‘‘ইয়াবা সেবনে শরীরে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হয়৷ সেবনের পর প্রথমে মনে হয় যেন শরীরে অনেক শক্তি এসেছে, সব ক্লান্তি কেটে গেছে৷ আসলে এটি একটি উত্তেজক মাদক৷ দীর্ঘমেয়াদে এটি পুরো স্নায়ুতন্ত্রের ওপর অসম্ভব খারাপ প্রভাব ফেলে৷ স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক কাঠামো ও কার্যক্রম নষ্ট করে দেয় ইয়াবা৷এমনকি এ ধরনের মাদকের প্রভাবে অনেক সময় মানুষ বদ্ধ পাগলের মতো আচরণ করে (সাইকোসিস সিনড্রম), যার ফলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের (স্ট্রোক) ঝুঁকিও তৈরি হয়৷''- ডা. তাজুল ইসলাম।
যে কোনও নেশার বস্তু, যেমন ইয়াবা অ্যালকোহল, নিকোটিন ভিত্তিক সিগারেট, গাঁজা ড্রাগ ইত্যাদিতে যে কেমিক্যালগুলি থাকে তা ব্যবহারকারীর শরীরে বেশ কিছু জৈবিক পরিবর্তন ঘটায়। কেউ যখন ওই নেশার বস্তু গ্রহণ করে, তখন ব্রেন ডোপামিন নিঃসরণ করে, যাতে আরামের অনুভূতি হয়। ফলে গ্রাহক ব্যক্তি বারবার সেই আমেজ পেতে চায়। না পেলে ওই বিশেষ বস্তুর জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে এবং যে কোনও ভাবে সেই তুরীয় অবস্থায় পৌঁছতে চায়। যেকোনও নেশার বস্তু নিয়মিত ব্যবহার করার ফলে শরীরের গ্রহণ ক্ষমতা বেড়ে যায়। না পেলেই উইড্রয়াল সিম্পটম দেখা দেয় এবং সেটা কাটানোর জন্যই আবার ওই বস্তু নিতে হয়। আসক্ত ব্যক্তি মনে করে যে, সে ওই বস্তুটিকে বাদ দিয়ে বাঁচতেই পারবে না। নেশার সামগ্রী তার কাছে তখন খাবার, জল বা অক্সিজেনের মতোই জরুরি হয়ে ওঠে। ক্রমশ নেশার বস্তুর উপর টান বাড়তে থাকে এবং আসক্ত ব্যক্তি কাজকর্ম, বাড়িঘর এবং বন্ধুবান্ধবদের প্রতি দায়িত্ববোধ হারিয়ে ফেলে। যে কোনও নেশায় আসক্তি মানুষের জৈবিক, সামাজিক এবং মানসিক বিষয়ের মিশ্রিত অবস্থা।
অপরাধ প্রবণ সমাজে কুসঙ্গের সহজ বিস্তার ও সহজলভ্যতা ছাড়াও বাংলাদেশে কর্ম ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কাজের চাপ, দীর্ঘ শ্রম ঘন্টা, মানহীন কাজের পরিবেশ, দীর্ঘ মেয়াদী বেকারত্ব, ব্যবসার কঠিন প্রতিযোগীতা ও স্বল্প প্রফিটিবিলিটি, জাপিত জীবনের কষ্ট, নিন্ম উপার্জন জনিত হতাশা, পারিবারিক টানাপোড়েন, বিশ্বাসহীন সামাজিক বন্ধন ইত্যাদি বহুবিধ কারণে মাদকের বিস্তার সর্বগ্রাসী হয়ে উপস্থিত হয়েছে।
হাতের নাগালে মাদক
ফেনসিডীলকে পিছনে ঠেলে বাংলাদেশের নেশার জগতে এক ভয়াবহ উন্মাদনা এনেছে অনাগ্রা ও ইয়াবা। মাদক সেবনের মূল ভূমিকায় সচ্ছল ঘরের শিক্ষার্থী, তরুণ, যুবা ও মধ্যবয়সী। মোবাইল ফোন ভিত্তিক সুলভ বাজারজাতকরণ, হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা, নারী ও শিশু শ্রম কেন্দ্রিক বিতরণ ব্যবস্থায় ইয়াবার আগ্রাসন দেশের শহর ও গ্রামের সর্বত্র। প্রথম দিকে উচ্চ বিত্ত ঘরের বখে যাওয়া ইয়ো ইয়ো ছেলে মেয়ে এবং মডেল কন্যা "ইয়াবা সুন্দরী" ভিত্তিক বিপণন দিয়ে শুরু হলেও সময়ের সাথে সুলভ হয়ে উঠায় বাহক এবং গ্রাহক হিসেবে শুহুরে নিন্ম মধ্যবিত্ত, পরিবহণ শ্রমিক, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মী ও বস্তির ছেলেরদের গন্ডী পেরিয়ে এখন গ্রামীণ কৃষি ও শ্রমজীবীর সন্তানদের হাতের