সতর্কতা
লেখাটা প্রাপ্তবয়স্কসম্ভবা। শিরোনামে ইচ্ছে করেই ‘আঠার যোগ’ লেখা হয় নি, পাছে কেউ ভুল ভেবে বসেন অধিক হিটের উদ্দেশ্যে এ চালাকি। তবে পড়তে পড়তে ‘আঠার যোগ’ সুলভ কোনো রশদ না পাওয়া গেলে সেটা পাঠকের উদারতা ভেবে নেব।
অহেতুক বাগাড়ম্বর
আমার পড়া জীবনের প্রথম উপন্যাস একটা প্রাপ্তবয়স্ক উপন্যাস ছিল। গদাধর। যে কথা বলতে মানা। লেখিকার নাম লেখা ছিল রাজিয়া সুলতানা বা কাছাকাছি কিছু। প্রিন্টার্স স্লাইডে কলকাতার কোনো এক প্রকাশনীর নাম লেখা ছিল। তখন আমি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। ১৯৭৬ বা ৭৭ সনের দিকে। আজ থেকে প্রায় ৩৫-৩৭ বছর আগেকার কথা।
আমার পড়ালেখায় হাতেখড়ি হয়েছিল প্রতিবেশী খোরশেদ কাকার হাতে। তিনি বিনা বেতনে খুব আনন্দের সাথে আমাদের ৬-৭ ঘরের ছেলেমেয়েদের পড়াতেন। স্কুলে তিনি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েন। একই স্কুলে আমরা নতুন ভর্তি হয়েছি। ঐ বয়সে কাকাকে অনেক সম্মানিত এবং গুরু শ্রেণির তীব্র ব্যক্তিত্ববান মনে হতো; মনে হতো কাকার বয়স ও স্থান বাবার সমপর্যায়ের। কাকা আমাদের পড়ান, আর আমার পড়ার গতি দেখে তিনি চমৎকৃত হোন। সবার মধ্যে আমিই সেরা ছাত্র, কাকা তা প্রতিষ্ঠিত করলেন।
ঐ বয়সে দিনের বেলা স্কুলে যাওয়া, স্কুল থেকে ফিরে ডাংগুলি, হাডুডু, জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলা, এবং রাতের বেলা কাকার কাছে মহোৎসাহে পড়তে বসা আমাদের রুটিন ছিল। পড়ার প্রতি তখন আমার এত উৎসাহ যে সামনে যা পাই তা-ই পড়ি। বাজার থেকে কাগজের মোড়কে যেসব সওদা আনা হতো, আমি তড়িঘড়ি মোড়ক খুলে সওদা সরিয়ে পড়তে বসতাম। বেশিরভাগ পাওয়া যেতো পরীক্ষার খাতা। ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই’, অথবা ‘দাদখানি চাল মসুরির ডাল...’ ইত্যাদি লেখা থাকতো। মনোযোগ দিয়ে পড়তে পড়তে দেখতাম কাগজ ছেঁড়া, লেখার বাকি অংশ নেই। আফসোস হতো বাকি অংশ পড়তে পারতাম না বলে।
আবার পথের ধারে বালুর উপর অ, আ, ক, খ, বা নতুন শেখা ছোটো ছোটো শব্দ লিখতাম; খাল বা পুকুর কাটা হলে পুকুরের মাটি-কাটা দেয়ালেও লিখতাম। 'বি' থেকে প্রথম শ্রেণিতে উঠবার পর বাড়ির পাশের খালে মাটি কাটা হয়। ওখানে আমরা অনেক লাফালাফি করে খেলাধূলা করেছি। দেয়ালে লিখে হাত পাকা করেছি। একবার একটা ছেলে সেই দেয়ালে খুব সুন্দর করে দুই অক্ষরের একটা বাংলা শব্দ লিখেছিল, যা নারীদেহের একটা গোপনাঙ্গ। তার দেখাদেখি আমি তার চেয়েও বেশি সংখ্যক বার, অধিক সুন্দর করে ঐ শব্দটা লিখেছিলাম। সবাই আমার পারদর্শিতায় অবাক হয়ে আমাকে অনেক বাহবা দিয়েছিল। কিন্তু পরের দিন সকালে গ্রামের মাদবর এসে আমার মায়ের কাছে এ ব্যাপারে নালিশ পেশ করলে মা আমাকে একটা পাট-শলাকা দিয়ে পিঠে কয়েক ঘা আঘাত করেছিল। এ জন্য আমি ব্যথা পেয়েছিলাম খুব কমই। কিন্তু এত সুন্দর করে ঐ শব্দটা লিখবার জন্য বাহবা না দিয়ে মা কেন আমাকে মেরেছিল তা বুঝতে আমার আরো কয়েক বছর সময় লেগেছিল।
খোরশেদ কাকা আমাকে প্রচুর পড়াতেন। অল্প কয়েকদিনেই খোরশেদ কাকার অবৈতনিক পাঠশালায় আমার প্রথম শ্রেণির বই পড়া শেষ হয়ে গেলে কাকা আমাকে দ্বিতীয় শ্রেণির বই পড়ানো শুরু করলেন। দ্বিতীয় শ্রেণিতে কাকার কাছে আমার পারদর্শিতা তুঙ্গে। কিন্তু প্রথম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার কিছুদিন আগে স্কুলের ক্লাসে আবিষ্কার করলাম আমি প্রথম শ্রেণির পড়া কিছুই পারি না। ঐ সময়ে কাকাদের পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারে ঝগড়া হয়েছিল, যার ফলে কাকার কাছে পড়তে যাওয়া বন্ধ ছিল। খুব টেনেটুনে আমি দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠি।
