকে ফরিদপুর গিয়ে আবার ঢাকায় ফিরে আসা তো যেতই! এতোদিন পরে, ৪৭ বছর পরে কেন এসেছি? সত্যি বলতে, আমার কোনো উত্তর জানা ছিল না।
আমার শৈশবে এবং বেড়ে ওঠার কালে ঢাকা থেকে ফরিদপুর যাওয়াটা আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা হলেও প্রায় সারাদিন লেগে যেত। সবসময়ই নদীপথে যেতে হতো, নারায়নগঞ্জ থেকে এমু বা অস্ট্রিচ বা ওরকম নামের কোনো দোতলা জাহাজে চড়ে দুরন্ত পদ্মা নদী দিয়ে আমাদের অভিযাত্রা করতে হতো। মাঝে দুমদিম নামের ছোট একটি ফেরিতে উঠতে হতো, দুপাশে পাট ও ধানতে ফেলে একটি সরু খাল দিয়ে আমাদের শহর ফরিদপুরে যেতাম। এখন যাতায়াত-ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতির ফলে যন্ত্রচালিত যানে করে, পদ্মায় ফেরি পার হয়ে, ঢাকা থেকে মাত্র চার ঘণ্টায় ফরিদপুরে যাওয়া যায়।
এবারে, ১৯৯০ সালে, আমি ও আমার স্ত্রী ঢাকায় পৌঁছার পরেই ঠিক করলাম ফরিদপুরে যাবো, কয়েক ঘণ্টার জন্য হলেও। এই সিদ্ধান্তের পেছনে কোনো বিশেষ কারণই ছিল না। আমরা ঢাকায় এসেছি তিন দিনের জন্য, একটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-উৎসবে যোগ দিতে। আমরা ঠিক করলাম চতুর্থ দিনে ফরিদপুরে যাত্রা করবো। আমাদের সঙ্গে ছিল আমার তরুণ ক্যামেরাম্যান শশী আনন্দ, যার পিতা-মাতা ভারতে এসেছিলেন রাওয়লাপিন্ডি থেকে। তারা দেশভাগের বছরেই এসেছিলেন। তারা যখন কলকাতায় আসেন, তখন তারা উদ্বাস্তু ছিলেন, কিন্তু শশী তো তা নয়। সে তো ভারতে জন্মেছে, কলকাতায়। সে যখন বড়ো হয়েছে তার পিতা-মাতা তাদের নিজেদের শহর সম্পর্কে অনেক গল্প করেছেন। রাওয়ালাপিন্ডিতে না গেলেও, শশী পূর্বাংশে আমার শহর কেমন, তা দেখার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
সেই ভ্রমণের কথা ভোলা যায় না। আমরা তিনজন ‘বিদেশী’Ñ আমি, আমার স্ত্রী গীতা সেন এবং শশী। আর আমাদের সঙ্গে গাইড হিসেবে আছেন আমার বন্ধু আবুল খায়ের। তিনি বড়োই মজার মানুষ।
শহরের যত কাছাকাছি আসছিলাম, আমাকে উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছিল।
কী হয়েছে? আমার গাইড জিজ্ঞেস করলেন।
খালটা তো সামনেই, আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললাম, আর তাকে চমকে দেবার জন্য বললাম, কাঠের ব্রিজটা!