নাগালেও পৌঁছে গেছে ইয়াবা, সাথে কিছু সহযোগী মাদকও। গ্রহণের মাত্রার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, বেপারোয়া গতির গাড়ি চালনা, ইভটিজিং, এমনকি ধর্ষণও। মাদকের বিষে পড়ে গ্রামীণ এলাকায় ও শহুরে বস্তিতে ছেলেদের পড়া লিখার গন্ডি থমকে আছে, কমছে না স্কুল ঝরে পড়াও। যুব সমাজকে ধ্বংসকারী মাদক ইয়াবা ব্যবসার কারণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গাড়ির হেলপার, দিনমজুর, পান দোকানি, শিশু শ্রমিক, কিছু রোহিঙ্গা এমনকি ছোটখাট ব্যবসায়ী, সাংবাদিকও এখন কোটিপতি বনে যাচ্ছেন। কোটিপতি হচ্ছেন পুলিশ এবং নারকটিক্স বিভাগের লোকেরাও। বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত আট বছরে মাদক হিসেবে ইয়াবার ব্যবহার বেড়েছে ৭৭ থেকে ১০০ গুণ৷
তরুণ জনসংখ্যাধিক্যের বাংলাদেশ "ডেমোগ্রাফিক ডেভেডিন্ট" এর কর্মক্ষমতাকে মাদকে বুঁদ করে দিয়ে বিদেশী ব্যবসায়ী ও গোয়েন্দাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চক্র, আন্তর্জাতিক চোরাচালানকারী এবং দেশীয় ব্যব্যসায়ী-পুলিশ- মাদক নিয়ন্ত্রকের সুবিস্তৃত "ব্যবসায়িক ত্রয়ী" বাংলাদেশ কেন্দ্রিক সর্বে সর্বা আর্থিক যোগের উইন উইন মাদক ব্যবসার সিচুয়েশন তৈরি করেছে। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের যুবসমাজকে টার্গেট করা বাজারে সফল হয়ে মিয়ানমার ও ভারতীয় মাদক সম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য সহ অন্য দেশেও। বাংলাদেশী শ্রমিকের মাধ্যমেই ইয়াবা পৌঁছে যাচ্ছে মধ্য প্রাচ্যের দেশে দেশে।
বাংলাদেশে মাদকের থাবা
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাবে ২০১৫ সালের পর থেকে বছর প্রতি প্রায় ২ কোটি করে ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার হয়েছে৷ এই সংখ্যা বাস্তব ব্যবসা ও পাচারের শতকের মাত্র এক অংকের ঘরে। দেশে ইয়াবার পরই মাদক হিসেবে বেশি ব্যবহার হয় কাফ সিরাপ ‘ফেনসিডিল'৷ অধিদপ্তর বলছে ‘‘পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায় যে, মাদক হিসেবে ফেনসিডিলের ব্যবহার কমছে৷ অন্যদিকে বাড়ছে ইয়াবার ব্যবহার এবং সেটা খুবই দ্রুত গতিততে৷ যারা ফেনসিডিলে আসক্ত ছিলেন, তারা ইয়াবার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন এবং তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন নতুন ইয়াবাসেবীরাও৷
বাংলাদেশে মাদক আসে যেখান থেকে
বাংলাদেশে ফেনসিডিল আসে সাধারণত ভারত থেকে, বহু পয়েন্টে। তবে ফেনসিডিল স্থানীয়ভাবেও তৈরি করেন মাদক ব্যবসায়ীরা৷ অপরদিকে বাংলাদেশে ইয়াবা আসে প্রধানত মিয়ানমার থেকে৷ মিয়ানমারের মংডুতে বাংলাদেশ সীমানার ১০ কিলোমিটারের ভেতরে ইয়াবার কারাখানা আছে বলে জানা যায়৷ কক্সবাজার হয়ে আসা ইয়াবা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহণে কাজ করেন নিম্নবিত্তরা আর তা ব্যবহার করেন মধ্যবিত্ত ও উত্তবিত্তরা৷ সম্প্রতি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এবং নারীও ইয়াবা পাচারের সময় ধরা পড়েছে৷ বিজিবি-র টেকনাফ অঞ্চলের কমান্ডার আবুজার আল জাহিদ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘মিয়ানমার