somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লৌকিক রহস্য; অথবা অলৌকিক

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কুটিমিয়ার বয়স তখন নয় কী দশ। গ্রীষ্মের এক ঝিমধরা দুপুরে ঘরের মেঝেতে খালি গায়ে শুয়ে সে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। এমন সময় প্রাণের বন্ধু গুঞ্জর আলী এসে হাঁক দেয়, ‘ও কুডি, গাব পাড়বার যাবি নি? নু, বাগে যাই।’
বাগের পাতি গাবগাছটায় এবার মেলা গাব ধরেছে। টসটসে পাকা গাবে দারুণ রস; বিচিগুলো মুখে পুরে জিহ্‌বার মাথায় অনবরত নাড়তে থাকে কুটিমিয়া; এ এক অমৃতের স্বাদ! এবার একদিনও সে বাগে যেতে পারে নি। কারণ, এ বছর সে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেছে। দুপুর বারোটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ক্লাস, অথচ বাগে ছেলেদের খেলা জমে ওঠে ঠিক দুপুরবেলাটায়, যখন সে স্কুলে থাকে।
আজ তার স্কুল ছুটি। কত দুপুর চলে গেছে সে বাগে গিয়ে খেলে না, বনের গাছগুল্ম থেকে ফলফলাদি খায় না। সহসা বাগে যাওয়ার কথা শুনে কুটিমিয়ার হুঁশ থাকে না। গলায় একটা গামছা জড়িয়ে গুঞ্জর আলীর সংগে রুদ্ধশ্বাসে গভীর বাগের দিকে ছোটে।

ঘন জঙ্গল আর ফলমূলের গাছপালায় পরিপূর্ণ গভীর বনটাকে এ গাঁয়ের সবাই ‘বাগ’ ডাকে। অজানা কাল থেকেই এ বাগ শণ, কাশ, বেত, আরো নানা জাতের আগাছায় ছেয়ে থাকতো। এর একধারে একটা ছোটো ডোবা; এ ডোবার পানিতে গোসল কিংবা রান্না হয় না, কারণ এটি কচুরিপানায় ভর্তি; এর পানি দেখতে কুচকুচে কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত, অধিকন্তু বসতিস্থান থেকে বেশ দূরে। এ ডোবার পানি শুকিয়ে কমে এলে ছেলেরা দল বেঁধে পানি সেচে মাছ ধরে। বাগের শণ আর আগাছা সাফ করে কেউ ফসল ফলাবার চেষ্টাও করে না, কেননা তাতে শ্রম ও অর্থব্যয়ের তুলনায় প্রাপ্য শস্যের পরিমাণ নেহায়েতই কম হয়। এ বাগের প্রকৃত কোনো মালিক আছে কিনা তা নিয়ে কেউ কোনোদিন ঘাঁটাঘাঁটি করে নি। কারো শণের প্রয়োজন হলে শণ কেটে নেয়। যার লাকড়ির দরকার পড়ে সে এসে আস্ত একটা গাছ কেটে ফেলে। বাগের আরেক ধারে কয়েকটা কবর আছে; যে-সব মৃতের স্ব-ভূমিতে জায়গা হয় না, তাদের জন্য বাগের এই কোনাটা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাগের ভিতরের গাছগুলো একেবারেই বনজ, ওগুলোকে কেউ বপন বা রোপণ করেছে বলে কারো জানা নেই। গাছগুলোর কোনো পরিচর্যাও হয় না, ওগুলো বেড়ে ওঠে প্রকৃতির আপন হাতের আদরযত্নের মধ্য দিয়ে। বাগের উত্তর ধারে একজোড়া অতি লম্বা তালগাছ; মৌসুম এলে তাল পাকে, পাখিরা ঠুকরে খায়, তলায় পড়ে, সেগুলোও বাগের পশুপখিরাই খায়। এ বাগে আমগাছের সংখ্যা সবচাইতে বেশি। দু-তিনটা কাঁঠাল গাছও আছে, একটা বরই গাছ, বড় দুটি শিমুল গাছ, আর আছে প্রচুর বেতঝাড়। আর আছে প্রচুর শেয়াল; সন্ধ্যা, মধ্যপ্রহর এবং শেষরাতে এদের সম্মিলিত শোরগোলে পুরো এলাকা সচকিত হয়ে ওঠে, এমনকি দুপুরেও কোনো কোনো নিঃসঙ্গ শিয়াল মাঝে মাঝে হঠাৎ ডেকে ওঠে। বাগের মধ্যিখানে সর্বাপেক্ষা বেশি স্থান দখল করে বিশাল ঝুপড়ির মতো দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীনতম একটি গাবগাছ।

গরমের দিনে বাগের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া নালাগুলো শুকিয়ে চর হয়; তখন ছেলেরা ওখানে খেলায় মেতে ওঠে। কেউ গেছোমেছো খেলে, আম কুড়ায়, কুল পাড়ে, তেঁতুল ছিঁড়ে; কেউ পাখির বাসা খোঁজে; কেউ ডাংগুলি বা মার্বেল খেলে; কেউ কেউ চড়ুইভাতির আয়োজন করে; কেউ গাছের শাখায় দোলনা বেঁধে আপন মনে দোল খেতে খেতে গান গায়। কেউ কেউ দারুণ ইঁচড়ে পাকা; তারা তাস খেলে, গাঁজা কিংবা আফিম খায়। যখন মাঠে মাঠে ফসল কাটার ধুম পড়ে যায় তখন কিন্তু বাগের দুপুরবেলাটা প্রায় নিরালা হয়ে পড়ে। যাদের কাজ নেই, কিংবা কাজের বয়স হয় নি কেবল ওদের দু-চারজনকে তখন বাগে দেখা যায়। দুপুরের গরমে প্রচুর গাব পাকে। তাই ছেলেরা দুপুরেই বাগে এসে গাবগাছে হানা দেয়।

কুটিমিয়া আর গুঞ্জর আলী বাগে ঢুকে খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলো, কারণ, ওরা দুজন ছাড়া বাগে আজ কেউ নেই; গাছের সবগুলো পাকা গাব আজ ওদের।
প্রকাণ্ড ঝাঁকড়া গাছটাতে দুজনে হুড়হুড় করে উঠে পড়ে। এবার প্রচুর গাব ধরেছে, গত বছরের চেয়ে অনেক বেশি। দু বন্ধু টুকটুক পায়ে এক ডাল থেকে আরেক ডালে যায়, মগডালে পৌঁছে একটার পর একটা টিপে পরখ করে দেখে পেকেছে কিনা। পাকাগুলো ছিঁড়ে লুংগির কোঁচড়ে গোঁজে, মাঝে মাঝে দু আঙ্গুলের চাপে টাস করে পাকা গাবের পেট ফাটিয়ে চুমুক দিয়ে রস খায়, বিচিগুলো মুখে পুরে নেবুনচুষের মতো চুষতে থাকে।
‘কয়ডা পাইলিরে কুডি?’ জাবর কাটতে কাটতে গুঞ্জর আলী জিজ্ঞাসা করে।
‘আট-দশটার মতন অইবো।’ কুটিমিয়া জবাব দেয়।
‘রসে একদুম টসটস করবার লাগছে, তাই না কুডি?’
‘হ…মি-ডা কী!’ কুটিমিয়া টেনে টেনে বলে।