এভাবে অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে উঠবার সম্মান অর্জন করি। এই সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকবার কাকাদের সাথে আমাদের ঝগড়া হয়েছে, যথারীতি আমার পড়া বন্ধ থেকেছে ততদিন। তবে কাকা যেহেতু আমাকে পড়ান, এবং ক্লাসে তিনি বরাবরই ফার্স্ট হয়ে থাকেন (ততদিনে কাকা হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন), আমার মা-বাবা তাঁকে খুব ভালোবাসেন, এবং তাঁর সাথে আমাদের পরিবারের অনেক ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়। এখন আমাকে আর কাকার বাসায় পড়তে যেতে হয় না। তবে তিনি নিয়মিত আমাদের ঘরে এসে বসেন, আমার মেধা নিয়ে মা-বাবার সাথে সপ্রসংশ আলোচনা করেন, দীর্ঘ সময় ধরে আড্ডা দেন। আমাকে মারেন, কাটেন, বেত্রাঘাত করেন। শাসন করেন। আমাকে পড়ান। মাঝে মাঝে এমনও মনে হতে থাকে, খোরশেদ কাকা বোধ হয় আমার মা-বাবারও বয়োকনিষ্ঠ শিক্ষক।
মূল পর্ব
দুই পরিবারে ঝগড়ার কারণে গত প্রায় বছর খানেক ধরে কাকার কাছে আমার পড়া হয় নি। আমি একা একা পড়ি। একা একা পড়েই চতুর্থ শ্রেণির প্রথম সাময়িক পরীক্ষা সম্পন্ন করলাম।
চতুর্থ শ্রেণির প্রথম সাময়িক পরীক্ষার অংক খাতা দিয়েছিল সেদিন। আমি হাইয়েস্ট পেয়েছি। ৮৫। অংকে নিকট অতীতে এত নম্বর কেউ পায় নি, ক্লাসে এ নিয়ে হেডস্যার প্রশংসায় আমাকে মাথায় তুলে নিলেন। ক্লাস ছুটি হলে আমি একদৌড়ে খোরশেদ কাকার কাছে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে তাঁকে অংক খাতা দেখাই- ‘আমি হাইয়েস্ট পাইছি কাকা!’ কাকা খাতা হাতে নিয়ে উলটে-পালটে দেখতে থাকেন। আমাদের গ্রামে খোরশেদ কাকার মতো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র নেই। সেই খোরশেদ কাকাও কোনোদিন অংকে ৮৫ পান নি। কিন্তু আমার খাতা দেখে কাকা খুব একটা খুশি না হয়ে বরং মৃদু তিরস্কার করলেন। খুব সহজ দুটি অংক কাটা গেছে। কাটা না গেলে আমি একশোতে একশো পেয়ে কয়েক তল্লাটে একটা ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারতাম। আমাকে নিয়ে তাঁর অনেক আশা-ভরসা। আমাকে কঠোর অধ্যবসায়ী হতে হবে। মাকে ডেকে এনে তার সাথে আমার লেখাপড়ার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করলেন। কাকা একটা চেয়ারে বসেছেন, মা চৌকিতে পা দুলিয়ে বসা। আমি মায়ের পাশে গিয়ে তার গায়ে ঠেস দিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ মা আর কাকা ঝগড়ার বিষয়াদি নিয়ে কথা বললেন। আমি হাতের বইখাতা চৌকির একপাশে রেখে আবোল-তাবোল কিছু একটা করছিলাম। হঠাৎ দাঁড়িয়ে বুকশেল্ফ থেকে কাকার কিছু বই নামালাম। অষ্টম শ্রেণির বই। ‘সবুজ সাথী’ হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উলটাচ্ছি। ওটা রেখে আরেকটা। আরেকটা রেখে কিছুক্ষণ চৌকি থেকে মাটিতে লাফিয়ে পড়ি; আবার বই নাড়াচাড়া করি। এর মধ্যেই পেয়ে যাই একটা বই, যেটার ওরিজিন্যাল মলাট নেই, বাঁশ-কাগজ দিয়ে পাতলা মলাট লাগানো। পুরোনো। পাতা উলটাই। গদাধর। যে কথা বলতে মানা। আমি কাকাকে জিজ্ঞাসা করি- ‘কাকা, এইডা কোন্ ক্লাসের বই?’ কাকা আমার দিকে একনজর তাকিয়েই কোনো জবাব না দিয়ে মায়ের সাথে কথা বলতে থাকলেন। আমি পাতা উলটাতে থাকি। অনেক দীর্ঘ লেখা। ক্লাসের বইয়ে এত বড়ো লেখা নেই। আমি পড়তে শুরু করি। কথাগুলো হুবহু মনে নেই, এত বছর পর।
...................