থেকে প্রশাসনিক উদ্যোগেই বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার করা হয়৷ আগে মংডু ধেকে ইয়াবা পাচার হতো৷ এখন একটি নতুন বন্দর সিটওয়ে (আকিয়াব) থেকে সমুদ্রপথে এই মাদকটি পাচার করা হচ্ছে৷ বাংলাদেশের অংশে প্রভাবশালী লোকজন, যেমন রাজনৈতিক নেতারাও এর সঙ্গে জড়িত৷ তাছাড়া মোবাইল ফোন এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের সহায়তায় ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ইয়াবা৷''
মাদক পাচারের প্রধান ‘ক্যারিয়ার' নারী ও শিশু
বাংলাদেশে মাদক হিসেবে একসময়ে ফেনসিডিল শীর্ষস্থান দখল করলেও, এখন ইয়াবা সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে৷ এর প্রধান ব্যবহারকারী তরুণ প্রজন্ম৷ তাই মোবাইল ফোন ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ইয়াবার বাজারজাতকরণ সহজ হয়েছে৷ বাংলাদেশে ক্যারিয়ার হিসেবে প্রধানত নারী ও শিশুদের ব্যবহার করা হয়৷''। মাদক চোরাচালানসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে বেশ কিছু সাংবাদিকও।
কারা মাদক গ্রহণ করে?
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি, অধিকাংশই বয়সে তরুণ, ১৭ থেকে ৩৮ বছরের মধ্যে৷ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘বাংলাদেশে এখন ইয়াবাসেবী তরুণের সংখ্যা ৪০ লাখের কম নয়৷ এখন চিকিৎসা নিতে আসা মাদকসেবীদের ৮০ ভাগই ইয়াবা আসক্ত৷ এরা বয়সে তরুণ এবং অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল ঘরের সন্তান৷ তরুণীরাও এই মাদক গ্রহণ করছেন৷ ইয়াবার পর ফেনসিডিল ও গাজায় আসক্তের অবস্থান৷ তবে প্রধানত নিম্নবিত্তরাই এগুলিতে আসক্ত৷''
মাদক পাচারের রুট বাংলাদেশ
দক্ষিণ এশিয়া বা এশিয়ার বাজারে বিভিন্ন ধরনের মাদক নিয়ে যাওয়ার জন্য নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলাদেশ! বিশেষত এ অঞ্চলের বন্দরগুলোর দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থার কারণেই চোরাচালানের রুট হিসেবে এ পথ পাচারকারীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে এমন কথাই বলা হয়েছে।
মে ২০১৫ চট্টগ্রাম বন্দরে ধরা পড়া একটি কোকেনের চালানের গন্তব্য ছিল ভারতের যে কোনো বন্দর, জাতিসংঘ মনে করছে, দক্ষিণ এশিয়াকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে আরও প্রচুর কোকেন পাচার হচ্ছে, যা ধরাই পড়ছে না৷ ল্যাটিন অ্যামেরিকার একটি সংঘবদ্ধ চক্র যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে নিজেদের চোরাচালানের রুট আড়াল করতেই দক্ষিণ এশিয়াকে পাচারের পথ হিসেবে ব্যবহার করছে৷ এ অঞ্চলের বন্দরগুলোর দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থার সুযোগ নিয়েই এ কাজ করছে তারা৷ তাই বাংলাদেশকেও তাদের মাদক চোরাচালনের রুটে পরিণত করছে৷ গত বছর বাংলাদেশে কোকেন ধরা পড়লেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন দেশের অভ্যন্তরে এখনও কোকেনের ব্যবহার নেই৷ তবে পাঁচারের রুট হিসবে ব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশ৷
মাদক সাম্রাজ্যে গডফাদার ১৪১, ওরা কারা?