দুজনের মুখক্রিয়া চলতে থাকলেও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বন্ধ থাকে। হঠাৎ কুটিমিয়ার চোখদুটো চকচক করে ওঠে। একটা চিকন ডালের একেবারে মাথায় বড় একটা গাব পেকে হলুদ হয়ে আছে। চিকন ডালটি বেয়ে অতোদূর যাওয়া যায় না, মুহূর্তে মটমট শব্দে ডাল ভেংগে পড়ে যাবে। তবু সে বার কয়েক ঝুলে পড়ে ওটা নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু সব চেষ্টাই বার বার বৃথা যায়। টসটসে এ গাবটা পাড়তে না পারলে তার মনে খুব আফসোস থেকে যাবে।
‘ও গুঞ্জর আলী, ক তো দেহি কী করন যায়?’ বলেই সে গুঞ্জর আলীর দিকে তাকায়, আর মুহূর্তের মধ্যে বাগের চারদিক কাঁপিয়ে সে ভয়ে বিকট চিৎকার দিয়ে ওঠে— 'ও বাবা রে…।’ কুটিমিয়ার পেছনের এক ডালে, যেখানে এতোক্ষণ গুঞ্জর আলী গাব পাড়ছিল, সেখানে গুঞ্জর আলী নয়, বসে আছে অন্য একজন, সে হনু পাগলি, তিন বছর আগে যে হনু পাগলি এ গাছের নীচের একটা ডালে ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়েছিল, সেই হনু পাগলি; ফরসা ধবধবে একটা লালপেড়ে শাড়ি তার পরনে। কুটিমিয়ার এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, গলায় ফাঁস দিয়ে মরবার সময়ে তার পরনে এমন একটি লালপেড়ে সাদা শাড়ি ছিল, তবে সেটি এতো ধবধবে ছিল না, খুব নোংরা আর ময়লা ছিল। অন্য কেউ হলে এখন ভয়ে জ্ঞান হারাতো, পা ফস্‌কে পড়ে গিয়ে কোমর-হাত-পা-ঘাড় ভাঙতো, মৃত্যুও হতে পারতো। কিন্তু কুটিমিয়া ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে সত্যি, তবু দু হাতে শক্ত করে গাছের ডাল ধরে চোখ বন্ধ করে গলা ফাটিয়ে ‘ও বাবারে’ করে চিৎকার পেড়ে যাচ্ছে।
আচমকা কুটিমিয়ার কাঁধের ওপর একটা শক্ত হাত পড়তেই সে আরো জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে। সেই হাত ওর কাঁধ ধরে ওকে ক্রমাগত টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কুটিমিয়ার মনে হচ্ছে হনু পাগলির হাতটাতে বাঘের হিংস্র ও ধারালো নখর গজিয়েছে, সেই নখর দিয়ে ওর কাঁধটাকে খামচে চিলেবিলে করে ফেলছে।
হঠাৎ কুটিমিয়া এক পরিচিত কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পায়—‘ও কুডি, তর কী অইছে রে? কী অইছে?’
কুটিমিয়ার প্রাণ বুঝি ধড়ে ফিরে আসে। ওর চিৎকারের শব্দ স্তিমিত হতে থাকে। সে অতি ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে দেখে, গুঞ্জর আলী ওর কাছে এসে কেবলই কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে যাচ্ছে; ভয়ার্ত স্বরে সে বলছে, ‘ও ভাই কুডি, তর কী অইছে? কী অইছে? ডরাইছা? কী দেইক্যা ডরাইছা?’
কুটিমিয়ার ভয় তবু কাটে না। শংকিত চোখে সে পেছনের ডালে তাকায়, সারা গাবগাছের সবগুলো ডালের দিকে তাকায়, নীচের দিকে তাকায়—না, হনু পাগলি নেই। কুটিমিয়ার শরীর তখনো থরথর করে কাঁপছে। কিছুক্ষণ পরপর বুক থেকে অন্তরকাঁপা ভারী দীর্ঘশ্বাস বের হয়। কিন্তু গুঞ্জর আলীকে সে আসল রহস্য খুলে বলে না। শুধু বলে, ‘গুঞ্জর, বাইত্তে যাবি? আমি যাই গ্যা। যাবি তুই?’
কুটিমিয়া তরতর করে গাছ থেকে নেমে দৌড়ে বাড়ির দিকে ছোটে। ফেরার পথে ভয়ে ভয়ে বার বার পেছনে তাকিয়ে দেখে গুঞ্জর আলীও আসছে কিনা। না, গুঞ্জর আলী আসছে না। কুটিমিয়ার মনের ভিতর আরেকটা ভয় দ্রুত দানা বাঁধতে থাকে—এই যে এতোক্ষণ যার সাথে গাবগাছে চড়ে গাব পাড়া হলো ওটা আসলে গুঞ্জর আলী নয়, ওটা অন্য কিছু, অশরীরী কিছু ছিল। এই ভরদুপুরে ওটা গুঞ্জর আলীর ছল ধরে ওকে বাগে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। নিশ্চয়ই কোনো বড় পীর-আওলিয়ার দোয়া আছে, কুটিমিয়া ভাবে, নইলে হয়তো এটা আজ ওর ওপর আছড় করতো, হনু পাগলির মতো ওকেও গাবগাছের নীচের ডালটাতে, কিংবা হয়তো একেবারে মগডালটাতেও উঠিয়ে গলায় ফাঁস পরিয়ে ঝুলিয়ে দিত। সবাই বলতো—আহারে, গরীবের পোলাডা মনের দুঃখে গলায় ফাঁস দিয়া ভবের মাইয়া ছাইড়া চইলা গেছে।

ভৌতিক ঘটনাগুলো ঘটবার বিশেষ বিশেষ ক্ষণ বা প্রহর আছে। এগুলো ঘটে হয় একেবারে নিরালা দুপুরে, অথবা ভরসন্ধ্যায়, ভরা পূর্ণিমা বা অমাবস্যায়, কিংবা রাত্রির মধ্য অথবা শেষ প্রহরে। ভরদুপুরে ঘরের বার হওয়া কুটিমিয়ার জন্য নিষেধ ছিল। এমন এক নিঝুম দুপুরে একটা অতিভৌতিক ব্যাপার ঘটেছিল। সেবারও সে প্রাণে রক্ষা পেয়েছিল।




