somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাদাকাতুল ফিতর কী দিয়ে আদায় করবেন: পণ্য নাকি মূল্য?

১৫ ই জুন, ২০১৮ বিকাল ৩:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সাদাকাতুল ফিতর কী দিয়ে আদায় করবেন: পণ্য নাকি মূল্য?

ড. বি. এম. মফিজুর রহমান আল-আযহারী
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।

সূচনা:
দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার সমাপ্তি লগ্নে সিয়াম সাধনার পরিপূরক হিসেবে সাদাকাতুল ফিতরের বিধান দেয়া হয়েছে। এটি ইসলামী শরীয়াতের অন্যতম অনন্য একটি অর্থনৈতিক বিধান। ঈদের নামাযের পূর্ব পর্যন্ত নির্দিষ্ট খাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ দান করার নাম সাদাকাতুল ফিতর। এটি ওয়াজিব মতান্তরে ফরয ইবাদাত। প্রত্যেক সক্ষমশীল ব্যক্তির উপর। যার কাছে ঈদের দিন সকালে তার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে। নিজের ও অধীনস্থ অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের পক্ষ থেকে। এর মাধ্যমে সিয়াম অবস্থায় সংঘটিত ক্রুটি-বিচ্যুতির যেমন ক্ষতিপূরণ হয়ে যায়, তেমনি সমাজের বিত্তহীন গরীব মানুষেরাও স্বচ্ছলতা লাভ করে ও ঈদের আনন্দে অংশগ্রহণ করতে পারে। ফলে সমাজে শান্তি, সৌহার্দ্য ও ভালোবাসার এক অপূর্ব পরিবেশ তৈরি হয়। এর মাধ্যমে গরিবের প্রতি ধনীদের মমত্ববোধ বাড়ে, দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয়। দৌহিক ও আত্মিক পরিতৃপ্তি অর্জিত হয়। এর আরেকটি নাম হচ্ছে যাকাতুল ফিতর বা যাকাতুল আবদান (শরীরের যাকাত)। এর দ্বারা সম্পদ পবিত্র করা উদ্দেশ্য নয়; বরং শরীর ও নাফস পবিত্র করা উদ্দেশ্য। যেহেতু, সিয়াম ভাঙ্গার কারণে এটি ওয়াজিব হয়, তাই নাম রাখা হয়েছে যাকাতুল ফিতর। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এটি আদায় করতে হবে কী দিয়ে? হাদীসের মধ্যে যে সব বস্তুর উল্লেখ আছে, সেগুলো দিয়েই আদায় করতে হবে। নাকি সেই পরিমাণ মূল্য পরিশোধ করলেও হবে?

সাদাকাতুল ফিতর কী দিয়ে আদায় করবেন: পণ্য নাকি মূল্য?

এই ব্যাপারে শরীয়াহ বিশেষজ্ঞগণের প্রধানত দুটি অভিমত রয়েছে:
এক. সাদাকাতুল ফিতর অবশ্যই পণ্য দিয়ে আদায় করতে হবে। মূল্য দিয়ে আদায় করলে হবে না।
এই মতের প্রবক্তাগণ হচ্ছেন: ইমাম মলিক, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমাদ (র.) প্রমুখ।
দুই. সাদাকাতুল ফিতর মূল্য দিয়ে আদায় করাও বৈধ।
এই মতের প্রবক্তাগণ হচ্ছেন: ইমাম আবু হানীফাহ, ইমাম বুখারী, সুফিয়ান সাওরী, হাসান বসরী, উমার বিন আব্দুল আযীয, ইবনু তাইমিয়্যাহ প্রমুখ। অবশ্য ইবনু তাইমিয়্যাহ প্রয়োজনীয়তার শর্তারোপ করেছেন।

প্রমাণাদি:

এক. প্রথম অভিমতের প্রমাণাদি:

১. সাদাকাতুল ফিতর সম্পর্কে যত হাদীস রয়েছে, সবগুলোতে পণ্যের কথা বলা হয়েছে। কোথাও মূল্য প্রদানের কথা নেই। যদি মূল্য প্রদান বৈধ হতো, তা হলে হাদীসে তা উল্লেখ থাকতো।
তাছাড়া, এটি একটি ইবাদাত। আর ইবাদাতের বিষয়টি হচ্ছে সম্পূর্ণ তাওকীফী (ওহী নির্ভর)। যেহেতু, হাদীসে পণ্যের মধ্যেই সীমিত করে দেয়া হয়েছে, তাই পণ্যের বাহিরে যাওয়া বৈধ হবে না।
ঐ সব হাদীসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:
ক. হযরত ইবুন ‘উমার (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন:
"فرض رسول الله ـ صلى الله عليه وسلم ـ زكاة الفطر صاعا من تمر أو صاعا من شعير".
“রাসূল (স.) যাকাতুল ফিতর হিসেবে এক সা’ খেজুর বা এক সা’ যব নির্ধারণ করেছেন”। (বুখারী, মুসলিম)।
খ.হযরত আবু সায়ীদ খুদরী (রা.) বলেন:
كنا نعطيها في زمان النبي صلى الله عليه وسلم صاعا من طعام أو صاعا من تمر أو صاعا من شعير أو صاعا من زبيب
“আমরা নবীর (স.) যুগে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা’ খাবার অথবা এক সা’ যব অথবা এক সা’ খেজুর অথবা এক সা’ পনির অথবা এক সা’ কিসমিস দিয়ে।” (বুখারী)।
অন্য বর্ণনায় রয়েছে:
وكان طعامنا يومئذ التمر والشعير، والزبيب والأقط‏
“তখন আমাদের খাবার ছিলো, খেজুর, যব, কিসমিস ও পনির”।
২. হযরত ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন:
فرض رسول الله صلّى الله عليه وسلم زكاة الفطر، طهرة للصائم من اللغو والرفث، وطعمة للمساكين
“রাসুলুল্লাহ (স.) যাকাতুল ফিতর ফরয/নির্ধরণ করেছেন যেন রোযাদার রোজাবস্থায় সংঘটিত সিয়াম পরিপন্থী) অনর্থক-অশ্লীল কথা-কর্ম থেকে পবিত্র হতে পারে এবং গরিব-মিসকিনরাও (প্রয়োজনীয়) খাবারসামগ্রী লাভ করতে পারে”। (আবু দাউদ,হাকিম)।
প্রতিপাদন পদ্ধতি:
فإذا كان النبي صلى الله عليه وسلم فرضها طعمة للمساكين، فإن الدراهم لا تطعم،
অত্র হাদীসে খাবারের কথা বলা হয়েছে। আর এ কথা কারো অজানা নয় যে, টাকা-পয়সা খাওয়া যায় না। অতএব, খাদ্যসামগ্রী দিয়েই ফিতরা আদায় করতে হবে।

দুই. দ্বিতীয় মতের প্রমাণাদি:

এই অভিমতের প্রবক্তাগণ কুরআন, সুন্নাহ, আছার (সাহাবী ও তাবেয়ীদের কথা-কর্ম) ও বুদ্ধিবৃত্তিক দলীল দিয়ে প্রমাণাদি পেশ করেছেন। নিম্নে এগুলো দেয়া হলো:

ক. কুরআন থেকে প্রমাণ:
আল্লাহর বাণী: خذ من أموالهم صدقة “হে নবী! তুমি তাদের সম্পদ থেকে সাদাকাহ গ্রহণ করো” (সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১০৩)।
এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, إن الأصل في الصدقة المالসাদাকাতের ব্যাপারে মূল বিষয়টি হলো, মাল বা সম্পদ। এ দৃষ্টিতে খাদ্যদ্রব্য যেমন সম্পদ, মূল্যটাও সম্পদ। তাই মূল্য দিয়েও যাকাত দেয়া যাবে।

খ. হাদীস থেকে প্রমাণ:

১. ইবনু ‘উমর (রা.) বলেন:
فرض رسول الله صلى الله عليه وسلم زكاة الفطر ، وقال : أغنوهم في هذا اليوم
“রাসূল (স.) যাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন এবং বলেছেন: “আজ গরিব-দুঃস্থদের অভাব মিটিয়ে দাও”। অর্থাৎ আজ ঈদের দিনেও যেন ওদেরকে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরতে না হয়, সে ব্যবস্থা করে দাও”। (আদদারু কুতনী)। অন্য বর্ণনায় আছে বয়েছে: أغنوهم عن الطواف في هذا اليوم (আদদারুকুতনী, বায়হাকী, হাকিম ও ইবনু আদি ফিল কামিল,)। অবশ্য এই হাদীসের সনদের মধ্যে أبي معشر নামক রাবীর কারণে দুর্বলতা আছে। তবে ইবনু সাআদ তার তাবাকাতের মধ্যে আরেকটি সূত্র থেকেও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। যেটিকে এই হাদীসের شاهد শাহেদ বলা যায়।
প্রতিপাদন পদ্ধতি: এ প্রসঙ্গে আল-মাসবূত গ্রন্থকার বলেন:
لأن المعتبر حصول الغنى. وذلك يحصل بالقيمة كما يحصل بالحنطة
“এখানে মূল ধর্তব্য হচ্ছে, স্বচ্ছলতা অর্জিত হওয়া। আর তা গম, যব ইত্যাদি দ্বারা যেমন অর্জিত হয়, মূল্য/টাকা-পয়সা দিয়েও অর্জিত হয়।
২. রাসূল (স.) মু‘আজকে যাকাত উত্তোলন ও অন্যান্য দায়িত্ব দিয়ে ইয়েমেনে পাঠিয়েছিলেন। তিনি ইয়েমেনে গিয়ে যব, খেজুর ইত্যাদির পরিবর্তে জামা-কাপড় যাকাত/সাদাকাত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। যেমনটি ইমাম বুখারী মুআল্লাক সনদে বর্ণনা করেছেন:

وقال طاووس قال معاذ –رضي الله عنه- لأهل اليمن: ائتوني بعرْض ثيابٍ خميص أو لبيس في الصدقة مكان الشعير والذرة، أهونُ عليكم وخيرٌ لأصحاب النبي صلى الله عليه وسلم
“তাউস বলছেন যে, মুআজ (রা.) ইয়েমেনবাসীদেরকে বলেছিলেন: “ তোমরা যব, ভূট্টা ইত্যাদির পরিবর্তে জামা-কাপড় প্রদান করো। এটিই তোমাদের জন্য সহজ এবং রাসূল (স.) এর সাহাবীদের জন্য উত্তম”।
এই হাদীসে মুআজ (রা.) যে যাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে মূল্য বিবেচনা করেছেন,তা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। এটি রাসূলের (স.) যুগেরই ঘটনা। তাহলে বোঝা গেল, মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে যাকাত প্রদান রাসূল (স.) কর্তৃক অনুমোদিত।
৩. রাসূল (স.) নারীদেরকে বলেছিলেন:
تصدقن ولو من حليكنّ
“তোমরা সাদাকাত দাও, যদিও তা হয় তোমাদের অলংকারাদি দ্বারা”।
ইমাম বুখারী এ প্রসঙ্গে বলছেন,
فلم يستثن صدقة الفطر من غيرها فجعلت المرأة تلقي خرصها و سخابها.
“এ ক্ষেত্রে রাসূল (স.) সাদাকাতুল ফিতরকে অন্যান্য যাকাত থেকে আলাদা করেন নি। এ কথা বলার পরে মহিলারা তাদের কানের ও গলার অলংকারাদি ছুঁড়ে মারতে লাগলো।”

