বছর তিন চার আগের বইমেলার কথা। সেবা প্রকাশনীর স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। প্রচন্ড ভীড়, বেশিরভাগই স্কুল কলেজের ছেলেমেয়ে। সামনে এগুতে না পেরে এক কোনায় দাড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ কানে ভেসে এল এক তরুণীর মন্তব্য – “ভাবতে অবাক লাগে একসময় এই বই গুলো কিভাবে যে পড়েছি! এখন বুঝি এগুলো আসলে কোনো লেখাই না।“ তারপর কয়েকজন ভারতীয় লেখকের প্রশংসা করে তিনি বললেন যে এগুলোই আসল সাহিত্য। তাকিয়ে দেখলাম আমাদের সমবয়সী এক তরুণী তার বান্ধবীর সাথে কথা বলছে।
আমার বলতে ইচ্ছা হলো – “একজন পাঠক পড়তে পড়তেই পাঠক হয়ে উঠে। সবকিছুই সবাই পড়ে না,যেটা তার ভালোলাগে সেটাই সে পড়ে। সেবার সবচেয়ে বড় অবদান এটাই যে, কিশোর কিশোরীদের ভালোলাগার মতো বই তারা প্রকাশ করেছে। সে বইগুলো সাহিত্যের মাঝে পড়ুক আর নাই পড়ুক, পড়ে তারা মজা পেয়েছে এবং ধীরে ধীরে তারা অন্য বইও পড়তে শিখেছে। আপনার এখন যে পাঠক মন তৈরি হয়েছে, তার ভিত্তি কিন্তু তৈরি হয়েছে এসব ‘বস্তাপচা’ বইগুলো পড়েই।“
বললাম না। কারণ বক্তা একজন তরুণী, তায় আবার সুন্দরী। বলামাত্র ঝগড়া লেগে যেতে পারে এবং নিশ্চিতভাবেই সে আশেপাশের মানুষের সমর্থন পাবে। আমি একটু গুতাগুতি করে সামনে গিয়ে কয়েকটা বই কিনে সরে আসলাম।
ক্লাস ফাইভ বা সিক্স এ থাকার সময় পরিচয় হয় সেবার সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং উপভোগ্য সিরিজের সাথে। মাসুদ রানা। বইয়ের শুরুতে রানার পরিচিতি পড়ার পর বইটা না পড়ে থাকা খুব কঠিন। “সীমিত গন্ডীবদ্ধ জীবনের সীমানা ছাড়িয়ে আপনাকে নিয়ে যাবে স্বপ্নের এক মায়াবী জগতে। আপনি আমন্ত্রিত।“ সেই আমন্ত্রন অগ্রাহ্য না করে পড়া শুরু করলাম মাসুদ রানা। প্রথম পড়েছিলাম “বিদেশী গুপ্তচর-১”। দ্বিতীয় পর্বটা আঙ্কেলের আলমারিতে ছিলো না। সেটা পড়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেক কটি বছর। পূর্ণাঙ্গ বই পড়েছিলাম “আমিই রানা” তারপর একে একে পড়া হয়েছে “ধ্বংস পাহাড়”, “ভরতনাট্যম”, “সতর্ক শয়তান” সহ অসংখ্য বই। তবে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে “অগ্নিপুরুষ” বইটি। কেউ যদি হুমায়ুন আহমেদের অমানুষ বইটি পড়ে মুগ্ধ হয়ে থাকেন, তাহলে অনুরোধ করব “অগ্নিপুরুষ” পড়ে দেখার । পড়ার পর অমানুষকে মনে হবে দুধের স্বাদ ঘোল দিয়ে মেটানো হয়েছে। অবশ্য “অমানুষ” ও প্রথম রহস্য পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিলো। দুটোই “ম্যান অন ফায়ার” বইয়ের অবলম্বনে লেখা। কিন্তু যে আবেগ নিয়ে “অগ্নিপুরুষ” লেখা হয়েছে, “অমানুষ’ এ তা নেই। এখনো “অগ্নিপুরুষ” পড়লে আমি শিহরিত হই।
সেবার আসল রত্ন যেটাকে আমি মনে করি, তা হচ্ছে এর অনুবাদ। বাংলাদেশ এবং ভারতের অনেক ভালো লেখকেরা অনেকে অনুবাদ করেছেন, কিন্তু আমি এ কথা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, সেবার অনুবাদ এর চেয়ে অনেক অনেক ভালো।
অনুবাদ মানেই প্রতিটি লাইন বা প্যারার বাংলা অনুবাদ নয়। এমনকি মূল কাহিনীর পুরোটা অনুবাদ করতে হবে এমন কোন বাঁধাধরা নিয়মও নেই। মূল কাহিনীর মজাটা পাওয়া যায়, এমনভাবে উপস্থাপনা করলেই সেটাকে ভাল অনুবাদের কাতারে ফেলা যায়। আর সেবার অনুবাদ এগুলো অনুসরন করে বলেই সে অনুবাদগুলো হয়ে উঠে অসাধারণ।
সেবাকে নিয়ে যে যাই বলুক, আমি একটা কথা বলতে কখনোই কুন্ঠাবোধ করবো না – আমার যে পাঠকসত্বা আছে, তার জন্য আমি সেবা প্রকাশনীর কাছে ঋণী। কৈশোরের সেই অলস দুপুরগুলো রাঙিয়ে দিয়েছিলো যে বইগুলো, সেগুলোকে আমি কি করে ভুলি?