somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ অপ্রাপ্তির পাপ

১২ ই অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১.
- বাবা তুমি এমন করছো কেন? প্লিজ, এইসব পাগলামো ছাড়ো!!
ডক্টর স্যাম করুণ সুরে চিৎকার করে ওঠলো।
রাতের বেলগ্রেডের আকাশে অমাবস্যার ঘোর নিরবতা! আলোর বন্যায় পথঘাট ভেসে গেলেও দানিয়ুবের স্রোত বেয়ে বেয়ে এক দুঃখের প্রস্রবণ বয়ে আসছে স্যামের ঘরে।
এক সপ্তাহ যাবৎ প্রফেঃ রাফা উদ্ভট দাবিটি করে আসছেন। অর্ধশত বৎসর আগের পাপের প্রায়শ্চিত্য করতে চাইছেন স্যামের বাবা। বয়স ষাট পয়ষট্টির মতো অথবা একটু বেশিই হবে। ভাল নাম ডাক আছে এমন দুই জন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছেও তাকে স্যাম নিয়ে গিয়েছিল। তিন তিনটি সাইকোলজিক্যাল টেস্ট করা হয়েছে। মাথায় তেমন কোন গোলমাল নেই। সুনির্দিষ্ট রোগের ক্যাটাগরিতে ফেলাও সম্ভব হয়নি।
অদ্ভুত বাসনা হলো তিনি এ পৃথিবীতে আর বেঁচে থাকতে চান না। ছেলে নিজের হাতে বালিশ দিয়ে চেপে যেন তাঁকে হত্যা করে। তাও মাঝরাতে, তিনি ঘুমানোর পর, যেকোন দিন। স্বাভাবিক পরিবেশে তাঁর অজান্তে এ কাজটা যেন ছেলে করে ফেলে।
অথচ মাসখানেক আগেও ওয়েস্ট সিটির কাউন্সিলর জিসান জকোভিচের মেয়ে জারার সাথে বিয়ের জন্য কথা পাকাপাকি করে এসেছিলেন, যারা কিনা এই শহরের সবচেয়ে অভিজাত পরিবার।
বেশিরভাগ চুলই পেকে গেছে। ভদ্রলোক বেলগ্রেড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস অনুষদে পড়ান। বাংলাদেশ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ইতালির মিলানে পুনরায় সেকন্ডারি এজুকেশন নিয়েছিলেন। এরপর ইউরোপের বড় বড় সব জায়গা ঘুরেছেন। ডক্টরেট করেছেন বার্লিন থেকে। বিয়েও করেছেন দীর্ঘদিনের সংগী সার্বিয়ান স্যামিন জোবানভিচকে। দেশে বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়সমুহে সম্মানিত হয়েছেন, নিমন্ত্রিত হয়েছেন বহুবার। এইরকম একজন স্মার্ট, সুশিক্ষিত, আধুনিক এবং সর্বোপরি বিঃখ্যাত ব্যক্তির ভাবমূর্তির সাথে এই ধরণের দাবি কোনভাবেই যায় না। একরোখা, অপরিবর্তনীয় সিদ্ধান্ত যেন নিয়ে রেখেছেন! লোকটি একদম অনঢ়।

প্রফেসরের সিদ্ধান্ত বদলাবার প্রচেষ্টায় মিসেস জকোভিচ এসেছিলেন একটু আগে। মেয়ের জামাইর বাবাকে এইরকম সিদ্ধান্ত নেয়াটা যে মোটেও যৌক্তিক নয়, সিম্পল এই ব্যাপারটা তিনি বোঝাতে র‌্যর্থ হয়ে চলেও গেলেন। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শ্বাশুরির সাদা মার্সিডিস গাড়ির দিকে হতাশ দৃষ্টিতে অশ্রুসজল চোখে তাই দেখছে স্যাম ও জারা। জারা সাধারণত সোসাইটির বেশ কিছু কাজ করে যা এখন বন্ধ করে ২৪ ঘন্টাই বাসায় থাকছে, যেহেতু স্যামের বাবা উল্টাপাল্টা আচরণ করছেন।

