বারাক ওবামা, আপনাকে অভিনন্দন জনাব। কিন্তু শান্তি তো মুকুটের শোভা নয়, তা বাস্তবের জ্বলন্ত প্রয়োজন।
আপনার অভিষেক হলো ২০ জানুয়ারি। এর দশ দিনের মধ্যেই আপনার নাম নোবেলের মনোনয়নের জন্য জমা পড়ে। আপনি সেদিনই বিজয়ী হয়ে গিয়েছিলেন। সম্রাটদের পরীক্ষা দেওয়ার দরকার হয় না। আমেরিকার হারানো ভাবমূর্তি ফেরাতে দরকার ছিল একজন বিনয়ী সম্রাটের এবং একটি নোবেল শান্তি পুরস্কারের। আপনার মধ্যে দুটোই আজ এক দেহে মিলে গেল। আপনি এই গ্রহের সবচেয়ে সম্মানিত ও সৌভাগ্যবান রাজপুত্র, কায়রোর সুধী সমাবেশে আপনার সালামের জবাবে আপনাকেও জানাই শুভেচ্ছার সালাম।
অথচ যুদ্ধ-সামরিকায়ন-দেশ দখল আর করের টাকার হরিলুটের সিলসিলা কিছুই তো পাল্টায়নি। প্রেসিডেন্টের রং বদল হয়েছে মাত্র। সাদার জায়গায় এসেছেন কালো আর উদ্ধত আহাম্মকের বদলা খাটছেন একজন সুদর্শন, সদাহাস্যময় ও বুদ্ধিমান প্রেসিডেন্ট। জর্জ বুশের বিষের বীণ দুনিয়াকে ভীত করেছিল, আপনার আশার বাঁশিতে জেগেছিল প্রতিকারের সাধ। রাজনীতি থেকে আশা হারিয়ে গিয়েছিল, আপনি তার পুনর্জন্ম ঘটালেন। আমাদের দেশেও উঠলো দিনবদলের হুজুগ। কিন্তু আপনিই একে একে ফিরিয়ে নিয়েছেন সব প্রতিশ্রুতি, ধ্বংস করেছেন সেইসব আকুল আশাকে। নোবেলজয়ের দিন আপনি হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে আফগানিস্তানসহ পশ্চিম এশিয়ার ভাগ্যনির্ধারণের বৈঠক করছিলেন। ‘যুদ্ধ পরিষদের’ সেই বৈঠকে সেনাপতি ছিলেন, উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন, হিলারি ক্লিনটনসহ ছিল আপনার ডান ও বাম হাতেরা। এর আগের দিন মার্কিন কংগ্রেস আপনাকে ৬৮০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা বরাদ্দ দেয়। ঐ বৈঠকে আপনি যখন আফগানিস্তানে আরও ৪৫ হাজার সেনা পাঠাতে রাজি হলেন, একই সময়ে অসলোয় ঘোষিত হলো আপনার নাম।
সঙ্গে সঙ্গে আপনার ওয়্যার কাউন্সিলের নাম হয়ে গেল ‘পিস কাউন্সিল’, যুদ্ধগুলো হয়ে গেল শান্তি, বৈশ্বিক সামরিক আধিপত্যের কর্মসূচির নাম হয়ে গেল মানবিক উদ্যোগ আর দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনীর কমান্ডার ও অজস্র ভয়ঙ্কর অস্ত্রের মালিক আপনি বনে গেলেন শান্তির দূত। আজ থেকে যেই আপনার আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে বা আপনার সমালোচনা করবে যে রাজনীতিক; তারা হয়ে গেল সন্ত্রাসী বা স্বৈরাচার। মার্কিন রাষ্ট্রযন্ত্র ও পেন্টাগন আপনার গায়ে বুশের রেখে যাওয়া যে নেকড়ের ছাল পরিয়েছিল, হরিণের মসৃণ চামড়ায় নোবেল কমিটি তা ঢেকে দিল। আজ আপনি সমালোচনার ঊর্ধ্বে। আপনাকে কুর্ণিশ।
অর্থনৈতিক মন্দায় আপনার দেশসহ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছে। কিন্তু ওয়ালস্ট্রিটের লুটেরাদের আপনি বুশের কায়দাতেই বেইল আউটের নবযৌবন দিয়েছেন। আপনি বুশের অগণতান্ত্রিক কালাকানুনের একটাও সরাননি। গুয়ানতানামো বে-এর দোজখ বন্ধের বদলে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিতে তৃতীয় দুনিয়ার গোপন কারাগারে নির্যাতন চালানোর বন্দোবস্ত করেছেন। আপনি মার্কিন দেশে নতুন স্বাস্থ্যবীমা কর্মসূচিকে অবহেলায় পরাজিত হতে দিয়েছেন। আপনার হাত দিয়েই এক-তৃতীয়াংশ মার্কিন নাগরিকের ব্যক্তিগত কর সামরিক খাতে চলে যাচ্ছে। তাহলেও মিডিয়ার কল্যাণে আপনার সুবচনী হাসি আর সুবোধ চেহারা আমাদের ভাবতে শেখায়, আপনি আমাদের আত্মীয়। সবাই আমাদের শেখায়, আর আমরা মগজ খাটানো বাদ দিয়ে ভাবি বিশ্ব-সম্রাট তো আমাদের আত্মীয়ই লাগে! আপনাকে তাই আমরা ভুলব না।