আবুল খায়ের বললেন, কাঠের ব্রিজটা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। খানিক পরেই আপনি সেখানে একটি কংক্রিটের ব্রিজ দেখবেন, ব্রিজটার বয়স পনেরো বছর।
আমরা ব্রিজটি অতিক্রম করার পর সোজা চললাম এবং একটি লেনে বাঁক নিলাম। সবকিছুই পরিচ্ছন্ন, সম্ভ্রান্ত, শ্রদ্ধেয় দেখাচ্ছিল। এই এলাকাটা আমাদের সময়ে অপরিচ্ছন্ন ও নিষিদ্ধ ছিল। আমাদের গাড়িটি একটি বাড়ির সামনে থামলো। আমরা নামলাম।
অভ্যর্থনা ও ভুরিভোজনের পরে আমরা খানিকটা বিশ্রাম নিলাম। এরপর আমরা 'অতীত' অনুসন্ধানে বের হলাম। পায়ে হেঁটে।
স্মৃতির পাতা থেকে সবকিছু একের পর একের হুড়োহুড়ি করে আসতে থাকলো। প্রায় একশ বা তারও বেশি স্থানীয় মানুষ আমাদের পেছন পেছন আসছিল। তারা আমাকে চিনেছে, দুই-তিনজন করে তারা জড়ো হতে থাকলো এবং বাড়িটি খুঁজতে খুঁজতে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকলো। আমি তখন উত্তেজিত, কারণ প্রতি পদেক্ষেপ একধরনের অনিশ্চয়তা আমাকে গ্রাস করছিল। স্মৃতি আর বাস্তবের মধ্যে কতটুকু মিল পাওয়া যাবে? আমি স্থানীয় লোকজনকে কোনো কথা বলতে দিতে চাচ্ছিলাম না, আমি নিজেই সবকিছু খুঁজে নিতে চাইছিলাম। সেটা একটা অভিজ্ঞতা ছিল যা আমি কখনোই ভুলবো না। এবং আমি আমার বাড়ি আবিষ্কার করলাম, একাই। ৪৭ বছর পর!
আমি যখন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, আমার সামনে তখন কিছু লোক এলোমেলা দাঁড়িয়ে। কেউই কথা বলছিল নাÑ আমাদের সঙ্গেও না, তারা নিজেরাও না। সেই নীরবতা ছিল আবেগসঞ্চারী।
গীতা আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো, সবকিছু চিনতে পারছো? লোকগুলোকে?
আমি মাথা নাড়লাম। গীতা আমাকে স্পর্শ করলো, আলতোভাবে। আমার কাঁদতে ইচ্ছে করলো, কিন্তু কাঁদলাম না।
কেউ একজন পেছন থেকে এগিয়ে এলো। সে বললো আমার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনিই আমার বাড়ির নতুন মালিক। ঐ মুহূর্তে সাধারণ গৃহবধূদের মতো দেখতে মাঝবয়েসী এক মহিলা এক গোছা ফুল আমার স্ত্রীকে দিয়ে হাসিমুখে বললেন, আপনি আপনার শ্বশুরবাড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন।
গীতা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে।
মহিলা এরপর আমাকে বললেন, আসুন, পুকুরপাড়ের স্মৃতিস্তম্ভ দেখবেন।
আমি হতবাক। গীতাও, সে আমার কাছ থেকে আমার বোনটি সম্পর্কে সবকিছুই শুনেছিল।
গৃহবধূটি আবার বললেন, আপনার বোন রেবার স্মৃতিস্তম্ভ।
গীতা আর আমি পরস্পরে দিকে তাকাই। আমার গলা বাস্পরুদ্ধ হয়ে ওঠে।
আসুন না! তিনি আবার বললেন।
হঠাৎ আমার জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর কথা মনে পড়ে। আততায়ীর হাতে নিহত হবার পূর্বে তার যে অনুভূতি হয়েছিল তা আমি অনুমান করতে চেষ্টা করলাম। মহাত্মা যদি এখানে থাকতেন!
