somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যে শহর অভিমান বোঝে না !

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ২:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘রুদ্ধশ্বাস এ শহর ছটফট করে সারারাত, কখন সকাল হবে, জিয়নকাঠির স্পর্শ পাওয়া যাবে, উজ্জ্বল রোদ্দুরে’- সেই প্রত্যাশিত উজ্জ্বল রোদ আর আসেনা আমার শহরে। শহরের অলিতে-গলিতে,পাড়া মহল্লায়,শুধুই অভিমান। আক্ষেপ বা ঘৃণাও কি নেই? আছে। এই আমার শহর, ভালোবাসার শহর-বেদনার শহর ‘রাঙামাটি’।

সেই ছেলেবেলা থেকেই এই শহরের আমাদের দুর্দান্ত বেড়ে উঠা। স্কুলের বেঞ্চে পাশাপাশি হাসাহাসি আমাদের। বন্ধুরা মিলে গাইতাম ‘আমরা করব জয়’ সেই বিশ্বজয়ী গান। আমার কে ছিলাম মুসলিম, কে হিন্দু, কে বৌদ্ধ সে খবর কেউ রাখতাম না। চেহারা না দেখলে বুঝতামইনা কে পাহাড়ি আর কে বাঙালি। জাতিগত পরিচয়ে কিছুই যায় আসতো না আমাদের। আমরা ছিলাম বন্ধু, শুধুই বন্ধু। পাহাড়ের রাজনৈতিক জিঘাংসা,অস্ত্রের ঝরঝানিতেও তিলমাত্র ছিড় ধরাতে পারেনি আমাদের বন্ধুতায়। একসাথে হৈ-হল্লা, মারামারি, ধরাধরি। শুধুই কি আমাদের? গত একচল্লিশ বছরের পার্বত্য রাঙামাটি শহরের চালচিত্র এটি। আমাদের বড়রা বা বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের ছোটরাও এইভাবেই বেড়ে উঠেছি। কোথাও যে সংকট ছিলোনা তাওতো নয়,তবে বৈরিতা ছিলোনা কোথাও ।

কিন্তু গত ২২ সেপ্টেম্বর আমাদের সবার চৈতন্যে, বোধে, বিশ্বাসে বড় ধরণের আঘাত করে গেলো। আমরা যা করিনি ,যা চাইনি কোনদিন তাই হয়ে গেলো। তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমরা দুইভাগে ভাগ হয়ে যে রাজনৈতিক জিঘাংসায় মেতে উঠলাম তা আমাদের সততাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, আমাদের দীর্ঘ যূথবদ্ধতাকেই দাঁড় করিয়ে দিয়েছে প্রশ্নের সামনে।

বহুকাল ধরে আমাদের সম্প্রীতির রেখা মুছে দিয়ে আমরা একে অপরকে কিভাবে ভয়ানকভাবে প্রতিপক্ষ মনে করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম পরস্পরের দিকে ! আমরা সবাই ‘পাহাড়ি’ আর ‘বাঙালি’ হয়ে গেলাম। ভুলে গেলাম আমরা পরস্পর বন্ধু্‌ ছিলাম। মনে রাখলামনা, অসাম্প্রদায়িক চরিত্র নিয়ে বেড়ে উঠা এই শহর আমাদের সবার।