‘ও-কাজে গদাধরের প্রথম হাতেখড়ি হয়েছিল লুকোচুরি খেলার মধ্য দিয়ে।
সন্ধ্যাবেলায় এ বাড়িতে লুকোচুরি খেলার ধুম পড়ে যায়। প্রতিদিনকার মতো আজও। বাড়ির শেষ মাথায় যে টিনের ঘরটা আছে, তার দরজায় তালা দেয়া। পাটাতনের নিচে অনেক ধুলোবালি জমে আছে, মাকড়সার বাসায় গা জড়িয়ে যায়। হেলেনা আর গদাধর হুড়োহুড়ি করে পাটাতনের নিচে গিয়ে লুকালো। চারপাশে পাটখড়ি, কাঠ, ফেলনা আসবাব, তার মাঝখানে খুব ছোট্ট, খুব ঘিঞ্জি জায়গাটুকুতে খুব চাপাচাপি করে দুজন বসেছে।
হেলেনা বলে, ‘ধুর, জায়গা হচ্ছে না। এক কাজ কর। আমি শুয়ে পড়ছি। তুই আমার বুকের উপর এসে শুয়ে পড়। জায়গা হয়ে যাবে।’ গদাধর তাই করে। একটু পর সে গদাধরকে বুক থেকে নামিয়ে দিয়ে বলে, ‘খুব গরম! চল, আমরা গায়ের জামা খুলে ফেলি।’ হেলেনা তার ফ্রক আর পাজামা খুলে ফেললো। ওর দেখাদেখি আহাম্মক গদাধরও গায়ের জামা খুলে ফেলে। এবার হেলেনা বলে, ‘দেখবি?’ ‘কী?’ ‘এই দেখ!’......এরপর শুরু হয় রগরগে বর্ণনা....আদি রসাত্মক কাহিনি....... ঠিক এই মুহূর্তে আমি খোরশেদ কাকার ভয়ে খুব শঙ্কিত হয়ে পড়ি- বড্ড ভুল বই হাতে তুলে নিয়েছি। কাকার চোখে ধরা পড়লে আর রক্ষা নেই। আমার শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। অতি সন্তর্পণে দাঁড়িয়ে তাকের উপর আগের জায়গায় বইটি রেখে দিলাম। তারপর খুব নিগূঢ়ভাবে মা আর খোরশেদ কাকার কথাবার্তা শুনতে লাগলাম।
আমার মা যদ্দিন বেঁচে ছিল, আমার সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত, অন্যান্য মহিলাদের সাথে আমার ব্যাপারে আলাপ করতে শুনতাম- ‘আমার পুলাডা খুব সরল সুজা। কিচ্ছু বুজে না।’ মা এ কথা দ্বারা বোঝাতে চাইত নারীদেহ ঘটিত ব্যাপার-স্যাপারগুলো আমি একদমই বুঝি না। অথচ আমার আজও মনে হয়, আমার আজকের বয়সে আমি যতটুকু পাকা, ঐ বয়সে আমার ইঁচড় এর চেয়ে কিছু কম পাকা ছিল না! নুরু নামের যে ছেলেটি আমার সহপাঠী ছিল, সে-ই আমাকে প্রথম জানিয়েছিল মেয়েদের বুকের স্তন বাচ্চাদের জন্য স্তন্য সরবরাহের চেয়ে আরো অনেক মজার কাজে ব্যবহৃত হয়। নুরু আমার চেয়ে বছর দুয়েক বড়ো ছিল। সে প্রায়ই একটা ছড়া কাটতো- ডালের মজা তলে যদি ডাল গলে- আর মেয়েদের মজা গালে। আমি অবশ্য এসব বুঝতে বেশ কিছু সময় নিয়েছিলাম।
আমি সুযোগ খুঁজতে থাকি, কখন খোরশেদ কাকা বাড়ি থেকে বাইরে বের হোন। ঠিক ঐ সময়ে বইটি নিয়ে আসবো। সুযোগটা জুটে গেল এর কয়েকদিন পর। খোরশেদ কাকা বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছেন। তাঁকে খোঁজা হচ্ছে। আশেপাশের কোনো গ্রামেই তিনি নেই। এই ফাঁকেই বইটি কব্জাগত করে ফেলি।
এই বইয়ের রসঘন বর্ণনা থেকে আমি সর্বপ্রথম প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের গভীর যৌবন-রহস্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করি।