অনেক কিছুই ভাবছে স্যাম। জীবন নিয়ে রাফা অনেক বড় বড় কথা বলতেন। জীবনের মটিভেশন হলেন বাবা। অমনোযোগি ছাত্রদের জন্য বিশেষ কনফারেন্সে তার বাবাকে অনুরোধ করা হতো। মোটিভেশনাল স্পিচের জন্য কতই না বিখ্যাত তার বাবা। এই লোকটাকে কে বোঝাবে? কার সাধ্য আছে এমন?
যে লোকটা দেউলিয়া হয়ে যাওয়া জিওলভিকে পুনরায় কোটিপতি হবার জন্য মোটিভেশন লেটার পাটিয়েছিল মস্কোতে সেই লোক কিভাবে হুট করে এতটা পাল্টে যাবে? স্যামের মনের পর্দায় ভেসে ওঠলো ছোটবেলার এক দুর্ঘটনার কথা।
ফ্যান্টাসি ওয়ার্ল্ড থেকে বের হয়ে একবার একটা মিলিটারি গাড়ি তাদেরকে চাপা দিতে প্রায় কাছাকাছিই চলে এসেছিল। কোনকিছু বিকল্প না ভেবেই স্যামকে বুকে আঁকড়ে ধরে তিনি লাফ দিয়েছিলেন নীচে। পড়ে গিয়ে পা ভেংগেছিল তার বাবার। স্যাম এই ভালবাসার কোন মানে খুঁজে পায়নি। রক্তের সম্পর্ক কতটা শক্তিশালি হতে পারে সেটা বুঝতে হলে এই ধরণের ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়।
ক্লাস টেনে পড়ার সময় স্যামের মনে মনে আকাংখা ছিল একটা প্লে স্টেশন কেনার। তাঁর বাবার মাসিক আয় খুব কম ছিল তখন। স্যাম কখনোই সেটা আশা করেনি। কিন্তু মাধ্যমিক পরিক্ষা শেষ করার পরের দিন সে বিস্মিত হয়েছিল। এত টাকা কোত্থেকে পেলেন তার বাবা?
বেশ পরে প্রতিবেশি জ্ঞাতি রিখার্ডোর কাছ থেকে জেনেছিল তিন মাস পায়ে হেঁটেছিলেন প্রফেসর রাফা! আর্থিক সংকট থাকলে নাকি প্রফেসররা এইরকম কাজ করে থাকে।
আচ্ছা বাবারা এত ভাল কেন হয়? সন্তানকে ভালবেসে তারা কি এমন সুখ পান?? বাবাদের কি নিজেদের স্বাদ আহ্লাদ থাকতে নেই??
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আনমনে এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিল স্যাম। কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রফেসরের কান্ডজ্ঞানহীনতা নিয়ে ভেবে পুনরায় হতাশ হলো। শেষমেষ বড় দুই পেগ হুইস্কি গলায় ঢেলে মানসিক স্থিরতার জন্য ঘুমিয়ে পড়লো যেটা সচরাচর করতে তাঁকে দেখা যায় না।

জারা খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠলো আজ। কাল পরিস্কার করা হয়নি কিচেন। প্রথমে সেগুলো ধুতে শুরু করলো। ইদানিং এগুলো নিয়ে সে বেশ দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছে।
তার কিছু সময় পরে ঘুম থেকে ওঠলো স্যাম। বেশ কিছুক্ষণ কাচের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করতে হলো তাঁকে। এরপর শাওয়ার নিয়ে সকালের নাস্তা করল।
সে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেছে তার অনেক পরে ঘুম থেকে উঠেই জারা জকোভিচকে কোমল গলায় ডাক দিলেন প্রফেসর। কফি দিতে অনুরোধ করে তিনি কাঁপা কাঁপা পায়ে ওয়াশরুমে ঢুকলেন। বেলা করে ওঠায় তাকে কেমন যেন দেখাচ্ছে! ভদ্রলোক খুব সময়নিষ্ট মানুষ। এমনিতে কখনোই লেট করেন না, অফ-ডে হলেও না। বরং ছুটির দিনই বেশিরভাগ সময় তিনি ব্যস্ত থাকেন।
হুট করে কি থেকে কী হয়ে গেল কেউই ভেবে পেল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের কাছে তিনি রেজিগনেশন লেটার দিয়ে বাসায় চুপচাপ থাকলেন। নিত্যদিনের রুটিন বাদ দিয়ে কেবল প্রাচীন বইপুস্তক পড়তে থাকলেন। খাওয়া দাওয়া সবই অনিয়মিত এক সপ্তাহ যাবত।