দুপুরের ঠাটা রোদ। কোথাও এক ফোঁটা বায়ু নেই। গ্রীষ্মের লাংগলচষা মাঠগুলো ধু-ধু আর খাঁখাঁ করছিল।
কুটিমিয়ার ছিল ঘুড়ি উড়ানোর প্রচণ্ড শখ। সেদিন সকালবেলা তার প্রতিবেশী খোরশেদ চাচা একটা বিশাল ঘুড়ি বানিয়ে দিয়েছিল। ঘুড়িটা সকালে বানালেও তখন সে উড়াতে পারে নি। তার কাছে মাত্র সাত-আট হাত সুতা ছিল। এতো অল্প সুতা দিয়ে ঘুড়ি উড়ানো যায় না। ঘুড়ি উড়াতে দীর্ঘ, সরু ও শক্ত গুটিসুতা লাগে। ঘুড়ি ডানা ঝাপটে উর্ধ্ব আকাশে উঠে ছোট্ট পাখিটির মতো ডিগবাজি খায়, গুত্তা কাটে। বিকেলে দূরের মেঘুলা বাজার থেকে ফেরার সময় খোরশেদ চাচা সুতা নিয়ে আসবে। এই সুদীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা তাকে কেবলই যন্ত্রণা দিতে লাগলো। স্কুলে যেতে তার মন চায় নি, তবুও গেলো। ক্লাসে বসে প্রবল আগ্রহ আর উত্তেজনায় ছটফট করলো; বইপত্র নাড়াচাড়া করলেও মন পড়ে রইলো প্রাণপ্রিয় ঘুড়িটার কাছে—যদি এমন হয়, বাড়ি ফিরেই দেখে সুতা পেঁচানোর ছোটো কাঠিটায় কোনো এক জিনের বাদশা সুতায় ভরে দিয়ে গেছে, বইখাতা ছুঁড়ে ফেলে এক দৌড়ে ঘুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়বে, জিনের বাদশাকে সে পনর পয়সার বাতাসাও দিবে।
ছুটি শেষে বাসায় ফিরে কুটিমিয়া হতাশ চোখে দেখে, তার শুকনো কাঠিটার গায়ে পুরোনো সাত-আট হাত সুতাই পেঁচানো রয়েছে।
কিন্তু তাকে ঘুড়ি উড়াতেই হবে। সে ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লো। উত্তেজনার যন্ত্রণা চেপে রাখতে না পেরে ঘুড়ি আর সুতার কাঠি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে হাওয়া হয়ে গেলো।
কিন্তু ঘুড়ি উড়ানো ভীষণ দায় হলো। একটুও বাতাস নেই, একটা শিমুল তুলা পর্যন্ত ওড়ে না।
অবশেষে এক অভিনব কায়দায় এতোটুকুন সুতা দিয়েই কুটিমিয়া ঘুড়ি উড়ানো শুরু করলো। সুতার মাথায় ঘুড়ি বেঁধে কাঠি হাতে ক্ষেতের লম্বা আইল ধরে সে দৌড় দেয়, অমনি সুড়সুড় করে ঘুড়ি ওপরে উঠে যায়। যেই না চাঁদি বরাবর উঠে এসে স্থির হয়ে দাঁড়ায়, অমনি সে হাত থেকে সুতার কাঠিটি ছেড়ে দেয়। বাতাসহীন শূন্যে দুদিকে ঢেউ খেলতে খেলতে অল্প একটু দূরে গিয়ে অতি ধীরে ঘুড়ি ক্ষেতের ওপর নেমে পড়ে।
কুটিমিয়া আবার আগের মতো কাঠি হাতে আইল ধরে জোরে দৌড় শুরু করে, ঘুড়ি মাথার ওপরে আসামাত্র কাঠি ছেড়ে দেয়। নীরব গুত্তা খেতে খেতে অলসভাবে মাটিতে নেমে আসে ঘুড়ি। কুটিমিয়া দেখে এ এক দারুণ মজা তো! ঘুড়ি উড়ানোয় এমন মজা সে জীবনে পায় নি।
এভাবে ছয়বারের মতো সে বাতাসহীন নিম্ন আকাশে ঘুড়ি উড়ালো। সপ্তমবারের মাথায় এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। আগের মতো অলস ঢেউ খেলে ঘুড়ি নীচে নামলো না, এক অদ্ভুত উলটো ঘটনা ঘটতে লাগলো। ধীরে ধীরে সেই ঘুড়ি ওপরের দিকে উঠতে থাকলো। আশ্বিনের ক্লান্ত দুপুরে অলস চিল যেমন বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে উর্ধ্বাকাশে উঠতে থাকে, মৃত গরু ভক্ষণ শেষে শকুনেরা যেমন গোলাকারে উড়তে উড়তে অদৃশ্য হতে থাকে, কুটিমিয়ার ঘুড়িটাও ঠিক সেভাবে উর্ধ্বাকাশের দিকে ধাবিত হতে থাকলো। দেখতে দেখতে ঘুড়িটি উত্তর আকাশের দিকে বহু ওপরে উঠে গেলো।
এরূপ দৃশ্যে কুটিমিয়া প্রথমে খুব মজা পেয়েছিল। সে ভেবেছিল, ঘুড়িটা হঠাৎ কোনো ঘুর্ণি বাতাসের মধ্যে পড়েছিল, যার ফলে এভাবে ওপরের দিকে উঠে গেছে, একটু পরই নীচে নেমে আসবে।
কিন্তু একটু পরও যখন ঘুড়ি নামলো না তখন সে হতবাক হয়ে গেলো; যখন বেশ ওপরে উঠে গেলো তখন তার হঠাৎ মনে হলো অনেক সাধের ঘুড়িটি আর নীচে নেমে আসবে না, আর তখনই সে গলা ছেড়ে চিৎকার জুড়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিকে দৌড়াতে শুরু করলো—আমার গুড্ডি উইরা গেলো গা—আমার গুড্ডি...গুড্ডি...। দৌড়াতে দৌড়াতে সে বার কয়েক হোঁচট খেলো, ক্ষেতের শক্ত ইটার ওপর পড়ে তার হাঁটু ছুলে গেলো, বুক ছুলে গেলো, গোড়ালি মচকে গেলো। শেষবার মাটিতে পড়ে গিয়ে সে যখন তৃষ্ণায় হাঁপাচ্ছিল, হঠাৎ কোথা থেকে এসে তাকে উঠিয়ে কোলে তুলে নিল পাশের বাড়ির মতির মা বুড়ি। বুড়ির বুকের সাথে মিশে গিয়ে অর্ধ-অজ্ঞান অবস্থায়ও সে আকাশের দিকে আংগুল উঁচিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় তার অতি আদরের ঘুড়িটা উধাও হয়ে যাওয়ার কথা বলতে লাগলো।
তার পরের কোনো কিছুই সে আর ঠাওর করতে পারে নি। যখন সে চেতন হলো তখন অনেক রাত হয়ে গেছে। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে তার বাবা-মা, চাচা-চাচি, ফুফু-দাদি সবাই তাকে ঘিরে বসে আছে। সবাই কেমন কাঁদ-কাঁদ হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে।
কুটিমিয়ার বাবা নালমিয়া তাকে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে নেন। বলেন, ‘তরে তো আর পাইতাম নারে বাজান, আর পাইতাম না।’ তারপরই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। কিন্তু কুটিমিয়া বাবার এভাবে কেঁদে ফেলার কারণ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না; সবাই কেন তাকে ঘিরে এভাবে মলিন মুখে বসে আছে তা-ও আন্দাজ করতে পারে না। সে অবাক চোখে সবার দিকে তাকিয়ে থাকে।