বাংলাদেশের মাদক সম্রাজ্য
বাংলাদেশের মাদক সম্রাজ্যের শীর্ষ গডফাদার হিসেবে আছেন সংসদের এমপি, যুবলীগ নেতা, উপজেলা চেয়ারম্যান এমনকি সিআইপি, সংখ্যায় এরা দেশজুড়ে ১৪১ জন। ক্ষমতাধর অনেক রাজনীতিকের ভয়ংকর কুৎসিত চেহারা বেরিয়ে আসার পরেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কোন ধরণের একশন নিতে আপারগ হওয়ায় ৩১ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়।তালিকাভুক্ত মাদক গডফাদারদের নাগাল পেতে ব্যর্থ হয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর এখন দুদকের দ্বারস্থ হয়েছে। দুদক চেয়ারম্যানের কাছে তালিকা পাঠিয়ে বলা হয়, অন্তত এদের অবৈধ আয়ের পথ ও বিশাল অর্থবিত্তের খোঁজ পেতে সক্ষম হবে দুদক। যুগান্তর বলছে তাদের হাতে এই লিস্ট আসে। তালিকার দ্বিতীয় পৃষ্ঠার একটি প্যারায় চোখ আটকে যায়। কারণ সেখানে বলা হয়েছে, ‘মাননীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি দেশের ইয়াবা জগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী। তার ইশারার বাইরে কিছুই হয় না। দেশের ইয়াবা আগ্রাসন বন্ধের জন্য তার ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট।’ তালিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দীন আহমেদ রোববার যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যমান আইনে মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ হাতেনাতে মাদক উদ্ধার ছাড়া আমরা কাউকে গ্রেফতার করতে পারি না। এক্ষেত্রে দুদক আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে।
সর্বনাশা বদি ও তার ৫ ভাই এবং তার সমুদয় আত্মীয় স্বজন মাদক চোরাচালানকারী
তালিকায় সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রাহমান বদি মাদক সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি বলা হয়েছে। এতে বদির সঙ্গে তার পাঁচ ভাইয়ের নামও উঠে এসেছে। তারা হলেন- মৌলভী মুজিবুর রহমান, আবদুস শুক্কুর, মো. সফিক, আবদুল আমিন ও মো. ফয়সাল। তাদের মধ্যে সরকারের প্রায় সব সংস্থার তালিকায় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি ছাড়া তার ৫ ভাইয়ের নাম রয়েছে। তবে আপন ভাই ছাড়াও তালিকায় বদির পিএস মং মং সেন ও ভাগ্নে সাহেদুর রহমান নিপুসহ আরও বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠভাজনের নাম রয়েছে।গোপনীয় প্রতিবেদনের ভূমিকা অংশে বলা হয়েছে, ‘সরকারদলীয় এমপি হওয়ার সুবাদে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অনুসারী/সহযোগী নিয়ে তিনি ইচ্ছেমাফিক ইয়াবা ব্যবসাসহ অন্যান্য উৎস হতে অবৈধ আয়ে জড়িত আছেন। শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীরা তার অনিচ্ছার বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসা করার সাহস রাখে না। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জেলার অন্য শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী বা টেকনাফের যে কোনো চাঁদাবাজ এলাকায় প্রভাব বিস্তারে সক্ষম নয়। বিশেষত মিয়ানমার থেকে চোরাচালান হওয়া ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ করার জন্য তার ইচ্ছাশক্তি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।’