পানি ঝাপটা দিয়ে বের হবার সময় জারা বয়স্ক লোকটাকে দেখল। ডাইনিং এ না দিয়ে বাসকক্ষেই সে নিয়ে এসেছে পুরো নাস্তার ট্রে।
বৃদ্ধ লোকটা সারা রাত নিশ্চয়ই কেঁদেছে। চোখ দুটি ফোলা রয়েছে এখনো। হালকামতোন ভাঁজ হওয়া গালের চামড়া আজ যেন অনেক কুঁচকে গেছে। একমাস আগেও তাকে দেখে মনে হতো বয়স ৪০ এর কাছাকাছি বা সামান্য বেশি। অথচ এখন মনে হচ্ছে ৩০ দিনে ৩০ বৎসর বেড়ে গেছে বেচারার বয়স!
- বাবা! আপনি এইরকম করছেন কেন, আমাকে বলবেন?
- না রে মা। আমি পাপ করেছিলাম। পাপ। যে পাপের প্রায়শ্চিত্য না করলে আমি কোনদিনও শান্তি পাব না। ঐ ওপারে চলে গেলেও না।
- কি এমন পাপ! যে আপনাকে ছেলের হাতে খুন হতে হবে?
- না মা! এটা আমি বলতে পারবো না। বলা যায় না, আমি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো একদিন চলে যেতে পারি। তখন ছেলেকে বলিস আমার স্কুল লাইফের ডায়েরিটা যেন পড়ে। ঐটায় লিখে রেখেছি আমার পাপের ব্যাপারটা!
- ছিঃ বাবা! এইভাবে বলছেন আপনি!! একজন আধুনিক মানুষ হয়েও আপনি পাপ পুণ্যের হিসেব করছেন?
- স্যরি মা। আমি এগুলো নিয়ে আলাপ করতে চাই না। তুই বরং নিজের কাজ কর। আমাকে একটু একা থাকতে দে।