পরদিন সারা গাঁয়ে আসল ঘটনা ছড়িয়ে পড়লো। ভরদুপুরে কুটিমিয়া নির্জন রুক্ষ ক্ষেতের ওপর দৌড়ে ঘুড়ি উড়াচ্ছিল। হঠাৎ সেই ঘুড়ির ওপর জিনের আছড় পড়ে। কুটিমিয়ার হাতে সুতা পেঁচানো কাঠি ছিল। কাঠিসমেত কুটিমিয়াকে নিয়ে সেই ঘুড়ি ভোঁ ভোঁ করে ক্রমশ ওপরে উঠতে থাকে। প্রথমে হাঁটু পরিমাণ উঁচুতে ঝুলে ছিল, তারপর কোমর পরিমাণ, তারপর গলা সমান—ঐ সময় মতির মা বুড়ি অদূরে তার ছাগল চরিয়ে বাড়ি ফিরছিল; হঠাৎ এই অদ্ভুত ও ভয়ানক কাণ্ড তার চোখে পড়ে, এবং মুহূর্তে তার যক্ষের ধন ছাগল ফেলে দৌড়ে এসে কুটিমিয়ার পা টেনে জাপ্টে ধরে। জিনটার শরীরে সাংঘাতিক শক্তি ছিল, মতির মা যতোই পা টেনে নীচে নামায়, ঘুড়িটা ততোই প্রবল বেগে, মতির মাকে সহ ওপরে উঠিয়ে নিয়ে যেতে চায়। মতির মা উচ্চস্বরে একটানা ‘কুল্‌হু আল্লাহু’ সুরা পড়তে থাকে। অবশেষে মুশকিল আসান হয়, কুটিমিয়ার হাত গলে সুতার কাঠি বের হয়ে যায়, জিনের ঘুড়িটা গুত্তা খেতে খেতে আসমানে উঠে মিলিয়ে যায়। সর্বাঙ্গ অবশ কুটিমিয়াকে বুকে চেপে আপদ-বালাই দূর হওয়ার দোয়া পড়তে পড়তে বাড়ি ফিরে আসে মতির মা।

চারদিকে হু হু করে মতির মার নাম ছড়িয়ে পড়লো। ভালো যে সে ওখানে ছাগল চরাতে গিয়েছিল, তা না হলে কুটিমিয়ার কী দশা হতো! তাকে আর খুঁজে পাওয়া যেতো না, আসমানের অনেক ওপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে কোনো এক গহিন জংগলে কিংবা মরুভূমিতে তাকে ফেলে দিত জিনটা। তার বাঁচার আর কোনো সম্ভাবনাই থাকতো না। মতির মার মতো এমন সাহসী, এমন দরদী মানুষ আর হয় না; নিজের জীবন বাজি রেখে জিনের সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে সে কুটিমিয়ার জীবন বাঁচিয়েছে।

কুটিমিয়াকে কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করে, ‘যেসুম দ্যাকলা জিন তুমারে টাইন্যা ওপরে নিয়া যাইতেছে, হেইসুম আতে গনে সুইত্যার গুডি ছাইড়্যা দিলা না ক্যান?’
কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমারে কত্থানি উপরে উডাইছিল? গিরা সুমান, নাকি বুক সুমান? নাকি মাতা সুমান?’
সে খুব লজ্জিতভাবে বলে, ‘পায়ের পাতা সুমান উপরে উইড্যা গেছিলাম।’
অবশ্য কারো কারো কাছে বললো কোমর পর্যন্ত, শেষ পর্যন্ত বললো মাথা সমান উপরে উঠে গিয়ে সে বেশ কিছুক্ষণ ঝুলে ছিল।
প্রথম প্রথম কুটিমিয়া এসব প্রশ্নের আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারে নি। সে উলটো প্রশ্ন করতো, ‘আমারে আবার গুড্ডিতে উড়াইয়্যা নিল কুনসুম?’
কুটিমিয়ার পালটা প্রশ্নে মানুষ বলতে শুরু করলো, ‘তুমার তো অহনে কিছুই মনে নাই। জিনে দরলে কিছছু মনে থাহে নি?’
আদতে কুটিমিয়া কিছুই মিলাতে পারছিল না। সে মনে করতে পারছিল না কখন ঘুড়ির সুতার কাঠি ধরে সে ঝুলে ছিল। সে শুধু সুতার কাঠি বার বার ছেড়ে দিয়ে ঘুড়ি উড়ানোর নতুন খেলায় মেতে উঠেছিল। অমন ঘটনা ঘটলো কখন?
একবার তার মা-বাবার কাছেই কুটিমিয়া বলে ফেললো, ‘আমারে তো গুড্ডিতে টাইন্যা উপরে উডায় নাই...’
বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘তুমার কি হেসুম কুনো উশ-জ্ঞান আছিল রে বাজান? উশ জ্ঞান থাকলে তো আতে গনে গুড্ডিই ছাইড়্যা দিবার পারতা।’
কুটিমিয়ার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। মতির মা এসে তার হাত দেখায়, ‘দ্যাক, তরে টানতে টানতে আমার আতের ফানা নাল অইয়্যা গেছে।’
কুটিমিয়া মতির মার লাল হয়ে যাওয়া হাতের তালুতে তার নরম হাতের আঙ্গুল বোলাতে থাকে। সত্যিই বেশ ফুলে গেছে, লাল হয়ে আছে।
মতির মা বলে, ‘তর দুই পায়ের গুরালিও ফুইল্যা গেছে। কম জুরে টানছি?’
কুটিমিয়া তার পায়ের গোড়ালিতে হাত বোলায়। হ্যাঁ, বেশ আরাম বোধ হচ্ছে। জায়গাটা ফুলে আছে।
কিন্তু কুটিমিয়ার মনে বিষম সন্দেহ, ‘আমি তো ক্ষ্যাতের ওপর দিয়া আলুপাত্তারি আটছিলাম, অনেকবার উইচট্যা খাইছি। এই ব্যাতা তো হেইসুমই পাইছি।’
এই বিস্ময়কর ঘটনার আরেকজন চাক্ষুষ সাক্ষী পাওয়া গেলো—সে হলো পাশের গাঁয়ের হোসেন মিয়া, যাকে সবাই একগড়া হুসেন মামু ডাকে।
হোসেন মামা ঐ সময় দূরের ক্ষেতে ইটামুগুর দিয়ে ইটা ভাংছিল। মতির মা যখন কুটিমিয়ার পা ধরে নীচের দিকে টানাটানি করছিল, তা দেখতে পেয়ে হোসেন মামাও ইটা ভাংগার কাজ ফেলে লম্বা এক দৌড় দিয়েছিল। কিন্তু ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই মতির মা কুটিমিয়াকে টেনে মাটিতে নামিয়েছিল। হোসেন মামার নিজ চোখে দেখা ঘটনা।
এসব কথা শুনে কুটিমিয়ার মনের ভিতরে আস্তে আস্তে বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করে, ‘হ, তাই-ই অইবো। আমি তো ঘুরের মইদ্যে আছিল্যাম। কী ঘডনা ঘইড্যা গেছে তা বড় আমার মনে আছে নি? মতির মা যা কইবার লাগছে হেইডাই সইত্য।’
এই ঘটনার পর থেকে ঘুড়ি উড়ানো তো নিষিদ্ধ হলোই, দুপুরবেলায় বাড়ি ছেড়ে বাইরে যাওয়াও কুটিমিয়ার জন্য পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হলো।