নোবেল কমিটি আপনাকে পুরস্কার দেওয়ার কারণ হিসেবে বলেছে, ‘ওবামা পরমাণু অস্ত্রবিহীন পৃথিবীর জন্য কাজ করেছেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে সংলাপের পরিবেশ এনেছেন এবং বহুপক্ষীয় কূটনীতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন।’ আমরা জানি, স্নায়ুযুদ্ধের পরের সবচেয়ে বড় সামরিক আয়োজন আপনি হাতে নিয়েছেন। রাশিয়া-চীন-ইরান আর উত্তর কোরিয়া ঘিরে (First Strike Global Missile Shield System) ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন হচ্ছে। আগাম পারমাণবিক হামলার জন্য প্রস্তুত পেন্টাগন। রোমান সাম্রাজ্যের আদলে আফ্রিকায় আফ্রিকম (African Command) আর দক্ষিণ আমেরিকায় সাউথকম (Southern Command) কায়েম হয়েছে। ভেনেজুয়েলাকে সামলাতে কলাম্বিয়ায় সামরিক ঘাঁটি বসছে, হন্ডুরাসের জনপ্রিয় সরকার উচ্ছেদ হয়েছে আমেরিকারই মদদে। পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বকে খেলো করে দিয়ে সেখানে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে আপনার চালকহীন বিমানগুলো। আপনার আমলে ইসরায়েলে সামরিক সাহায্য কমার কথা থাকলেও বেড়েছে। ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে একসঙ্গে একাধিক বড় যুদ্ধ চালানোর জন্য তৈরি করা হচ্ছে পেন্টাগনকে। বীভত্স সব অস্ত্র যোগ হচ্ছে তাদের ভাণ্ডারে। মহাকাশ, সমুদ্র আর বিশ্বের ভূমির সামরিকায়নের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকেও হার মানাচ্ছে। আপনি এই সব আয়োজনের মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন। আপনাকে উপেক্ষা করে সাধ্য কার?
আপনার শান্তির সশস্ত্র আহ্বানে বিশ্বাস রাখেনি ইরান, তালেবান ও উত্তর কোরিয়া। পাকিস্তান ও মিয়ানমারের সামরিক জান্তা পাচ্ছে ছাড়। রুশ ভালুক পুতিন আপনার বন্ধুত্ব নেননি। আপনার আহ্বানে ফিলিস্তিনে জবরদখল বসতি স্থাপন ও হত্যা বন্ধ করেনি ইসরায়েল। আপনি তার উপহাসের পাত্র। আপনি ভারতের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করেছেন তাকে দিয়ে চীনকে সামাল দেওয়ার জন্য, ভারতকে এ অঞ্চলের আমেরিকা বানানোর জন্য। তাতে করে এশিয়ায় অস্ত্র প্রতিযোগিতা আরও বেড়েছে।
কিন্তু এটা ঠিক যে, বেকার কূটনীতিকেরা আরামকেদারা থেকে উঠে বসতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের এখন সাম্রাজ্যের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়াতে হচ্ছে। কারণ বিশ্বের কেন্দ্র আমেরিকা হলেও তার বৃত্তটি ছোট হয়ে গেছে। আপনার দেশ যখন ইরাক-আফগানিস্তান নিয়ে ব্যস্ত ছিল তখন ইউরোপে রাশিয়া ও তুরস্ক, এশিয়ায় চীন ও ইরান এবং আরবে মিসর ও সিরিয়া নিজস্ব বৃত্ত তৈরি করে ফেলেছে। এদের সঙ্গে সমঝোতা না করলে উদ্দেশ্য হাসিল হবে না। আমেরিকার দম কমিয়ে দিয়েছে ইরাক ও তালেবান, আরেকটি বড় যুদ্ধ আপনি এখনই করতে পারবেন না। সাম্রাজ্যের এই দুর্বলতাকেই গুণ বলা নোবেল কমিটির অবদান। সামরিকায়ন, অবৈধ যুদ্ধ ও দাপটেরই সবুজ সংকেত এই পুরস্কার। আপসপন্থার আড়ালে ছুরির শান আপনারই কেরামতি।
জনতার আশাকে আহত করলেও আপনি পতনমুখী সাম্রাজ্যের আশাকে চাঙা করেছেন। আবার একাধিপত্য আসবে বলে আপনাকে নেতা মেনেছে পাশ্চাত্য। আপনি শিল্পায়িত দেশগুলোকে দিয়েছেন বাস্তব ভরসা আর এশিয়-আফ্রিকীয়-ল্যাটিনো-আরব ও মুসলিমদের সামনে দিয়েছেন রংদার বক্তৃতা। আপনার হাসিকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় মানুষের, আপনার হাত নাড়ায় তারা তবু অভয় পেতে চায়। আপনার আশার স্পর্ধার কাছে তারা তাদের নিজস্ব আশাবাদ খুইয়ে ফেলেছে। তারা হারিয়ে ফেলেছে বিজ্ঞাপন ও রাজনীতির ভেদ। তাদের চোখে এই শতাব্দীর প্রথম রাজনৈতিক নায়ক তো আপনিই! আঞ্চলিক নায়কদের দিন শেষ। সাম্রাজ্যের সর্বত্র আপনি যাতে সূর্যসমান হন, নোবেল তারই বিনিয়োগ। ধন্য আশা কুহকিনী!
