১। ধরুন একটা ছেলে বা মেয়ে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপজাতীয় কোটায় চান্স পেল (যেমন বুয়েটে উপজাতীয় কোটা আছে)। এই একই ছেলে বা মেয়ে গ্র্যাজুয়েট বা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আবারো সিভিল সার্ভিসে ঢুকতে কোটার সুবিধা পাবে। তাইলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো! দুই বার অন্য যোগ্য কাউকে মেধা ভিত্তিক প্রতিযোগিতায় ঠকানো হল, অর্থাৎ ২ বার রাষ্ট্র কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট তৈরি করলো,অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীর অনুকুলে!
অথচ হবার ছিল এরকম- ৫ থেকে ১০ বছর বিশেষ বিশেষ উপজাতীয় অথবা অনগ্রসর আঞ্চলিক (জেলা) কোটা থাকবে (এই কোটা শুধু মাত্র ঐ এলাকায় স্থায়ী ভাবে বসবাস করাদের জন্য, রাজধানী বা অন্য শহরে বসবাসকারীর জন্য নয়), এই সময়ের মধ্যে উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলে উচ্চ শিক্ষার অবকাঠামো এবং সেই ভাবে কর্মসংস্থান অবকাঠামো (প্রণোদনা দিয়ে বেসরকারি বিজনেস সেখানে যাবে, সরকার দুরদর্শী ইনফাস্ট্রাকচার মেনেজমেন্ট করবে)। তারপর কোটা উঠে যাবে।
২। ব্যাপক প্রতিযোগীতার এই সময়ে কোটা ধারী কোন একজন ছাত্র ছাত্রী জীবনে শুধু একবার কোটা সুবিধা নিয়ে রাষ্ট্রীয় অনুকুল্য নিতে পারার কথা। কিন্তু সেটা বাংলাদেশে আনলিমিটেড!
১৭ থেক ২০ লক্ষ ছেলে মেয়ে একটি ব্যাচে থাকে, আপনি একই ছেলে বা মেয়েকে মুক্তি কোটায় স্কুলে ঢুকালেন, আবার কলেজে, আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার চাকুরিতে। বিশাল বিশাল সব আবদার। বাকিরা শুধুই মুড়ি খেয়ে যাচ্ছে!
অথচ এই একজনকে বার বার কোটা দিবার মানে হচ্ছে তার আসলে সত্যিকারের কোন ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে না বরং তাকে বার বার ঠেলে বা তুলে দিতে হচ্ছে অন্যদের ঠিকিয়ে। সুতরাং এই পুরো সিস্টেম টেকসই না।
৩। শহরে বসবাসকারী এবং শহুরে ভোগ ও জীবনে অভ্যস্ত ছেলে মেয়েরা জেলা কোটার সুবিধা ভোগ করেন, অথচ পিছিয়ে পড়া পিতৃ ভিটার অঞ্চলে কখনই বড় হননি, কিংবা একেবারেই সংযোগ নেই। অথচ জেলা কোটা ভোগের দাবিদার শুধু ঐ বিশেষ অঞ্চলে স্থায়ী ভাবে বসবাসকারী ও শিক্ষা গ্রহণ কারীরাই, যারা রাষ্ট্রের সুবিধা গুলো থেকে বঞ্চিত হয়েছে!