এভাবে বছর দুয়েক চলে যায়, আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ধীরে ধীরে শিথিল হতে থাকে। এক সময় সেই নিষেধাজ্ঞার কথা বাড়ির সবাই বেমালুম ভুলে বসে। সেই ভুলে যাওয়ার ফাঁক গলে গলে কুটিমিয়া এক-আধটু করে দুপুর বেলায়ও বাইরে বেরোনো শুরু করলো। বাগের গাবগাছে গাব পাড়া, বেতবনের বেতুল তোলা, তেঁতুল-কুল-আম পাড়া, পাখির বাসায় ডিম আর পাখি খোঁজা, যখন তখন জলে ঝাঁপ দেয়া, এমনকি ঘুড়ি উড়ানোও, সব চলতে থাকলো আগের মতো। ঠিক এমন সময়েই এক দুপুরে সে গুঞ্জর আলীর সাথে বাগের গাবগাছে গাব পাড়তে গিয়েছিল।

আরো একবার একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল।
কুটিমিয়ার বয়স তখন বারো-তের। সে, তার ছোটো ভাই চানমিয়া আর চাচাত ভাই আলামিয়া—রাতে এ তিনজন একত্রে রসুই ঘরে থাকে।




কুটিমিয়াদের বাড়ির উত্তর দিকে একটা বড় ঝিল আছে। সেই ঝিলে বারো মাস পানি থাকে। ঝিলের চারদিকের উঁচু জমিতে আউশ আর আমন ধানের চাষ হয়। বৃষ্টি হলে ধানক্ষেতের পানি গড়িয়ে সেই ঝিলে নামে। পানির সেই ধারা বেয়ে ঝিল থেকে ধানক্ষেতের ওপরে উঠে আসে দুই-তিন সনী কইমাছ। রাতের বেলা ধানক্ষেত মাড়িয়ে এসব কইমাছ ধরাতে প্রচুর রোমাঞ্চ আছে। কিন্তু বৃষ্টির রাতে কইমাছ গাবানোর রহস্য সবাই জানে না, জানলেও কেউ ঘর থেকে বেরোয় না কেবল সাহসের অভাবে।
পাশের বাড়ির আবুল এ ব্যাপারে দারুণ ওস্তাদ। সে কুটিমিয়ার প্রিয়বন্ধুদের একজন। সে আবুলের মুখে রাতে কইমাছ ধরার অনেক গল্প শুনেছে। আবুলদের বাড়িতে বড় হাঁড়িতে জিয়ানো আলীশান কইমাছের দাপাদাপি দেখে মাছ ধরার ইচ্ছেয় সে পাগল হয়ে উঠেছে বহুদিন। কিন্তু আবুলের মাছ ধরার নিশিসঙ্গী সে কোনোদিন হতে পারে নি। কেননা, রাত-বিরাতে মা-বাবা তাকে ঘর থেকে বেরোতে দেন নি।

কিন্তু কুটিমিয়া এখন স্বাধীন। সে বড় হয়ে উঠেছে। এখন তাকে মা-বাবার সাথে এক ঘরে শুতে হয় না। কিছুদিন আগে থেকে তারা তিন ভাই আলাদা ভাবে রসুইঘরে ঘুমায়। রাতে যে ভয়ডর লাগে না তা না। তিনজনের মধ্যে চানমিয়া সবার ছোটো। সে শখ করে এদের কাছে থাকে। বড়ই খেয়ালি ছেলে, একেকদিন হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে চিৎকার জুড়ে দেয়, ‘ও বাজান, আমারে নিয়া যাও। আমারে নিয়া যাও বাজান।’ বাবা কিংবা মা এসে তাকে ঘরে নিয়ে যান।
মাঝেমধ্যে মা-বাবা কিংবা চাচা-চাচিরা পায়খানা প্রস্রাবের জন্য বের হোন, ওদের ঘরের দরজায় টোকা দেন, বেড়ায় থাপ্পড় দেন বা মৃদু ডাকাডাকি করেন। এতে একটা লাভ হয়, বুকের ভিতর যদিও বা সামান্য ভয়ডরের উদ্রেক হয়, এই ডাকাডাকিতে তা হালকা হয়ে যায়। কিন্তু এতোকিছুর পরও পুরোটা রাত কুটিমিয়ার কাছে নিজেকে খুব স্বাধীন মনে হয়। ঘর থেকে চুপিচুপি বেরিয়ে কারো সাথে জয়পাড়া হলে সিনেমা দেখে এলে বাড়ির কাকপক্ষীটিরও জানার সাধ্য নেই।

আশ্বিনের এক রাতে সারারাত অঝোর ধারায় বৃষ্টি হওয়ার পর শেষ রাতের দিকে তা থেমে গেলো। কুটিমিয়ার মনের ভিতর তখন তোলপাড়—‘ইশ্‌, যদি আবুল আইয়া ডাক দিত, আইজক্যা অনেক কইমাছ ধরন যাইতো।’ সে কান খাড়া করে থাকলো, কারণ, তার দৃঢ় বিশ্বাস আবুল আসবেই। যখন সে মা-বাবার সাথে এক ঘরে থাকতো, এমন নিশীথে কাশতে কাশতে তাদের দুয়ার পার হয়ে রাস্তায় বের হয়ে যেতো আবুল; খাল পার হয়ে ওপারের ধানক্ষেতে গপাগপ অনেক কইমাছ ধরতো।
কুটিমিয়া কান খাড়া করেই ছিল, এমন সময় হঠাৎ নীচু গলায় আবুলের ডাক, ‘কুডি ঘুমাইতেছা নি রে?’
এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় কুটিমিয়া। তারপর পাটখড়ির ঝাঁপ সরিয়ে দরজায় এসে দাঁড়ায়। রোমাঞ্চে থরথর গলায় জিজ্ঞাসা করে, ‘ওইপাড়ে যাবি?’
‘হ...যাবি নি? গেলে আয়।’
‘খাড়া, আইফ্যার লাগছি।’ বলেই ঘরের ঝাঁপ ভেজিয়ে দ্রুত বের হয়ে আসে।
আবুলের এক হাতে ছাতা ফুটানো, আরেক হাতে একটা টর্চ আর ব্যাগ।
‘তুই টর্চটা আতে নে।’ আবুল বলে।
‘জুতি আনলি না?’ কুটি জিজ্ঞাসা করে।
‘জুতি লাগবো না।’
ধানক্ষেতের আইল বরাবর আসতেই পানির কলকল শব্দ, তাতে কইমাছের ছোটাছুটি আর ক্যাতকুত শব্দে কুটিমিয়ার শরীরে উত্তেজনার আগুন জ্বলে উঠলো।
দুজনে ধানের সারি ফাঁক করে ক্ষেতে নামে—টর্চের আলো সামনে ফেলেই কুটিমিয়া পাগল হয়ে গেলো, এত্ত কই! কইমাছের এরূপ দাপাদাপি-ছোটাছুটি সে জীবনেও দেখে নি।
হাতের ছাতাটা কুটিমিয়ার হাতে দিয়ে আবুল বলে, ‘তুই খালি সোজা কইরা টর্চ মারতে থাক।’
আবুলের বাম হাতে ব্যাগ। উবু হয়ে একটা একটা করে কইমাছ ধরে ব্যাগের ভিতরে পুরতে লাগলো। একেকটা কই বড়ই দুষ্টু—ধরতে গেলেই ছুট দেয়—পিছে পিছে আবুলও ছোটে। কিন্তু ওর চালাকির কাছে কইমাছের দুষ্টুমি কিছুই না।
‘আমিও দরি?’ কুটিমিয়া আবুলকে বলে।
‘তুই পারবি? লাইড দরবো ক্যাডা?’ আবুল মৃদু ভর্ৎসনার স্বরে বলে।
‘এক কাম করি, তুই ছাতি আর লাইটটা দর, আমার কাছে ব্যাগ দে, আমি কয়ডা দইর‌আ দেহি।’ কুটিমিয়া বলে।
‘তুই পারবি ন্যা।’ আবুল একটা ঝাড়ি দেয়। কুটিমিয়া মর্মাহত হয় এবং দমে যায়।

