somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঈশ্বরচিন্তা - ৪

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৩:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঈশ্বরচিন্তা - ১

ঈশ্বরচিন্তা-২

ঈশ্বরচিন্তা-৩


মানুষের প্রাচীনতম ধর্মীয় অনুভুতি গুলো প্রথমত উৎপন্ন হয়েছিল একধরনের ভীতি থেকে। প্রথম যে মানব সমাজে অলৌকিকতার ধারনা এসেছিল তা সম্ভবত প্রকৃতিকে বুঝতে অক্ষমতার কারনেই। প্রাচীন সমাজে ধর্মমত গুলো প্রধানত ছিল যাদু নির্ভর। বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিকে না বুঝতে পেরে সেগুলোকেই উপাসনা শুরু করে প্রস্তর যুগের মানুষ। এ উপাসনা কিন্তু সম্পূর্ন পার্থিব কারনেই হত। প্রাথমিক উপাসনা সম্ভবত ছিল ঝড় বন্যা বজ্রপাত হতে বাচার জন্যে। সেজন্যেই আমরা দেখতে পাই প্রতিটি প্রাকৃতিক শক্তিকে উপাসনা করার ব্যাপারটি। সমাজ যখন আরো জটিল এবং কাঠামোবদ্ধ হয়ে এল তখন মানুষের মৌলিক চাহিদার বাইরেও অন্যান্য চাহিদা তৈরী হল। যার ফলে উপাসনার অনুষঙ্গও বাড়লো। শিকারে যাবার আগে শিকারের দেবতার উপাসনা বা মাছ ধরেতে যাবার আগে পানির দেবতার প্রতি উপাসনা সেগুলোই নির্দেশ করে।

প্রকৃতির কাছে উপাসনার সময়ই মানুষ আবিষ্কার করে প্রাচীনতম ধর্মীয় বোধ। পুরস্কার এবং তিরস্কার বা শাস্তি। কয়েকটি ধর্ম ছাড়া বাকি সব ধর্মই দাড়িয়ে আছে পুরস্কার এবং তিরস্কারের এই কাঠামোর উপর। তবে প্রাচীন সমাজে এই পুরস্কার বা তিরস্কারের ব্যাপারগুলো ছিল হাতে হাতে ফল পাবার মত। অর্থাৎ যখন পুরস্কার বা তিরস্কার হিসেবে চলতি জীবনের কোন অনুষঙ্গই উঠে আসত। হয়ত বাচ্চা হওয়ার জন্যে অথবা বেশী ফলনের জন্যে। খরায় ফসল জ্বলে গেলে সেটাকে ইন্টারপ্রেট করা হত দেবতাদের রোষ হিসেবে।

প্রাথমিক ধর্মগুলো তাই প্রকৃতিবাদী ছিল। এবং পুরস্কার বা তিরস্কারও সীমাবদ্ধ ছিল পৃথিবীর জীবনের মাঝেই। এই ব্যাপারগুলো পরিচালনার জন্যে শ্রমবিভাগ ঠিক কখন তৈরী হয়েছিল জানা যায় না। তবে পুরুহিততন্ত্র যে অন্যতম প্রাচীন প্রতিষ্ঠান এটা নিশ্চিত হওয়া যায়। পুরোহিতরা তাদের নিয়ন্ত্রন বজায় রাখার জন্যেই ধর্মবোধে নতুন রহস্যের আমদানি করে। তাদের হাতে ধর্মবোধের নিয়ন্ত্রন চলে যাওয়ায় একই সাথে তারা হয়ে উঠে রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস। আমরা দেখতে পাই কৃষিভিত্তিক সমাজে গ্রামগুলোতে গ্রাম্যপ্রধান দের সাথেই গুরুত্বের সাথে অবস্থান করতে পুরুহিত দের। প্রাচীন সমাজ গুলোতে গ্রাম্য প্রধান সাধারনত ন্যাচারাল লিডার বা অধিকতর সক্ষম মানুষেরাই হত। কিন্তু ক্ষমতার ভাগাভাগিতে যখন পুরুহিতরা ফ্যাক্টর হয়ে উঠল তখনই বোধহয় মানুষের মাঝে প্রথম "আনডিফাইন্ড" কোয়ালিটির মানুষরা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাওয়া শুরু করেছিল। যে ঐতিহ্য আমরা এখনও বহন করে চলেছি।

সমাজের জটিলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের চাহিদা এবং সে অনুসারে না পাওয়ার ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়। মানুষ পুজার ফলে প্রতিশ্রুত পুরস্কার না পাওয়ার ক্ষোভ যখন পুরুহিতদের সিংহাসন টালমাটাল করে দিল তখনই সম্ভবত জন্ম নেয় মানব ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ন ধারনা। পুরুহিতরা বুঝতে পেরেছিল নিয়ন্ত্রনের উদ্দেশ্যে মানুষকে তৃপ্ত রাখাও জরুরী। যখন পার্থিব চাহিদা পুরনে দেবতারা ক্রমাগত ব্যর্থ হচ্ছিল তখন বাধ্য হয়েই পুরুহিত দের খুজতে হয় জনসাধারনকে তৃপ্ত করার নতুন উপায়। মৃত্যুর পরের জীবনের ধারনা জন্মায়। পুরস্কারের সংজ্ঞা তাই পার্থিব থেকে সরে গিয়ে পরলৌকিক হয়ে উঠে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে স্বর্গ নরকের আলাদা সংজ্ঞা তৈরী হয় নি বলেই মনে হয়। মৃত্যুর পরের জীবনটাকে পার্থিব জীবনের আদলেই ডিজাইন করে পুরুহিতরা। সেখানে পুরস্কার আর শাস্তির তালিকা তাই তৈরী হয় পার্থিব ইন্দ্রীয় সুখ এবং কষ্ট কে ঘিরেই। সেখানে আমরা দেখতে পাই ক্ষুধা, পান, নারী সঙ্গের বর্ননা। আর শাস্তি হিসেবেও আগুন কেই বেছে নেয়া হয় যা চিরকাল মানুষের ভয়ের কারন।