নোবেল কমিটি বলেছে, পুরস্কার দিয়েছি ‘এ কারণে যে তিনি যা অর্জন করতে চাইছেন আমরা তাতে সমর্থন দিতে আগ্রহী। ...আমরা পরিষ্কার সংকেত দিচ্ছি যে, তিনি যা কিছুর পক্ষে আমরা তারই পক্ষে।’ তাহলে কি নোবেল কমিটি নতুন সম্রাটের অসীম ক্ষমতাকেই অভিষিক্ত করছে? আপনার আমলনামায় বড় কোনো সুকৃতি এখনো লেখা হয়নি। মাত্র আট মাসে সেটা সম্ভবও নয়। তাহলে এ পুরস্কারের কী কারণ? কারণ ছাড়া যদি কার্য না-ই হয় পুরস্কার তাহলে ফলল কীভাবে? ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম যা, আপনার নোবেলপ্রাপ্তিও তা। জর্জ বুশ আগাম আক্রমণের ধারা চালু করেছিলেন। নোবেল কমিটি দিল আগাম পুরস্কার। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মতোই এ পুরস্কারও যখন অহেতুক ও ব্যর্থ বলে প্রমাণ হবে, তখন দেওয়া হবে পরিবর্তিত বাস্তবতার দোহাই। বাস্তবতাকে ইচ্ছামতো সাজানো ও ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা আছে বলেই যুদ্ধ করে আসার পর উড্রো উইলসন, টেডি রুজভেল্ট, হেনরি কিসিঞ্জার, শিমন পেরেজদের মতো মার্কিন-ইসরায়েলি প্রেসিডেন্টরা শান্তির শিরোপা জিততে পারেন! সাবাস নোবেল কমিটির তেলেসমাতি!
ধন্য আশা কুহকিনী! আশার দাবিতেই আপনি জনপ্রিয় হয়েছেন। কিন্তু আপনি যে আশার সমাধির খাদেম হতে চলেছেন সেই সমাধিতে ইরাক-ফিলিস্তিন-আফগানিস্তানসহ অনেক আশার বৃক্ষ শুকিয়ে কাঠ হচ্ছে। বুশ-ব্লেয়ারের উত্তরসূরি হয়ে তাদেরই দেওয়া মুকুটে আপনি পরলেন সেই বৃক্ষের একমাত্র সবুজ পাতাটি—যার নাম ছিল আশা। কেবল আশা জাগানোর জন্যই আপনাকে ভালোবেসেছিল এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার কালো মানুষেরা। আশার সওদাগর, আমরা কি তবে আশার অধিকারও হারালাম?
শান্তি কখনো মুকুটে থাকে না, সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় থাকে না। শান্তি গুমরে মরছে যুদ্ধক্ষেত্রে, উদ্বাস্তু শিবিরে, ক্ষুধার্তদের উদরে, স্বজনহীন শিশুদের কান্নায়। শান্তি শায়িত আছে বিশ্বের সব গণকবরে। বাংলাদেশ, ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, আর্মেনিয়া, বসনিয়াসহ সব গণহত্যাকে যখন আপনি গণহত্যা বলে চিনবেন, যারা তা ঘটিয়েছিল তাদের যখন শান্তির ঘাতক বলে মানবেন এবং ওই সব গণকবরে শায়িতদের আত্মীয়-পরিজন-দেশবাসীকে সমকক্ষের মর্যাদা দেবেন, সেদিনই আপনি শান্তির রাজপুত্র হবেন।
রূপকথার রাখাল স্বপ্নে মুকুট পেয়ে রাজা হয়ে যেতে পারে, জনতার রাখালকে তা অর্জন করতে হয়। আপনাকেও তা অর্জনের আহ্বান জানাই। কারণ আশার মৃত্যু নাই এবং আশা সর্বদাই স্পর্ধাবান।
*লেখাটি আজকের প্রথম আলোয় প্রকাশ পেয়েছে।