somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এখনো ঘুমঘোরে দুরঅতীতে ফিরে যান দয়াল কৃঞ্চ চাকমা...................

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এখনো ঘুমঘোরে দুরঅতীতে ফিরে যান দয়াল কৃঞ্চ চাকমা। চোখের সামনে স্পষ্টই দেখতে পান সুসজ্জিত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে একদল দামাল বাঙালি যুবকের তুমুল প্রতিরোধ যুদ্ধ। গাছের উপর বসে সেই যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী সেইদিনের মাঝবয়সী দয়ালকৃঞ্চ এখন বয়সের ভারে ন্যুজ। তবুও তিনি ভোলেননি অসীমসাহসী এক বাঙালী যুবক মুন্সী আব্দুর রউফ এর কথা। যুদ্ধের পর সবাই যখন ফিরে গেছে যার যার গন্তব্যে সেই সময় নিথর পড়ে থাকা মুন্সী আব্দুর রউফ এর মরদেহ পরম যতেœ সমাহিত করেছিলেন এই দয়ালকৃঞ্চ। শুধু সমাহিত করাই নয়,এরপর দীর্ঘ ছাব্বিশটি বছর এই যুবকের প্রতি কী এক অন্তহীন ভালোবাসায় পরমযত্মে তার সমাধী পাহারা দিয়েছেন তিনি। এখনো সেই সমাধীর পাহারাদার তিনি।
মুন্সী আব্দুর রউফ ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধী পেয়েছেন,তাও জানতেন না দয়াল। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে সেই সময়কার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর(অব.) রফিকুল ইসলামের ব্যক্তিগত আগ্রহে তৎকালীন বিডিআর যখন মুন্সী আব্দুর রউফ এর সমাধী খুঁজে বের করার জন্য মাঠে নামে তখই এই দয়ালকৃঞ্চের সহায়তায় খোঁজ মিলে সেই ছোট্ট টিলা’টির। যেখানে পরম মমতায় শুয়ে আছে দেশমাতৃকার অন্যতম এক বীরযোদ্ধা। সেই থেকে পাদপ্রদীপের আলোয় বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ এর সমাধী,সেই সাথে দয়াল কৃঞ্চ চাকমাও। বীরশ্রেষ্ঠের মা মুকিদুন্নেছাও তাই ছেলের সমাধী খুঁজে পেয়ে দয়ালকে নিজের আরেক ছেলে হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়েছেন।

কি হয়েছিলো সেদিন ঃ ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল। প্রতিদিনের মতোই সেদিনও কাজের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন দয়াল কৃঞ্চ চাকমা। হঠাৎ দেখতে পান বুড়িঘাট এর চেঙ্গী নদীতে কয়েকটি সুসজ্জিত ও শক্তিশালী নৌযান ও গানবোটে নিয়ে পাক বাহিনী ডুকে পড়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা এলাকায়। তিনি কিছু বুঝে উঠার আগেই নৌযানগুলো থেকে শুরু হয় গোলাবর্ষন। ভয়ে গাছে ছড়ে বসেন দয়াল। আর দেখতে থাকেন অসম অস্ত্রধারী দুই বাহিনীর যুদ্ধ। ভারিঅস্ত্রের বিরুদ্ধে হালকা অস্ত্রের লড়াইয়ে বিস্মিত তিনি। বাঙালী যোদ্ধাদের প্রতিরোধে দুইটি পাক লঞ্চ ও একটি স্পিডবোট নদীতেই ধ্বংস হয়ে যায়,বিধ্বস্ত হয় পাকবাহিনীর অসংখ্য সৈন্য। অতিরিক্ত পাক বাহিনী এলে এক পর্যায়ে পাক বাহিনীর তীব্র আক্রমনের সামনে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলী পিছু হটা শুরু করে। কমান্ডার চিৎকার করে সবাইকে পিছু হঠার নির্দেশ দিলে,মুন্সী আব্দুর রউফ ( দয়াল তখনো নাম বা পরিচয় জানতেন না) পাল্টা কমান্ডারকে জবাব দেন,আমি ওদের (পাক বাহিনী) ঠেকিয়ে রাখছি,আপনি পুরো ব্যাটেলিয়ন নিয়ে নিরাপদে পিছু হটে যান । রউফ এর একক প্রতিরোধের কারণে প্রাণ বাঁচে প্রায় অন্ততঃ আশিজন মুক্তিযোদ্ধার। কিন্তু নিয়মিতর কী নির্মম পরিহাস। হঠাৎ কয়েকটি মর্টার শেল এসে আঘাত হানে মুন্সী আব্দুর রউফ এর অবস্থানের উপর। এরপর সব শেষ,সমাপ্ত সমস্ত প্রতিরোধ। পাক বাহিনীও ফিরে যায় নিজস্ব গন্তব্যে। গাছ থেকে নেমে আসেন দয়াল। নিজ চোখে দেখা এক অসীম সাহসী যুবক যোদ্ধার মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে মন কেঁদে উঠে তার। পরম মমতায় তাকে দাফন করেন। কবরস্থ করার ইসলামী নিয়ম হয়তো তিনি জানতেন না,কিন্তু ভালোবাসা তো আর নিয়ম মানেনা। সেই ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এই অচেনা যুবকের কবরের প্রতি কী এক আশ্চর্য আকর্ষনে তিনি নিয়মিত পরিচর্যা করে গেছেন। শুধু তাই নয়,সেইদিন পথ হারিয়ে ফেলা তিন মুক্তিযোদ্ধাকে নিজের বাসায় আশ্রয় দেয়ার পর নিরাপদে ফিরে যেতে পথ চিনিয়ে দিয়ে তিনি পালণ করেছিলেন এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব।