আর কোন উচ্চবাচ্য করলো না জারা। এমনিতেই সাইকো পাবলিক নিয়ে সে ভয় পায়। নার্সারিতে পড়ার সময় এক সাইকো মেডাম তাঁদের পড়াতেন। তিনি যে সাইকো ব্যাপারটা কেউ জানত না। তবে এটুকু জানা ছিল উনি রেগে গেলে বেশ ভয়ানক হন। কিন্তু বাচ্চাদের কাছে মনে হতো মানুষ থেকে অন্য ভয়ানক প্রাণির মতো আচরণ করতেন। জারার চোখে এখনো দিনের আলোর মতই ভাসে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে গর্জন করে ম্যাম খপ করে তার হাত ধরে ফেলেছিলেন। লোহার ন্যায় শক্ত দাঁতগুলোর সাহায্যে ওর কচি হাতে কামড় দিয়ে রক্ত বের করে ফেলেছিলেন। সাথে সাথেই অন্য বাচ্চারা আতংকে চিৎকার করতে থাকে। প্রচন্ড গোলমাল শুনে পাশের ক্লাস থেকে স্যার/ম্যামরা এসে পড়েছিল। অনেক কষ্টে ঐ মহিলার হাত থেকে জারাকে উদ্ধার করা হয়।
এখন অনেক বড় হয়েছে সে। কিন্তু সেই ঘটনার পর থেকে মেন্টালি সিক/সমস্যা আছে এমন কারো কথা শুনলে অন্তত একবার ঢোক না গিলে সে পারে না। স্বভাবতই নতুন কোন ভয়/বিপদের আশংকা কমবেশি সে পাচ্ছে প্রফেসরের কাছ থেকে। অতএব সে হাল ছেড়েই দিল।
ঠিক ছেড়ে দিল যে, তাও আবার না। বরং ফোন করে ডায়েরিটা পাবার একটা চেষ্টা করলো। স্বামীর সাথে করা প্লান মোতাবেক সে বুদ্ধি করে সফট ঘুমের ওষুধও একসময় খাইয়ে দিল প্রফেসরকে। বেশ ভাল একটা ব্যাপার হলো প্রফেসরের ব্যক্তিগত বুকশেলফ এখন আর লক করা থাকে না। বইয়ের মাঝে মাঝে বেশ কিছু ডায়েরি আছেে। বেশিরভাগই ইংরেজিতে তবে রাশিয়ান, বাংলা, উর্দু এবং পার্সিয়ানও আছে। হিস্ট্রি নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে তিনি বেশ কয়েকটি ভাষাও রপ্ত করতে পেরেছেন। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস বিশারদ হিসেবে পশ্চিমে তাঁকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে গণ্য করা হয়।
প্রফেসর রাফা ঘুমে থাকতে থাকতেই ইউনি থেকে স্যাম চলে আসল। উর্দু/পার্সিয়ান/আরবি কেউই জানে না। তবে রাশিয়ান/সার্বিয়ান উভয়ই জানে। স্যাম অবশ্য বাংলা/ইংরেজি জানে ভালই।
সবমিলিয়ে প্রফেসরের লেখা ২৭ টি ডায়েরি তারা নিজেদের শয়নকক্ষে সরিয়ে আনল। চমৎকার হাতের লেখা স্যামের বাবার। এইরকম গুণী একজন মানুষের জন্ম দুর্নিতি-পীড়িত বাংলাদেশে। সে কখনো যায়নি ওখানে। সবচেয়ে বড় কথা স্যামের জন্মদাতা পিতা তিনি। এই লোকটি ছাড়া রক্ত সম্পর্কের কোন মানুষ এ পৃথিবীতে সে চিনেই না। বাংলাদেশে নাকি এখনো আছে তার চাচা ও চাচাত ভাই-বোনেরা। ২০-৩০ বছর পরে ওখানে গিয়ে নাকি কোন লাভ হবে না বলেই জানিয়ে আসছেন জ্ঞানোদয়ের পর থেকে তাকে। সেও তেমন জোরাজুরি করেনি। তবে এখন প্রফেসরকে নিয়ে স্টাডি করতে হবে। প্রাইভেসির ওপর আর সম্মান রাখলে আর চলছে না।
বাংলায় লেখা আছে ৪টি ডায়েরি। একটি ডায়েরির কাগজগুলো নিম্নমানের। স্যাম এটা খুব সাবধানে খুলল!

