অস্ট্রেলিয়ায় ক’দিন ধরে বাইকি গ্যাং ওয়ারের বাতাস বইছে। পাশাপাশি ড্রাগ ওয়ার-ও শুরু হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। গত এক বছরে এই প্রথম টিভির উপস্থাপক-উপস্থাপিকাদেরকে কেমন তটস্থ দেখা যাচ্ছে। দু’দিন আগে সিডনী এয়ারপোর্টে বাইকি গ্যাং একপক্ষ আরেকপক্ষের উপর হামলা করে সবার চোখের সামনে পিটিয়ে একজনকে মেরে ফেলেছে! আর সপ্তাহখানেক আগে সিডনীর পুলিশ ঘোষিত-ড্রাগ লর্ডকে প্রকাশ্য রাস্তায় তার ছেলের সামনে গুলি করে ঝাঁঝড়া করে দিয়েছে প্রতিপক্ষ।
এইসব ঘটনা নিয়ে লেখার কিছুই থাকতো না যদি আজকের সকালের নিউজ না দেখতাম। বাইকি গ্যাং ওয়ার ঠেকানোর আগাম সতর্কতা হিসেবে ক্যানবেরা পুলিশ গতকাল ক্যানবেরার এক গ্যাং লীডারকে গ্রেফতার করেছে। পাউরুটির টোষ্টে মাত্র কামড়টা দিয়েছি, তখনই টিভি স্ক্রীনে দেখা গেলো ঐ লীডারকে। পাঁচ/ছয়জন পুলিশ মিলেও তাকে কব্জা করতে পারছেনা। একদম মুভি স্টাইলে সব পুলিশ মিলে তাকে রাস্তায় উল্টা করে শুইয়ে ফেলে হাতকড়া লাগালো। এবং একটু পরেই জানা গেলো ঐ গ্যাং লীডার মুসলিম!
মনটা খারাপ না হয়ে উপায় নেই। কারন যে ড্রাগ লর্ডকে রাস্তায় গুলি করা মারা হয়েছে সেও মুসলিম! এবং এদের অধিকাংশই মাইগ্রেটেড লেবানিজ। ঐ ড্রাগলর্ডের ভাইকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়েছে প্রকাশ্যে দিনের বেলায় প্রতিপক্ষের বাড়িতে গুলি করে দু’জনকে মেরে ফেলার অভিযোগে। সে ভাই আবার এখন জেল থেকে ডিক্লেয়ার দিয়েছে সে তার বড় ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নিবে। প্রতিপক্ষের সবাইকে সে খুন করাবে এমনকি যদি তাদের ছোট বাচ্চা থাকে, তাকেও! আজকের খবরে দেখলাম পুলিশ লেবানিজ অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে হেভী আর্মস নিয়ে টহল দিচ্ছে।
এইসব ঘটনার মাঝখানেই আরেক ঘটনা ঘটেছে গত সপ্তাহে। সিডনীর বিখ্যাত মুসলিম ইমাম শেখ হেলাল নিজে মসজিদের দরজা লাথি দিয়ে ভেংগে অন্যদের নামে মিথ্যা ভ্যান্ডালাইজিং’র অভিযোগ করেছে পুলিশের কাছে। পুলিশ এসে যখন সিসিটিভি’র ফুটেজ থেকে বের করেছে শেখ হেলাল নিজে লাথথি মেরে দরজা ভেংগেছে, মসজিদ কমিটি অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ইনভেস্টিগেশানে জানা গিয়েছে মসজিদ কমিটির নির্বাচন উপলক্ষে প্রতিপক্ষ কমিটিকে ফাঁসানোর জন্যে শেখ হেলাল এই ট্রিক্স করেছিলেন। সবচেয়ে থতমত খেয়ে গেলাম তখন, যখন ক্যামেরামেন শেখ হেলালকে সরাসরি লেপটপে ফুটেজটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো তার মন্তব্য কী, ঐ ধূর্ত শেখ বলতে লাগলো, ‘দিজ ইস আ ট্রিক্স! দিস ফুটেজ ইজ আ ট্রিক্স!’ ক্যামেরামেন যখন বললো এটা কীভাবে ট্রিক্স হতে পারে যখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে শেখ হেলাল নিজে লাথথি দিয়ে দরজা ভাংগছেন? মাথায় সাদা কাপড়ে ঢাকা, লম্বা জুব্বা পড়ে চামচা পরিবেষ্টিত শেখ হেলাল ক্যামেরামেনকে রীতিমত ঘেউ ঘেউ করে বললেন ‘আ’ম নট লায়িং, দিস ইজ ট্রিক্স, দিস ফিল্ম ইজ ট্রিক্স! দিস ক্যামেরা ইজ ট্রিক্স! ইউ লায়িং! ইউ লায়ার!’
