somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইটের ভাটায় মরণ ফাঁদ!

১০ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৮:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



নন টেকসই নির্মান ও টপ সয়েল ইটের মাত্রাতিরিক্তি ব্যবহারঃ ইটের ভাটা মাটি, পানি, জলজ বাস্তুসংস্থান,মাটির অণুজীব ও উর্বরতা ব্যবস্থা (হিউমাস) অর্থাৎ বাংলাদেশের কৃষি ও পরিবেশের জন্য মরণ ফাঁদ!

১। বর্ষায় গঙ্গা ও যমুনার প্রতিটি প্রতি বছর আনুমানিক ১ থেকে ১.৫ লাখ টন বালি বহন করে এনে বাংলাদেশ অংশে নদী গুলোকে মেরে ফেললেও (সিল্টেড আপ) এবং নদীপথ ভয়ংকর পর্যায়ে কমিয়ে আনলেও আমাদের দেশে বালি উত্তোলন ও ব্যবহারের সমন্বিত পরিকল্পনা নেই। (১৯৭২ সালে প্রথম জরিপে নদীপথ ছিল ৩৭০০০ কিলোমিটার, বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে দেশের নদীপথ নেমে এসেছে মাত্র ২৬০০ কিলোমিটারে)। এত বিপুল পালির সমাহার স্বত্বেও এখনও বালির তৈরি ইটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে না।

২। ভূমির উপরিভাগের মাটি উর্বর। মাটির উপরিভাগের অণুজীব ও উর্বরতা ব্যবস্থাপনাকে ধ্বংস করে দিয়ে বর্তমানে বছরে নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হয় কমবেশি ২ হাজার ৫০০ কোটি পোড়ামাটির ইট। এর কাঁচামাল হিসেবে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টন কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি নষ্ট হয়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিবছর ১ শতাংশ কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। এর ৯৭ ভাগ নষ্ট হচ্ছে অপরিকল্পিত গ্রামীণ গৃহায়ণ ও ইটের ভাটার কারণে।

উপরের মাটি তুলে ফেললে সেই জমির উর্বরতা (হিউমাস) কমপক্ষে ২০ বছরের জন্য নষ্ট হয়ে যায়।

৩। অন্যদিকে ইট তৈরির কারণে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রায় ৫০ লাখ টন কয়লা ও ৩০ লাখ টন জ্বালানি কাঠ। প্রতি বছর প্রায় ১৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ইট তৈরি হয় প্রায় পাঁচ হাজার ইটভাটার মাধ্যমে। এ ইট তৈরি করতে প্রায় ১০ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে নির্গত হয়, যা জনপ্রতি দিনে শূন্য দশমিক ২ কেজির সমতুল্য। যা দেশের মোট নির্গত কার্বনডাই-অক্সাইডের প্রায় ৩০ ভাগের বেশি। এর বাইরে আছে বিপুল পরিমাণ সালফার ডাই অক্সাইড নির্গমন। এক হিসাবমতে, ৫০ শতাংশ বায়ুদূষণ হয় নির্মাণের শিল্পের মাধ্যমে।

উল্লেখ্য ঢাকা শহরে প্রতিবছর সাড়ে তিন হাজার মানুষ বায়ুদূষণজনিত অসুখে মারা যায়। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের একটি তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, ঢাকা শহরের বাতাসে ৪০ ভাগ ক্ষুদ্র কণা আসে ঢাকার চারপাশের ইটভাটার মাধ্যমে। অন্য আরেকটি তথ্য থেকে জানা যায়, ঢাকার চারপাশের ইটভাটার মাধ্যমে ১৫ হাজার ৫০০ টন সালফার ডাই-অক্সাইড, ৩ লাখ ২ হাজার টন কার্বন মনো-অক্সাইড, ৬ হাজার টন ব্ল্যাক-কার্বনের ১ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রতি বছর নির্গত হয়।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জনপ্রতি বছরে ১০৮টি ইট ব্যবহূত হয় নির্মাণকাজের জন্য। প্রচুর ইট ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন আমাদের কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে বায়ুমণ্ডল তথা পরিবেশের ব্যাপক দূষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে।

৪। যে ৫০ লাখ টন কয়লা ইটের ভাটায় ব্যবহৃত হচ্ছে তা দুনিয়ার নিকৃষ্টতম ভারতীয় কয়ালা যাতে অশোধনযোগ্য সালফারের পরিমান ৬% এর বেশি (যা অনুর্ধ্ব ০,০৬% হওয়া শ্রেয়), উচ্চ মানসম্পন্ন হিসেব কয়লার মান হিসেবে প্রায় ২০ থেকে ১০০ গুণ বেশি খারাপ এই কয়লা । এর অশোধিত অপদ্রব্য বাংলাদেশের জল স্থল এবং বাতাস বিষিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের কৃষকের স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের মূলে রয়েছে ইটের ভাটার অশোধিত হাই পার্টিক্যাল এবং ভারত-বাংলাদেশের যাতবতীয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল, ক্যামিক্যাল হ্যাজার্ডে সয়লাব নদীর পানি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ খাবারের পানিতে দূষণ থাকে যা স্বাস্থ্য বিপর্যয় ডেকে আনছে এবং হাস্পাতালে রোগীর মিছিল তৈরি করছে ।