মনে প্রশ্ন আসেই,তবে কি সেদিনের ঘটনা শুধুই নিছক একটি ঘটনামাত্র ? নাকি আমাদের অজান্তেই আমাদের ভেতরে বেড়ে উঠা ‘অভিমান’ এর ক্ষোভ হয়ে আত্মপ্রকাশ? এনিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে, সভায়, তদন্তে, ওয়েবে এবং ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক পর্যায়েও। কিন্তু কেনো এই অভিমান ? কেনো পাহাড়ের সবুজ মানচিত্রে যুগল বেড়ে উঠা পাহাড়ি-বাঙালি তরুণ পরস্পরের প্রতি এমন ‘অভিমান’ নিয়ে বেড়ে উঠছে। কারা এই ‘অভিমান’ তৈরি করতে ভূমিকা রাখছে,কারা উস্কে দিচ্ছে জাতিগত জিঘাংসার বিষবাষ্প ? এই সব প্রশ্নের জবাবে নীরব হয়ে থাকা মুখগুলো বড়ই করুণার্ত দেখায়। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তির পক্ষে যেমন আছে অজস্র মানুষ,আবার বিপক্ষেও কম নয়। এদের মধ্যে বাঙালি যেমন আছে,পাহাড়িও আছে। গণতান্ত্রিক সমাজে ভিন্নমত,ভিন্ন অবস্থান থাকতেই পারে। এনিয়ে পাল্টাপাল্টি ‘গ্রহণযোগ্য’ উপায়ে গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন করাও দোষণীয় নয়। কিন্তু বিরোধিতার স্বার্থে বা বিরোধিতা করা নতুবা সমর্থন করার অপরাধে কাউকে হত্যা করা কি গ্রহণযোগ্য কোন সমাধান? কিন্তু গত পনের বছর ধরে পার্বত্যাঞ্চলের প্রায় পাঁচশতাধিক তরুণের রক্তের দাগ কি প্রমাণ করে? এতোগুলো পরিবারও কি ‘অভিমানী’ হয়নি,প্রচলিত সিস্টেমের প্রতি। কি অন্যায় ছিলো এই পরিবারগুলোর ? শান্তিচুক্তির পনের বছর পরও কেনো পাহাড়ে চাঁদাবাজি অব্যাহত আছে। কেনো হ্রদের জলে নৌযান চালাতে,সড়কে মোটরযান চালাতে, ঠিকাদারি কাজে, ব্যবসায়,সর্বত্র চাঁদা দিতে হবে ? কিসের দায় ? সশস্ত্র আন্দোলনের দুই দশকে যে চাঁদা অস্ত্র ক্রয় বা বিশাল সশস্ত্র গ্রুপ লালনে ব্যয় হয়েছে সেই চাঁদা আবার কেনো ? চাঁদার হাত থেকে কি পাহাড়ী-বাঙালি কেউ মুক্তি পাচ্ছে? প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজির শিকার, অপহরণের শিকার সাধারণ মানুষের মনে যে অভিমানের বরফ জমছে তা গলাতে কি কোন উদ্যোগ আছে? হত্যা, খুন, গুমের শিকার পরিবারগুলোর ‘ক্ষোভ’ কি সময়ে-সুযোগে বিস্ফোরিত হবেনা ? ভুমি পার্বত্য চট্টগ্রামে বরাবরই জটিল একটি সমস্যা। এনিয়ে বিরোধ দিনে দিনে জটিল হয়েছে। এই সমস্যা সমাধানে গঠিত কমিশনকে যেমন ঠিকভাবে কাজ করতে দেয়া হয়নি,তেমনি কমিশনও নিজের কাজের সীমারেখা সম্পর্কে সচেতন ছিলনা। আবার ভূমি জরিপ নিয়েও আছে পাহাড়ি-বাঙালির ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান। কিন্তু বাস্তবতা হলো,এই সংকট কাটছে না। এ দায় একা সরকারকে দেয়াও ঠিক হবেনা। সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন যেমন আছে,তেমনি দায় কম নয় স্থানীয় ‘সুবিধাভোগী’ রাজনীতিবিদদেরও। ভূমি জটিলতার শিকার সাধারন পাহাড়ি-বাঙালিরা ‘অভিমান’ তাই ক্রমশঃ বাড়ছে।

পাহাড়ে অনেক উন্নয়ন সংস্থা। টাকা থলি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় পথে পথে। উন্নয়নের এইসব ফেরিওয়ালাদের কথিত উন্নয়ন এই এলাকায় কিছু সুযোগসন্ধানী সুবিধাবাদী গোষ্ঠী তৈরি করেছে বটে। কিন্তু তার পার্বত্য জনপদের সত্যিকারের সামগ্রিক উন্নয়নতো করতেই পারেনি বরং তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনায় গলদের কারণে পাহাড়ি-বাঙালি বৈষম্য আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। দেশী বিদেশী বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরতদের তালিকায় জাতিগত পরিচয় খুঁজতে গেলে তা রীতিমতো হতাশাজনক। আর কর্মএলাকা নির্বাচনেও আছে দুঃখজনক বৈষম্য। এই হতাশা,বৈষম্য যদি কারো মনে অভিমান তৈরি করে,আর সেই অভিমান যদি ক্ষোভে রূপ নেয়,এর দায় কার ?

