তোমাদের ছেড়ে চলে এসেছি
তার মানে এই নয় তোমাদের কথা আমাকে ভুলে যেতে হবে
চলে গেলেও কিছু স্মৃতি সাথেই রয়ে যায়, তোমরা জানো
ভুলে গেলেও সবকিছু মুছে ফেলা যায় না, তোমরা দেখেছ
তোমাদের ছেড়ে চলে এসেছি, তোমাদের আঙিনায়
বুনে এসেছি রাশি রাশি আলোবীজ, অজস্র বৃক্ষব্যোধি, যত্ন নিও
তোমরা হয়ত দেখো নি, অথবা কখনো টের পাও নি
এখনো সকাল গড়িয়ে দুপুর, এরপর বিকেলের নরম রোদে
ঘাসের সবুজে উদাত্ত কদম ফেলে উন্মুক্ত ময়দানের মাঝখানে গিয়ে
কে একজন দাঁড়ান
দক্ষিণ সরণির ধার ধরে পশ্চিম, উত্তর ও পুবের ভবনের
প্রতিটি বারান্দায়, প্রতিটি ঘুলিঘুপচি পেরিয়ে তাঁর দৃষ্টি অবিরল পাখির চোখে
উড়ে যেতে থাকে, যেখানে একদঙ্গল দুষ্টু বালিকা
শ্রেণিশিক্ষকের চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্লাসের বাইরে এসে গলাগলি ধরে ভীষণ
আমোদে নাচানাচি করে।
কলেজপালানো উন্মাদগুলো কি এখনো পালায়? রেলিঙ ডিঙিয়ে
ঝাঁপ দেয়? আবাহনির মাঠে গিয়ে দিনভর
ক্রিকেটের খেপ খেলে? সমগ্র পিলখানা তন্ন তন্ন করে ওদের খুঁজে
বেড়াতেন নূর হোসেন স্যার; তারপর প্রথমে ভাইস প্রিন্সিপাল,
এরপর আমার সামনে এনে দাঁড় করালেই ওরা ফিক করে হেসে উঠতো।
বলেছিলাম, এ বছর যে ছেলেটি সবচে বেশি কলেজ পালাবে, আমি তাকে
এক অমূল্য পুরস্কার দেব। ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরাই কলেজ পালায়।
ভাইস প্রিন্সিপাল মিটিমিটি হাসছিলেন।
তোমরা কি এখনো কলেজ পালাও, সোনার ছেলেরা?
আমি তোমাদের ক্ষমা করতে চেয়েই পুরস্কারের কথা বলতাম;
এই খোড়া অজুহাত ছাড়া তোমাদের ক্ষমা করার চতুর কোনো কৌশল
আমার জানা ছিল না।
এখনো মাঝরাতে গর্জে ওঠে আজিজ স্যারের ক্লাস; তুমুল হাস্যকোলাহল
আর করতালিতে আঁধার ভেঙে খান খান হয়ে যায়। স্বর্গ থেকে ইথারে
ভেসে আসে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণ –
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
এখনও বাতাসে কান পাতলেই ভেসে আসে শাহনাজ ম্যাডাম
আর মুছুল্লী স্যারের অমৃত কণ্ঠস্বর
যাঁরা উপস্থাপনাকে করে তুললেন কিংবদন্তিরও অধিক শিল্প
ঐ যে দেখো, ‘মায়ের মতো আপন কেহ নাই রে…’ গাইতে গাইতে
অন্তর্ভেদি কান্নায় ভেঙে পড়লেন মনিরুল স্যার।
নজরুলের সুরে মূর্ছনা তুলছেন গানের পাখি ফারহানা ম্যাডাম।
রেখা ম্যাডামের নৃত্যচ্ছন্দে আশ্চর্য দোল খায় ফুল আর পাখির হৃদয়।
হঠাৎ হঠাৎ আমিও অডিটোরিয়ামে ঢুকে পড়ি। কী আশ্চর্য! আহা,
কী অদ্ভুত দৃশ্য দেখো- এখনো তোমরা ঠায় বসে আছো-
অডিটোরিয়ামের কানায় কানায় ভর্তি কী প্রকাণ্ড আলো –
একেকটা উজ্জ্বল অগ্নিকুণ্ডের থেকে
ঠিকরে পড়ছে কী তীব্র দ্যুতিময় তেজ!
