somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দৃকের ঘটনায় চীন বা তিব্বত নয়, সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে মামলাটা সরকারের সঙ্গে

০৩ রা নভেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দৃক কাণ্ডে বুঝলাম বুদ্ধিজীবিতার মুড়িঘন্টে ঝোলের ঢলে মাছের মুড়োটাই ভেসে গেছে। এবং এও বুঝলাম, কর্মহীন ‘সঠিক চিন্তা’ দায়িত্বহীনও হতে পারে। তাই প্রতিবাদহীন ফাঁকা মাঠে পুলিশ এসেছে, প্রদর্শনী বন্ধ হয়েছে, দৃকের দরজায় তালা পড়েছে। সুকুমার রায় লিখেছিলেন, ছিল একটা রুমাল হয়ে গেল বেড়াল। চীনা দূতাবাসের লাল রুমাল চোখের পলকে স্বদেশি স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রক্তচু শাঁসানি থেকে নিষেধাজ্ঞা হয়ে যেতে আইন লাগলো না, লাগলো যাদু। যাদুবলেই দেশটা ভারত-আমরিকার পাশাপাশি চীনেরও হয়ে গেল। প্রশ্নটা তাই, সখী তুমি কার? তিব্বত তুমি কার? দৃক তুমি কার? পুলিশ তুমি কার? চিন্তাবিদ তুমি কার? ভারতের, চীনের, আমেরিকার না বাংলাদেশের?

ঘটনা যে আকাশ থেকে পড়ে না তা তো আমরা জানিই। ল্যাম্পপোস্টকে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে প্রতিবাদ করতে দেওয়া হলো না। অকথ্য জুলুম-নির্যাতন হলো। মার্কিন-ব্রিটিশ তেলকোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট পেট্রোবাংলার সামনে প্রতিবাদ করায় বেদম পিটুনি খেতে হলো আনু মুহাম্মদসহ তেল-গ্যাস কমিটির অজস্র কর্মীকে। ফরহাদ মজহারের ঢাকা কাবে ঢুকতে না পারার বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ ও তাঁর লুঙ্গি পরাকে ‘মৌলবাদী’ বলে বদনাম দেওয়া হলো। সমুদ্রের গ্যাস ইজারার বিরুদ্ধে জনআন্দোলন থেকে শুরু করে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যায্য আন্দোলনকে সরকারের মন্ত্রীরা বললেন ‘ষড়যন্ত্র’। এখন দৃকের ফটকে তালা ঝুললো। এগুলো কীসের আলামত? এসবের যে কোনোটির সঙ্গে যে কারোরই দ্বিমত এমনকি বিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু প্রহার করা, পা ভেঙ্গে দেওয়া কিংবা তাদের ঘরবাড়ি-প্রতিষ্ঠানে তালা দেওয়া, বদনাম দিয়ে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা ফ্যাসিবাদী খাসলত। এইটা ভুললে চলবে না।

ঠিক যে চীন-ভারত বুঝা দরকার। তবে তার জন্য তিব্বত বা কাশ্মীর যাওয়ার দরকার নাই। দৃকে গেলেই চলতো। দৃক এলিট পেইন্ট না বার্জার পেইন্ট না রক্সি পেইন্ট সেটা পরের আলোচনা। এই দুইকে এক নিঃশ্বাসে করলে অনেক সময় কিংকর্তম্যবিমূঢ় হতে হয়। একাত্তরে অনেকে এরকম দশায় পড়েছিলেন।

আমাদের অধিকার রয়েছে ইরাক-আফগানিস্তান-ফিলিস্তিন বা তিব্বত-মণিপুর-কাশ্মীর কিংবা মাওবাদী-তালেবান কিংবা মার্কিন-ভারত-চীন বা ইসরায়েলের বা যে কারো পে বা বিপে মতপ্রকাশ করবার। কে ভুল বা কে সঠিক তা নিয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে বিতর্কও চলতে পারে। এটুকু আইনী স্বাধীনতা নাগরিক অধিকারের গোড়ার শর্ত। এটুকু হলো পায়জামার ফিতা, এটা না থাকলে কোনো গেরো দিয়েই সংবিধানের লজ্জাস্থান ঢাকবার কোনো সুযোগই পাবে না বুর্জোয়া আইন ও নৈতিকতা। নাগরিকের বিবেকের জিম্মাদার রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যক্তি বা সমাজ স্বয়ং। এ চিন্তা ছাড়লে বিপদ।

কথা হলো, রাষ্ট্রযন্ত্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী বন্ধ করে দিয়েছে। এর জন্য কোনো অজুহাত দেখানোরও দরকার মনে করে নাই তারা। ১৯৯৩ সাল থেকে অন্তত হাজার দুই প্রদর্শনী হয়েছে সেখানে। সারাদেশে অহরহই তা হয়ে আসছে। তবে কি সবই বেআইনী? পুলিশ না বললেও আমরা জানি, ভারতের সঙ্গে যে মৈত্রী চুক্তি করা হয়েছিল শেখ মুজিব আমলে, পরের সব সরকার যা নবায়ন করেছে এবং সংসদে যা বিধানের মর্যাদা পেয়েছে; সেখানে এরকম ধারা আছে যে, বন্ধুরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। আর কার সঙ্গে এরকম চুক্তি করা আছে কে জানে? এটা গেল একটা দিক।

