ঈশ্বরচিন্তা - 1
একটা ছোট গল্প দিয়ে শুরু করছি। মেরুদন্ডী প্রানীর প্রাচীনতম পূর্বপুরুষ হচ্ছে সেলা। বেচারাদের অবশ্য পৃথিবী নিয়ন্ত্রন করা বর্তমান কর্ডেট দের তুলনায় কিছুই ছিল। স্পাইনাল কর্ডের সামান্য উর্ধ্বাংশই ছিল তাদের সম্বল। ছোট, কয়েক সেন্টিমিটারের প্রানীগুলো ছিল প্রচন্ড বিপদে। তখন রাজত্ব চলছে বিশাল বিশাল আর্থোপোড প্রিডেটরের। সাত আট ফুট লম্বা এই সব কিলিং মেশিন সমুদ্র দাবড়িয়ে বেড়াত। সেলা লুকাত বালির নীচে।
এখন কি ভাবা সম্ভব? প্রাথমিক ভাবেই ভাবা যায় এই সেলা ব্যাটাদের কোন অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল যাতে তারা হতে পেরেছে সবচেয়ে শক্তিধর মেরুদন্ডী দের পূর্বপুরুষ। আর আর্থোপোডেরা হতে পেরেছে তেলাপোকা। কিন্তু বাস্তবে তাদের কোন বিশেষ ছিল না সেই আর্থোপোডদের ডেজার্ট হওয়া ছাড়া। স্পাইনাল কর্ডের অর্জন একটি ব্যার্থ প্রাকৃতিক নির্বাচনের উদাহরন হয়ে যাবারও যথেষ্ঠ সম্ভাবনা ছিল।
কিন্তু হঠাতই শুরু হয়ে গেল বরফ যুগ। কততম বরফ যুগ আমার সঠিক মনে নেই। কিন্তু বরফ যুগের শুরুতে বিপুল সামুদ্রিক প্রানী ডাঙ্গায় চলে আসল। ডাঙ্গায় দেখা গেল অন্য সমস্যা। যে প্রথিকুল গ্যাস এবং ম্যাগমা ভস্মের হাত থেকে বাচার জন্যে আর্থোপোডদের অর্জিত বহি:কংকাল অসম্ভব রকম এফিসিয়েন্সির প্রমান দিয়ে আসছিল, তুলনামুলকভাবে শান্ত পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে তারা যখন এক্সপোজ হয়ে গেল তখন সেটা একটা বাড়তি বোঝায় পরিনত হল। স্পাইনাল কর্ড অর্জনাকরী সেলার বংশধরেরা বাড়তে লাগল আকৃতিতে তাদের অন্ত:কংকাল কাঠামোর সুবিধায়। আর আর্থোপোডেরা তাদের বহি:কংকাল কাঠামোর জন্যে সীমাবদ্ধ বৃদ্ধির জন্যে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে শুড়ওয়ালা তেলাপোকায় পরিনত হবার প্রস্তুতি নিল।
হয়ত আর কিছুদিন পর বরফযুগ শুরু হলে বুদ্ধিমান হিসেবে ইভোলভ করত আর্থোপোডেরাই, আর ভাড়ার ঘরে মেয়ে আর্থোপোডেরা মানুষ দেখে চিতকার চেচামেচি করত।
গল্পের মরাল হচ্ছে আকস্মিকতা। কোইনসিডেন্স।
মহাবিশ্ব অত্যন্ত জটিল একটি তন্ত্র। এখানে কোন সাড়বস্তু আউটপুট হিসেবে পেতে হলে কিছু আকস্মিকতার সাহায্য দরকার। আবার সেই আকস্মিকতা কোন দৈববলে হয় না। যেকোন সিস্টেমের প্রোবাবিলিস্টিক ন্যচারের জন্যেই হয়।
মহাবিশ্বের প্রধান সুত্রগুলি তাই অত্যন্ত সার্বজনীন, যেখান থেকে পার্টিকুলার সলিউশান পেতে গেলে আক্ষরিক সমাধানের ভান ত্যাগ কররতে হয়। আমরা এখনও অসংখ্য আসন্নীকরনের সাহায্য নিয়ে জেনারেল রিলেটিভিটির ফিল্ড ইকুয়েশান গুলি সমাধানের চেষ্টা করি।