পুরো বই পড়ে শেষ করতে আমাকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত যেতে হয়। পড়তে হয় লুকিয়ে লুকিয়ে। অল্প অল্প করে। এর মধ্যে খোরশেদ কাকা বাড়ি ফিরে এসেছেন। বইটি তিনি খুঁজেছেন কিনা তাও জানি না। খুঁজে না পেলে তিনি নির্ঘাত আমাকেই সন্দেহ করবেন। তখন আমার মরণ ছাড়া কোনো পথ খোলা থাকবে না। তবে খোরশেদ কাকাকে এড়িয়ে চলি। তাঁর কাছে পড়তে বসতে হয় না এটাই সবচেয়ে বড়ো স্বস্তি। লেখাপড়া বাদ দিয়ে তিনি এখন খালি বখাটেপনা করেন মা-বাবা-ভাইদের সাথে। বেকার মানুষ। তাঁর বাবা লঞ্চের সারেং। সারেংয়ের তখন অনেক দাম ও কদর। কাকাকে লঞ্চে একটা চাকরি-বাকরি ধরবার জন্যও চাপ দেয়া হচ্ছিল। আমার খুব ইচ্ছে হতো- খোরশেদ কাকা যেন খুব শীঘ্র চাকরির জন্য বাসা ছেড়ে বেরিয়ে যান। তার সাথে এত লুকোচুরি আর ভালো লাগে না।
খুব শীঘ্রই মনের আশা পূরণ হলো। দুই পরিবারের মধ্যে আবার ঝগড়া। এবার দীর্ঘ সময়ের জন্য। প্রায় দুই বছর, বা আরো বেশি। এই সময়ে আমি, নুরু, হাইস্কুলের বন্ধুরা এক জায়গায় জড়ো হয়ে এ বইটি পড়তাম। বইটির মালিক তো আমিই, আর এটা আমিই বেশি সংখ্যক বার পড়েছি, কাজেই গোলাকার আড্ডায় আমি মাঝখানে বসে বইটি পড়ি, মাঝে মাঝে বিশেষ বিশেষ লাইন বা প্যারাগ্রাফ ব্যাখ্যা করি, বাকিরা প্রাণ ভরে সেই রস উপভোগ করে!
ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠবার পর হলো কী, বইটি পালা করে একেক দিন একেক জনকে পড়তে দেবার সিদ্ধান্ত হলো। ব্যস। ‘গদাধর’ চক্রাকারে ঘুরতে থাকলো এক হাত থেকে আরেক হাতে। সপ্তম শ্রেণি পার হলো। বই তখনো ফেরত আসে নি। অষ্টম শ্রেণিতে উঠবার পর বইটি উধাও হয়ে গেল- কার কাছে আছে কেউ স্বীকার যায় না। বইটি হারিয়ে গেল! আমার খুব কষ্ট হতে লাগলো বইটির জন্য। এমনকি কাঁদতেও ইচ্ছে করেছিল।
খুব সম্ভবত নবম শ্রেণিতে উঠে গেছি, অথবা অষ্টম শ্রেণির শেষের দিকে। খোরশেদ কাকাদের সাথে সম্পর্ক এখন স্বাভাবিক, তবে কোনো দহরম-মহরম নেই। একদিন খোরশেদ কাকাদের সেই বাংলা ঘরে গিয়ে বসলাম। কী মনে করে উঠে দাঁড়িয়ে তাকের উপর হাত বাড়ালাম। একটা বই- যেটি স্কুলে আমাদের বন্ধুদেরকে পালাক্রমে পড়তে দিয়েছিলাম, যেটি হারিয়ে গিয়েছিল বলে খুব আফসোস হয়েছিল। বইটি অনেক জীর্ণ ও মলিন হয়ে গেছে। খুব মায়া হলো। বইটির পাতাগুলো খসে যাচ্ছে- কত টর্চার হয়েছে এ বইটার উপর! আমি আলগোছে ‘গদাধর’ হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
এরপর কবে, কীভাবে ‘গদাধর’ কোথা থেকে কী হয়ে গেল তা আর মনে নেই।
পরের উপন্যাস