আমার ছিল একটা সোনালি দিন, একটা সোনার ডায়াস।
উর্ধ্বপানে একটা তর্জনি।
আকাশে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে। তোমাদের দু চোখে ছিল
স্বপ্নবোনার নেশা। যারা একদিন একটা দেশকে কাঁধে তুলে নেবে,
তারপর তরতর করে সিঁড়ি ভেঙে উর্ধ্বে এবং
আরো অনেক অনেক উর্ধ্বে উঠে দীর্ঘ উড়াল দেবে অমর্ত্যের অন্বেষায়।
তোমার হাতে সোনার কাঠি, তোমার হাতেই জাদুর কাঠি
সামনে তোমার স্বপ্ননগর, তোমার হাতেই স্বপ্নচাবি
তোমরা হবে ভোরের দোয়েল, শালিক, টিয়া, ময়না
এ দেশ তোমার মায়ের গলার সবচে দামি গয়না
অস্থির আলমাজী ম্যাডাম। অস্থির ভাইস প্রিন্সিপাল। সকলেই অস্থির।
তামাম শিক্ষকের চোখ ও হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়ে কুণ্ড কুণ্ড
জমাট কুয়াশা। হায়, ওরা পারবে তো? পারবে তো?
কেমিস্ট্রির দুর্বোধ্য সূত্রাবলি, বায়োলজির পাষাণ কঙ্কাল, গণিত কিংবা
ফিজিক্সের বিঘতপুরু বইয়েরা তখনো থাকবে, প্রতিটা
পরীক্ষার আগের রাতে যেমন করে ওরা আতঙ্কময় হয়ে উঠেছিল, তেমনি।
অস্থির তোমাদের শিক্ষকেরা হয়ত-বা হতাশায় হাল ছেড়ে দেবেন।
এই সুন্দর পৃথিবী তখনো সুন্দরই থাকবে। কিন্তু হায়, তখন
তোমাদের সুবর্ণ এক্সপ্রেস তোমাদের পেছনে ফেলে বহুদূর চলে গেছে,
যেটি এ জীবনে উলটোপথে কখনোই ফিরে আসবে না
তোমাদের তুলে নেয়ার জন্য।
..................................... সকলেই অস্থির।
তামাম শিক্ষকের চোখ ও হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়ে কুণ্ড কুণ্ড
জমাট কুয়াশা। হায়, ওরা পারবে তো? পারবে তো?
.....................................তোমরা পারবে। তোমরাই ফোটাবে জমাট কুয়াশা
ভেদ করে সূর্যখচিত ভোরের উদ্ভাস। তাহলে তোমরা জাগো। আজই
তোমাদের ছেড়ে চলে এসেছি, তার মানে এই নয় আমি নেই
আমার অদৃশ্য ছায়া এখনো তোমাদের চারপাশ ঘোরে
আমার হাতে এখনো জাজ্বল্যমান এক সোনার লাঠি তোমাদের পদচিহ্ন
ধরে ধরে অনলস হেঁটে চলে
তোমাদের ছেড়ে চলে এসেছি, তার মানে এই নয় আমি আমার
সকল অধিকার হারিয়ে এসেছি।
তোমাদের ভালোবাসবার, তোমাদের জন্য একফোঁটা অশ্রু ফেলবার
অধিকার কেউ কোনোদিন কেড়ে নেবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবি না।
কামরুজ্জামান স্যার যখন হঠাৎ হঠাৎ কেঁদে ওঠেন– তখনই
বড্ড টের পাই, আট সহস্র ফুলের নাড়িতে এখনো আমার বাস,
যেখানে এখনো ঘুমের ভেতর কাঁদি,
কাঁদতে কাঁদতেই আট সহস্র ফুলের হৃদয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ি।
২৬ নভেম্বর ২০১৬
উৎসর্গ
আমার একটা বাগান ছিল
সেই বাগানে ফুল ছিল, সবুজ, কচি পাতা ছিল
বৃক্ষ ছিল
আর ছিল অষ্ট হাজার পাখি।
পাখির গানে আমার হৃদয় আকুল হতো
ফুলের গন্ধে আমি বিষম বিমূঢ় হতাম
আমি এখন অনেক দূরের অচিন পাহাড়
ফুলপাখিদের জন্যে আমার বুকের ভেতর কেমন করে
কেমন করে! কান্নাগুলো আটকে থাকে
আমার সাধের ফুলপাখিরা কেমন আছে?
কেমন আছে, কেউ কি জানো?
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১২:১৬