২২ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি সহিংসতায় কেউ মারা যায়নি বলে জানি আমরা। কথাটি সত্যি নয়। অবশ্যই মারা গেছে। যারা মারা গেছে তাদের নাম ‘বিশ্বাস’ ‘সম্প্রীতি’ ‘আস্থা’। বেঁচে আছে কেবল ‘অভিমান’। এই অভিমানের কারণে গত তিনমাসেও শহরের সবচে প্রাচীন ব্যবসাকেন্দ্র তবলছড়ি বাজারে যায়না পাহাড়ীরা,শহরের সবচে ব্যস্ত শপিং মল বিএম মার্কেটেও যায়না তারা। শহরের অন্যান্য স্থানেও বাঙালিদের দোকানে কেনাকাটা করতে চায়না,এমনকি বাঙালির ট্যাঙিতেও উঠতে চায়না,এমন অভিযোগ বাঙালীদের। পাহাড়িদের এই ‘অভিমান’ হয়তো যৌক্তিক। নিজের শহরে, নিজের বাজারে লাঞ্ছিত হলে ‘অভিমান’তো হবেই। প্রতিক্রিয়া হয়তো এতোটা তীব্র নয় কিন্তু বিপরীতে বাঙালিদেরও ‘অভিমান’ আছে। এই ‘অভিমান’ বয়কট হয়তো করছেনা,তবে ভবিষ্যতে সংকট তৈরির পথকে প্রশস্থ করবে বটে। আবার পাহাড়ি বাঙালির এই অভিমান নিয়ে স্থানীয় রাজনীতিও আছে,আছে সাম্প্রদায়িক উস্কানি। মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা,ওয়েবে প্রচার,আন্তর্জাতিকভাবে অপপ্রচারতো আছেই।

কিন্তু কেউই কারো অভিমান বুঝতে পারছে না,বুঝতে চাইছে না। পাহাড়িরাভাবে- ‘সব দুঃখ শুধুই আমাদের’। আর বাঙালিদের ভাবনা -‘নিজ দেশে থেকেও আমাদের কপালে কিছু নাই।’ আর এদের পরস্পরের অভিমানের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাও নাই,অভিমান কমানোর চেষ্টাও নাই। রাজনীতিবিদরা তো রাজনীতি নিয়েই আছেন। এই অভিমান কমাতে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক ‘দীপংকর তালুকদার’ও নিশ্চুপ। আবার নতুন জাতীয়তাবাদী ‘দীপেন দেওয়ান’ও মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। মাঝখানে পাহাড়ী-বাঙালী স্থানীয় নেতারা নিজ নিজ দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থটাই দেখছেন সবার আগে । তাহলে সংকটের সমাধান কোন পথে ?

অভিমানে দগ্ধ এই শহরের মানুষের অভিমান ভাঙাবে কে? কে উদ্যোগ নিয়ে ফিরিয়ে আনবে পুরনো সেই দিন। সেই হাতে হাত ধরে, পায়ে পায়ে যুগল পথচলা, যৌথ স্বপ্ন বোনা। পুরনো সেইসব দিন, কেউ কারো জমি দখল করবেনা,অপহরণ-হত্যা-গুম-খুন বন্ধ হবে, ফুলে ফলে সুবর্ণ সবুজ নিরাপদ পাহাড়ে কোন জুম্মবী গাইবে গান-‘ভালোবাসায়.. বেদনায়.....’। আমরা সেই সোনালী দিনের প্রতীক্ষায়...যেদিন জীয়নকাঠির স্পর্শের উজ্জ্বল রোদ্দুরে আলোকিত হবে আমাদের পাহাড়....আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম।
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×