আমি হাসবো না কাঁদবো তাই বুঝতে পারছিলাম না শেখ হেলালের কান্ড দেখতে দেখতে। গতমাসে আবার সিডনীর আরেক শেখ ফতোয়া দিয়েছেন ‘হাজবেন্ড চাইলে তার বউকে জোর করে সেক্স করতে পারবে’, সোজা বাংলায় ‘হাজবেন্ড তার বউকে রেপ করা বৈধ’! ঐ ঘটনার পর জিপসীর অফিসের ভিক্টর যখন আমাকে বলেছিলো ‘অল্ মুসলিম মোল্লা’স আর সাইকো’; তখন কোন গ্রাউন্ডের উপর দাঁড়িয়ে ভিক্টরের প্রতিবাদ করবো বুঝতে পারছিলাম না।
এখানকার অনেক ইসলামিস্ট আবার এইসব মোল্লাদেরকে ডিফেন্স করেন। তাদের ভাষায় ‘এই সব কিছু ম্যানিপুলেটেড। ঘটনা আসলে ভিতরে’। আমার তখন হাসি আসে- এরা মানুষকে কী এত গাধা মনে করে? মানুষ যতদিন পযন্ত সচেতন ছিলোনা, ততদিন এরা নামতা পড়ে গিয়েছে- এসব মিডিয়ার কারসাজী, এসব আমাদের ইমেজ নষ্ট করার জন্যে সাজানো নাটক! এখন যখন এক একজন মানুষই এক একটা মিডিয়া, এরা এখনো সেই পুরানো ঢোল পিটিয়েই চলছে ‘এসব মিডিয়ার বাড়াবাড়ি!’
কিছুদিন আগে খুব বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছে লিডকাম্ব ট্রেন স্টেশনে। ব্যক্তিগত একটা কারনে এমনিতেই কিছুটা আপসেট ছিলাম। হঠাৎ করে ট্রেনের দুলুনি সামলাতে না পেরে পিছনে এক অজি ভদ্রলোকের পায়ের আংগুলের উপর পা পড়ে গিয়েছিল। আমি ‘আ’ম রিয়েলী স্যরি, এক্সট্রিমলী স্যরি স্যার’ বলেও কোনো কাজ হলোনা। ভদ্রলোক ট্রেনের এত্তগুলো মানুষের সামনে রীতিমত চিৎকার করে বলে উঠলেন ‘ইউ বেগার মুসলিম টেররিষ্ট!’ আমি কোনোরকমে নিজেকে সামলে শুধু বললাম ‘আ’ম রিয়েলী স্যরি এন্ড আ’ম নট টেররিষ্ট। ইট ওয়াজ জাস্ট এন এক্সিডেন্ট স্যার’।
ভদ্রলোক লিডকামে নেমে গেলেন, নেমে যাওয়ার আগে পিছন ফিরে আমাকে আগুন ঝড়া লুক দিয়ে গেলেন। এম্নিতেই মন খারাপ, আরো মন খারাপ করে অবশেষে সিট পেয়ে যখন বসলাম, অনেক্ষন পর দেখি পাশের বুড়ি অজি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ঘটনা কী বুঝলাম না। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেসও করলাম না। শালার জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আবার কোন ফ্যাসাদে পড়ি। বুড়ি দেখি এবার নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করে ‘আপসেট?’
বললাম- আপসেট হওয়াই কি স্বাভাবিক না?
বুড়ি তখন যা বললো তার মর্মার্থ হলো- ঐ লোকের আসলে দোষ দেয়া যায় না।
যখন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম কারন কী।
বুড়ি সেই বিখ্যাত ডায়লগ শুনিয়ে দিল ‘অল মুসলিমস আর নট টেররিষ্ট, বাট অল টেররিষ্ট আর মুসলিমস’।
এই ডায়লগের পক্ষে বিপক্ষে প্রচুর যুক্তি দেয়া যায়, কিন্তু তর্ক করতে মন চাইলনা। বুড়ি নেমে যাওয়ার আগে আমার হাতের উপর তার জরাজীর্ণ হাত রেখে আমার মাথার স্কার্ফের দিকে ইংগিত করে বললেন, ‘ডোন্ট বি আপসেট মাই চাইল্ড। ইউ হ্যাভ টু পে দ্য কস্ট হোয়েন ইউ ট্রাই টু বি আইডিয়ালিস্টিক’।
এক অজি গালি দিয়ে যায়, আরেক অজি মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়; এক শেখ একেক পর এক গ্রাম্য পলিটিক্স করে মসজিদ কমিটির নির্বাচনে জিততে, আরেক শেখ একের পর এক মেয়ে বিষয়ক ঘৃণ্য ফতোয়া দিয়ে যায় হয়তো মিডিয়ায় আসার লোভে; আর আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা- হাসবো না কাঁদবো?