তাই কোন তত্ব স্ট্যাটিক নয়, যেকোন তত্ব নির্ভর করে তার ইনিশিয়াল পর্যবেক্ষন, প্রাথমিক হাইপোথিসিসের উপর। তাই হাজার বার সঠিক প্রমানিত হওয়া তত্ব হাজার একবারে অসাঢ় প্রমানিত হতে পারে। তাতে কিছু যায় আসে না। কারন বুদ্ধিবৃত্তিক প্রানী হিসেবে যৌক্তিক সিদ্ধান্তই নেয়ার চেষ্টা করে যাব। সেই সিদ্ধান্ত ভুল হতে পারে। কিন্তু তাও অপ্রমানিত সুপার স্ট্রিং থিওরীতে আমার আস্থা থাকবে পৃথিবীকে কোন কচ্ছপের পিঠে ভাসমান থালা বলে কল্পনা করার চেয়ে। কারন অতিতন্তু তত্ব দাড়িয়ে আছে কিছু সাহসী হাইপোথিসিসের উপর, সেই হাইপোথিসি থেকে এসেছে সৌন্দর্য মন্ডিত এক গানিতিক মডেল। কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরীর কুৎসিত ইনফিনিটি প্লেগে আক্রান্ত তত্ব গুলোর চেয়ে এটি গাণিতিক ভাবে সুসংহত। যদি এটি ব্যার্থ হয় তবেও এটি মানুষকে দিয়ে যাবে মহাবিশ্বকে দেখার নতুন কিছু দৃষ্টিকোন। এজন্যেই কোন বৈজ্ঞানিক তত্বই ব্যার্থ নয়, কারন তার পথ ধরেই নতুন তুলনামুলকভাবে সম্পূর্নতর নতুন তত্ব।
অন্যদিকে কছ্ছপতত্ব মানুষকে নতুন কোন আলো দেখাবে না। বরং অজানা সম্পর্কে যৌক্তিক ধাপগুলোতে মানুষকে অনুৎসাহিত করে পেছনে ঠেলে দেবে।
মানব সভ্যতার ইতিহাস একবিশাল আরোহ পদ্ধতি যা ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবে যুক্তি এবং মানবতা দিয়ে। এই এগিয়ে যাওয়ায় কোন শেষ কথা নেই। যারা দাবী করে শেষ কথা আছে তারা সত্য জানতে আগ্রহী নয়, অথবা সাহসী নয়।
মানুব সভ্যতার ইতিহাসে মানুষ যতটা অধিবিদ্যিক ধারনার পেছনে সময় নষ্ট করেছে তাও কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। এর পেছনে রয়েছে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে ইনসিকিউরিটি। প্রতিমুহুর্তে মৃত্যুকে ভয় পাওয়া। মহাবিশ্বের মাঝে নিজের গুরুত্বহীনতাকে অস্বীকার করা। কিছু একটা থেকে যাবে সেই আশা প্রথম মানুষের মাঝে ঢুকিয়েছিল পৌরাণিক পুরহিতরা। অনেকটাই পলিটিক্যাল কারনে। কিন্তু এই আশায় ঘুরপাক খাচ্ছে প্রতিনিয়ত, আর দলবদ্ধতার সিকিউরিটির প্রতি তাদের তীব্র আকাঙ্খাই তাদের অবচেতন ইনসিকিউরিটিকে প্রমান করে। প্রতিমুহুর্তেই নিজেদের দলকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসানোর চেষ্টা, কিংবা কি হারে বিশ্বে তাদের নিজেদের সংখ্যাবৃদ্ধি তা প্রমানের জন্য অসংখ্য পরিসংখ্যান উপস্থাপন সবকিছুই প্রমানকরে দাবী কৃত ঐশ্বরিক আধ্যাত্নিকতার অসাঢ়তাকে। এই তীব্র নিরাপত্তাহীনতাই জন্ম দেয় হিংসার, ক্রোধের। আমি দিকে দিকে তার চিহ্ন খুজে পাই।
ঐতিহাসিক ভাবে যার অস্তিত্বেই প্রশ্নবিদ্ধ সেই মোজেস এর প্রতিশ্রুত ভুমির কথা বলে পশ্চিম উপত্যকায় ,গাজায় চলে সেটেলমেন্ট, অকুপেশনের যাতাকলে নতুন হলোকাস্ট, কিংবা মার্কিন মুলুকে শ্বেত আধিপত্য বাদীদের মদদ দেয় যাযকরা, ইভানজেল(উচ্চারন নিশ্চিত নই) খ্রীষ্ঠান এক যাযক ঘোষনা দেয় বারাক ওবামার রক্ত পবিত্র ভুমিকে আরো পবিত্র করবে , কিংবা আমার দেশের বাংলাভাই, সৌদির বিন লাদেন!!
