হাসপাতালের কেবিন থেকে চাঁদ দেখা যায়না। কিন্তু জোছনা দেখা যায়, ভরাট জোছনা। ক’দিন আগেই পূর্ণিমা গেল। এখনো তার রেশ রয়ে গিয়েছে।মনে হচ্ছে, পুরো পৃথিবী যেন জোছনায় ডুবে আছে। চুরি করে হাসপাতালের ছাদে চলে গেলে কেমন হয়? মাথা কেমন ভো ভো করছে, নাহলে নার্সদেরকে ফাঁকি দিয়ে চলেই যেতাম। পনের তলার ছাদে দাঁড়ালে নিশ্চয়ই নিজেকে জোছনা-পরী মনে হবে। মনে হবে আকাশে ভেসে যাচ্ছি……অবশ্য বেড পর্যন্ত বিশাল জানালার পর্দা সড়ালেই বেরিয়ে আসে মেঘ। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ… তুলোর মত… ভিজে ভিজে স্বপ্নের মত…… আমি যেন আকাশের উপর ভেসে ভেসে ঘুমুচ্ছি… জানো, ছোটবেলায় আমার প্রিয় একটা দিবাস্বপ্ন ছিল। আম্মু বকা দিলেই মন খারাপ করে বারান্দায় বসে বসে স্বপ্ন দেখতাম একদিন আমার খুব বড় একটা অসুখ হবে। হসপিটালের সাদা ধবধবে বিছানায় শুয়ে থাকব। আমার মাথার কাছে ফুলদানীতে কয়েকটা ফুল থাকবে। একটা বিশাল জানালা থাকবে যেটা দিয়ে গাছ দেখা যাবে। আর ঐ গাছে একটা পাখির বাসা থাকবে। আমি শুয়ে শুয়ে পাখি আর গাছ দেখবো। তখন আম্মু আর বকা দিবেনা…… এখন ঠিকই ধবধবে সাদা রুমে, সাদা চাদরে শুয়ে আছি। বিশাল বিছানাও আছে। গাছ আর পাখির বদলে আছে মেঘ…… হাজার হাজার মেঘ… ওরা শুধু চলে যাচ্ছে…এতো বিরামহীন মেঘেরা, একটুও থামেনা। কখনো যেন হেঁটে, কখনো যেন দৌঁড়ে…ওরা যাচ্ছেতো যাচ্ছে...ওরা কোথায় যায়? এতগুলো মেঘ থেকে একটাও কি পৌঁছে তোমার দেশে? ওখানে যেখানে তুমি এখন গভীর ঘুম। তোমার জানালার পাশে গিয়ে কি একটাও থমকে দাঁড়ায়? তোমাকে কি বলে দেয় অনেক দূরে একটা মেয়ে হসপিটালের কেবিনে শুয়ে জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে, জোছনা দেখতে দেখতে, মেঘ দেখতে দেখতে তোমাকে ভাবছে।………আম্মু একটু আগে পেপার পড়ে শুনাচ্ছিল। কোন সাংবাদিক যেন সন্তানদের পড়ার খরচ চালাতে না পেরে কিডনী বিক্রি করে দিতে চেয়েছে। টিভিতে নাকি রাহেলার উপর নিউজ করছে। ভারতে ‘নতুন বাংলাদেশ’ মানচিত্র হাতে মিছিল করেছে ‘নতুন বাংলাদেশের’ দাবীদাররা। ……… আমি শুনেও শুনি্না। চুপ করে থাকি। আম্মু আমার অনাগ্রহ দেখে নিজেই চুপ মেরে যায়। আম্মু বুঝেনা এত বকর বকর মেয়েটা এমন চুপ মেরে আছে কেন। আমার আসলে কথা বলতে ইচ্ছা করেনা…… একটা সময় মানুষের জীবনে সবকিছু কত অর্থহীন হয়ে যায়। কাল যখন একটা সময় মনে হচ্ছিল আমি বুঝি চলেই যাচ্ছি- অদ্ভূদ শুন্যতায় মনটা ঘনীভূত উদাসীনতায় ডুবে যাচ্ছিল। এই তাহলে চলে যাওয়া? জীবনে এতকিছুর তবে অর্থ কী থাকে? কী অর্থ থাকে হিংসা আর তীব্র রাগের? কী অর্থ থাকে ভালবাসা আর এত মায়ার? এভাবেই যে সবাই চলে যায়…… বুক ভরা শূন্যতা নিয়ে… আমার তখন লিচুনচুর চেহারা ভাসছিল চোখের সামনে… বড়বড় চোখের মায়াভরা শিশুটা নতুন ধমক দিতে শিখেছে ‘বঅঅপপ!’ এতরাতে ও নিশ্চয়ই ভাবীর কোল ভরে ঘুমিয়ে আছে……… এই ছোট ছোট শিশুরা…ওরাও একসময় বড় হবে। তারপর ওরাও একদিন চলে যাবে…… ইঞ্জেকশানের পর ইঞ্জেকশান…প্রথমে গলা ছেড়ে কাঁদলেও হাল ছেড়ে দেয়া নাবিকের মত একসময় এলিয়ে পড়ে ছিলাম চুপ করে। একটা মানুষ চলে গেলে ঠিকই আবার সব চলে নিজস্ব নিয়মেই। তবে কেন এত অসহ্য হাবুডুবু খেয়েও ভেসে থাকার চেষ্টা?......তারচে’ তুমিও এসো আমার মেঘের উপর… মেঘ ভেসে যাক অনেক অনেক দূর… একসময় ফেরার ঠিকানা হারিয়ে ফেলি…… জীবনের শেষ মোড়ে এসেতো একসময় না একসময় ঠিকনা হারিয়ে ফেলতেই হয়……
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০০৮ ভোর ৬:৩৯