অতঃপর জনহিতৈষী শুভাকাঙ্খিদের দল আর থাকিতে পারিল না। এই যথার্থ মাহেন্দ্রক্ষনে, যা কিনা পুঁথি পঞ্জিকার নির্ভুল হিসাবে এই ক্ষুদ্র নশ্বর জীবনে একবারই আসে, সেই সময়ে কিনা কন্যার পিতৃশ্বরের এহেন নির্বিকার কালক্ষেপন! তাহারা সকাতরে মাথা দুলাইয়া এমন নির্বুদ্ধিতার তিরস্কার করিতে করিতে অতি বিজ্ঞ ভাব লইয়া দরবারে উপস্থিত হইলেন।
কহিলেন, “মহারাজ, যদি আজ্ঞা হয়, তবে একখানা প্রস্তাব ছিল।“
- নির্ভয়ে কও।
- আমাদের কন্যা রাজেশ্বরী যথাযথ যৌবনাপ্রাপ্ত হইয়াছে। রূপে, গুণে, সৌহার্দ্যে তাহার জুড়ি মেলা ভার। বলি কি, এইবার তাহার জন্য একজন যোগ্য মনিহার পাত্র সন্ধান করিবার সময় আসিয়াছে। কালবিলম্ব অনুচিত!
মহারাজ অত্যন্ত চিন্তাসম্বলিত চেহারায় লাল চক্ষু রগরাইয়া, মাথার টোপর খানিকটা নাড়াইয়া কহিলেন, “বটে! তা, রাজেশ্বরীর শিক্ষা কতদুর সম্পন্ন হইয়াছে?”
- খোঁজ লইয়া জানিলাম, তোতালয় শিক্ষাভোজনালয় হইতে তিনি সম্মানের সহিত পক্ষি-দর্শন শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করিয়াছেন। আজকাল অবশ্যি উনার কথাবার্তা, চিন্তাধারায়ও তাহার প্রকাশ্য প্রমান পাওয়া যাইতেছে। মুখস্ত বুলির মতন সারাক্ষন এমনও দুর্বোধ্য লাইন আওড়ায় যাহা কিনা আমাদের মতন বিজ্ঞ রাজপন্ডিতদেরও বোধগম্য হয়না।
- খাসা। আমাদের কন্যা তবে যথার্থ শিক্ষাই পাইয়াছে। অতঃপর, সে কি করিতে ইচ্ছুক?”
- আজ্ঞে, সে কি কথা! বলি, দর্শন শিক্ষা তো অনেক হইল। এইবার কিনা কিঞ্চিত বাস্তব শিক্ষাও হউক। শাস্ত্রে বলে, সংসার ধর্মই নারীর বড় ধর্ম।
- বটে। খাসা বলেছ। সমস্ত পক্ষীরাজ্যে ঢাকঢোল পিটাইয়া তবে জানাইয়া দাও, আমাদের রাজকন্যা রাজেশ্বরী, যাহার তুলনা পক্ষীকুলে অপ্রতুল, তাহার জন্য যোগ্য, পুরুষোত্তম, অপ্রতুলতর পাত্র বিচরন করা হউক।
**
- মহারাজ, বলিতেই হয়, আমাদের রাজকন্যার উপর ভাগ্যদেবী যথেষ্টই প্রসন্ন। নইলে, বরগুনে পাণি গ্রহনেচ্ছুক হবুবরদের সংখ্যা যে ফর্দ ছাড়াইয়া যাইতেছে!