স্থানীয় সূত্র জানায়, মিয়ানমার হয়ে ভিআইপি প্রটেকশনে ইয়াবার বড় বড় চালান টেকনাফে নিয়ে আসার কাজটি করেন বদির ৫ ভাই। আর সেগুলো দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাইকারি ডিলারদের কাছে পৌঁছে দেন পিএস মং মং সেনসহ তার নিজস্ব অনুসারীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কক্সবাজার জেলার একজন পুলিশ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য নিজেই মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার কারণে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের দর্শকের ভূমিকায় হাত গুটিয়ে বসে থাকার আর কোনো উপায় থাকে না। সবাই সবকিছু জানলেও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার কৌশল বেছে নিতে বাধ্য হন। সাবেক বিএনপি পন্থী এবং বর্তমানে আওয়মীলীগ করা ইয়াবা ব্যবসায়ী সাইফুল করিম ওরফে হাজী সাইফুল ইয়াবার আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি, যে কিনা একজন সিআইপিও (বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি)।মাদক ব্যবসা করে তিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক। তবে অন্য ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার পার্থক্য আছে। কারণ সাইফুল অনেক উপরতলার মানুষ।স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, সাইফুলের ঘনিষ্ঠ এক ইয়াবা ব্যবসায়ীকে কয়েক মাস আগে আটক করা হয়েছিল। এরপর পুলিশ প্রশাসনের এমন উচ্চপর্যায় থেকে ফোন আসে, যা কল্পনাও করা যায় না। এরপর থেকেই স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা সাইফুলকে অনেকটাই সমীহ করে চলেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির স্নেহভাজন সাইফুলের হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়ার নেপথ্যে আছে মূলত ইয়াবার চোরাচালান।
টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ ওরফে জাফর চেয়ারম্যানও কম যাননি। ছেলে মোস্তাককে সঙ্গে নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী ইয়াবা সিন্ডিকেট। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকায় তাদের অবস্থান যথাক্রমে ২ ও ৩ নম্বরে। এতে বলা হয়েছে, ‘পিতা-পুত্র একত্রে রাজনীতি ও ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে তৎপর। জাফর চেয়ারম্যান বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও ৫-৬ বছর আগে তিনি স্থানীয় বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।' তালিকার ৪ নম্বরে আছেন সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিএ) মং মং সেন। তার বাবার নাম অং সেন। টেকনাফ পৌরসভার চৌধুরীপাড়ায় তার বাড়ি। এছাড়া এমপি বদির ফুফাতো ভাই কামরুল হাসান রাসেলের নামও আছে তালিকায়।তালিকার ৭ নম্বরে থাকা জাফর ওরফে টিটি জাফরের ইয়াবা নেটওয়ার্ক দেশজুড়ে। আগে তিনি হুন্ডি ব্যবসা করতেন। হুন্ডি জগতেও তিনি মাফিয়া হিসেবে পরিচিতি পেলে তার নাম হয় টিটি জাফর। পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা সিআইডির তালিকায়ও টিটি জাফরের নাম রয়েছে। তবে সেখানে তার পরিচয় আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালানি হিসেবে।
বিস্ময়কর ব্যাপার হল, স্থানীয়ভাবে ক্লিন ইমেজের রাজনীতিক নেতা হিসেবে পরিচিত বেশ কয়েকজন নেতার নামও ইয়াবা গডফাদারদের আশ্রয়দাতা হিসেবে তালিকায় উঠে এসেছে। যেমন বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে পরিচিত কক্সবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীর ছেলে রাশেদ ও মাহবুব মোরশেদের নাম আছে যথাক্রমে তালিকার ১১ এবং ৪৭ নম্বরে।