স্বদিচ্ছা থাকলে গ্যাস সংকটের এই দীর্ঘ সময়ের ভুক্তোভোগীতা পরিহার করে বহু আগেই মহেশখালী এলএনজি টার্মিনাল ও এতদসংক্রান্ত পাইপলাইনের কাজ শেষ করা যেত। এটা ভুলে যাবার মত বিষয় না যে, সরকার পর পর দুটি মেয়াদের একেবারে শেষ দিকে পৌঁছেছে। যে কোন লার্জ স্কেইল প্রোজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য ১০টি বছর একটি অতি দীর্ঘ সময়। এটা ছাড়াও অব্যবহৃত সাঙ্গু ভিত্তিক গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন কাজে লাগিয়ে সাময়িক এলএনজি টার্মিনাল বানানো যেত বহু আগেই। টেকসই কিছুই না করে দুর্নীতি পরায়ণ ও প্রকল্প ব্যয় উপর্যুপরি বাড়াতে তৎপর দুর্বিত্তমনা উন্নয়ন প্রকল্প ব্যবস্থাপকরা (রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক) বহু সময় ক্ষেপণ করে এসে এখন ঠিক কর্ণফুলীর মোহনায় চট্রগ্রাম বন্দরের প্রবেশ মুখে অর্থনীতিতে "খাল কেটে কুমির আনা"র ব্যবস্থা করেছে।
১। সার কারখানার জেটি দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের একদম প্রবেশমুখে, (কাফকো ও সিইউএফএল জেটিতে এলএনজির জাহাজ ভেড়ানো হবে)। এতে সংকুচিত হয়ে পড়বে দেশের অর্থনীতির প্রাণ চট্টগ্রাম বন্দরের চ্যানেল। একটি প্রতিবেদন বলছে, প্রতিদিন দুই কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করতে হলে বছরে কমপক্ষে ২৩০ দিন জাহাজ ভেড়াতে হবে কাফকোর জেটিতে। ভাসমান স্থাপনায় যখন এলএনজি জাহাজ ভেড়ানো হবে, তখন ৩০০ মিটার প্রশস্ত চ্যানেলের ২০ মিটার ওই এলএনজির জাহাজের দখলে চলে যাবে। এলএনজি জাহাজ থেকে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের নিরাপদ দূরত্ব কমপক্ষে ১৫০ মিটার। এ হিসাবে ৩০০ মিটার প্রশস্ত চ্যানেলের ১৭০ মিটার দিয়ে কোনো বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করতে পারবে না। অর্থাৎ কাফকো এলাকায় চ্যানেল সংকুচিত হয়ে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের পথ থাকবে ১৩০ মিটার। এই অবস্থান দিয়ে পাশাপাশি দুটি জাহাজ অতিক্রম করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ (ছবি ও তথ্য-প্রথম আলো)।
২। এলএনজির জাহাজের কারণে যেকোনো দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বন্দর। জোয়ার ভাটা থাকার কর্ণফুলীর এমনিতেই অগভীর চ্যানেল আরো সংকীর্ণ হয়ে সমূহ নৌ যান সংঘর্ষ ঘটিয়ে দুর্ঘটনা ডেকে আনতে পারে। অতীতে আমরা দেখেছি একটা জাহাজ ডুবি'র উদ্ধার জনিত সমস্যা দূর করতে ১৫ দিনের বেশি লেগেছে।
৩। চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল ব্যবহার করে এখন সমুদ্রপথে কনটেইনার পণ্যের ৯৯ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি করা হয়। ফলে পণ্য আনা-নেওয়ার জাহাজ বন্দরে ভিড়তে সমস্যা হবে, অপেক্ষা দীর্ঘ হবে, খালাসের সময় ধীরগতি হবে, বাড়বে জাহাজজট। গোটা অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়তে পারে।