প্রান্তিক মানুষেরা ধর্মপালনে উৎসাহী হয় না। দারিদ্র্য টিকে থাকা এসবের সাথে লড়াই করতে করতে তাদের উপর স্বর্গ নরক একাকার হয়ে যায়। অনকে দুর থেকে দেখলে যেমন খুব ভিন্ন দুটি রং কেও আলাদা করা যায়। আর উচ্চবিত্তের মাঝেও রিচুয়াল পালনের হার কম, ধর্ম চিরকাল পালিত হয় মধ্যবিত্ত সমাজ দ্বারাই।
আমি লোভের সাগরে ডোবা মানুষ দেখতে পাই, অতিলৌকিক পুরস্কারের আলোয় জ্বলজ্বলে চোখ দেখতে পাই। অসংখ্য স্তুতি দেখতে পাই । কোন এক স্বৈরাচারের প্রতি। তার পরাক্রমশালী ক্রোধ, বালকসুলভ আবেগ, গভীরতাহীন চিন্তাশক্তি, আর অদ্ভুত "ন্যায়বিচার" দেখে তাকে আমার কমবয়সে সিংহাসনে ওঠা কোন মিশরীয় ফারাও মনে হয়। উচ্চারিত স্তুতি আর অর্থহীন রিচুয়ালের প্রতি তার তীব্র আগ্রহ দেখে তাকে আমার সম্ভ্রান্ত পরিবারের বখে যাওয়া একমাত্র সন্তান মনে হয়। প্রতিমুহুর্তে তার নিজস্ব সৃষ্টির কাছ থেকে নিজের নাম শুনতে চাওয়ার মত হাস্যকর হীন্মন্যতার কারনে আমার মনে হয় তার শৈশব খুব ডিস্টার্বেন্সের মধ্য দিয়ে গেছে। তার মাঝে আমি অসংখ্য অস্তিত্বের সংকটে ভোগা মানুষের ছাপ দেখতে পাই। যুগে যুগে মানুষহের সকল কষ্ট স্তুপ হয়ে জমে যেন তার অবয়ব তৈরী হয়েছে। মানুষের সামাজিক পরিমন্ডলে সকল সমস্যার যে স্থুল সমাধান মানুষের মাঝে আসে সেই সমাধান গুলো এক্সিকিউট করতেই যে স্বত্বা দরকার তাকে তেমনই দেখতে পাই। ডুবে যাওয়া মানুষের শেষ চেষ্টার প্রধানতম উধাহরন হিসেবে যুগে যুগে ধর্মবেত্তারা তাকে তৈরী করেছে।
ঈশ্বর কি এই মহাবিশ্বের অনুকুলে যতগুলো আকস্মিকতা দরকার ছিল তার সংকলন হতে পারে? তাহলে মহাবিশ্বের সাথে ইশ্বরের ইন্টারএকশান খুবই সীমাবদ্ধ এবং নৈর্ব্যত্তিক।
অসংখ্য পবিত্র বই দেখতে পাই । অনেক মনোযোগ দিয়ে পড়েও সেগুলো থেকে কোন মহিমান্বিত শব্দগুচ্ছ পেলাম না। ওল্ড টেস্টামেন্ট পড়ে মনে হল কোন প্রাচীন যুগের ত্যারেন্তিনোর মুভির স্ক্রিপ্ট। এত বর্বর মানুষের বর্ননা পবিত্র ভাবা হতে পারে আমার ধারনা ছিলনা। সুসমাচারে দেখলাম অসংখ্য স্ববিরোধী এবং পরিবর্তিত ঈশপের গল্পের সমাহার। দেখলাম কুরানে অদ্ভুত সব আদেশ। দেখলাম যাদুতে আক্রান্ত হচ্ছেন নবীজি আর তার প্রতিকার নাযিল হচ্ছে।