তালিকার ১৬ নম্বরে থাকা মাদক গডফাদার মীর কাশেম ওরফে কাশেম মেম্বারের পরিচয়- তিনি সরাসরি জাহাজে করে ইয়াবার চালান পাচার করেন। ১৭ নম্বরে থাকা সৈয়দ হোসেন সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেনের ভাই। তালিকার ২০ নম্বরে আছে আক্তার কামাল ও শহীদ কামাল দুই ভাইয়ের নাম। এরা স্থানীয় এমপি বদির আত্মীয়। তালিকায় আছে বদির বোনজামাই পুলিশের সাবেক ওসি আবদুর রহমানের খালতো ভাই। স্থানীয়ভাবে এরা বদির বেয়াই হিসেবে পরিচিত। তালিকার ৩২ নম্বরে থাকা মৌলভী আজিজের নামটি খুবই উল্লেখযোগ্য। কারণ তিনি স্থানীয়ভাবে একজন দানশীল ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, দানশীলতার আড়ালে তার আসল পরিচয় ইয়াবা গডফাদার। তালিকার ৮৪ নম্বরে আছে বিএনপির সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রেহানা আক্তারের ভাতিজা ইসমাইল হোসেনের নাম। ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় মাদক গডফাদারদের মধ্যে আছে বিহারি ক্যাম্পের ইশতিয়াক, রামপুর থানা যুবলীগ নেতা তানিম ও মেরুল বাড্ডার স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জয়নালসহ মোট ৩২ জন।এছাড়া তালিকায় রাজশাহী বিভাগের মোট ২১ জন হেরোইন গডফাদারের নাম রয়েছে। এরা সীমান্তের ওপার থেকে বড় বড় হেরোইনের চালান এনে রাজশাহীর গোদাগাড়ি, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ সীমান্তবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় বিক্রি করেন।
ক্রসফায়ার নয়, বিচার চাই
সম্প্রতি মাদক নিয়ন্ত্রণে কথিত জিরো টলারেন্সের নাম করে পুলিশ ও র্যাব আবারো ন্যায়বিচারের প্রতিবন্ধক "ক্রসফায়ার" শুরু করেছে। অথচ আমরা দেখছি বাংলদেশের মাদক সম্রাজ্য এর ক্ষমতাবলয় মদদপুস্ট এবং ক্ষমতাবলয় ই এর সাক্ষাৎ সুবিধাভোগী। তাই ব্যবসায়ী ও মাদক সেবক নামক ডালপালা নয়, গোড়া শুদ্ধ উপড়ানোই চাই।
১। রাজনীতিতে সাংসদ বদির গডফাদার, বদি, বদির সমুদয় মাদক ব্যবসায়ী আত্মীয়, বদির সাঙ্গ পাঙ্গ এবং মাদক ব্যবসায় জড়িত স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সংসদ ও দল থেকে বহিস্কার করে স্থায়ী বিচারের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় এইধরনের কথিত জিরো টলারেন্স আসলে পুরানোদের হটিয়ে নতুনদের ব্যবসার সুযোগ তৈরির মহড়া বৈ অন্য কিছু নয়।
২। ক্রসফায়ারে বাংলাদেশের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কিংবা দমন কোনটাই হয়নি। বরং দেশের সরকার ও পুলিশ বাহিনীকে দুধর্ষ সন্ত্রাসী বানিয়ে ছেড়েছে।
৩। ক্রমাগত ক্রসফায়ার জনান দিচ্ছে যে, বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থা সমাজের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এবং দমনে কোনই প্রভাব রাখে না। একদিকে অতি দীর্ঘ কাল ক্ষেপণের বিচার সমাজের আপরাধ নিয়ন্ত্রণে কোন ভুমিকা রাখে না, দমন তো দুরের কথা। অন্যদিকে বাংলদেশের আদালত অপরাধ সংঘঠনের রুট কজ এনালাইজ করে সরকারকে অব্জারভেশন ও রুলিং দিতে নিদারুণ ভাবে অযোগ্য অক্ষম। ফলে মাদক মাদকের যায়গাতেই থেকে বিস্তৃত হচ্ছে, পাচারকারীরা ঘুষ ও তদবির করে পার পেয়ে যাচ্ছে, হয়ে যাচ্ছে অবৈধ ব্যবসায়ের হাত ধরে আঙুল ফুলে কলা গাছ।
৪। সরকার রাজনৈতিক ভাবে না চাইলে মাদকের বিস্তার রোধ অসম্ভব। মাদক রোধে "টপ ডাউন" এপ্রোচ নিতে হবে। যে কোন "বটম আপ" উদ্যোগ এখানে ব্যর্থ এবং লোক দেখানো।
৫। বিচারালয় বিবেক তাড়িত হয়ে বাধ্য না করলে প্রশাসনও ঘুষ ও চাঁদার যোগে তৈরি আর্থিক যোগের সম্রাজ্য ভাঙবে না। পুলিশ প্রশাসন, নারকটিক্স, এদের সোর্স (এই তিনের যোগ সাজশই মূল মাদক বাজারজাত সহয়াতাকারী),বিচার ব্যবস্থা, গডফাদার রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থ্য রহিত করে নেতৃত্ব নিজ নিজ অর্থ যোগের কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট পিছনে ফেলে স্বচ্চ বিচার করতে সাহস করলে, মাদক সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
