somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন সদাশয় লেখক ও তাঁর ভক্ত পাঠকের কথা

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আফতাব আলি সাহেব এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কিরণ মিয়া খুব ব্যথিত। সে আফতাব আলি সাহেবের অধীনস্থ একজন সাধারণ গ্রেডের কর্মচারি। বসের আকস্মিক দুর্ঘটনায় হাসপাতালে থেকে সে যথাসাধ্য সেবাশুশ্রূষা করছে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে-বসে আফতাব আলি সাহেবের সময় কাটে, তাঁর নিঃসঙ্গ বার্ধক্যে কিরণ মিয়াই একমাত্র সেবাদাস হলেও অভিজাত বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা তেমনই, সচরাচর একজন নামডাকঅলা লেখকের যেমন হয়ে থাকে। বন্ধুরা এসে ফুলের তোড়া সমেত শুভেচ্ছা ও আশু রোগমুক্তি কামনা করেন। কিরণ মিয়া বসের পাশে ফুলের তোড়া গুছিয়ে সুসজ্জিত করে।

আফতাব আলি সাহেব একজন অতি নামকরা লেখক না হলেও উচ্চ শ্রেণীর পাঠকগণের কাছে তিনি সুনামের তুলনায় অনেক বেশি সমাদৃত। সুগভীর বাক্‌রীতি ও রচনাশৈলীতে সমৃদ্ধ তাঁর গ্রন্থসম্ভার; সর্বসাধারণকে এসবের মর্মোদ্ধারে প্রচুর বেগ পেতে হয়। এ নিয়ে তাঁর একটুখানি চাপা অহংকারও আছে। তবে, তাঁর লেখালেখি সম্পর্কে কেউ তাঁর সাথে আলাপ-আলোচনা করলে তিনি বেজায় সন্তুষ্ট হোন। তাঁর রচনার বিষয়বস্তু সর্বদাই দরিদ্র জনগোষ্ঠী, তাদের জীবনযাপন প্রণালি, সুখদুঃখ, ইত্যাদি। তিনি ‘গরীবের বন্ধু’ খ্যাতি-প্রত্যাশী; এই খ্যাতি তাঁর জুটেছেও বেশ।
আফতাব আলি সাহেব একজন নামকরা এবং দক্ষ কর্মকর্তাও বটে। তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে যতোদিন বেঁচে থাকবেন, দাপ্তরিক কর্মদক্ষতার জন্য কলিগদের মাঝে বরং আরো কিছুদিন বেশি বাঁচবেন।

অফিসে কাজের ফাঁকে, কিংবা কাজের মধ্যে আফতাব আলি সাহেবের সাথে কিরণ মিয়ার মাঝে মাঝেই দেখাসাক্ষাৎ ঘটে; কখনোবা ক্যান্টিনে একত্রে চা-নাস্তাও চলে। অধীনস্থদের সাথে ইন্টার-এ্যাকশনের একটা ভালো জায়গা এটা।
আফতাব আলি সাহেবের গল্প পড়ে স্বল্পবুদ্ধি কিরণ মিয়া খুব মুগ্ধ। চা খেতে খেতে সে তাঁর সর্বশেষ বইটির প্রসঙ্গ তোলে।
‘আপনার বইটি কিন্তু অসাধারণ হয়েছে, স্যার।’
আফতাব সাহেবের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়। ‘আপনি পড়েছেন নাকি বইটা?’ তিনি জিজ্ঞাসা করেন।
‘আমি আপনার বইয়ের একজন নিয়মিত পাঠক, স্যার। প্রকাশ হবার সাথে সাথেই কিনে ফেলি।’ কিরণ মিয়া গর্বের সাথে বলে। আফতাব আলি সাহেব চমৎকৃত হোন। তাঁর নিজ অফিসের একজন কর্মচারি তাঁর বইয়ের নিয়মিত পাঠক, এটা তাঁর জন্য অনেক আনন্দের। কিরণ মিয়াকে তাঁর খুব ভালো লাগে।
একটু সুস্থ হয়ে উঠলে আফতাব আলি সাহেব পুরোদমে লিখতে শুরু করলেন। ডাক্তারগণের বিনীত নিষেধ উপেক্ষা করে তিনি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখতে থাকেন; লিখা হলে তাঁর ভক্ত এবং অনুগত ‘ভৃত্য’কে তা পড়তে দেন। কিরণ মিয়া গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ে, মুগ্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। প্রতিদানে বস তাকে ধন্যবাদসহ কৃতজ্ঞতা জানান, এবং কিরণ মিয়ার মতো একজন স্বল্প শিক্ষিত পাঠক তাঁর লেখার ‘মেসেজ’ অনুধাবনে সক্ষম হয় বলে তিনি তার বুদ্ধিমত্তা ও সাহিত্য-জ্ঞানের খুব তারিফ করেন। এতে কিরণ মিয়া উৎসাহিত বোধ করে।