‘গদাধর’ পড়বার সমসাময়িক কালে আমি আরো কয়েকটা উপন্যাস পড়েছিলাম। ‘সিমি রাণীর গোপন কথা।’ এটি পাশের বাড়ির মনেরা আমাকে পড়তে দিয়েছিল, যখন আমি পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। এ বইটি মনেরাকে পড়তে দিয়েছিল আমার চাচাত ভাই জামাল। জামাল ওর সাথে প্রেম করবার জন্য পাগল ছিল। বইয়ের কাহিনি পড়ে যদি মনেরার মন গলে, জামালের উদ্দেশ্য ছিল এটা! আর মনেরা কেন এটা আমাকে পড়তে দিল? মেলা থেকে বেশ দামি একটা আংটি কিনেছিলাম। সাধারণ আংটির দাম চার আনা থেকে আট আনা। পাশের গাঁয়ের মৌলভ বাড়ির মেলা খাওয়ার জন্য মা আমাকে দেড় টাকা দিয়েছিল। খুব সম্ভবত আমার আংটিটার দাম ছিল এক টাকা বা পাঁচ-সিকা (একটাকা চার আনা)। মেলা থেকে ফেরার পর সবাই একে অপরের জিনিস দেখায়। মনেরাকে আমার দামি আংটিটা দেখালাম। ও খুব আহ্লাদি স্বরে আবদার করে বসলো মাত্র একদিনের জন্য ওকে আংটিটা পরতে দেয়ার জন্য। মেয়েদের আবদার রাখতে পারা যে ভাগ্যের ব্যাপার তা অবশ্য ঢের আগেই বুঝে গিয়েছিলাম! কিন্তু একদিন যায়, দুইদিন, তিনদিন- সাতদিন- মেয়ে তো আংটি ফেরত দেয় না! আংটির জন্য মনেরার পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করি। মাঝে মাঝে মা জিজ্ঞাসা করে, ‘তর আংটি কই?’ আমার জবাব নাই। একদিন সন্ধ্যার একটু পর, দু ঘরের মাঝখানে আবছা অন্ধকারে উলটো দিক থেকে মনেরা আসছিল। খপ করে ওর হাত চেপে ধরে আংটি-পরা আঙ্গুলে জোরে চাপ দিই। ‘উহহহ’ বলে মনেরা কুঁকড়ে ওঠে। হাত ঝাড়তে ঝাড়তে আমার চোখের দিকে তাকায়। আবছা অন্ধকারে মনে হয় ওর গভীর চোখ আমাকে গিলে ফেলছে ক্ষুধায়। ও আমাদের চেয়ে দু বছরের বড়ো। আমার চেয়ে এক বা দু ক্লাস নিচে পড়তো। খুব সুন্দরী ছিল। কথা বলতো শুদ্ধ করে। আমরা বলতাম 'আইছিল', 'আছিল'। মনেরা বলতো ‘এসেছিল’, ‘ছিল’। ওর এ শুদ্ধ ভাষা আমাদের কাছে বড্ড বিরক্তিকর মনে হতো। দল বেঁধে এ নিয়ে মনেরাকে ভেঙাতাম। মনেরা ভুবন-মোহিনী হাসিতে জগৎ ভুলিয়ে দিত। ব্যথার্ত স্বরে মনেরা বললো, ‘কেউ যদি দেখে ফেলতো!’ ‘কী দেখত?’ ‘জানি না’ বলে একটা ঝামটা দিয়ে মনেরা উলটো পথে ফিরে গেল। আমি দু ঘরের মাঝ দিয়ে অন্য উঠোনে যেতেই দেখি মনেরা এসে হাজির। আমার হাতে একটা বই দিয়ে বলে, ‘এটা পড়ো। তোমাকে উপহার দিলাম।’ এই বই পরের দিন জামালকে দেখালে সে আমার উপর ভীষণ ক্ষেপে যায়।
এবার প্রেমোৎপাদক বা প্রেম-সহায়ক বইটির কাহিনি কিছুটা জানা যাক।
গভীর রাতে সিমি রাণী এক বোতল বিষ হাতে নিয়ে বসে আছে। অন্য এক গাঁয়ে তার প্রেমিকও বিষের শিশি হাতে রাত একটা বাজবার অপেক্ষায় সময় গুনছে। একটার সময় দুজন একযোগে বিষপান করে এ ধরাধাম থেকে চিরবিদায় নেবে। তার শিয়রের কাছে পড়ে আছে একটা ডায়েরি- সিমি রাণীর জীবনের করুণ ঘটনাপ্রবাহ।
ডায়েরিটাই হলো সিমি রাণীর গোপন কথা। কী সেই গোপন কথা?