কুটিমিয়ার বাম দিকে একটা বড় রকমের ক্যাতকুত শব্দ হলো—ওদিকে টর্চ ধরতেই ওর দু চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেলো—‘একদম হাত্তির সুমান কই রে!’ বলেই সে নীচু হয়ে ওটা ধরার জন্য হাত বাড়ায়, কিন্তু কইটা খড়্‌ড়ৎ করে সামনের দিকে একটা লম্বা দৌড় মারলো, তারপর ধানের গোছার মধ্যে টুপ করে লুকিয়ে গেলো। কুটিমিয়া নাছোড়বান্দা, ওটা সে ধরবেই। সে পা টিপে টিপে সামনে এগোয়, আলগোছে ধানের গোছায় হাত রাখে, অমনি কইমাছটা আবারো দৌড়ে আগের মতো মাথা গুঁজে লুকিয়ে যায়। এভাবে লুকোচুরি খেলা চলতে থাকলো, কুটিমিয়া দৌড়ায়—কইমাছটাও দৌড়ায়, যেন দাঁড়িয়াবাঁধা খেলা। শেষ পর্যন্ত এক দৌড়ে মাছটা কোথায় গিয়ে কোন্‌ ধানগোছার মধ্যে লুকালো তার কোনো হদিস পাওয়া গেলো না।
আবুল ঠিকই বুঝেছিল কুটিমিয়া মাছ ধরতে জানে না। এতো চেষ্টা করেও মাছটা ধরতে না পেরে সে মনে মনে খুবই লজ্জিত হলো। লজ্জিত হবার আরেকটা কারণ হলো এতোক্ষণ সে আবুলের জন্য টর্চ ধরে নি, নিশ্চয়ই ওর ওপর ভীষণ চটে আছে।
কুটিমিয়া ঘুরে আগের জায়গায় চলে আসে। আবুল মাছ ধরতে ধরতে সামনের দিকে অনেক দূর চলে গেছে। ও এতোই পটু যে টর্চের আলো ছাড়াই অন্ধকারে দেধারছে মাছ ধরছে। মাছের ছোটাছুটি, মাছের পিছনে আবুলের দৌড়, টুপটাপ শব্দ, মৃদু কাশি শোনা যায়। কুটিমিয়া সামনে এগোয়।
‘ব্যাগ ভরছে নি রে?’ সংকুচিত স্বরে কুটিমিয়া জিজ্ঞাসা করে।
‘হুঁম।’
‘তুই কুতায়?’ টর্চ মারতে মারতে আরো সামনে যায় কুটিমিয়া।
মাছ ধরার নেশা বড় নেশা। এই নেশায় ধরলে দিনদুনিয়ার কোনো কথা মনে থাকে না। কাদাপানির মধ্যে আবুলের পা ওঠানামার শব্দ পাওয়া যায়, ওর নাকের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পাওয়া যায়। কুটিমিয়া সামনে এগোতে থাকে।
‘তুই কই রে?’ কুটিমিয়া আবার জিজ্ঞাসা করে।
‘এই যে...।’ আবুল একটু টেনে টেনে বলে।
‘এতো দূরে গ্যাছা ক্যান?’
আবুল আস্তে আস্তে বেশি পানির মধ্যে চলে গেছে। সে হাতড়েও মাছ ধরতে বড় ওস্তাদ।
কুটিমিয়া ধানের সারি ফাঁক করে টর্চের আলো ফেলে সামনে এগোয়।
‘আবুল...।’ কুটিমিয়া স্বর একটু উঁচু করে ডাকে।
‘কী...?’ দূরে আবুলের জবাব শোনা যায়।
‘তুই কত দূরে গ্যাছা?’
‘এই যে...’
কুটিমিয়া ধানগাছের ওপর দিয়ে সামনে টর্চ মারে। ধানের মধ্যে উবু হয়ে থাকলে কি কিছু দেখা যায়? আবুলকেও দেখা যায় না। সামনে মাছের নড়াচড়া লক্ষ করে ও বোধ হয় এক জায়গায় ঝিম ধরে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পানিতে আর হাঁটার শব্দ পাওয়া যায় না।
‘আ..বু..ল...।’ কুটিমিয়া দীর্ঘ উচ্চ স্বরে ডাকে।
কিন্তু আবুলের কোনো উত্তর আসে না। কুটিমিয়া আবার টর্চ মারে। আবুলের মাথা দেখা যায় না। ধানের গোছাও নড়াচড়া করে না। আবুল কত দূরে গেছে?
‘আ...বু...ল...। আবুল রে...।’ কুটিমিয়া লম্বা গলায় ডাকতে থাকে।
আবুল নিরুত্তর।
আবার সে ডাকে, ‘আ...বু...ল...’
হঠাৎ ফজলুর কথা মনে হতে না হতেই কুটিমিয়ার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। হাতের সবকিছু ফেলে উলটো ঘুরে সে দ্রুত নিশ্বাসে বাড়ির দিকে দৌড়াতে শুরু করে। সে দৌড়ায়—কাদা, ধানগাছ মাড়িয়ে সে দৌড়ায় আর গলার সর্বোচ্চ স্বরে চিৎকার দিয়ে ডাকে—‘বাজান...বা-জা-ন...ও বাজান...।’ তার ভয়ার্ত চিৎকার পুরো ঝিলের চারপাশে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। কাদাপানি কোনো কিছুর কথা তার মনে থাকে না। ধানের গোছায়, লতায় তার পা আটকে যায়, দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে গিয়ে আবার সে উঠে দৌড়াতে থাকে, গগণবিদারী শব্দে তার কণ্ঠে কেবলই ‘বাজান বাজান’ ডাক শোনা যেতে থাকে।
প্রায় দু-তিন শ গজ দূরে বাড়িতে ঘরের ভিতরে কুটিমিয়ার বাপজান ঘুমভাঙ্গা চিৎকার দিয়ে ওঠেন—‘তুই কুতায় রে বাজান? তর কী অইছে...?’ ঝড়ের বেগে বেরিয়ে খালপাড়ে এসেই তিনি পানিতে ঝাঁপ দেন, সাঁতরে এপাড়ে আসেন, দৌড়ে কুটিমিয়ার কাছে গিয়ে সাপটে ধরে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে খালপাড়ে এসে দাঁড়ান। দুজনের সর্বাঙ্গ তখন থরথর করে কাঁপছে।
মুহূর্তে সারাবাড়ির মানুষ ঘর ছেড়ে খালের পাড়ে চলে আসে। কুটিমিয়া তখন বাপজানের বুকে মিশে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছে—‘আমি ডরাইছি বাজান—আমারে তাড়াতাড়ি বাইত্তে নিয়া যাও।’
প্রর্বল বর্ষণে খাল ভরে গেছে, প্রচণ্ড স্রোত। কিন্তু আশ্চর্য, কুটিমিয়া এই খাল কীভাবে পার হয়ে এপাড়ে এসেছিল তা তার মনে পড়ে না।
তার ছোটো চাচা ওপাড়ে বাঁধা বৃষ্টির পানিতে ডুবে যাওয়া কোষা নৌকা সেচছে ওদেরকে পার করে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