কিরণ মিয়া এক সময় লক্ষ করে, বসের সাম্প্রতিক লেখাগুলো বের হয়ে আসছে তাঁর সদ্য দুর্ঘটনা-কবলিত সময়ের মধ্য থেকে, যেখানে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তাঁর অগণিত শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি, তাঁর এই ঘোর দুর্বিপাকে যাঁরা তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁদের প্রতি। কিরণ মিয়া আশায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, বসের লেখায় তার নামটিও উঠে আসছে।

বস পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেন। কিরণ মিয়া মর্মাহত হলো। হাসপাতাল ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন বস, তখনো নিবন্ধের কোনো সর্গে কিরণ মিয়ার সামান্যতম উপস্থিতিও দেখা যায় নি। হাসপাতাল ছাড়ার পূর্ব মুহূর্তে কিরণ মিয়ার চোখমুখ আরেকবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, যখন বস তাকে একটা আশার কথা শোনালেন।
‘মাসখানেকের মধ্যে আমার নতুন বইটি বের হতে যাচ্ছে।’
‘এ তো খুবই আনন্দের কথা, স্যার। কংগ্রাচুলেশন ইন এ্যাডভান্‌স।’
‘একজন মহান লোককে আমার বইটি উৎসর্গ করবো, যিনি আমাকে এই দুঃসময়ে অভূতপূর্ব সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন।’ আফতাব আলি সাহেব এ কথা বলতে বলতে সকৃতজ্ঞ চোখে কিরণ মিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
কে এই মহান লোকটি, কিরণ মিয়া তা সুনিশ্চিতভাবেই জানে। বসের প্রতি নিদারুণ অভিমান জমেছিল তার মনে। সে তাঁকে একটুখানি অকৃতজ্ঞও ভাবতে শুরু করেছিল। কিন্তু এখন তার নিজের কাছেই নিজেকে খুব ছোটো ও লোভী মনে হতে থাকলো। তিনি কত মহান, তার মতো এক ‘দরিদ্র’ অধীনস্থের নামে একটি বই তিনি উৎসর্গ করবেন, তাঁর মহত্ব অতুলনীয়।

বই প্রকাশের আগেই কিরণ মিয়াকে বদলির কারণে অন্যত্র চলে যেতে হয়। সে মনে মনে নিজেকে একজন বোদ্ধা পাঠক ভাবতে শুরু করে, বুদ্ধিমানও। সে ছোটোখাটো আড্ডাখানায় আফতাব আলি সাহেবের বইয়ের একটু-আধটু আলোচনা করে, তাঁর বই থেকে দু-একটা উদ্ধৃতি দিয়ে সামাজিক কিংবা বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তি পেশ করে, তখন উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ কিরণ মিয়ার জ্ঞানের গভীরতা ও বুদ্ধির পরিপক্বতা দেখে তাকে সমীহ করে বটে। তার প্রতি মানুষের এই সমীহ ও সদাশয় ভাব তাকে আরো অনুপ্রাণিত করে; সে ভাবে, নিশ্চয়ই সদাশয় আফতাব আলি সাহেব তাকে কখনো স্বল্পবুদ্ধি কর্মচারি ভেবে অবজ্ঞার চোখে দেখেন নি।

বছর খানেক পর কিরণ মিয়া জানতে পারে আফতাব আলি সাহেবের বইটি যথাসময়েই বের হয়েছে। তার মনে আবার অভিমান সঞ্চারিত হতে থাকে, তার নামে উৎসর্গীকৃত বইয়ের অন্তত একখানি কপি বুকপোস্ট করে বস তার কাছে পাঠিয়ে দিতে পারতেন।
শেষ পর্যন্ত কিরণ মিয়া বইটি পড়তে পারে। এটি বেশ বাজার পেয়েছে, আফতাব আলি সাহেবের যতটুকু নামডাক, সে তুলনায় বইটির বিক্রি বরং বেশিই হচ্ছে। সে বাজার থেকে বইটি কিনে এনেছিল।

হাসপাতালের যে ডাক্তার আফতাব আলি সাহেবকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন, বইটি তাঁকে উৎসর্গ করেছেন লেখক।
কিরণ মিয়ার খুবই মর্মাহত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা সে হয় নি। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য আবারো সে নিজের কাছে অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছিল। তার মতো একজন অখ্যাত ও নির্বুদ্ধি গোবেচারাকে একটি বই উৎসর্গ করবেন আফতাব আলি সাহেব কোন্ যুক্তিতে?

২৪ মার্চ ২০০৯

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৫২
২৮টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×