মা-বাবা-হারা সিমি তার বোনের সাথে দুলাভাইয়ের সংসারে বসবাস করে। এক যুবকের সাথে তার প্রেমও হয়। .....গল্প মনে করার চেষ্টা করছি। মনে পড়ে তো পড়ে না। মনে হয় এই তো ধরে ফেলেছি। নাহ্, গল্প মনে নেই। ভাসা ভাসা কিছু মনে পড়ে- তার বোনের একটা অবৈধ সন্তান হয়, যখন তার দুলাভাই থাকে প্রবাসে। দুলাভাই বাড়ি ফিরে এলে বুদ্ধিশুদ্ধিহীন বোন খুব চালাকি করে ঘটনাটা চাপিয়ে দেয় সিমির উপর- বলে বাচ্চাটা সিমির। বিয়ের আগেই প্রেম করে বাচ্চা বানিয়েছে। সিমি সমস্ত দোষ নীরবে মাথায় চেপে নেয়। ....এরপর ঘটনার সাসপেন্স বা সংঘাত কী ছিল, কিছুতেই মনে করতে পারছি না! তবে বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় সিমির এমন একটা কথা লেখা ছিল- ‘বিদায় পৃথিবী।’
বইটা পড়ে আমার কষ্ট হয়েছিল। তবে মনেরার সাথে আমার কিছু হতে পারে নি। মনেরা বড়োদের প্রেমের সামগ্রী ছিল। শাড়ি পরে হেঁটে গেলে ওকে একটা রঙিন রাজহংসীর মতো দেখাতো। অল্প দিনেই ওর বিয়ে হয়ে গেল। মনে মনে ভাবতাম, ‘ধুর, মনেরা কোনো সুন্দরী হইলো?’ আঙুরফল টক, জানেন তো!
অন্য একটি বই আমার মনে খুব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল- ‘দুর্ধ্বর্ষ দস্যু বনহুর’। এ বইটি খোরশেদ কাকার ঘর থেকে এনেছিলাম। ‘গদাধর’-এর সাথেই হয়তো কোনো এক ফাঁকে এই বইটাও নিয়ে এসেছিলাম। তবে ‘সিমি রাণীর গোপন কথা’ আগে পড়েছি, নাকি ‘দুর্ধ্বর্ষ দস্যু বনহুর’, সেটা নিশ্চিৎ করে বলতে পারছি না। যদি আমাকে বলা হয় আমি কোন্ বইটি পড়ে সবচেয়ে বেশি মজা পেয়েছি? আমার একটুও দ্বিধা নেই বলতে যে সে বইটি হলো রোমেনা আফাজের ‘দুর্ধ্বর্ষ দস্যু বনহুর’। নির্জন রাতে গহীন অরণ্যের বুক চিরে দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে এক অশ্বারোহী। সর্বমহলে সে একজন কুখ্যাত দুর্বৃত্ত। অথচ গরীবেরা সাহায্যের জন্য তার কাছেই ছুটে আসে। নির্যাতিতরা নির্যাতনের শিকার থেকে নিষ্কৃতি পেতে বনহুরের শরণাপন্ন হয়। এক গভীর ষড়যন্ত্রের মূলোৎপাটনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বনহুর। ঐদিকে তার প্রেমের অপেক্ষায় প্রহর গোনে এক আত্মোৎসর্গীকৃত প্রণয়িনী- মনিরা। ...গল্প নিশ্চয়ই মনে নেই। এরই মধ্যে হয়তো অন্য কোনো সিরিজের গল্প এর সাথে মিলিয়ে ফেলেছি। কিন্তু এ বইয়ের প্রতিটা অনুচ্ছেদ উত্তেজনায় ভরপুর ছিল। কোথায় যাচ্ছে বনহুর? পারবে তো নিরাপত্তা বেষ্টনি ভেদ করে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে? আমার সেই বয়সে যদি ফিরে যেতে পারতাম- হায়, খুলে বসতাম সমগ্র রোমেনা আফাজ।
এ মুহূর্তে আরেকটি বইয়ের কথা মনে পড়লো- ‘আমি দালাল বলছি।’ এমনও হতে পারে যে, এ বইটি আমি ‘গদাধরের’ও আগে পড়ে্ছিলাম। মনে পড়লো- এটা একটা ছোটোগল্পের বই ছিল। একটা গল্পের নাম ছিল 'আমি দালাল বলছি।' মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার উপর লিখিত। মেহেদী হাসানের বাবা সিলেটের ছাতুগঞ্জে চাকরি করতেন। তাঁর একটা পারিবারিক লাইব্রেরি ছিল। রিটায়ার করার পর গ্রামের বাড়ি ফিরে এলেন। বইগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলেন ঘরের কাড়ে। মেহেদী হাসানের মা মাঝে মাঝেই আমাকে ডেকে নিয়ে তাঁদের কাড় থেকে জিনিসপত্র নামাতেন। জিনিসপত্রের সাথে আমি বইও নামাতাম। একটা বইয়ের কথাই মনে পড়লো- ‘আমি দালাল বলছি’। একজন সৎ, সাহসী মুক্তিযোদ্ধা নিজেকে দালাল বলছিলেন। বিভিন্ন অসংগতি তাঁকে আহত করছিল খুব। ... মনে পড়ছে না। যা বললাম মূলভাব ঠিক এটাই ছিল কিনা তাও নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। শেষের লাইনটা খুব সম্ভবত এরকম ছিল- ‘কারণ, আমি একজন দালাল।’