৪। ১৯৯২ এর পর শিক্ষায় মেয়েদের উপবৃত্তি চালু হবার পরের দুই দশকে শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ এবং মান উভয়েই বেড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলুতে দেখা যাচ্ছে পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহন, পাশের হার এবং মোট জিপিএ ৫ প্রাপ্তিতে মেয়েরা এগিয়ে। এমতাবস্থায় শিক্ষা উপবৃত্তিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, শিক্ষা উপকরণ ফ্রি দেয়া (স্কুল ও কলেজ ড্রেস, ব্যাগ, জ্যামিতি বক্স,জুতা, ঘড়ি ইত্যাদি), মেয়েদের জন্য স্কুল ও কলেজে ফেসিলিটি (অন্তত স্বাস্থ্য ও সেনিটেশন) বৃদ্ধি করা, ট্রান্সপোর্টেশন ফেসিলিটি যেমন সাইকেল লোন দেয়া, পাবলিক পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন ফ্রি করা, নারী শিক্ষক বাড়ানো, শিক্ষা মান ও শিক্ষক মান বাড়ানো, গরীব পরিবারে কৃষি বা গার্মেন্টস শ্রমের কাছাকাছি হারে আর্থিক শিক্ষা প্রণোদনা দিয়ে নারী শিক্ষা আরো এগিয়ে নেয়া দরকার।
এই সব বেসিক ফেসিলিটি ও ইনফাস্ট্রাকচারে মনোযোগ না দিয়ে মেয়েদের কোটা রাখার অদুরদর্শী কাজ হচ্ছে।
আরো একটি অসামাঞ্জস্যের উদাহরণ হোল- মুক্তি কোটা নিজেই-
৫। কোটা সুবিধায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে জীবিত মুক্তিযোদ্ধার সর্বেসর্বা বিচরণ। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা যেহেতু তদবির করতে বেঁচে নেই তাই উনাদার পরিবারের সদস্যদের উপস্তিতি প্রায় নেই বললেই চলে মুক্তি কোটায়। অন্যদিক জীবিত বৈধ ও অবৈধ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের একক বিচরণ লিস্ট, এই লিস্ট এ অবৈধ রা দিন দিন ভারি হচ্ছে, তাদের তদবির দিন দিন কলুষিত করছে মুক্তি কোটার লিস্ট। ফলে মুক্তি কোটার চুড়ান্ত অপপ্রয়োগ হচ্ছে।
৬। সব চাকুরীতে কোটা থাকার যৌক্তিকতা নেই। বুদ্ধিবৃত্তিক, শিক্ষা ও গবেষণা এবং পরিকল্পনা খাত গুলোতে কোন ধরণের কোটা থাকতে পারে না। কোটায় বা বাঁকা পথে চাকুরী নিয়ে বা কম শিক্ষার সুযোগ নিয়ে কেউ হয়তো দেশে প্রশাসনে সাধারণ বা নিন্ম বুদ্ধিবৃত্তিক গতানুগতিক সার্ভিস দিয়ে যেতে পারবে কিন্তু বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে বহু সমস্যায় জর্জরিত ও জটিল হতে থাকা সম্পদ ব্যবস্থাপনা, কৌশলগত পরিকল্পনা, ডিজাইন ও ইঞ্জিনিয়ারিং বাস্তবায়ন ইত্যাদি খাতে এবং দেশের গন্ডির বাইরের ইন্টেলেকচুয়াল বিষয়াদিতে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের কোটা প্রোডাক্ট নিয়ে বাংলাদেশ কখনই প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। এই ধরনের নিন্মমান মানবসম্পদ (রিসোর্স) দেশকে সম্মানজনক ভাবে রিপ্রেজেন্ট করতেও পারে না।
৭। দেশের পশ্চাত্পদ লোকালয় গুলোকে, প্রাকৃতিক কারণে পিছিয়ে পড়া নাগরিককে সুরক্ষা দিতে সেখানে কিছু টাইম ডিফাইন্ড অতি সীমিত কোটা থাকতে পারে। এ সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রকে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে অর্থনীতি সচল করার এবং কর্মসংস্থান তৈরির স্থায়ী কাঠামো তৈরি করতে হবে। বোধ ও বিবেকসম্পন্ন একটি স্বাধীন সমাজে অনির্দিষ্টকালের জন্য মেধা ও যোগ্যতার স্বীকৃতির বিপরীতে মেধাহীন পঙ্গুত্ব তৈরির ‘কোটা ব্যবস্থা’ নামক প্রণোদনা চলতে দেয়া যায় না। দেশটি তার স্বাধীনতার ৪৮তম বছরে পদার্পণ করেছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৭