৪. হযরত আনাস (রা.) থেকে বণিত,
أن أبا بكر -رضي الله عنه- كتب له التي أمر الله رسوله صلى الله عليه وسلم: ومن بلغت صدقته بنت مخاض وليست عنده وعنده بنت لبون فإنها تقبل منه ويعطيه المصدِّق عشرين درهمًا أو شاتين، فإن لم يكن عنده بنت مخاض على وجهها وعنده ابن لبون فإنه يقبل منه وليس معه شيء
আবু বকর (রা.) তাঁর কাছে আল্লাহ তাঁর রাসূল (স.) কে যাকাত সম্পর্কে যে বিধান দিয়েছেন, তা লিখে পাঠান: “যে ব্যক্তির উটের যাকাত হিসেবে বিনতে মাখাদ (যে উটের এক বছর পূর্ণ হয়েছে) ফরয হয়েছে, অথচ তাঁর কাছে তা নেই, তার কাছে আছে বিনতু লাবুন (যে উটের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে), তখন তা তাঁর কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে। আর যাকাত উসূলকারী (ক্ষতিপূরণ স্বরূপ) মালিককে বিশটি দিরহাম বা দুটি বকরী দিবে।
وجه الدلالة: هذا الحديث صريح في جواز أخذ القيمة بدلاً من الواجب. وإذا ثبت جواز أخذ القيمة في الزكاة المفروضة في الأعيان فجوازها في الزكاة المفروضة على الرقاب من باب أولى.
এই হাদীস থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, মূল্য দিয়েও যাকাত দেয়া যায়। সম্পদের ফরয যাকাতের ক্ষেত্রে যদি মূল্য গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে সাদাকাতুল ফিতরের ব্যাপারে মূল্য গ্রহণ না করার তো কোন প্রশ্নই আসে না।


গ. আছার থেকে প্রমাণ الأدلة من الآثار :
১.
ذهب كثير من الصحابة بل أكثرهم في عهد معاوية إلى جواز إخراج نصف صاع من سمراء الشام بدلاً من صاع من تمر ، فهذا دليل على أنهم يرون نصف الصاع معادلاً في القيمة للصاع من التمر أو الشعير ونحو ذلك
অনেক সাহাবী বিশেষ করে মুয়াবিয়া (রা.) যুগে এক সা’ খেজুরের পরিবর্তে শামের গম থেকে অর্ধ সা’ আদায় করেছিলেন। কারণ, মূল্যের বিবেচনায় অর্ধ সা’ সামরাহ এক সা’ খেজুরের সমান ছিলে। অতএব, মূল্য দিয়ে যাকাতুল ফিতর আদায় করা বৈধ। যেমনটি আবু সায়ীদ খুদরীর বর্ণিত হাদীসেই বলা হয়েছে:
فلما جاء معاوية وجاءت السمراء قال أرى مدا من هذا يعدل مدين
অতঃপর যখন মু‘আবিয়া আসলেন এবং শাম থেকে সামরাহ (গম) আসলো, তিনি বললেন, আমার মনে হয় সিরিয়ার গম থেকে এক মুদ (মূল্যের দিক থেকে) দুই মুদের সমান। (তাই সামরাহ দিয়ে যাকাত আদায় করলে অর্ধ সা’ দিলেই চলবে)।
অন্য বর্ণনায় রয়েছে:
" إني لأرى مدين من سمراء الشام تعدل صاعاً من تمر "
“আমার মনে হয়, শামের দুই মুদ (অর্ধ সা’) গম এক সা’ খেজুরের সমান”। (অর্থাৎ মূল্য বিবেচনায়)।

২. হযরত ‘উমার বিন আব্দুল আযীযের যুগেও মূল্য প্রদানের মাধ্যমে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা হতো। ইবনু আবি শাইবাহ তাঁর মুসান্নিফের মধ্যে এ মর্মে একাধিক বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।
ক.
عن قرة قال: جاءنا كتاب عمر بن عبد العزيز: "في صدقة الفطر نصف صاع عن كل إنسان أو قيمته نصف درهم
হযরত কুররাহ বলছেন, আমাদের কাছে এই মর্মে ‘উমার বিন আব্দুল আযীযের পত্র এসেছিলো যে, আমরা যেন প্রত্যেক ব্যক্তির সাদাকাতুল ফিতর আদায় করি অর্ধ সা’ কিংবা তার মূল্য র্অধ দিরহাম দিয়ে।
খ.
وكتب - رحمه الله - إلى عامله في البصرة: أن يأخذ من أهل الديون من أعطياتهم من كل إنسان نصف درهم
‘উমার বিন আব্দুল আযীয বসরায় তাঁর গভর্ণরকে আদেশ করেছিলেন, তিনি যেন (সদাকাতুল ফিতরার জন্য ) রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের বেতন থেকে অর্ধ দিরহাম করে গ্রহণ করেন।
তাহলে বোঝা গেল,
وكان هذا الفعل منه وأصحاب رسول الله متوافرون، فلم يعلم عن أحد الاعتراض سراً أو جهراً.