তবে জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাসী এই কথা বলে আদতে যে লাশ পড়ছে তা কেবল চুনোপুটিদের, আবার এমন কোন স্বচ্চ অপরাধীর তালিকা করার প্রক্রিয়া তৈরি হয়নি যেখানে আমরা নিশ্চিত হতে পারতাম যে এরাই মাদক ব্যবসায়ী। ফলে মূল গডফাদারদের টিকিয়ে রেখে মাঠ পর্যায়ের কিছু ব্যবসায়ী হত্যা এই জিরো টলারেন্স নীতির প্রতারণা হিসেবেই বিবেচিত হবে।
রাজনীতির লোকেদের বাইরেও
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর সাথে মাদকের কানেকশন বহু পুরানো। বাংলাদেশে সঙ্গীত ও শিল্প সংস্কৃতির সাথে জড়িতদের কিঞ্চিৎ থেকে মধ্য পর্যায়ের মাদক সংশ্লিষ্টতাও বাস্তাব। জনপ্রতিনিধি সহ ছাত্র ও পেশাজীবীদের এই অন্ধকার কানেকশন গুলো ভেঙে দিতে হবে পুরোপুরি। শিল্পীদের মাদক বিরোধী সত্যিকার ভুমিকায় আনতে হবে।
পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা চাই, চাই পর্যাপ্ত নিরাময় কেন্দ্র
মাদকের বিস্তার রোধে সমাজ পর্যায়ে, স্থানীয় প্রশাসন পর্যায়ে সর্বোচ্চ সচেতনতা দরকার। মাদকের আসক্তির প্রকার, আসক্তি নির্ণয়-উইথড্র্যাল সিন্ড্রোম,উইথড্রয়াল সিম্পটমের মোকাবিলা ইত্যাদির জ্ঞান ছড়াতে হবে। পিতা মাতা ও স্কুলের ভুমিকা এখানে অগ্রণী।মাদক সেবীকে ঘৃণা না করে তাকে পরম মমতা ও দায়িত্বশীলতা দিয়ে বিপথ থেকে ফিরাতে পরিবার ও সমাজকে কাজ করতে শিখতে হবে। গড়তে হবে পর্যাপ্ত নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। পর্যাপ্ত মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা তৈরি করা বাংলদেশে একেবারেই ভুলে যাওয়া বহু বিষয়ের একটি।
শেষের কথা-
মাদক সমাজের জন্য অভিশাপ। মাদক আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, আমাদের রাষ্ট্রের তারুণ্য নির্ভর উতপাদন মুখীতা যে কয়েকটি ভয়ংকর কারণে বাধগ্রস্ত হচ্ছে তার মধ্যে মাদক অন্যতম।
১। আমাদের যুব সমাজের চোখের সামনে মানব সম্পদ পরিচর্যা ও কর্মসংস্থান তৈরির কোন ট্রান্সপারেন্ট লক্ষ্য ও প্রক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারেনি কোন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল। আমাদের ছেলেমেয়েরা জানেনা তারা পড়ালেখা শেষ করে কি করবে ? কি আছে তাদের ভবিষ্যতে? রাজনৈতিক দলের দখল লূট সন্ত্রাস চাঁদা ও বেপারোয়া অর্থ লোপাট কেন্দ্রিক পাশবিক দুর্বিত্তপনা ও হিংশ্রতা দেখে দেখেই তারা বড় হচ্ছে একটির পর আরেকটি প্রজন্ম। এখানে জীবিকার প্রায় সবকটি মেধাভিত্তিক এমনকি শ্রম নির্ভর সরল পথও হয় ইচ্ছাকৃত রাজনৈতিক প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় কঠিন করে তোলা হয়েছে অথবা একেবারেই রুদ্ধ করে স্বজনপ্রীতি ও ঘুষের জন্য বরাদ্দ করে রাখা আছে।
ডিপ্রেসড এমপ্ল্যমেন্ট এবং মানহীন কর্মপরিবেশের ভয়ংকর চাপ ও উৎকণ্ঠার ইকোনমিতে মধ্য ও নিম্নবিত্তের চাকরি পাবার, চাকরি পেলেও সেখানে উপরে উঠে আসা আশা নাই। বরং মধ্যবিত্ত আস্তে আস্তে সংকুচিত হয়ে নিম্নবিত্ত হচ্ছে। সামাজের জীবন মান কষ্ট সাধ্য ও শ্রম ঘন ক্লান্তির হয়ে পড়লে আশাহীন মানুষ কেমিক্যাল একসটেসিতে মুক্তি খুঁজবে সেটাও স্বাভাবিক।
২। মাদক ব্যবসা সরকারী দল গুলোর সন্ত্রাসী ছাত্র ও যুব উইং কে লালন পালন করার অন্যতম প্রধান ইকোনমিক ফাউন্ডেশন। বলা যায় উন্নয়ন বাজেট লুট, চাঁদাবাজি এবং মাদক এই তিনের উপর ক্ষমতাসীনদের সব সন্ত্রাসী উইং গুলি আর্থিক ভাবে দাঁড়িয়ে উঠে। দিকদিশাহীন যুব সমাজকেই আজ তাই মাদক সম্রাটরা টার্গেট করে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে সমাজের সর্বস্তরে। আমাদের আদর্শহীন দুর্বিত্ত রাজনীতিবিদরা প্রতিবেশী দেশ দুটোর ভাগাড়ের পচা মাংস খাওয়ার মতই মাদক থেকে আসা নোংরা টাকার দিকে লোভী শকুনের মত ঝাপিয়ে পড়েছে।