ফজলুর জীবনেও এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু আশ্চর্য, ঘুণাক্ষরেও কুটিমিয়ার সেই ঘটনা মনে পড়ে নি।




ফজলু আর হামজু পাগলা একসাথে আড়িয়াল বিলে ঝাঁকিজাল দিয়ে মাছ ধরতো। মাছ ধরা তাদের পেশা ছিল। তাদের দুজনের একটা কোষা নৌকা ছিল। হামজু পাগলা বইঠা বাইতো, ফজলু কোষায় দাঁড়িয়ে জাল ফেলতো। ভোর রাতে তারা বাড়ি থেকে বের হতো। আধমাইল দূরে ফকির বাড়ির ঘাটে নৌকা বাঁধা থাকতো। হামজু পাগলাদের বাড়ি একটু দূরে ছিল। ফজলুদের বাড়ির কাছে এসে সে ফজলুকে ডাক দিত, ফজলু জাল নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলে দুজনে একত্রে হাঁটতে হাঁটতে ঘাটে যেতো।

এক ভোর রাতে হামজু এসে হাঁক দিল, ‘ও ফজলু, তাড়াতাড়ি আয় দেহি।’
ফজলু চোখ ডলে ঘর থেকে জাল নিয়ে বের হয়। বউ ঘরের দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ে।
এর বহুক্ষণ পর হামজু পাগলার ডাকে ফজলুর বউয়ের ঘুম ভেঙ্গে যায়।
‘ফজলু, ও ফজলু...’
‘ও হামজু ভাই...,’ তড়িঘড়ি দরজা খুলে ফজলুর বউ শংকিত স্বরে বলে, ‘উনারে না নিয়া গেলা?’
‘কী কও তুমি?’ হামজুর কণ্ঠস্বরে ভয়মিশ্রিত বিস্ময়।
‘একবার না উনারে নিয়া গেলা?’ কাঁপা গলায় সে আবারো বলে।
‘কী কও তুমি? সর্বনাশ অই নাই তো ভাবীজান?’
বউয়ের কলজের পানি শুকিয়ে যায়। সে বলে, ‘তুমার ভাই তো সইত্য সইত্যই তুমার সাতে গেলো।’
ফজলু সত্যি সত্যিই গিয়েছিল, তবে হামজু নয়, অন্য কেউ তাকে ডেকে নিয়েছিল।

ফজলুর বউ আর হামজু পাগলার ভয়ার্ত চিৎকারে মুহূর্তে পাড়াপড়শিরা জড়ো হয়ে পড়ে, সারা বাড়ি, সারা গ্রাম, সম্ভাব্য সব জায়গা তন্ন তন্ন করে ফজলুকে খোঁজা হয়। সবার ধারণা হয় ফজলুর এতোদিনকার শত্রু রমিজ মোল্লাই তাকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে খুন করেছে, তারপর আড়িয়াল বিলের কচুরিপানার নীচে গায়েব করে দিয়েছে।
সবাই আড়িয়াল বিলের দিকে ধাবিত হয়, ফকির বাড়ির ঘাটে কোষা নৌকাটি নেই, ওটি কই গেলো? রমিজ মোল্লাই নিয়েছে।
আড়িয়াল বিলের ঠিক মোহনায় খালের ধারে ফজলুকে পাওয়া গেলো। খালের কিনারে রসি দিয়ে লগির সাথে কোষা নৌকাটি বাঁধা রয়েছে। ফজলু আর হামজু পাগলা প্রতিদিন মাছ ধরা শেষে এই জায়গায় এসে এভাবে নৌকা বেঁধে মহাজনদের অপেক্ষায় থাকতো।
লগি থেকে তিন হাত দূরে ফজলুর শরীর পানির নীচে উলটো করে চুবানো, পা দুটি সটান ওপর দিকে খাড়া হয়ে আছে। পায়ের তালু আর আঙ্গুলগুলো ধবধবে পরিষ্কার, একটুও কাদা লেগে নেই; পানিতে লুঙ্গির কোনা ভাসছে।
ফজলুর দেহ পানি থেকে ডাঙ্গায় তোলা হলো। মাথা থেকে বুক অব্দি কাদার ভিতর গাড়া ছিল। শরীরের কোথাও ধ্বস্তাধ্বস্তির চিহ্ন নেই, নখের একটা আঁচড়ও কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। পাথরের একটা মূর্তিকে উলটো করে আলগোছে কাদায় পুঁতে দিলে যেমন হয়, মনে হলো ঠিক সেভাবে নরম করে ফজলুর মাথা থেকে বুক পর্যন্ত কাদায় গেঁথে দেয়া হয়েছিল।

কুটিমিয়ার অবস্থাও ফজলুর মতোই হতে পারতো। হয় নি, কারণ সবার বিশ্বাস, তার ওপর নিশ্চয়ই অলি-আউলাদের নেক দোয়া আর রহমত আছে। যে আবুল তাকে ডেকে এনেছিল, জানা গেলো প্রায় মাস খানেক আগে সে গোবিন্দপুরে তার ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে গেছে। কুটিমিয়া নিজেই তাকে গুদারায় উঠিয়ে দিয়ে এসেছিল। আবুল বাড়িতে নেই বলে কুটিমিয়ার মনে কত দুঃখ ছিল, অথচ এই কথাটা তার একবারের জন্যও মনে পড়লো না—‘আবুল বাইত্তে নাই, এই রাইত্রে কে ডাকে?’

