ঈশ্বরচিন্তা -২
ঈশ্বরচিন্তা - ১
নিয়ন্ত্রন, শব্দটি বেশ গুরুত্বপূর্ন । কারন সবাই নিয়ন্ত্রন করে অথবা নিয়ন্ত্রিত হয়। নিয়ন্ত্রন হতে পারে জাগতিক অথবা ঐশ্বরিক অলৌকিকতা পূর্ন। আমরা যেকোন স্বাভাবিক সিস্টেমের মতই নিয়ন্ত্রন চাই। নিজের দায়িত্ব কারো ঘাড়ে দিতে পারলে আশ্বস্ত হই। স্থুলবুদ্ধিরা পীর ফকির ধরে থাকে, পরলৌকিক দায়ত্ব নেবার জন্যে। এজন্যেই যুগে যুগে মানুষ এবসোলিউট অসম্ভব কথা শুনিয়েছে আমরা মেনে নিয়েছি। এখনও যুক্তরাষ্ট্রে আছে মোর্মেন ধর্মালম্বীরা, সায়ান্টোলজির অনুসারীরা। এই মহাবিশ্ব জটিল এবং বিভ্রান্তকারী। যখন ছোট অবস্থায় ভাবতাম এই আকাশের কোন শেষ নেই তখন শরীর কেপে উঠত। ভেবে পেতাম না কিভাবে অসীম কে চিন্তা করা যায়। তাই আমরা দুর্বল। আমাদের বৌদ্ধিক এবং দার্শনিক দায়িত্ব অনেক ভারী মনে হয় আমাদের কাছে। তাই দায়িত্ব ছেড়ে দিতে আমরা সদাসর্বদা প্রস্তুত।
নিয়ন্ত্রন মানব সমাজের প্রধান বিল্ডিং ব্লক। মানব সমাজ তৈরী হয় ব্যাক্তি মানুষ কে অস্বীকার করার মধ্য দিয়েই। সামাজিক সম্পর্ক সেখানে ব্যাক্তি মানুষের চেয়ে বেশী গুরুত্বের অধিকারী। একারনেই তৈরী হয় গাবদা সাইজের আইনের বই। যদিও এটা সাধারন ধারনা যে সমাজ ছাড়া টিকে থাকা অসম্ভব, কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে ধারনাটি সমাজের প্রতি অতিপক্ষপাতে আক্রান্ত। যেখানে আমজনতা নানা নিয়ন্ত্রনের চক্করে পরে অন্ধকার দেখার পরেও ভেবে নেয় ননসেন্স নিয়মকানুন তার ভালোর জন্যেই তৈরী করা, সেখানে আমরা দেখতে পাই ব্যাক্তি মানুষের করুন মৃত্যু। এই শতাব্দীতে সমাজের প্রথম কাজ মানুষ কে সার্ভ করা নয়, তার নিজের পেট ভরা। এবং তার সুফল ছোট্ট একটি দলকে প্রদান করা। কিছু মানুষ বুঝে যেতে পেরেছে মানুষের সমাজ কে যারপরনাই বিশ্বাস করে, তাই সমাজের নাম ধরেই নিয়ন্ত্রনের জাল বসানো সম্ভব। এই কতিপয় মানুষরাই যুগে যুগে দেখা দিয়েছে কখোনো রাজনৈতিক নেতা, কখোনো ধর্মবেত্তা রুপে।
মানব সমাজে ঈশ্বরের নামে নিয়ন্ত্রন অনেক পুরোনো ইতিহাস। সেই পুরাতন যুগের গ্রাম্য পুরোহিত থেকে যার শুরু। সকল আধুনিক ধর্মই যখন মুলধারায় মাথা তুলে দাড়িয়েছে তখন তীব্রভাবে রাজনৈতিক হয়ে গিয়েছে। আমরা দেখতে পাই কিভাবে গীর্জাগুলো রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্লজ্জভাবে দখল করে নিত, কিংবা আধুনা হিজবুত তাহরীর কিংবা জামাত যা চায়। ইসলাম শুরু থেকেই পলিটিক্যাল ছিল। কারন মুলধারায় এটি অনেক দ্রুত আসতে পেরেছে। অন্যদিকে ক্রিশচিয়ান ধর্ম দীর্ঘদিন আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকেছে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের আগে। এটা খুব ইন্টারেস্টিং একটা বিষয় কিভাবে ঈশ্বর মানব রাজনীতির এত বড় একটি ফ্যাক্টর হয়ে উঠেন। তিনি একের পর এক ওহী পাঠাতে থেকেন রাষ্ট্র পরিচালানার উপর। যদি ওহী না পাঠান তাহলে তার প্রতিনিধিত্বকারী যাযকেরা জিওর্দানো ব্রুনো পুড়িয়ে মেরে রাজনৈতিক ক্ষমতার ষোলকলা পূর্ন করে। মধ্যযুগের ইনকিউজিশনের কথা মনে হয় মানব ইতিহাসে নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সবচেয়ে কুৎসিত প্রচেষ্টার একটি। হিটলার বাবাজী যেটি জাতীয়তাবাদের ধুয়ো ধরে ৪০০ বছর পর আবার করে দেখিয়েছে।