অতঃপর বীরশ্রেষ্ঠের কবরের খোঁজ ঃ ১৯৯৭ সালে সরকারী উদ্যোগে খুঁজে বের করার চেষ্টা শুরু হয় সব বীরশ্রেষ্ঠের সমাধীর। সেই সময় বুড়িঘাট যুদ্ধের অন্যতম যোদ্ধা ও বর্তমানে রাঙামাটির মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রবার্ট রোনাল্ড পিন্টুর দেয়া তথ্য মতে দয়াল কৃঞ্চ চাকমাকে খুঁজে বের করা হয়। পরে দয়ালের সহযোগিতায় খোঁজ মিলে মুন্সী আব্দুর রউফ এর সমাধীর। সরকারী উদ্যোগে সংস্কার ও পরে আধুনিকায়ন হয় এই বীরের সমাধীর। কিছু সহায়তা মিলে দয়াল কৃঞ্চর চাকমার কপালেও।

একজন বীরশ্রেষ্ঠকে দাফন করে দীর্ঘদিন তার কবর রক্ষনাবেক্ষন করা,পথহারা মুক্তিযোদ্ধাদের পথ চিনিয়ে দিয়ে সহযোগিতা করাসহ তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ দয়াল কৃঞ্চ চাকমাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় সংযোজন করার আলোচনা হয়েছে বিভিন্ন সময়। নানিয়ারচর উপজেলা প্রশাসন ও রাঙামাটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময় নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। কিন্তু তারপরও কাজের কাজ কিছু হয়নি। দয়াল কৃঞ্চ চাকমাকে মুন্সী আব্দুর রউফ এর সমাধীর তত্ত্বাবধানের বিনিময়ে কিছু মাসিক ভাতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তাও তিনি পাননা বলে জানালেন। বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে পাঁচশ বা একহাজার টাকা পান,এছাড়া আর কোন সরকারী সহায়তা নেই এই বয়বৃদ্ধের।

রাঙামাটি জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রবার্ট রোনাল্ড পিন্টু জানিয়েছেন,আমরা বিভিন্ন সময় সরকারের উচ্চ পর্যায়ে দয়ালকৃঞ্চকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির দাবী জানিয়ে লেখালেখি করেছি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলায় এতবছরেও এই কাজটি শেষ হয়নি,এটা আমাদের সবার জন্যই লজ্জার।

তবুও কারো প্রতি কোন অভিমান নেই তার, দয়াল কৃঞ্চ চাকমা এখনো বয়সের ঋজুতা,অসুস্থতা আর শত টানাপোড়নের সংসারের ঝুট ঝামেলায়ও নিজের মতো করেই রক্ষনাবেক্ষন করেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ এর সমাধীর। জানালেন,অনেকেইতো অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন,বলেছেন নিয়মিত ভাতা প্রদান করা হবে,কই কেউতো কথা রাখলোনা,সরকারীভাবে কি পেলাম আর কি পেলাম না তা নিয়ে এখন আর ভাবিনা,আমার মৃত্যুর পর আমার সন্তানরাও এই সমাধীর রক্ষনাবেক্ষন করবে। স্বজন না হয়েও স্বজনের মত মমত্ববোধের এমন বহিঃপ্রকাশ কোথায় আছে ! ফরিদপুরের বোয়ালমারি উপজেলার সালামতপুর গ্রামের এক যুবকের সাথে পার্বত্য রাঙামাটির দুর্গম নানিয়ারচর উপজেলার ভাঙ্গমুড়া গ্রামের একজন দয়ালকৃঞ্চ চাকমা এইভাবে সৃষ্টি হয় এক হৃদ্যতার গল্প। পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত সাম্প্রদায়িক রাজনীতি,দীর্ঘসময়ের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘর্ষও যেই সম্পর্কে কোনদিনও ন্যুনতম চিড় ধরাতে পারেনি। এ গল্প তাইতো আজ সবার মুখে মুখে....যে গল্পের কোন শেষ নেই।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×