৫। মাটি, পানি, জলজ বাস্তুসংস্থান এবং মাটির অণুজীব ব্যবস্থাপনা ধ্বংস হয়ে পড়ায় আমাদের কৃষককে অতি বেশি মাত্রায় রাসায়নিক সার বীজ কিটনাশাক ব্যবহার করতে হচ্ছে। ফলে ফলনের উৎপাদন খরচ লাগামহীন হচ্ছে, ভূমি আরো বেশি বিষাক্ত হচ্ছে। জমির উপরিভাগের মাটি দিয়ে পোড়া ইট তৈরি করায় দিন দিন খাদ্যের হুমকিতে যাচ্ছে দেশ। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে খাদ্যনিরাপত্তা পুরোপুরি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

৬। বাংলাদেশে মাঝে মাঝেই ইট ভারতে (ত্রিপুরায় বিশেষ করে) বিক্রি করছে। ইট তৈরিতে ভারতে মাটির উপরিভাগ ব্যবহার করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। অথচ আমরা মাটির উপরিভাগ বিক্রি করে দিয়ে কৃষি ও পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনছি। যেকোনো মূল্যে দেশের বাইরে ইট বিক্রি বন্ধ করতে হবে।

৭। ইট ভাটায় কাজ করা শ্রমিক ভয়াবহ স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের শিকার।

৮। ইটের বিকল্প হিসেবে ফেরো সিমেন্ট, স্যান্ড সিমেন্ট, অটোক্লেভড অ্যারেটেড কনক্রিট (এসিসি), সেলুলার লাইটওয়েট কংক্রিট (সিএলসি), সিসি ব্লক/হলো ব্লকের ইত্যাদি বিকল্প পণ্য ও প্রযুক্তি এসে গেছে। বাংলাদেশকে এখনই ইটের ব্যবহার একেবারেই সংকুচিত করে ফেলতে হবে। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ইট বিক্রি বন্ধ করুক। বিনিময়ে বালু্র সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

ইট তৈরিতে যে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়, ব্লক ব্যবহারে তা ৪০ শতাংশেরও নিচে নেমে আসবে। ব্লক দিয়ে তৈরি দেয়ালের ওজন ইট দিয়ে তৈরি দেয়ালের ওজনের ৩৫ শতাংশ কম হয়। ফলে ভূমিকম্প ঝুঁকির বিপরীতে স্থাপনা টেকসই হয়।

৯। অন্যদিকে বালু দ্বীপায়নের অনুষঙ্গ, ফলে বালির ব্যবহারের ড্রেজিং যেন অপরিনামদর্শী না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। ড্রেজিং এমনভাবে করা চাই যাতে নদীর নাব্যতা থাকে (নদী গর্ভ সিল্টেড আপও না হয়ে যায়) ও আবার তার ব-দ্বীপায়ন প্রক্রিয়াও চালু থাকে। এ দুয়ের ট্রেইড অফ করে বালি উত্তোলন নীতিমাল করে নির্মাণ শিল্পে বালির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার।

১০। এর বাইরেও রয়েছে স্টোন চিপস এর উপর শুল্ক কমানোর ব্যাপার। উচ্চ শুল্কের কারনে পাথুরে চিপস আমদানির পরিবর্তে ব্যাপক হারে দেশীয় ব্রিক চিপস ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশে এক, দুই বা তিন তলার স্বল্প উচ্চতার ও স্বল্প লোডের আবাসিক ভবন নির্মানে হোলো ব্লকের ব্যবহার একেবারেই নেই। সব ক্ষেত্রেই সলিড (ঢালাই) কনক্রিটের ব্যবহার হচ্ছে। এইসব কারনে ইটের ব্যবহারে মাত্রাতিরিক্ত চাপ তোইরি হয়েছে।

বিদ্যমান নির্মাণকৌশল ও প্রযুক্তি কোনোভাবেই পরিবেশবান্ধব বা কৃষিবান্ধব নয়। নির্মাণ করতে গিয়ে আমরা আমাদের মাটি, পানি, উর্বরতা, পরিবেশ এবং প্রতিবেশকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলেছি।

টেকসই নির্মান টেকসই কৃষি, টেকসই স্বাস্থ্য ও টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার পূর্বশর্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:১১
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পরিণতি - ৩য় পর্ব (একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস)

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮



( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।)

তিন


আচানক ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি । আবছা আলোয় মশারির বাহিরে চারপাশটা অপরিচিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইফতার পার্টি মানে খাবারের বিপুল অপচয়

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৩



গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো।
সারাদিন রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাকাই ছিলো। ভাবলাম, আজ আরাম করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে। হায় কপাল! মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি গজব ভীড়! এত ভিড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×