এই প্রকৃতিবাদী ধর্মবোধ থেকে একেশ্বরবাদীতায় উত্তরন হয়েছে কোন দার্শনিক উৎকর্ষের জন্যে নয়। বরং আমরা দেখতে পাই গ্রীক মেধাবীরা বহু ঈশ্বরেই বিশ্বাস করতে। অন্যদিকে একেশ্বর বাদী হিব্রু সভ্যতার(যদিও মোজেস বা ডেভিড ,সলোমনের সময় হিব্রু ধর্ম পুরোপুরি একেশ্বর বাদী ছিল না। জিহোভা ছাড়াও আরো কিছু মাইনর দেবতার পুজা হত) কিন্তু সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞানের অবদান শূন্যের কোঠায়। একেশ্বর বাদ প্রধানত বিবর্তিত হয়েছে রাজনৈতিক কারনেই। পুরোহিতরা সবসময়ই সম্রাটদের তোষামোদী করত, আবার সম্রাটরাও পুরোহিত দের রয়েসয়ে চলত। সম্রাটের শক্তির প্রমান হিসেবেই পুরোহিতরা ঘোষনা করত কোন দেবতার সুপিরিয়রিটি। একযুগের দেবতা তাই অন্যযুগে অপাংক্তেয় হয়ে পড়ত। এভাবেই ক্রমাগত রাজনৈতিক শক্তির চালিকা হিসেবে পুরুহিত তন্ত্রই একদেবতার ধারনা নিয়ে আসে।

মানুষের মৌলিক নীতিবোধের সাথে স্বর্গ নরক কতটা কম্পাটিবল তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। তবে নরকের ধারনা আমি কোনভাবেই নৈতিক বলতে পারি না। অনন্ত শাস্তির ধারনা অসুস্থ ধারনা। বারট্রান্ড রাসেল জেসাসের নৈতিক চরিত্র নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কারন তিনি নরকে বিশ্বাস করতেন। আর নৈতিক বিষয়গুলোর বিকাশ এভাবে ভয় বা লোভ থেকে আসুক সেটাকে গ্রহনযোগ্য ভাবা যায় না। লোভ জিনিসটাই একটা কালো অনুভুতি। তাই সুস্থ নৈতিকতা লোভের মাধ্যমে মোটিভেটেড হওয়া উচিত নয়। আর ভয়ও একটি নৈতিকভাবে দুর্বল মোটিভেশন। পুরস্কার বা শাস্তি নয়, মানুষের মনে প্রয়োজন মানবতার মোটিভেশন। আমার সামনে বিপদগ্রস্ত মানুষ থাকলে তাকে আমি সাহায্য করব, এটার মোটিভেশন চিরায়ত মানবতাই হওয়া উচিত।

মানুষের ইতিহাসে অসংখ্য বর্বর অধ্যায় আমরা পার করে এসেছি। রোমান কলিসিয়াম থেকে শুরু করে ক্রুসেড, উইচ হান্ট, ভিন্ন মতালম্বীদের পুড়িয়ে মারা, জোসেফ স্ট্যালিন, এডলফ হিটলার, হেনরী ট্রুম্যান, বেন্জামিন নেতানিয়াহু,জুলফিকার আলী ভুট্টো, গোলাম আজম, জর্জ ডব্লিউ বুশ, সাদ্দাম, বলে শেষ করা যাবে না এত অমানবিকতার ইতিহাস। মানব সমাজের ইতিহাসে আমরা ক্রমাগত উদাহরন তৈরী করেছি নৃশংসতার, রক্তের আর মানবতার বিরোধী যুদ্ধের। কিন্তু তারপরও টিকে আছি আমরা। নতুন শিশুরা আসছে, তারা হাসছে কাদছে। এখনও পৃথিবীতে অবশিষ্ট আছে আনন্দাশ্রু। মানুষ টিকে থাকবে। তবে কোন প্রযুক্তি, মহান জ্ঞান, অসংখ্য ঈশ্বর, স্বর্গ নরকের হাইপোথিসিসের জন্যে নয়, মানুষ টিকে থাকবে মানুষের মনে থাকা নি:শর্ত মানবতার জন্যে। প্রতি যুগেই অন্তত কিছু মানুষ এই নি:শর্ত মানবতাকে রক্ষা করেছে, আগলে রেখেছে। এই যুগেও রাখবে। আর পৃথিবীতে টিকে থাকবে আনন্দাশ্রু।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৫:৩২
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×