ধর্মের মানবিক হতে গিয়ে কিভাবে রাজনৈতিক হয়ে জিজিয়া কর উৎপাদনে উৎসাহী হয়ে পরে এটির বিশ্লেষনে গেলে সমাজের নিয়ন্তা হবার যে সুপ্ত বাসনা মানব মনে লুকিয়ে থাকে, অথবা অসংখ্য ব্যাক্তিস্বত্তাকে হত্যা করে যে আমোদ লাভ করা যায়, সেদিকেই দৃষ্টি যায়। সকল ধর্মই শুরু হয় আধ্যাত্নিক মুখোশে। কিন্তু একজন চতুর রাজনীতিবিদের মত ধর্মের কাঠামোও নিয়ন্ত্রন লোভী হয়ে উঠে। প্রকারান্তে ঈশ্বর হয়ে উঠেন "পাওয়ার হাঙ্গরী"। সর্বশক্তিমানের এরকম শক্তির লোভ কেন যেন বেমানান দেখায়।
কোন ধর্মের মাঝে সত্যিকার সাম্যের কথা থাকে না, বিভেদ বিভাজন, বর্নবাদ প্রত্যেক ধর্মের সুন্দর অনুশাসনের নীচে লুকিয়ে থাকে। কারন যে সমাজে মানুষের ব্যাক্তিতার মূল্য আছে সে সমাজকে নিয়ন্ত্রন করাও কঠিন। এজন্যেই ধর্ম দেয় বিভাজনের রুপরেখা, নিয়ন্ত্রনের প্রধান হাতিয়ার যে বিভাজন। ধর্ম মানুষে ধার্মিক এবং বিধর্মী এই দুইভাগে বিভক্ত করে দেয়। ঈশ্বর বিশ্বাসের পুরস্কার স্বরুপ ধার্মিকদের হাতে পরে রাষ্ট্র পরিচালনার ভার। তারা নিয়ন্ত্রন করবে বিধর্মীদের। কারন তারা বিশ্বাস করে ভিন্ন কোন ঈশ্বরকে।
মানুষ ব্যাক্তিস্বত্তা কে সামাজিক চাপে অস্বীকার করে অনেক সময়। কিন্তু সকল নিয়ন্ত্রনের প্রধান শত্রু এই ব্যাক্তি মানুষটি। যারা সম্মান করে নিজস্ব চিন্তাকে তারা নিয়ন্ত্রকের চোখে অপরাধী। টুকরা টুকরা করা হয়েছিল মনসুর হাল্লাজকে। কোপানো হয়েছিল হুমায়ুন আজাদকে। সকল পত্রিকায় কমিউনিস্ট পার্টির জয়জয়কার ছাপানো হত লেলিনের রাশিয়ায়। বিরোধী দলের পার্থীদের নির্বাচনে প্রচারনা করতে দেয়া হত না বিপ্লব পরবর্তী রাশিয়ায়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইন্সিটিউশন সম্ভবত ডানপন্থী লোকদের তৈরী। ধর্মের সাথে জাতীয়তাবাদ মিশিয়ে নতুন নতুন বিভাজনের খসড়া আর নিয়ন্ত্রনের নীলনকশা প্রতিনিয়তই তৈরী হচ্ছে।
নিয়ন্ত্রিত হতে চাই না আমি। সুন্দর তম হোক আর কুৎসিততম হোক, ছোট্ট পৃথিবীতে দু-চারটে কথা ভাবতে চাই, বলতে চাই। কারো উপকার না করতে পারি, কারো ক্ষতি না করে থাকতে চাই। নিজের ব্যাক্তিগত স্বত্তাকে একটু সম্মান করতে চাই। মাথা একটু কম নোয়াতে চাই।
বিজ্ঞান ঈশ্বর সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত নেয় নি, তাই ঈশ্বর আছেন কি নেই সেটা সম্পর্কে আমার কোন সিদ্ধান্ত নেই। তবে আমি ব্যাক্তিস্বত্তা কে সম্মানের জন্যে অনন্ত নরকই যদি সেই স্বৈরাচারী স্কাইড্যাডি আমার জন্যে বরাদ্দ করেন তাহলে আমি বলব ব্রিং ইট অন।