দেশে দেশে যুদ্ধ বিগ্রহ, হানা হানি আর সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মুখে আমরা প্রায়ই পন্য বর্জনের ডাক পাই। পাকিস্তানী পন্য, ভারতীয় পন্য, মার্কিন পন্য, ইজ্রায়েলি পন্য, ন্যাটো ভুক্ত ইউরোপীয় পন্য ইত্যাদি বর্জনের ডাক আসে প্রায়ই। কারন এই দেশ সমূহ নিয়ত আগ্রাসন এবং যুদ্ধ সংঘর্ষে লিপ্ত।
অনগ্রসর শিক্ষা,অনৈক্য আর পারস্পরিক অবিশ্বাস কে পুঁজি করে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় সম্পদের লুটপাট সহজীকরন এবং ব্যবসা সম্প্রসারনের ব্যপকতার জন্য পশ্চিমারা উন্নয়নশীল দেশ (বিশেষ করে মধ্য প্রাচ্য এবং আফ্রিকা) সমূহে ব্যাপক ভাবে সংঘর্ষ হানাহানি কে নারচার করছে, ক্ষুধা আর বেকারত্ব কে কাজে লাগিয়ে তলে তলে জঙ্গিবাদ কে ফাইনান্সিং করছে আর সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ কে সমুন্নত রাখছে।
আগ্রাসী শক্তির সামরিক সংস্ক্রিতিক এবং সার্বিক অর্থনৈতিক আগ্রাসনের উপর দাঁড়িয়ে পশ্চিমের পন্য বর্জন এক কার্যকর ডাক হয়ে উঠতে পারে। উদাহরন স্বরূপ, ১৬০ কোটি মুসলমানদের কঞ্জিউমার মার্কেটে ইহুদি পণ্যের ব্যাপক বর্জন সম্ভভ হলে সেই পন্য কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়বে নিশ্চিত। বিশেষ পন্য বর্জনের আগে খুঁজে বের করা দরকার,সেই পন্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইজরায়েলের ডোনার কিনা, প্রোমটার কিনা। সব ক্ষেত্রে ইহুদি এবং ইজ্রায়েলি পন্য সমার্থক নাও হতে পারে। এটা ধারনাগত বিষয় যে, সকল ইহুদি কোম্পানিই কিংবা ইহুদি ইনভেস্টমেন্ট থাকা কোম্পানিই ইজ্রায়েলি এস্টাব্লিশ্মেন্ট এর ডোনার অথবা প্রমোটার। কিন্তু এর পুরোপুরি সত্যতা নাও হতে পারে। এ ব্যাপারে বাজার গবেষণা, তথ্য উপাত্ত দরকার। তবে সাধারন ভাবে সাম্রাজ্য বাদী পন্য বর্জন করে স্বদেশী পন্য ব্যবহারে উৎসাহিত করা গেলে কর্মসংস্থান বাড়বে, এতে অর্থনীতি বেগবান হবে। সুতরাং ক্ষতির কিছু নাই। তবে সত্যিকার পন্য বর্জন মানে চেঞ্জ অফ লাইফ স্ট্যাইল। কেউ যদি ভোগবাদী বস্তুবাদী লাইফ স্ট্যাইল পরিবর্তন করতে পারেন, তাঁর জন্য সালাম ও বিনম্র শ্রদ্ধা।
একই প্রেক্ষাপট বাংলাদেশে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির নামে এখানে সাম্রাজ্যবাদীদের পণ্যের একমুখী শুল্ক মুক্ত অনুপ্রবেশ হচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশী পন্য ভারত চীন এবং আমেরিকায় শুল্ক মুক্ত প্রবেশআধিকার পাচ্ছে না। অন্যদিকে উন্নত প্রজুক্তির সহায়তায় ব্যাপক পরিসরে উতপদনের কারনে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী পণ্যের কম দাম এবং গুনগত মান এর সাথে অভ্যন্তরীণ বাজারেই পেরে উঠছে না বাংলাদেশী পন্য। তাই ব্যালান্স অব ট্রেড এর কার্যকর উপায় খুজতে হবে, পণ্যের গুনগত মান বর্ধন, প্রযুক্তি সক্ষমতা তৈরিতে সরকারী বেসরকারী সহায়তা এবং কমিটমেন্ট নিশ্চিত করা গেলে এবং সেই সাথে দেশী পণ্যের চাহিদা এবং প্রতিযোগিতা বাড়লে বাংলাদেশী পণ্যের গুণগত বাড়বে অবশ্যই। স্বদেশী পন্য আন্দোলন আদতে দেশের অর্থনীতিকেই সংহত করে বেকারত্ব দূরীকরণে ভূমিকা রাখবে।
পন্য বর্জন? ঘর থেকেই হোক শুরুঃ
অন্যকে পন্য বর্জন করতে বলার আগে নিজে থেকেই শুরু করা উচিত। নিজের দৈনন্দিন জীবন থেকে ব্রিটিশ মার্কিন ইজ্রায়িলি ভারতীয় পাকিস্তানি চাইনিজ তথা সকল বিদেশী পন্য যথা সাধ্য বাদ দিয়ে দেশী পন্যকে উৎসাহিত করা সাধারন ভাবেই নাগরিকের দেশাত্ববোধের অংশ।