২.
"আজ জেল থেকে বেরুলাম। পুলিশকে ১২ লাখ টাকা দিতে হয়েছে। বড় চাচার কারণে খুনের মামলায়ও জামিন পেয়ে গেলাম। খুন তো আমিই করেছি। কিন্তু আমার মাথায় এছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। ছোটবেলা থেকেই বাবা আমার প্রতিটি আবদার পূরণ করে আসছে। একটা দাবীও অপুর্ণ রাখেনি।
তাঁর চাওয়া বেশি কিছু ছিল না। এসএসসিতে এ+ পাওয়া ছিল তাঁর প্রাণের চাওয়া। আমি সেটা করতে পেরেছি।
সত্যি হলো আমি পারিনি। ঠিকঠাক নিয়মে পরিক্ষা দিলে নির্ঘাৎ ফেল করতাম। ভ্যাগিস, গ্রুপে আমি ছিলাম। কোন টাকা ছাড়াই আমরা সবাই প্রশ্ন পেয়েছি। পাসের বাবা, দাদা চৌদ্দগোষ্টি উদ্ধার করে ফেলেছি আমরা!
আমার দাবি ছিল নতুন ৩ টেরাবাইট পিসি, ১ টেরা ল্যাপটপ কোর আই সেভেন, 160 cc আরএক্স মোটরবাইক আর পঞ্চাশ হাজার টাকা। বাবা বলেছিল কোন সমস্যা নাই। সে দিবে। কিন্তু ৩ মাস হয়ে গেল।
আসলে ঘুষের টাকার অভাব ছিল। ডিজিটালাইজ করার পর ঘুষের পয়সা কমে গিয়েছিল। নতুন সুযোগের পেছনে তখনও বাবা তদবির করে যাচ্ছিল।
বাবা দিচ্ছি দিচ্ছি করে মোটরবাইকটা দেয়নি। তিন মাস হয়ে গেল। আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। কতোবার ঝগড়া করলাম, কাপ পিরিচ প্লেট ভাঙ্গলাম, দরজায় লাত্থি দিলাম, শো কেসের গ্লাস ভাঙ্গলাম। কিন্তু বাবার টাকা জোগাড় হয়নি।
১৭ সেপ্টেম্বর আমার মাথায় খুন চেপে গেল।
দরজা খোলাই ছিল। রাত আড়াইটায় গিয়ে চেপে ধরেছিলাম। বালিশটা তার নাকের ওপর ধরেছিলাম। বেশি কিছু করতে পারেনি। একটু নড়াচড়া করেছিল। কিন্তু লাভ হয়নি। আমার হাতেই মরণ লেখা ছিল....."


ডায়েরিটা পড়ে স্যামের মনে হলো ছাদ চক্রাকারে ঘুরছে তার চারদিকে। নিঃশক্তির মতো দুর্বলতা গ্রাস করলো তাঁকে। চোখের তরল অংশের রাসায়নিক বস্তু ঝাড়বাতির মতো জ্বলানিভু করতে করতে স্নায়ুতন্ত্র যেন বিকল করে দিল। স্নায়ুতে শিরশির একটা স্রোত এসে গা গুলিয়ে আসছিল। তাঁর মনে হলো এখনই সে পড়ে যাবে। জারা তাকে খপ করে না ধরলে পিলারের সাথে লেগে মাথা ফেটেই যেত এখন। টেনে টেনে বিছানায় নিয়ে আসলো অনেক কষ্টে।

জারা বাংলা ভাষা জানে না। ঐ অংশটুকু তাই বুঝতে পারছিল না। এসি ছেড়ে দিয়ে স্যামকে কিছুক্ষণ আরাম করতে দিলো। এরপর ডাক্তর এলোমচি'কে ফোন করলো আর নিজে থেকে জগ থেকে পানির ঝাপটা দিয়ে তাকে সজাগ করলো। দশ মিনিটের মধ্যেই ডাঃ এলোমচি চলে আসলেন। স্যামকে হালকা টিপস দেয়া ছাড়া আর কিছু করা লাগলো না, বেশ সুস্থ হয়ে ওঠলো এর মধ্যে। স্বাভাবিক হবার পর সে পুলিশ ইন্সপেক্টর অ্যানা'কে ফোন করলো।
অ্যানা স্যামের ভাল বন্ধু। অ্যানার সাথে তাঁর জীবনের বহু গোপন ব্যাপার স্যাপার, আনন্দ-দুঃখ, সুখ-অসুখ জড়িত। ছোটবেলার রোমাঞ্চকর কিছু কাজে তারা দুজন একে অপরের সাথী ছিল। এখনো তাদের সম্পর্কটা খুব ভাল আছে। অ্যানার কাছে একটা লোক আছে যাকে মেকআপ করালে দেখতে হুবহু স্যামের মতোই লাগবে। তাঁরা একটা পিকনিক আয়োজনের পরিকল্পনা করলো। আগামি রবিবার লিসবনের উদ্দেশ্যে তারা রওয়ানা হবে।