কুটিমিয়ার নানা একজন পরহেজগার লোক ছিলেন। মায়ের মুখে কুটিমিয়া তার নানার অনেক গল্প শুনেছে। গভীর রাতে নানা মসজিদে যেতেন তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে। একেবারে ফজরের নামাজ শেষ করে আসতেন। এরকম এক গভীর রাতে নানা জিনকে নামাজ পড়িয়েছিলেন।
কুটিমিয়ার মায়ের জীবনে একবার একটা অদ্ভুত ও ভয়ানক ঘটনা ঘটেছিল। অনেক শৈশবে।
কুটিমিয়ার নানা তার মাকে ঘরের বাইরে থেকে নাম ধরে ডাকছেন, ‘রহিমন!’ রহিমন বিবি বাবার ডাক শুনে ঘর থেকে বের হয়। ঘর থেকে বেরিয়ে বাবাকে ডাকতে থাকে, ‘আব্বাজান, আফনে কুতায়?’ ‘এই তো সামনে।’ আব্বাজান জবাব দেন। রহিমন বিবি আরো এগিয়ে যায়। আবার ডাকে, ‘আব্বাজান, আফনে কুতায়?’ ‘এইতো আরেকটু সামনে।’ আব্বাজানের জবাব ভেসে আসে। রহিমন যতো এগিয়ে যায় তার বাবার কণ্ঠ ততো দূরে সরে যেতে থাকে।
এমন সময় রহিমন বিবির চাচি তার কণ্ঠ শুনতে পান। লন্ঠন হাতে ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। রহিমনকে খুঁজে পাওয়া যায় বাড়ি থেকে বেশ দূরে গোরস্থানের কাছে। সেই সময় কুটিমিয়ার নানা তিনদিনের তাবলিগে মইতপুর গিয়েছিলেন। অথচ এই বিষয়টি রহিমন বিবির একদমই খেয়াল ছিল না।
মায়ের মুখে কুটিমিয়া কতবার শুনেছে এই কাহিনি! মা বলতো, ‘রাইত বিরাইতে কুনুদিন এক ডাকে বাইরে যাইবা না।’ অথচ কুটিমিয়া আবুলের ‘এক ডাক’ শুনেই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল ধানক্ষেতে কইমাছ ধরার জন্য।

সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনাটি ঘটেছিল রহমিন বিবির গায়ে হলুদের রাতে। বাড়ি ভর্তি মানুষ গমগম করছে। সুর করে বিয়ের গান গাইছে। হঠাৎ রহিমন বিবির খোঁজ হয়। কিন্তু রহিমন বিবি নেই—সারা বাড়ি খুঁজে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। তখন কেউ একজন খেয়াল করলো—মাঘ মাসের এই রাতে কে যেন পুকুরের পানিতে ঝপঝপ করে গোসল করছে। রহিমনের মা দৌড়ে পুকুর ঘাটে গিয়েই চিৎকার দিয়ে ওঠেন— ‘সবাই দেইক্যা যান—রহিমন বিবি পানিতে দাফাইতেছে। মুক দিয়া গোঙ্গাইতেছে। আফনেরা আহেন। আমার রহিমন মইরা যাইতেছে।’
কুটিমিয়ার নানাজান জানতেন, এ ছিল জিনদের কাজ। রহিমন বিবিকে জিনেরা ধরে নিয়ে পুকুরে চুবিয়ে মারতে চেয়েছিল।

সেই শৈশব-কৈশোর থেকে এসব ভূতপ্রেত আর জিনপরীদের ঘটনা কুটিমিয়ার জীবনে এতো বেশি ঘটেছে যে এক সময় তা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনার মতোই হয়ে পড়ে।
যেখানেই ভূতপ্রেত আর জিনপরীদের গল্পের আসর বসতো, কুটিমিয়া সেখানে গিয়ে বসে পড়ে নিবিড় মনে গল্প শুনতো। ভয়ে তার শরীর জাড়কাটা দিয়ে উঠতো, তবু ওসব তার ভালো লাগতো। সে শুনেছে, রাতবিরাতে চলার পথে কোনো প্রাণীর সাথে দেখা হলে ওটি ভূত কিনা তা বোঝার একটা কৌশল আছে। ভূতের কোনো ছায়া থাকে না। অতএব, মানুষ হোক, আর শিয়াল, কুকুর, গরু, হাতি হোক, পাশ কেটে যাওয়ার সময় প্রথমেই দেখতে হবে মাটিতে ওদের ছায়া পড়েছে কিনা। কিন্তু মুশকিল হলো, অন্ধকার রাতে কীভাবে বুঝবে ওদের ছায়া আছে কী নেই?
আরো সে শুনেছে, পথ চলতে চলতে যদি কোনো অপরিচিত কণ্ঠ নাম ধরে ডেকে ওঠে, কখনোই প্রথম ডাকে সাড়া দিতে নেই—তিন ডাকের মাথায় জবাব দিতে হবে। ভূত কখনো একবারের বেশি ডাকে না। প্রথম ডাকে সাড়া দিলে আর রক্ষা নেই।

ভূতের শরীর বেজায় লম্বা, চিকন আর পাতলা, গলার ওপর থেকে মাথা কাটা থাকে, চোখ থাকে বুকের মাঝখানে, সারা শরীরে মাখানো থাকে জবজবে পিচ্ছিল জাতীয় পদার্থ। অতীতে অনেক সাহসী যুবক ভূতের সাথে কুস্তি লড়েছে। ভূত তাদের চিকন আর পিছল শরীর দিয়ে মানুষকে পেঁচিয়ে ফেলে, মানুষকে ঠেলেঠুলে আস্তে আস্তে পুকুর-বিল-খালের কাদার মধ্যে নিয়ে যায়, পা-ওপরে অবস্থায় মাথাসহ অর্ধেক শরীর কাদায় গেড়ে ফেলে। কখনো কখনো বুড়ো বটগাছ, ঝুপড়ি তেঁতুল কিংবা তালগাছের মাথায় নিয়ে ফেলে দেয়। সাহসীরা উলটো ভূতকে কব্জা করে ফেলে। সেই ভূত তখন মুক্তির জন্য অনেক কান্নাকাটি করে। বন্দি ভূতকে দিয়ে অনেক আশ্চর্য আর অসাধ্য কাজ সমাধা করা যায়।
ভূত সন্দেহ হলেই সর্বাগ্রে তাকে ‘মামা’ বলে ডেকে উঠতে হয়। ভূত তখন আর ভূত থাকে না, সত্যিকারের মামা হয়ে ভাগ্নেকে সারা পথ আগলে রেখে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে যায়।
অবশ্য অপরের কাছে যেসব গল্প শুনেছে, কুটিমিয়ার জীবনে তার কোনোটিই ঘটে নি, ঘটেছে অন্যরকম।

২০০৬
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:৪৭
৩৫টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×