- আপ্লিকেশন কটা পড়িয়াছে? পাত্রদের গুনপরিচয়, বংশবিচার করিয়া এর মধ্যে সবচাইতে উপযুক্তকেই মনঃপুত বলিয়া বিবেচিত হইবে।দরকার হইলে রাজ্যজুড়ে এসেমেস এর মাধ্যমে ভোটিং ব্যবস্থাও করিব।
- আজ্ঞে হুজুর, এই যে পত্রপটে পাত্রের পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবিটি দেখিতেছেন, এ হল পক্ষিকুলের সম্ভ্রান্ত রয়্যালখেচর পরিবারের বিবাহোপযোগী একমাত্র পুত্র। আহা! কি সুদর্শন গড়ন, কি সুকুমার ভঙ্গি! সুবিন্যন্ত পালকগুচ্ছ, সুগম্ভীর ন্যাজ ! একেই না বলে রাজপাত্র।
- আত্মনাং সংবরনং, রাজপন্ডিত। পাত্রের গুন-পরিচয় বাতলাও।
- আজ্ঞে, পাত্র সদ্য বিলাত ফেরত, অত্যন্ত সুশিক্ষিত। সেখানে নাকি কোন এক মনুষ্য বিদ্যালয়ের ব্যালকনির খাঁজে বসিয়া প্রত্যহ মনোযোগ দিয়া বুলি শ্রবন করিতে করিতে তিনি শ্রবনবিদ্যার উপর পিএইচডি করিয়া ফেলেন। কিন্তু, যতদুর শুনি, কোনো সার্টিফিকেট…
- পন্ডিরাম, আমি আর কিছুই শুনিতে চাইনা। কন্যার রানীমাতার বড় শখ, জামাই বিলাত-ফেরতই হইতে হইবে। তাহার শিষের সুরও যেন হইবে আংরেজী। এমন পাত্র তো কুঁড়িদিন দেবদারু গাছে তপস্যা করিয়াও মেলেনা। অতিসত্তর পত্র মারফত পাত্রকে তালাশ করিয়া আশু বিবাহ সম্পন্নের বন্দোবস্ত্ করিতে বল। পক্ষীকুঞ্জতে রাজ্যের সক্কলকে নেমন্তন করো।এমন আনোন্দোৎসবের আয়োজন করো যা কেউ কোনদিন দেখেনি…।
**
রাজদূত এক অদ্ভুত সংবাদ নিয়া আসিল। রাজকন্যা রাজেশ্বরী নাকি আর সেই আগের মতটি নেই। রাজদরবারের সবাই অতি আগ্রহ নিয়া জানতে চাহিল তাহাদের অভিজ্ঞ পরামর্শ বরাবরের মতই সুফলে গেলো কিনা। রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, “হ্যা রে, সে কি আর আগের মতন গান গায়?”
- না, হুজুর।
- বেশ। বেশ। তা, আগের মতন যেখানে সেখানে নেচে বেড়ায়?
- জ্বী, না।
- খেলা করে?
- না।
- অদ্ভুত বুলি আওড়ায়?
- আজ্ঞে, না।
“উত্তম! উত্তম!” রাজা অত্যন্ত সুপ্রসন্ন হইয়া নিজের গজমতির মালাটি খুলিয়া দিয়া আজ্ঞা করিলেন, কন্যাকে দেখিতে যাইবেন।
**
অতঃপর, রাজা আসিল। মন্ত্রী আসিল। রাজপন্ডিতগন আসিল, পাইক-পেয়াদা আসিল। রয়্যালখেচরের একমাত্র পুত্র বিলাত-ফেরত জামাই যথাযথ অভ্যর্থনা জানাইয়া পেখম উচাঁইয়া কহিলেন, “ওই যে!”
সবাই দেখিল, রাজকন্যা পড়িয়া আছে চুপচাপ। তাহার অভিলাষী দৃষ্টি আকাশ খোঁজে না। তাহার দর্শনবিদ্যা যেন লজ্জিত হইয়া বিশাল এক প্রশ্নবোধক রূপে ক্ষণকালের জন্য ঝুলিয়া রহিল।
রাজা খানিকটা অপ্রস্তুত হইয়া সামলাইয়া নিয়া কহিলেন, “খাসা! রাজপক্ষীর জীবন তবে যথার্থই সম্পুর্ন হইয়াছে!”
***
পাখিসব করে রব, রাতি পোহাইলো;
একটি কুসুম-কলি অকালে ঝড়িলো।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৩:৫৭