এই উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সত্যিকারের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ভিশনারি নেতৃত্ব। দরকার সমাজের ব্যাপক মানুষের একসাথে জেগে উঠা।
৩। বছরের পর বছর পারিবারিক ভাবে মাদক সম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করা বদি পরিবারের (উদাহরণ স্বরূপ, এরকম আরো বেশ কয়েকটি পরিবার রয়েছে) লোকেরদের সাংসদ কিংবা সি আই পি হিসেবে মর্যাদা দিয়ে রেখে তৃনমূল পর্যায়ের কিছু ব্যবসায়ী হত্যা করা মাদক বিরোধী অভিযানের সবচেয়ে প্রতারণার দিক।
৪। মৌলিক বিষয়টা হচ্ছে ক্রসফায়ার হচ্ছে রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিচারহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা।
৫। বাংলদেশে তার প্রতিবেশী দুটি দেশ মিয়ানমার ও ভারতের বর্ডার ফোর্স কর্তিক সরাসরি মাদক সন্ত্রাসের শিকার। বাংলাদেশের তরুণ ও যুব সমাজের বাজারকে কেন্দ্র করে দুটি দেশই সীমান্তের ঠিক পাশের ফেন্সিডিল ও ইয়াবার কারখানা চালু রেখেছে এবং প্রতিষ্ঠানিক মদদে এই ব্যবসাকে বাংলাদেশে পুশ করছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে গরু ব্যবসায়ীদের প্রায়ই ভারতীয় বর্ডার গার্ড হত্যা করে, কিন্তু এই একই বাহিনী বাংলাদেশী এজেন্টদের টাকা দিয়ে কয়েক যুগ ধরে বাংলাদেশে ফেন্সিডিল ব্যবসা পুশ করছে। আর চরম ইরেস্পন্সিবল দেশ মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশে ইয়াবা পাচারের সাথে সরাসরি ব্যবসায় যুক্ত।
এই বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আনা দরকার, প্রধানমন্ত্রী টু প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের কুটনীতিতে তো বটেই।
আধুনিক বিশ্বের দ্বিপাক্ষিক রাষ্ট্রীয় সম্পর্কে দুর্বল বা অসচেতন অথবা দুর্বল শাসনে থাকা কিংবা মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনায় বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে পশ্চাৎ পদ প্রতিবেশীকে এইভাবে বুদ্ধি হীন ও মেধা হীন করার চক্রান্তের নমুনা বিরল। এই অপ তৎপরতার আন্তর্জাতিক মনোযোগ চাই। এই হীনতা বন্ধ সময়ের দাবী তো বটেই। তবে বাংলাদেশের সচেতন সমাজ, অগ্রসর নাগরিক, প্রশাসন এবং সরকারকে এই উপলভদ্ধি ও বোধ জন্মাতে হবে সবার আগে। অন্যথায় কেউই সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। আর ক্রসফায়ার নামক অন্যয্যতা চলতে থাকলে মাদক নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য কিংবা সাফল্য দুটাই ব্যহত হবে।
৬।সবশেষে আমাদের যা ভাবতে হবে, তা হল সীমান্ত এলাকার নাগরিকের বেকারত্ব কমাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির টেকসই পথ বের করতে হবে অর্থাৎ এইসব এলাকার বৈধ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড জোরদার করতে হবে। সীমান্তে ব্যাপক সংখ্যক নাগরিককে বেকার রেখে, ব্যাপক সংখ্যক উদ্বাস্তু রেখে মাদক সহ যে কোন পণ্য পাচার সমস্যার টেকসই সমাধানে আসা বেশ দুষ্কর বটে!
শুভ বোধ জাগ্রত হোক দিকে দিকে। তারুণ্য রক্ষা পাক, বাংলাদেশ এগিয়ে যাক।
পরিশিষ্ট-
মাদকের আসক্তির প্রকার, আসক্তি নির্ণয় - উইথড্র্যাল সিন্ড্রোম, উইথড্রয়াল সিম্পটমের মোকাবিলা, প্রিয়জনদের ভূমিকা, আসক্তির চিকিৎসা-ওষুধ ও থেরাপি সাহায্য,আসক্তি মুক্ত হওয়ার উপায়, মানসিক পুনর্বাসন ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত পড়ুন (ভারতীয় সাইট)।
https://bengali.whiteswanfoundation.org/article/addiction-is-it-a-matter-of-choice/
https://bengali.whiteswanfoundation.org/article/addicted-to-drugs-how-can-medication-and-therapy-help/
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৩:০৫