তিন সাগর কন্যাকে নিয়ে আরেকটা উপন্যাস ছিল- তারা তিন বোন। উপন্যাসের নাম মনে নেই। সপ্তম থেকে নবম শ্রেণি- এর মাঝখানে কোনো এক সময়ে জাহিদ আমাকে ‘শেষের কবিতা’ পড়তে দিয়েছিল। এ সময়ের মধ্যে ‘ব্যথার দান’ও পড়েছিলাম লঞ্চে বসে। এবার আরো কিছু বইয়ের কথা মনে পড়ছে- ‘চিতা বহ্নিমান’- ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের বই। খুব ভালো লেগেছিল। কিন্তু বইটির নামের অর্থ বুঝি নি তখন। এক অহঙ্কারী ধনীর দুলালীর বিয়ে হয়েছে একজন আপাত-মূর্খ, আনস্মার্ট যুবকের সাথে। বিভিন্ন ভাবে জামাইকে অপমান ও অপদস্ত করে সে মেয়ে। জামাই অবশ্য নিজের ব্যক্তিত্ত্ব বজায় রাখে। সে খুব কনফিডেন্ট, একদিন তার বউ নিজের ভুল বুঝতে পারবে। এ জামাই যে কত শিক্ষিত, মার্জিত রুচিবোধ সম্পন্ন, জ্ঞানী লোক, তা অবশ্য মেয়ের কোনো এক বান্ধবী তাকে দেখা মাত্রই বুঝতে পারে। স্ত্রীও শেষ পর্যন্ত স্বামীকে চিনতে পারে। কত বন্ধু-বান্ধবের সামনে তাকে 'অশিক্ষিত' ও বর্বর বলে তিরস্কার করা হয়েছে- আজ দেখে তার সেই বন্ধুরা তার জামাইয়ের নখেরও তুল্য নয়। অনুশোচনার আগুন জ্বলতে থাকে স্ত্রীর বুকে। বহ্নিমান অর্থ হলো যা জ্বলছে, বা জ্বলমান, জ্বাজ্জল্যমান। যে চিতায় অবিরাম আগুন জ্বলছে। জ্বলমান চিতা।
পড়েছিলাম ‘লালুভুলু।’ বিমল মিত্র ও নীহার রঞ্জন গুপ্তের অনেক বই পড়েছি- যেগুলোর নাম মনে নেই। ‘বমি’ নামে উপন্যাসটা- আবু রুশদ, আবু ইসহাক, শওকত ওসমান- কার লেখা জানি না- ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণিতে থাকবার সময়ে পড়ি।
এভাবে কাগজের ঠোঙ্গা থেকে ছেঁড়াটোটা যেখানে যা পেয়েছি পড়েছি। ক্লাসের পাঠ্যবই ছিল সবচেয়ে বড়ো বিনোদনের বই। তখন কোনো পত্রিকা পড়ি নি আমরা, কারণ আমাদের ওখানে তা ছিল না। সংবাদপত্রের অস্তিত্ত্ব শুধু ক্লাসের বাংলা দ্বিতীয় পত্রে ‘সংবাদপত্র’ নামক রচনা-লিখনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। যদ্দূর মনে পড়ে, সপ্তম শ্রেণিতে উঠবার পর যেবার ঢাকা গিয়েছিলাম, সেবার লঞ্চে সর্বপ্রথম এক ভদ্রলোকের হাতে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ নামক সংবাদপত্রটি দেখেছিলাম। আমি তাঁর পাশে বসা ছিলাম। ইত্তেফাক তাঁর হাতে; আমি ঘাড় বাঁকা করে ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে তাঁর হাতে রাখা ইত্তেফাকে চোখ ঘুরাচ্ছিলাম। ভদ্রলোক খুব অবাক এবং বিরক্ত হয়েছিলেন, এখন বোধ করি। তাঁর পড়া শেষ হলে ওটা আমার হাতে দিয়ে ‘তুমি পড়তে পারো?’ বা এ ধরনের কিছু কথা বলেছিলেন। আমার ধারনা, তাঁর বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, এত ছোটো অক্ষরের লেখাগুলো আমার মতো ছোটো চোখঅলা এক কিশোরের পক্ষে পড়া সম্ভব। আমি খুব মনোযোগ সহকারে জীবনে প্রথমবারের মতো সংবাদপত্র পড়ছিলাম। ঐ সময়ে আমাদের দোহারে ‘জয়পাড়া সিনেমা হলে’ প্রচুর ছবি দেখতাম। মেহেদী হাসানদের ঘরে বসে ওদের রেডিওতে, বা প্রতিবেশী সহচর আবুলের রেডিওতে ‘হ্যাঁ ভাই, আসিতেছে’ সিনেমার বিজ্ঞাপন খুব মজা করে ছোটো-বড়ো সবাই একত্রে সমবেত হয়ে শুনতাম। ইত্তেফাকের মাঝের পাতায় এরকম বেশ কিছু সিনেমার বিজ্ঞাপন দেখে আমি যারপরনাই উত্তেজনা বোধ করি। বিজ্ঞাপনের নিচে যে-সব সিনেমা হলের নাম লেখা ছিল, ওগুলো পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে যায়।