এমনিতেই বন্দরের পণ্য খালাস এতটা ধীর গতিতে পৌঁছেছে যে তা সামগ্রিক আমদানী রপ্তানিতে খারাপ প্রভাব ফেলেছে। গত অক্টোবরে - সাড়ে ২৭ হাজার টন ইউরিয়া সার নিয়ে 'এমভি নেভিয়স সেরেনিটি' নামের জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে বহির্নোঙরে প্রায় ৮৫ দিন অপেক্ষা করে। অথচ চাহিদামতো লাইটারেজ জাহাজ পেলে স্বাভাবিকভাবে সব পণ্য খালাস করতে জাহাজটির লাগার কথা সর্বোচ্চ ১৫ দিন। প্রতিদিন ৮ হাজার ডলার বা সাড়ে ছয় লাখ টাকা হারে খরচ গুনে ৭০ দিন বাড়তি সময় অবস্থান করায় এ জাহাজের আমদানিকারককে এখন বাড়তি গুনতে হবে সাড়ে চার কোটি টাকা! শুধু 'এমভি নেভিয়স সেরেনিটি' জাহাজই নয়; চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আসা প্রতিটি জাহাজের ধীরগতির খালাসই এভাবে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে।
অতি উল্লেখ্য যে, প্রতিবেশী দেশের বাঁধায় সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ তো ভেস্তেই গেছে, উপরন্তু চট্রগ্রাম বন্দরের অভিজ্ঞতা ও ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপার্টিজ কাজে লাগিয়ে কর্ণফুলীর মোহনায় "মেরিনা বে" করার যে দেশী বিদেশী যৌথ প্রস্থাবনা ছিল তাও অজ্ঞাত কারণে আলোর মুখ দেখেছে না। মোহনা থেকে জোয়ার ভাটা থাকা সংকীর্ণ নদী চ্যানেলের ১৬ কিমি ভিতরে কোনভাবেই চট্রগ্রামের মত এটতা হাই ক্যাপাসিটির সমূদ্র বন্দর চালানো যায় না। উপরন্তু একের পর এক পরোক্ষ বাঁধায় দেশের প্রধান বন্দরের জাহাজ জোট বাড়ানোর সকল ফন্দি বুঝে না বুঝে বাস্তবায়িত হচ্ছে!
৪। এলএনজি প্রাপ্তিতে সার কারখানা দুটির উৎপাদন নিয়মিত হতে পারতো, কিন্তু জেটি হারানোয় উৎপাদিত সার খালাস করার (হাই ক্যাপাসিটি ট্রান্সপোর্টেশন) পথ আটকে দেয়ায় তারা পূর্ণ উৎপাদনে যেতে পারবে না (সার প্রোডাকশন সাইকেলের স্বাভাবিক এক্সিট পথ বন্ধ থাকায়)। ফলে দুটি সার কারখানা যে গতিতে সার উৎপাদন করবে তা সাধারণ ট্রাকে করে খালাস করে কুল পাবে না এবং উৎপাদন কমিয়ে দিতে হবে কিংবা শুধু স্টোরেইজ সংকটেই প্ল্যান্টই বন্ধ করতে হবে! অন্যদিকে দেশের বেশিরভাগ এলাকায় ধান কাটার সময় চলে আসায় সারের পিক চাহিদার সময়ও পেরিয়ে এসে ফলে স্টোরেইজ চাহিদা এমনিতেই বাড়তে পারে। উল্লেখ্য বহুবিধ প্রত্যক্ষ পরোক্ষ কারণে দেশের সার উৎপাদন দিন দিন কমছে এবং নিন্ম মানের বিদেশী সারে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। অথচ একটা সময় ছিল কাফকোর এমোনিয়া/ইউরিয়া সার অস্ট্রেলিয়াতেও রপ্তানি হয়েছিল!
প্রতিবেশী দেশ গুলোর তুলনায় ৫ গুণের বেশি খরচ করার পরেও বাংলাদেশের প্রকল্প বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রীতা বহু অবকাঠামোগত বিপদ ডেকে আনছে, যার এন্ড টু এন্ড ইকোনোমিক এন্ড রিস্ক ইমপ্যাক্ট এনালাইজ করার ক্ষমতা টুকুও দেশের আন ইফিশিয়েন্ট রাজনৈতিক প্রশাসন দেখাচ্ছে না। এতে আরো বেশি গতিতে বাড়ছে প্রকল্প গুলোর বৈদেশিক ঋণের সুদ সহ বিভিন্ন শর্ত। সময়মত প্রকল্পের কাজ শেষ না করে বিভিন্ন জোড়াতালি মার্কা "কুইক এন্ড ডার্টি" সমাধানে দেশের অর্থনীতিত মৌলিক ফাউন্ডেশন গুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জ্বালানি খাতে উপর্যুপরি টেম্পোরারি "কুইক এন্ড ডার্টি" সল্যুশন এনে আল্টিমেইট টেকসই সমাধানের পথ দীর্ঘ করার দীর্ঘসূত্রীতা পরিহার করুন। মহেশখালীর এলএনজি টার্মিনাল এবং এর সকল সঞ্চালন পাইপলাইন দ্রুততম সময়ে শেষ করে চট্রগ্রাম বন্দরের স্বাভাবিক ক্যাপাসিটি নিশ্চিত করুন। গ্যাস সম্পদ সহ বন্দর ব্যবস্থাপনার সঠিক ও টেকসই “অবকাঠামো সেন্স” জাগ্রত হোক। বাংলাদেশ এগিয়ে যাক!
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৪:৪৫