চক্র
বুড়োদের ঘর
আমার অনটনের সংসারে কোনোদিনই স্ত্রী ও সন্তানদের শখ মেটাতে পারি নি। মাসের শুরুতে যে বেতন পাই, মা-বাবার ওষুদের খরচ আর মাস-কাবারি খোরাকি দেয়ার পর যা থাকে তা দিয়ে খুব কষ্টে মাসের তিন সপ্তাহ পার করি, বাকি দিনগুলো ধারদেনায় চলে।
এজন্য স্ত্রীর অসন্তোষ আমাকে নীরবে মেনে নিতে হয়। বড় ছেলেকে টিফিনের খরচ এতোটাই মেপে দিতে হয় যে, সে কোনোদিন বন্ধুদের ‘ট্রিট’ করতে পারে না, আর বন্ধুরাও কোনোদিন রিটার্ন ট্রিট না পাওয়াতে ওকে আর কোনো পার্টিতেই ডাকে না। ওর এই লজ্জা আর অপমানের কথা মনে হলে আমার চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে পড়ে।
ছোটো ছেলেটা একদিন স্কুলে অন্য এক বাচ্চাকে সিল্ক ক্যাটবেরি চকোলেট খেতে দেখেছিল। ওর খুব লোভ হয়েছিল। এক টুকরো চকোলেট চেয়েও সে পায় নি। ফ্লোরে চকোলেটের খোসা পড়ে থাকলে সেটি সে কুড়িয়ে নেয় এবং খোসা চাটতে চাটতে বাড়িতে এসেছিল। ছোটো ছেলের এ ঘটনায় আমি আর আমার স্ত্রীর বুক ভেঙে গিয়েছিল।
বড় ছেলের একদিন খুব ক্রোধ হলো। সে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘তুমি বাড়িতে টাকা দাও কেন? আর দিবে না, বুঝেছ? ঐ টাকা দিয়ে আমাদেরকে আরেকটু সুখে রাখবে।’
আমরা খুব কষ্টে কিছু টাকা জমিয়ে ছোটো ছেলের জন্য একদিন একটা সিল্ক ক্যাটবেরি চকোলেট কিনে আনলাম। সে মহাউল্লাসে সেটি খেলো, তার কয়েকজন বন্ধুকে দিল, ভাইয়া আর আপুকে দিল, এবং আমাকে আর তার মাকেও কিছু না দিয়ে পারলো না।
স্ত্রী একদিন ক্ষোভ করে বলছিল, ‘বাড়িতে কি কিছু টাকা কম দেয়া যায় না?’
ছোটো ছেলে কীভাবে যেন কথাটা ধরে ফেলে। বললো, ‘আব্বু, তুমি তোমার বাবাকে টাকা দাও কেন?’
আমি হেসে ফেলি। তাকে বুকে জড়িয়ে বলি, ‘তোমাকে ক্যাটবেরি চকোলেট কে কিনে দিল, বলো তো?’
‘তুমি।’ সে ঝটপট উত্তর দেয়। আমি বলি, ‘তাহলে বলো তো, আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন কে আমাকে লজেন্স কিনে দিত?’
এবারও সে প্রশ্ন শেষ হবার আগেই জবাব দিয়ে ফেললো, ‘তোমার বাবা।’ তারপর সে হাসতে থাকে, আমি তার মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে থাকি।
...
আমার বৃদ্ধ মা-বাবা বেহেশ্তবাসী হয়েছেন অনেক বছর। আমি আর আমার স্ত্রী আমার মা-বাবার পুরোনো বাড়িটাতে থাকি। ছেলেমেয়েরা অনেক বড় হয়েছে। কিছুদিন পর পর ওরা বাড়িতে আসে।
ওরা আমাদের কোনো খারাপ গুণ পায় নি। ওরা যখন বাড়িতে আসে, সঙ্গে ওদের বউয়েরা আর ছেলেমেয়েরাও আসে। তখন আমার বাড়িতে চাঁদের হাট বসে। নাতি-নাতনিগুলো আমাদের গলা জড়িয়ে পড়ে থাকে। বাড়ি থেকে যাবার সময় আমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যেতে মা-বাবার সাথে তীব্র মর্জি করতে থাকে।
কিন্তু ওরা জানে, আমরা আমার মা-বাবার ঘর ছেড়ে কোত্থাও যাব না। আর আমরাও দৃঢ়ভাবে জানি, একদিন ওরাও এই বুড়োদের ঘরেই ফিরে আসবে।
বেঁচে থেকো, আমার সোনার প্রতিমারা, সুখে থেকো।
৮ আগস্ট ২০১৪