জয়পাড়া যেদিন হাঁট বসতো, হাঁটে যাওয়াও আমার জন্য বড়ো আনন্দের ও বিনোদনের ছিল। রাস্তার ধারে বইয়ের দোকান বসতো- তাতে বিভিন্ন ধরনের ধাঁধার বই, গানের বই, যাত্রাপালার বই, নামজ শিক্ষা, কী করিলে কী হয়, রাশিনামা, আব্দুল করিমের কবিতা (গানে গানে সাম্প্রতিক কাহিনি), উপন্যাস থাকতো; দোকানের পাশে টাঙানো থাকতো নানা ধরনের পোস্টার বা ছবি- কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মায়ের কোলে শিশু, ইত্যাদি। বাবা হাঁটে বেচাকেনা করতো, রসগোল্লা বা চানাচুর খাওয়ার জন্য চার আনা, আট আনা করে পয়সা দিত। ঐ পয়সা দিয়ে বই কিনতাম। ছায়াছবির গান, রাশিনামা, ধাঁধা, এগুলোই বেশি কিনতাম। এ অভ্যাসটা অবশ্য খুব ছোটোবেলা থেকেই ছিল। একটু বড়ো হবার পর কিনতে শুরু করলাম যাত্রাপালার বই। গ্রামে যেসব যাত্রাপাল মঞ্চস্থ হতো, সেগুলোর বই এখানে কিনতে পেরে আমি খুব পুলকিত এবং গর্বিত বোধ করতাম। যাত্রাপালা দেখতে গিয়ে কোন্ সিকোয়েন্সের পর কী ঘটতে যাচ্ছে তা আগোভাগেই বলে দিয়ে পাশে বসা মানুষদের তাক লাগিয়ে দিতাম; কেউ কেউ আবার ধমকও দিত আগে আগে কাহিনি বলে দেয়ার জন্য। আমি এ ফুটপাতের দোকান থেকেই আরেকটা উপন্যাস কিনেছিলাম- ‘দুই দিনের সংসার।’ এটা ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির মাঝামাঝি কোনো এক সময় পড়েছিলাম। এ বইটি পড়বার আগে ছাপার অক্ষরে যা পড়তাম, তাই মনে হতো নিখুঁত- এটি পড়েই সর্বপ্রথম আমি বইয়ের কাহিনি ভালো বা মন্দ ইত্যাদি ‘সমালোচনা’ করতে শিখি। এ বইটির প্রথম অধ্যায়ের কাহিনির সাথে পরের কাহিনির কোনো মিল ছিল না। আমি পড়তে পড়তে মনে মনে বলেছিলাম, ঐ অংশ না লিখলেও চলতো। হয়তো এমনও হতে পারে, পুরো কাহিনিটি আমি বুঝতেও পারি নি। এক গৃহবধূ। সুন্দরী রূপসী। এক প্রতিবেশী ভাসুরের সাথে তার প্রেম হয়ে যায়। নিজের সংসার ছেড়ে ভাসুরের সাথে ঘর বাঁধে। কিন্তু নতুন সংসার মাত্র কয়েক দিন স্থায়ী হয়। গল্পের শেষ লাইন আমার মনে এখনও অবিকল ভাসে- ‘তাইতো তার মনে দুদিনের সংসার।’ কিন্তু শেষ কথাটার সাথে অনুচ্ছেদের আগের কথাগুলো কেমন যেন আওগোছালো ছিল, তা আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম।
ক্লাসপাঠ্য বইয়ের বাইরে পড়ার সুযোগ এর চেয়ে বেশি ছিল না। তদুপরি, যে বইগুলো পড়তে পেরেছি ঐ ইঁচড়ে পাকা বয়সে, পরবর্তীতে তা থেকেই বই পড়ার প্রতি কিছু নেশার জন্ম হয় আমার মধ্যে।
ম্যান ইজ মর্টাল। মানুষ মাত্রই বই পড়ে। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সব বয়সে। লিটারেচার ইজ নোবডিজ বেবি। বয়স দ্বারা বুদ্ধি বিচার হয় না। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র হয়েও সেজন্য গদাধর নামক বিখ্যাত বইটি পড়তে সক্ষম হয়েছিলাম। আমি আমার সেই কৈশোরকে কুর্নিশ করি।
৬ মে ২০১২
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১৮ দুপুর ১:৫৭