সাহাবী ও তাবেয়ীদের যুগে মূল্য দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা হতো। কিন্তু কেউ এর বিরোধীতা করেছেন, এমন কোন প্রমাণ নেই।
৩. প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ইমাম আবু ইসহাক আস-সাবীঈ الإمام أبو إسحاق السبيعي বলেন:
وأدركتهم وهم يؤدون القيمة في زكاة الفطر
“আমি তাদেরকে মূল্য দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে পেয়েছি” (ইবুন আবি শাইবাহ)।
আবু ইসহাক মধ্যম স্তরের একজন তাবেয়ী। তিনি আলী (রা.) সহ অন্যান্য অনেক সাহাবীকে পেয়েছিলেন। তাদেরকে বলতে তিনি সাহাবীদেরকে বুঝিয়েছেন। অতএব, প্রমাণিত হলো, এটি সাহাবীদের আমল ছিলো।

৪. প্রসিদ্ধ তাবেয়ী আল-হাসানুল বাসরী বলেন:
"لا بأس أن تعطى الدراهم في صدقة الفطر".
“দিরহাম দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করায় কোন অসুবিধা নেই” (ইবনু আবি শাইবাহ)।


ঘ. বুদ্ধিবৃত্তিক দলীলাদি:
১.
أنه لم يثبت عن النبي ـ صلى الله عليه وسلم ـ ولا عن أحد من الصحابة نص في تحريم دفع القيمة .
“সাদাকাতুল ফিতর মূল্য দ্বারা পরিশোধ করা যাবে না” এমন কোন কথা/ নস না রাসূল (স.) থেকে না কোন সাহাবী থেকে প্রমাণিত হয়েছে।
২.
الأحاديث الواردة في النص على أصناف معينة من الطعام لا تفيد تحريم ما عداها، بدليل أن الصحابةـ رضي الله عنهم ـ أجازوا إخراج القمح - وهو غير منصوص عليه - عن الشعير والتمر ونحو ذلك من الأصناف الواردة في الأحاديث الصحيحة .
হাদীসে নির্দিষ্ট খাদ্যপণ্য উল্লেখ করার দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় না যে, এ গুলো ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে ফিতর আদায় করা যাবে না। কারণ, সাহাবীগণ (القمح)গম দ্বারা যাকাতুল ফিতর আদায় করার অনুমতি দিয়েছেন। অথচ গমের নাম কোন হাদীসে উল্লেখ নেই।
৩.
إن كثرة الطعام تحوجه إلى بيعه بأقل الأثمان للحصول على المال، والقيمة تمكنه من شراء ما يلزمه من الأطعمة والملابس وسائر الحاجات.
যদি শুধু মাত্র পণ্য দিয়েই যাকাতুল ফিতর আদায় করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে, অধিকাংশ ফকীর তা বাজারে বিক্রয় করে দেবে। কারণ এত খেজুর, যব, গম ইত্যাদি তার প্রয়োজন নেই। ফলাফল দাঁড়াবে, না সে খাদ্য দ্বারা উপকৃত হতে পারবে, না সে পণ্যের সমান মূল্য পাবে। বরং বিক্রয় করতে গেলে সে পাবে অনেক কম মূল্য। ফলে এখানে গরীবই হবে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থ। পক্ষান্তরে, তাকে মূল্য দিয়ে দেয়া হলে সে তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সুবিধামত ক্রয় করে নিতে পারবে।
৪. পণ্যের যাকাতের উপর কিয়াস:
ولأنه مال زكوي فجازت قيمته كعروض التجارة
যাকাতুল ফিতরতো প্রকৃতার্থে যাকাতের মাল। তাই ব্যবসায়িক পণ্যের যাকাত যেমন মূল্য নির্ধারণ পূর্বক অর্থ দিয়ে প্রদান করা হয়, তেমনিভাবে যাকাতুল ফিতরও মূল্য দিয়ে দেয়া যাবে।
৫.
ولأن القيمة مال فأشبهت المنصوص عليه
তাছাড়া, হাদীসের মধ্যে যে সব খাদ্যদ্রব্যের উল্লেখ আছে সেগুলো যেমন মাল/সম্পদ, তদ্রƒপ মূল্য/টাকাও তো মাল সম্পদ। তাই মূল্য দিয়েও দেয়ায় কোন বাধা নেই।
৬.
ولأنه لما جاز العدول عن العين إلى الجنس بالإجماع بأن يخرج زكاة غنمه من غنم غيرها جاز العدول من جنس إلى جنس
যেই ছাগলগুলোর উপর যাকাত ফরয হয়, ঐ নির্দিষ্ট ছাগল থেকে যাকাত না দিয়ে যদি অন্য ছাগল দিয়ে যাকাত দেয়া হয়, তাহলে তা আদায় হয়ে যায়। অতএব, নির্দিষ্ট বস্তুর পরিবর্তে যেমন ঐ জাতীয় বস্তু গ্রহণ করায় আপত্তি নেই, তদ্রƒপ এক প্রকার (খাদ্যদ্রব্য) থেকে অন্য প্রকারে (মূল্যে) স্থানান্তর হওয়াতেও কোন বাধা থাকতে পারে না।