বাংলাদেশে এটাকে সামাজিক আন্দোলন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা গেলে নিজস্ব পন্যের চাহিদা বাড়বে, সেই সাথে গুনগত মানও। ইজ্রায়িলি, ইঙ্গ মার্কিন, ভারতীয়, পাকিস্তানি, চাইনিজ পন্য ছাপিয়ে "বাংলাদেশী" পণ্যই হয়ে উঠুক আমাদের জীবন যাত্রার অনুষঙ্গ।
নিজে থেকেই শুরু করুন- কোক খাওয়া বন্ধ করলে, বেনসন টানা বন্ধ করলে সেটা আপনার স্বাস্থের জন্যই ভালো, উপরি পাওনা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়।
বিদেশী পন্য বর্জন কে সাময়িক হিসেবে নয়, বরং দৈনন্দিন জীবন যাত্রা থেকেই চিরতরে বাদ দিতে হবে।
সেই সাথে বিলাস পন্যের বাহুল্য বাদ দিতে হবে, বিলাস পণ্য উতপাদনে উন্নয়নশীল দেশ সমূহ যোজন যোজন পিছিয়ে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়ে বিলাস পন্য, বাহাদুরি দেখানো অমুক দেশের শাড়ী পাঞ্জাবী লেহেঙ্গা জামা জুতা, তমুক দেশের পারফিউম, ঘড়ি ইত্যাদি ইত্যাদির ব্যবহার সীমিত করুন, যথা সাধ্য বাদ দেবার চেষ্টা করুন।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে অত্যন্ত শক্ত স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে, ভাবতে অবাক লাগে যে ভারত এবং চীন থেকে আমাদের রেডি মেইড কাপড় আমদানির যে ইম্পোরট বিল, সেটা আকাশ চূম্বী। এটা মেনে নেয়া যায় না। এই আমরাই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে স্বদেশী পন্য ব্যবহারের ডাক দিয়েছি, খাদি কাপড় উদ্ভাবন করেছি।
সত্য মিথ্যায় ভরা সেন্সেশনাল বিজ্ঞাপন আমাদের ভিতরে বিদেশী পন্যের কদরের যে ভূত তৈরি করেছে, সেটাকে ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলতে হবে। নিজের দিক থেকেই শুরু করা গেলেই তবে সম্মিলিত বর্জন সম্ভভ হবে।
সত্যিকারের পন্য বর্জন মানে লাইফ স্টাইল চেঞ্জ, আমাদেরকে একটি ভালো কারনে লাইফ ভোগবাদী - বস্তুবাদী লাইফ স্ট্যাইল পরিবর্তন করতে হবে।
ইহুদি পন্যঃ সুদ ভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থা
যারা শুধু মাত্র ইজ্রায়েলি কিংবা ইহুদি পন্যের প্রতি নজর দিচ্ছেন এই সময়ে, জেনে রাখুন ইহুদিদের প্রধান পন্য সুদ ভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থা। ইহুদীদের প্রাচীন মহাজনী সুদ ভিত্তিক ব্যবসার বর্তমান রূপ পুঁজিবাদী ব্যাংকিং এবং ফাইনান্সিং। মহাজনী সুদ এর প্রচলক ইহুদীরাই, প্রাচীন ইহুদী সমাজের সেই মহাজনী সুদ ব্যবস্থাপনা কে উন্নত করে তারা আজ অতি চাকচিক্য ময় ব্যাংকিং, ফাইনান্সিং, লোন, মর্টগেজ, ক্রেডিট ইনভেস্টমেন্ট, ক্রেডিট লেনদেন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে।
ইউরোপ এবং আমেরিকানদের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেরই শেয়ার রয়েছে ইহুদি ফাইনান্সিং হাউজ গুলোর, অনেক ধনী ব্যক্তি ইহুদির। সে অর্থে পৃথিবীর নামকরা অনেক পণ্যই তাদের আংশিক মালিকানায় রয়েছে। একটি দুটি নাম বেরা করা তাই সময়ের অপচয়। তবে পর্যায় বিশেষে সব ইহুদি পণ্যই ইজ্রায়েলি পন্য নয়। আবার অনেক আমেরিকান ইউরোপীয় পণ্যই আংশিক ভাবে ইহুদি পন্য।
একটি সাধারন ধারা হল, যখনই কোন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা পায়, তখন ইহুদি ফার্ম গুলো তাতে ফাইনান্সিং করে। শেয়ার বাজার হতে কোম্পানির শেয়ার কিনে নেয়। এরা কর্পোরেট ফাইনান্সিং, ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট এবং ভেঞ্চার ক্যপিটালিজমের অগ্রদূত।