আমি ক্লাস ত্রি এর বিজ্ঞান বইতে হাজার বছরের পুরাতন এইসব বই এর থেকে উন্নত সত্যের কথা দেখেছি।
আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি না। আমি মানুষ। প্রতিটি ইকুয়েশন আমাকে আনন্দ দেয়, ইলেক্ট্রোডাইনামিক্সের যে সমীকরনটা সেদিন কম্পিউটারের সাহায্য ছাড়া সমাধান করে ফেললাম সেটা আমায় আনন্দ দেয়, সার্ভার স্ক্রিপ্টিং এ যে সোজা থ্রেড যোগ করতে পেরে একটা ভুল বানানের হ্যালো ওয়ার্ল্ড রিডিরেক্ট করতে পারলাম তা আমাকে আনন্দ দেয়, সেদিন ফাইনম্যানের ক্যারেক্টারইসটিকস অফ ফিজিক্যাল ল বই টা খুজে পেয়ে শিশুর মত নেচেছিলাম, ভালোবাসার মানুষটির হাতে হাত রাখতে এখনও প্রথম দিনের মত আমার মন খুশিতে ভরে যায়, আমি আনন্দিত হই। আমার অনুভুতি , সুখ দু:খ সবকিছুই বাস্তব এবং জান্তব। আমার খুশি হতে কিংবা এ পৃথিবীতে আমার খুশি ছড়িয়ে দিতে ,কিংবা সমস্য জর্জরিত পৃথিবীতে অন্তত একটি সমস্যার আংশিক সমাধানের ইচ্ছা, সবই তীব্র বাস্তব। কোন অলৌকিক ইশারায় নয়।যদি ভালোবাসা, হেসে উঠা , নতুন বইয়ের পাতার যৌবনের গন্ধ নেয়ার জন্যে আমার মৃত্যুর পর আমার মিশে যাওয়া কোষ থেকে কোন অতিলৌকিক স্বত্বা ক্লোন তৈরী করে আমাকে আজন্ম অক্সিডেশনের জন্যে নরকে নিক্ষেপ করতে চান তাহলেও আমি দু:খ করব না, বরং তার অবিচারের জন্য প্রতিবাদ করব। আমাকে চিন্তা শক্তি দেয়ার পর সেটার স্বাধীন ব্যাভারে যদি আমি অপরাধী হই, তাহলেও মাথা নত করব না।
আমি গর্বিত আমি মানুষ। আমি আনন্দিত আমি পেয়েছি জ্ঞানের স্বাদ, ভালোবাসার সৌরভ, ঘাসের উপর পড়ে থাকা শিশিরে আলোর পূর্ন আভ্যন্তরীন প্রতিফলন। আমি কোন আঙ্গুর রস বয়ে যাওয়া হুর পরী বেষ্টিত অজানা যায়গার আমাকে লোভ দেখায় না। আমি এই মাটিতেই সুখপাই , কবিতা পড়ে সুখ পাই, কথা বলে সুখ পাই।