মামলাটা তাই আগে রাষ্ট্রের সঙ্গেই মীমাংসা করে নেওয়া দরকার। এই রাষ্ট্র আজ সাম্রাজ্যবাদের আড়কাঠি বনে গেছে। একে মুক্ত করতে হলে জনগণের বিরুদ্ধে এর যে দাঁতনখ সেটাকে চিনতে হবে, ঠেকাতে হবে। রাষ্ট্রকে জনগণের অধীন করা ছাড়া বাইরের চাপ বা আঘাত কিছুই মোকাবেলা করা যাবে না। কারণ, টিকে থাকতে গেলে রাষ্ট্র প্রয়োজন। সেকারণেই তার ওপর নিজেদের অধিকার ও ক্ষমতাকায়েম ছাড়া উপায় নাই।

দৃক এখানে একাই ভিক্টিম হয়নি, ভিক্টিম হয়েছে স্বাধীন নাগরিক তৎপরতা। দৃক বা এর কর্ণধার শহীদুল আলমের পোস্টমর্টেম করে এ দিকটা ঢাকা যাবে না। বরং অবৈধ চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে শহীদুল আলম রাষ্ট্রের অন্যায় ক্ষমতাপ্রয়োগকে উদোম করে দিয়েছেন। দালাইলামার নির্বাসনে যাওয়ার ছবি দেখানোর ইচ্ছা জেগেছিল যে ফটোগ্রাফারের, চাপের মুখেও তিনি তাঁর নাম-ধাম-নিবাসের তথ্য এসবি-কে দেননি। এটা যদি কৌশলী চালও হয়, সেটা তাঁরই বাহাদুরি। পুলিশের কর্ডনের মাঝখানে শহীদুল আলমের একা দাঁড়িয়ে থাকা এ ক্ষেত্রে আলোকচিত্রী, আলোকচিত্র এবং মতপ্রকাশের অধিকারের প্রতি পিতৃসুলভ দায়িত্বের পরিচয়ই মনে হয়। আর আমরাও জানলাম কোন ‘গণতন্ত্রের’ সামিয়ানা তলে আমাদের বাস।

কাশ্মীর বা মণিপুর বা আসামের স্বাধীনতা আন্দোলনে নানান শক্তির ‘হাত’ থাকতে পারে, কিন্তু মোটাদাগে এগুলো কারো পকেটের আন্দোলন নয়। কিন্তু দালাইলামা ভারতের পকেটে বসে আন্দোলন চালাচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি ওবামার কাছে সাম্রাজ্যের কৃপা প্রার্থনাও করে এসেছেন। ভারতের অরুণাচলের ধর্মশালায় তাঁর আস্তানাটি আর কিছু নয় ‘র’ ও সিআইএ-র আখড়া। অর্থের যোগানও কম নয়। ধর্মশালার বিক্ষোভকে তিব্বতের রাজধানী লাসা’র বিক্ষোভ হিসেবে দেখানোয় সিএনএন-এর জারিজুরিও ফাঁস হয়ে গিয়েছে। তার মানে এই নয় যে, তিব্বতে চীন বর্বর দখলদারি বজায় রাখেনি। ঠিক ভারত যেমনটা করছে কাশ্মীরে-মণিপুরে।

দক্ষিণ এশিয়া উত্তপ্ত ও অস্থির হয়ে উঠছে। বাঙলাদেশেরো এক সীমান্তে চীন-মায়ানমার আর বাকি তিন দিকে ভারতের তুমুল উত্থান ঘটছে। বাংলাদেশ যেন আটকে পড়ছে এ দুটি পর্বতের মাঝখানের চিপা গিরিখাতের মধ্যে। দুটি চলন্ত জাহাজের মাঝখানে পড়া ডিঙিনৌকার মতো বাংলাদেশ উথাল-পাথাল দুলছে। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো দুনিয়াকে নিজেদের মতো সাজাতে গিয়ে যুদ্ধের ঝড় জাগাচ্ছে, অর্থনীতিতে ঘটাচ্ছে ভূমিকম্প। এসবের ঝাপট আর কম্পনে আমরাও কম কাঁপছি না। ভারতীয় দূতাবাসের নির্দেশে নির্যাতিত ও বন্দী হওয়া ছাত্রছাত্রীরা কিংবা মার্কিন-ব্রিটিশ কোম্পানির স্বার্থে নিপীড়িত তেল-গ্যাস রা আন্দোলনের কর্মীরা সেই পরাকম্পনের আঘাত নিজেদের দেহে অনুভব করেছেন। দৃকের ঘটনায় চীনা ড্রাগনের হল্কাও টের পাওয়া গেল।

আর টের পাওয়া গেল যে, দেশ আর দেশ নাই। এইটা এখন প্রদেশ। প্রদেশের মেজাজ থেকে নয়, হবুচন্দ্র কি গবুচন্দ্র পরাশক্তির চাওয়া-পাওয়ার বাইরে এই দেশ, এর মানুষ এবং এর রাজনৈতিক গন্তব্যের নিরিখেই ঘটনার বিচার করা উচিত। যে চিন্তা ও তৎপরতা বাস্তব মানুষের স্বার্থের মধ্যে তার নোঙর পাতে না, তার সঙ্গে মরিয়ার্টি বা পিনাক বা কোনো চীনা অংবংচং-এর খুঁটির জোরে নড়া ছাগমন্ত্রীদের কী তফাত?

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১:৫৬
২২টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×