৭.
إن سكوت النبي ـ صلى الله عليه وسلم ـ عن أدائها بالقيمة دليل على جوازها.
মূল্য দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের ব্যাপারে রাসূল (স.) এর নীরবতাই প্রমাণ করে এটা বৈধ/জায়েজ।
৮. যে সব হাদীস দ্বারা সাদাকাতুল ফিতরকে খাদ্যপণ্যের মধ্যে সীমিত রাখার প্রমাণ দিয়েছেন প্রথম মতে বক্তাগণ (كلها أحاديث فعلية، وليست قولية.
) সবগুলো ফেলী হাদীস। একটিও কওলী হাদীস নেই।
৯. দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার বিষয়টিকে তা‘আব্বুদী বিষয় বলা ঠিক নয়; বরং এটা হচ্ছে মাসলাহী বিষয় । যা সুস্পষ্ট।
১০. যারা দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে যাকাতুল ফিতর আদায়ের কথা বলেছেন, তাদের কাছে হাদীসে বর্ণিত বস্তুগুলো ছাড়াও যে কোন এলাকার غالب قوت البلد প্রধান খাদ্য দিয়ে আদায় করলে যাকাতুল ফিতর আদায় হবে। এখানেও কিন্তু মূল্যকেই বিবেচনা করা হয়েছে।
১১. হাদীসের মধ্যে শুধুমাত্র খাদ্রসামগ্রীর কথা উল্লেখ করার কয়েকটি কারণ হতে পারে:
ক.
ندرة النقود عند العرب في ذلك الحين، فكان إعطاء الطعام أيسر على الناس.
ঐ সময় আরবদের কাছে মুদ্রা ছিলো দুষ্প্রাপ্য বিষয়। তাই খাদ্যদ্রব্য দিয়ে সাদাকাতুল ফিতরা প্রদান করাটা সহজ ছিলো।
খ.
أن قيمة النقود تختلف وتتغير قوتها الشرائية من عصر إلى عصر، بخلاف الصاع من الطعام .
“মুদ্রার মূল্যমান ও ক্রয় ক্ষমতা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পরিবর্তিত হয়ে যায়। কিন্তু সা’র পরমাণে কোন পরিবর্তন আসে না। এজন্য সা’কে চিরস্থায়ী নিসার হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। যাকাতের নিসাবের মত।
গ.
كما أن الطعام كان في ذلك العهد أيسر على المعطي، وأنفع للأخذ.
খাবার প্রদান করা ঐ যুগে দাতার জন্য যেমন সহজ ছিলো, গ্রহীতার জন্যও তেমন অধিক সুবিধা/কল্যাণকর ছিলো।
ঘ. তাদের অধিকাংশ ক্রয়-বিক্রয় হতো এই সব পণ্য দিয়ে যে গুলো হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। মূদ্রার প্রচলন কম থাকায় তখন ছিলো পণ্যের বিনিময়ে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবস্থা। তাই সহজার্থে রাসূল (স.) তাদের জন্য খাদ্যদ্রব্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
মূল্য দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের বিষয়টি ইমাম বুখারীও প্রাধান্য দিয়েছেন। ইমাম কুরতুবীও এই মতটিকে গ্রহণ করেছেন। তিনি যাকাতের মাসারিফ/খাতসমূহের তাফসীর প্রসঙ্গে (أَغنوهم عن السؤال في هذا اليوم) (তাদের কে আজকের এই দিনে অভাবমুক্ত করে দাও) এই হাদীসটি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন:
وإنما أراد أن يغنوا بما يسد حاجتهم، فأَي شيء سد حاجتهم جاز، قال تعالى: "خذ من أموالهم صدقة"، فلم يخص شيئا من شيء.
“এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, তাদের প্রয়োজন পূরণ করে দেয়া। অতএব, যা কিছু দিয়ে তাদের প্রয়োজন পূর্ণ হয় তই জায়েজ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তুমি তাদের সম্পদ থেকে সাদাকাহ নাও” । এতে আল্লাহ কোন বস্তু থেকে কোন বস্তুকে বিশেষভাবে আলাদা করে বলেন নি”।
ইবনু আবি শাইবাহও এই মত গ্রহণ করেছেন। এ জন্যই তিনি তার কিতাবে শিরোণাম দিয়েছেন এভাবে: باب في إعطاء الدراهم في زكاة الفطر “দিরহাম দিয়ে যাকাতুল ফিতর প্রদান অধ্যায়”।