পশ্চিমের দেশ গুলোতে বাড়ি গাড়ি ফোন পিসি হোম এপ্ল্যায়েন্স প্রায় সব জিনিস ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই পাওয়া যায় মাসিক ইন্সটলমেন্টে। এটাই ইহুদিদের আর্থিক ব্যবস্থাপয়ার চরম রূপ, পুরো একটা জীবন তাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনার কাছে দায়বদ্ধ, দেনার দায়ে জর্জরিত। সাধারণ ভাবে পশ্চিমারা এটা টের পায় না, কিন্তু যখন চাকরিটি হরিয়ে বসে তখন তারা সব হারিয়ে পথে বসে।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ঋণ প্রেখাপটঃ
ভারতবর্ষে এই মহাজনী ব্যবস্থায় ব্রিটিশ আমলে কোটি কোটি কৃষক জমি সহায় সম্বল হারিয়েছে। জমিদার দের মাধ্যমে চালিত এই ব্যবস্থা ব্রিটিশ দের শোষণ এর কার্যকর মাধ্যম ছিল।
কিন্তু বাংলাদেশ আজও এই ব্যবস্থা থেকে বের হতে পারেনি। সমাজে ক্ষুদ্র ঋণের যে অনিয়ন্ত্রিত এবং আন অডিটেড প্রসার তা মহাজনী ব্যবস্থাপনার ই সমার্থক। গ্রামীণ ব্যাংক, আশা সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত ক্ষুদ্র ঋণের কার্যক্রম চালালেও দেশে হাজার হাজার অবৈধ ক্ষুদ্র ঋণের কোম্পানি অনিয়ন্ত্রিত সুদ দিচ্ছে। এর বাইরে রয়েছে সমিতি। এই সমিতি রয়েছে দেশের প্রতিটি হাট বাজারে, বাস টার্মিনাল, রিক্সা স্ট্যান্ড, লঞ্চ ঘাটে।
নিজ গ্রাম এর অভিজ্ঞতাঃ
লেখকের নিজ গ্রাম এর আওতা মুক্ত নয়। গ্রামের বাজারের প্রতিটি দোকানদারের সমিতির মেম্বার হওয়া বাধ্যতামূলক, প্রতিটি রিক্সা ওয়ালার ও। সমিতিতে দৈনিক বা সপ্তাহিক চাদা দেওয়া ও বাধ্যতামূলক। বিপদে আপদে সমিতি লোন দেয়। বিশ্বাস হবে না আপনার ১০০ টাকার ১ মাসের সুদ ১০ টাকা। এটা এতই মহামারী আকার পেয়েছে যে, ১৬ হাজার টাকার বিপরীতে ৬৩ হাজার টাকা পরিশোধ করেও লোন এর টাকা পুরোপুরি শেষ করতে পারেনি আমারই পরিচিত এক লোক। নিজ গ্রামের বাস্তব অভিজ্ঞতা। আমি নিজে অন্তত ২ টি পরিবার কে চিনি যারা সব হারিয়ে গ্রাম ছাড়া হয়েছে। আমাদের প্রশাসন নির্বিকার। টাকার ভাগ পেলেই তাদের সন্তুষ্টি।
মনে পড়ে? শেক্সপিয়ারের শাইলক চরিত্র!
সুদ ভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নিপাত যাক। সুদ-চক্র ব্রিদ্ধি-ইনফ্লাশন এর ত্রিমাত্রিক লোভনীয় চক্রে আমাদের জীবন ধারনের আর্থিক ব্যবস্থাপনা দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে, চক্রাকারে জটিল থেকে জটিল তর হচ্ছে। সাথে সাথে অতি সুক্ষ ভাবে আমাদের অজান্তেই আমাদেরই আর্থিক লেনদেন এ ঢুকে যাচ্ছে পুঁজিবাদী আর্থিক ব্যবস্থা।
তাই যার যত বেশি ইনকাম ই হোক না কেন, দেনার দায় দিন দিন বাড়ছেই।
শিক্ষা ব্যবস্থায় শুধু মাত্র পুঁজিবাদী অর্থনীতি কেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, সুদ ভিত্তিক অর্থনীতির বাইরে বাজার এবং পন্য ভিত্তিক অর্থনীতি এখানে অবহেলিত। মুক্ত বাজার অর্থনীতির আগ্রাসনে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি এবং দেশী পণ্যের বিকাশ নিশ্চিত করনের স্ট্র্যাটেজিক শিক্ষা আমাদের কারিকুলামে অনুপুস্থিত। তাই আমরা পাস করে মাল্টি নেশন কর্পোরেট স্বার্থকেই সেবা দিচ্ছি।
মুক্তির জন্য দরকার শিক্ষা, শিক্ষার জন্য দরকার সঠিক স্ট্র্যাকচার, সঠিক স্ট্র্যাকচার এর জন্য দরকার সঠিক ভিশন, সততা এবং স্বদেশের জন্য দায়বদ্ধতা।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ৯:০১