somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেজর জলিল, আপনি ঠিক বলেছিলেন- ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা’'।

১৬ ই জানুয়ারি, ২০০৮ সকাল ৯:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০০৭ রাত ৯:৫৬

(ইউনিতে ১৬ ডিসেম্বরের প্রোগ্রামে স্টুডেন্টদের পক্ষ থেকে আমার এবং মুনার বক্তব্যের পর তৎকালীন বিমানবাহিনী থেকে পালিয়ে এসে সরাসরি সম্মূখসমরে যুদ্ধে অংশ নেয়া স্যারের বক্তব্য শুনে স্যার এবং স্যারের মত সকল মুক্তিযোদ্ধাদেরকে শ্রদ্ধা জানাতে আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস)

স্যার,
বয়সের কারনে হয়তো অভিজ্ঞতা কম বলেই আমি আর মুনা ওভাবে প্রশ্ন তুলেছিলাম। আমরা আসলে একটু আলোর জন্যে ক্ষুধার্ত মুখ তুলে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছি- কখন মেঘ সরে যাবে! আমাদের ক্ষোভে তাই আপনার মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত স্মৃতিতে যদি আঘাত লেগে থাকে, আমাদেরকে মাফ করবেন! আমরা দু’জন আমাদের জেনারেশনের পক্ষ থেকে আপনাদেরকে আসলে শুধু আমাদের কনফিউশানের কথাই জানাতে চেয়েছিলাম স্যার!

স্যার, আপনি যখন বলছিলেন কীভাবে ধরা পড়লেই সাথে সাথে কোর্ট মার্শালের রিস্ক নিয়ে একদম লাস্ট ফ্লাইটে পালিয়ে এসেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে, কীভাবে যুদ্ধে আপনার পাশেই শহীদ হয় আপনার সহযোদ্ধা, তখন আমার গত বছরের বিজয় দিবসের কথা মনে পড়ছিল। বিদেশের মাটিতে আমরা ক’জন বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রী বুভুক্ষের মত বাংলাকে খুঁজছিলাম! কী বলব, এমনকি আমরা নেট থেকে বিটিভির এড্ পর্যন্ত ডাউনলোড করতাম স্যার! নতুন এড এলেই আমাদের আনন্দ দেখে কে!! সেবার বিজয় দিবসের সারপ্রাইজ-গিফট হিসেবে একজন বাংলাদেশী ছাত্র নেসলের এডটা পাঠালো আমার কাছে, দেখলাম নেসলে’র এডে আমার লাল-সবুজ পতাকাটা উড়ছে, ওরা আনন্দ উল্লাসে কী ভীষন অহংকারে দৌঁড়াচ্ছে, গাচ্ছে ‘চল সবাইইইই……’! ছোটকাল থেকে পিটিতে কতবার পতাকাকে স্যালুট করেছি স্যার, কখনো পতাকার সংজ্ঞা বুঝিনি, অথচ নেসলের এডে সেই একই পতাকা দেখে কেঁদে ফেলেছিলাম! আমার রুমের দরজায় তখনি অপটু হাতে বানিয়ে লাগিয়ে দিয়েছিলাম আমার দেশের পতাকা! তাই আপনার বক্তব্যের সময় শুধু আপনার চোখ ছলছল করেনি স্যার, আমার, আমাদের বুকের ভিতরটাও তখন নদী হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু যখন আপনি বললেন আপনার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা চাচার স্ত্রী কীভাবে ছোট ছোট তিনটা বাচ্চা নিয়ে খেয়ে না খেয়ে থেকেছে- কানাকড়ি সাহায্য পায়নি কারো কাছ থেকে, অথচ মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় যে লোক ইন্ডিয়ায় পালিয়ে থেকে যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে বংগবন্ধুর নরম মনের চূড়ান্ত বদ-ব্যবহার করে কোনোমতে তার গা ঘেষে একটা ছবি তুলে সে ছবি বাঁধাই করে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট তুলে পরবর্তীতে হয়ে গিয়েছে দেশের গন্যমান্য মুক্তিযোদ্ধা(!), তখন আমরা আমাদের হতাশা লুকাতে পারিনা স্যার! আপনি ও আপনার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা মিলে যেভাবে একসময় মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট সারেন্ডার করতে চেয়েছিলেন, আমাদেরও সেভাবে নিজেদের ক্ষোভের কাছে সারেন্ডার করতে ইচ্ছা করে।মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক পজিশন ধরে রাখার ঘৃন্য রাজনীতিকে দলে-পিষে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করে! আমাদের কাছে তাই এ দেশের রাজনীতিবিদরাই সবচে বড় স্বাধীনতাবিরোধী। আমরা মুক্তিযুদ্ধকে পাপোষের মত ব্যবহার করতে দেখে রাগে, ঘৃনায় আর ক্ষোভে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে অপেক্ষায় আছি।একাত্তুরে যেইসব ছোট ছোট বাচ্চারা ছাদের উপর লুকিয়ে লুকিয়ে পাকি আর্মিদের গাড়িতে পাথর ছুড়ত, ইচ্ছা হয় তাদের মত হাতে তুলে নেই পাথর। আমাদের বুকের ভিতরে যে শিল পাথর ফেটে চৌচির হয়ে আছে, সেই পাথরের খন্ড তুলে নিয়ে যেন ছুড়ে মেরে গুড়িয়ে দেই এ দেশের ঘৃন্য রাজনীতি। কিন্তু আমরা পারিনা। আমাদের বুকের ভিতর তাই পাহাড় সমান রাগ, সে রাগ নিয়ে তাই আমরা আমাদের অনিশ্চিয়তার কথাই বলেছিলাম স্যার!