উপসংহার:
ইসলামী শরীয়াহর সবটুকুই হচ্ছে মানুষের কল্যাণ বা মাসলাহাহ। সেটা হোক مصلحة محضة অথবা مصلحة راجحة । সাদাকাতুল ফিতরের বিষয়টিও এর বাহিরে নয়। তাই এখানে দেখা উচিত কীসে গরিবের কল্যাণ নিহীত। এটি আপেক্ষিক বিষয়। কখনো কল্যাণ নিহীত থাকতে পারে খাদ্যদ্রব্য প্রদানে। যেমন, ধরুন যে সব এলাকায় খাদ্য সংকট চলছে। আবার কখনো তার কল্যাণ থাকতে পারে মূল্য প্রদানে। যেমন, আমাদের দেশের বাস্তবতা। এখানে মানুষ খাদ্যদ্রব্যে চেয়ে মূল্য পেতেই বেশী আগ্রহী। কারণ, এর দ্বারাই সে তার নানাবিধ প্রয়োজন পূর্ণ করতে পারে অতি সহজে। রাসূল (স.) এই কল্যাণের কথা চিন্তা করেই সেই সময়ে সহজ পদ্ধতি বলে দিয়েছিলেন। তাই আমরা শেষপ্রান্তে এসে বলতে পারি, যে স্থানে যেভাবে সুবিধা ও অধিকতর কল্যাণের সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে সেভাবেই আদায় করা যাবে। তা হতে পারে হাদীসে বর্ণিত খাদ্যদ্রব্যগুলো অথবা তার সমপরিমাণ মূল্য। ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ এটিকেই প্রয়োজন বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক জ্ঞান দান করুন।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমিও যাবো একটু দূরে !!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২২

আমিও যাবো একটু দূরে
যদিও নই ভবঘুরে
তবুও যাবো
একটু খানি অবসরে।
ব্যস্ততা মোর থাকবে ঠিকই
বদলাবে শুধু কর্ম প্রকৃতি
প্রয়োজনে করতে হয়
স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে
তবেই যদি মুক্তি মেলে
সফলতা তো সবাই চায়
সফল হবার একই উপায়।
রসুলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×