যদি আমি গর্বের সঙ্গে আমার বাবাকে বলতে পারতাম যে তার ছোট্ট রেবার ছোট্ট স্মৃতিস্তম্ভটি কী মমতার সঙ্গে রা করা হয়েছে! রা করেছেন তারাই, যারা তার সম্পত্তি ক্রয় করেছিলেন। মালিকানার হাতবদল হলেও স্মৃতিস্তম্ভের কিছু হয়নি। পুকুরপাড়ে ছুটে যাই।
আমি যদি আমার মাকে বলতে পারতাম যে তার মৃদুভাষীয় মেয়েটি এখনও ঘাতক-ঘাটের পাশে আছে, যে-ঘাটে জসীমদা সারাদিন কাটিয়ে একটি দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন।
হঠাৎ করে আমার চোখের সামনে ঝিলিক দিয়ে ওঠে অনেক দিনের হারিয়ে যাওয়া ছেলের মায়ের বুকে আলিঙ্গনাবদ্ধ হবার দৃশ্যটি। ঘটনাটি ছিল মা ও জসীমদার শেষ সাাতের। মায়ের মৃত্যুর তিন বছর আগেকার কথা। সম্ভবত জসীমদা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধানের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন।
সেটা ছিল এক স্মরণীয় মুহূর্ত। জসীমদা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার সৃজনশীল কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ডি.লিট. উপাধি পেলেন। অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে, কিন্তু তিনি কলকাতায় থেকে গেলেন। তিনি অনেকবার আমাকে ফোন করেছিলেন, কিন্তু আমি কলকাতার বাইরে ছিলাম। আমি ফিরে এলে তাকে ফোন করলাম। তিনি আমাকে দ্রুত তার বন্ধুর বাড়িতে যেতে বললেন, যেখানে তিনি অবস্থান করছিলেন এবং 'মা'র কাছে নিয়ে যেতে বললেন। মা তখন আমার তৃতীয় ভাই গণেশ-এর সঙ্গে শহরের দক্ষিণাংশে নাকতলায় অবস্থান করছিলেন। মা তখন খুব অসুস্থ, শয্যাগত, হৃদরোগী। আমি ফোনে জসীমদার কথা বললাম এবং আধা ঘণ্টার মধ্যে বাড়ির দরোজায় উপস্থিত হলাম। যেইমাত্র গাড়িটি তার ইঞ্জিনের গর্জনের মাধ্যমে বাড়ির সামনে থামলো, আমরা শুনলাম মা ডাকছেন, জ-সী-ম।
ম-া-া। জসীমদা সাড়া দেন।
জসীমদা সময় ব্যয় না করে গাড়ি থেকে দৌড়ে বেরুলেন। চকিতের মধ্যে দু-জনকে বাড়ির উঠোনে দেখলাম। তারা আলিঙ্গনাবদ্ধ, মা ও ছেলে। তারা বাচ্চাদের মতো কাঁদছিলেন।
ধীরে ধীরে আমি ভেতরে প্রবেশ করলাম এবং বারান্দায় বসলাম। আমি তাদের খানিক দূর থেকে দেখছিলাম -- তাদের এই মিলন আমাকে আবেগাপ্লুত করে তোলে।
আমার একজনের কথা মনে হলো। ঋত্বিকের চেহারা মনে পড়লো -- ঋত্বিক ঘটক, যে দেশবিভাগের ঘটনাগুলো নিয়ে খুবই তাড়িত ছিল! সারাজীবন ধরে! তার কথায়, তার ছবিতে দেশবিভাগ আর দেশবিভাগ।
'সময় বদলেছে এবং আমিও বদলেছি,' দেশবিভাগের এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে আমার বাবা বলেছিলেন। আমার বাবা এটা বলেছিলেন আমাকে এবং আমার বন্ধুদের -- সলিল (চৌধুরী), ঋত্বিক (ঘটক), তাপস (সেন), কলিম (শরাফী) এবং সব বন্ধুর প্রিয়তম বন্ধু নৃপেনকে (গঙ্গোপাধ্যায়)। বাবা খুব সাহসী ছিলেন, নিজেকে কখনোই উদ্বাস্তু ভাবতেন না এবং ঋত্বিকের মতো দেশভাগের যন্ত্রণায়ও ভুগতেন না।
ছবির লিঙ্ক: http://www.mrinalsen.org/
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১২ রাত ৯:৫৯