স্যার, আপনিই আমাদেরকে শুনিয়েছেন জেনারেল ওসমানীর সেই ঐতিহাসিক উক্তি- যখন তুখোড় ট্যালেন্ট বাংগালী ছেলে ওসমানীকে জেনারেল রেঙ্ক দিতে বাধ্য হয়ে পাকি জেনারেল তাচ্ছিল্য করে বলেছিল ‘তোমার হাইট যেখানে রিকয়ারমেন্টের চে’ কম সেখানে কীভাবে সাহস কর জেনারেল রেঙ্ক নিতে?’ ওসমানী সোজা তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল- ‘Napoleon was two inches lower than me!!’ সেই জেনারেলের চেহারা তখন কেমন হয়েছিল কল্পনা করে খুশীতে গর্বে যে আমরা উদ্দীপ্ত হয়ে উঠি সেই আমরাই যখন আত্নসমর্পন অনুষ্ঠানে ওসমানীকে খুঁজে পাইনা, এবং খুঁজে না পাওয়ার পিছনের নোংরা ইতিহাস জানতে পারি, আমরা তখন আমাদের হতাশা ঢাকতে পারিনা স্যার! আমাদেরকে মাফ করবেন।

স্যার, আপনি যখন বললেন চুরি করে বংগবন্ধুর ভাষন শুনে কীভাবে আপনারা গোপন শপথ নিয়েছিলেন দেশকে বাচাতেই হবে, তখন আমরাও যেন নতুন শপথে জেগে উঠি! আমরাও যেন দেশ বাঁচানোর এক নতুন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠি! কিন্তু আবার যখন সেই বংগবন্ধুর পরবর্তীকালের ইতিহাস নিয়ে তার মুক্তিযোদ্ধাকালীন অবদানকেও ছোট করে দেখা হয়, কলংকের ইতিহাসের কালো কালো কালি যেন আমাদের মুখেও ছাপ দিয়ে যায়। আমরা তাই স্যার মুখ লুকানোর জায়গা না পেয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠি স্যার! ‘এততদিন পরও তোমরা এখনো বংগবন্ধু আর জিয়া কে তাদের নিজ নিজ মর্যাদা দিতে পারলেনা’-বিদেশীদের এই উপহাসে আমাদের রক্ত ছলকে উঠে।আমরা তাই চিপতে চিপতে তিতা বানিয়ে ফেলা লেবুর মত তিক্ত হয়ে গিয়েছি স্যার!

স্যার, যখন দেখি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একটা সাইকেল পর্যন্ত অক্ষত না থাকা জাপান ধনীদেশগুলোর কাতারে নাম লিখিয়েছে, যখন দেখি বিধ্বস্ত-ক্ষতবিক্ষত ভিয়েতনাম পর্যন্ত উঠে দাঁড়িয়েছে, যখন দেখি আমাদেরই মত সাউথ কোরিয়ার মাথাপিছু গড় আয় হাজার ডলার ক্রস করে যায় আর আমরা চারশ’ ডলারে পৌঁছুতে হিমশিম খেয়ে যাই, যখন ‘ওহ! দ্যাটস পুওর কান্ট্রি? আই স’ ইউর ফ্লাড এন্ড প্রোভার্টি ইন সিএনএন! আইল নেভা ফরগেট দ্য পিকচার অফ আ বেইবি-হারসেলফ বেইবি ক্যারিয়িং এনাদার বেইবি স্টান্ডিং বিসাইডস দ্য রোড!’- শুনতে হয়, তখন স্যার আমরা উদাস হয়ে উঠি ইতিহাসের প্রতি, উদাস হয়ে উঠি দেশের প্রতি, উদাস হয়ে উঠি নিজেদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের প্রতি! আমরা তখন বাধ্য হয়ে বলি- ধুর! এই দেশে কিচ্ছু হবেনা! আমাদেরকে তাই ভুল বুঝবেন না স্যার।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০০৮ সকাল ৮:১২
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×