৩.
শেক্সপিয়র বলেছিলেন- পৃথবীটা রঙ্গমঞ্চ! আমরা খালি অভিনয় করে চলেছি। স্যামের কাছে ব্যাপারটা মুর্ত মনে হয়। তার কাছে বেঁচে থাকাটা যেন চার মাত্রার একটি চলচিত্র। সময়ের বক্ররেখা বরাবর স্থানের তিনটি মাত্র নাকাল হয়ে কেবলই ছুটছে। মানুষেরা প্রাণপণে চাচ্ছে যেন সময়ের গতিটা থামানো যায়, কিন্তু পারছে না। কারণ এটার স্ক্রিপ্ট আগে থেকেই লেখা। বদলানো যায় না। যাবে না। মাঝে মাঝে লুপ আছে এই চলচ্চিত্রে। একই ব্যাপার ঘটছে চক্রাকারে। লুপ কেবল জায়গাটা বদলাচ্ছে। আর মানুষ নামের চরিত্রগুলো বদলে যাচ্ছে, চিত্রনাট্যকে আরো বিচিত্র করতে লুপগুলো স্রষ্টা নামের বিরাট শিশু অনিঃশেষ কলম দিয়ে লিখে চলেছে আনমনে।
স্যাম নিজেকে একটা লুপের শেষ করার অবস্থানে দেখতে পায়। তবে কালের প্রবাহে প্রকৃতির কোনকিছুই এক জায়গায় থাকতে পারে না। দুইদিন আগের একরোখা, অনঢ় প্রফেসর আজ ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছেন। অস্বাভাবিক দিনগুলো কেটে যাচ্ছে স্যামদের।

তারা একসাথে ডিনার করেনি অনেকদিন হলো। এদিকে স্যামদের ঘর কেমন যেন স্বাভাবিক হয়ে গেল। আজ এই পরিবারের সব সদস্যই মুডে আছে। ডিনারে বসে রসাত্ববোধক দু-একটা কথাও চরম রসাত্ববোধক বাক্য বলেছেন প্রফেসর রাফা। জারার কাছে সবচেয়ে ভাল খবর হলো তিনি তার অদ্ভুত দাবী থেকে সরে এসেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন- জীবনটাকে এভাবে শেষ করে দেওয়াটা আসলেই অন্যায়। পৃথিবীতে কাজের মানুষ খুব কম। এই ভুবনটাকে অসুন্দর, আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত করতেই দিন চলে যায় বেশিরভাগ মানুষের। অথচ তারা বাঁচেও বেশিদিন। কাজের মানুষেরা এভাবে চলে গেলে কি হবে?
আসলে তিনি আবেগের বশে এটা করতে চেয়েছিলেন। এখন নেহায়েত বাচ্চামি বলে এটা সনাক্ত করলেন এবং কয়েক দিনের অনিয়ম, উশৃংখলতার জন্য দুঃখপ্রকাশ করতে থাকলেন ছেলে, ছেলের বউ দুজনের কাছেই।

৪.
নাটকীয়ভাবে কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেল প্রফেসর রাফার পরিবার নিয়ে। প্রথমত তিনি নিজেকে খুন করতে আদেশ করতেন ছেলেকে। এরপর তাঁর কিছু স্টেটমেন্ট পাওয়া গেল পারিবারিক বন্ধুর কাছে। যেগুলোতে তাঁর মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী না করতে বারবার সাবধান করেছেন। যেদিন প্রফেসর খুন হন সেদিন লিসবনে ছিল স্যাম। পুলিশ ইন্সপেক্টর অ্যানা, এডভোকেট কার্লো, ওয়েস্ট সিটি এডমিনিস্ট্রেটর মিস্টার রাবয়েতোর সাথে পিকনিক করছিল তারা।
তরুণ গবেষক ডক্টর স্যামকে এরেস্ট করা হয়েছে! খবরটা অনলাইন/অফলাইনে ভাইরাল এখন। ওঁর বাবার পুরনো পাপের বিস্তারিত তুলে ধরে খবরের কাগজগুলোর কাটতি হচ্ছে খুব। পিতার পাপের প্রায়শ্চিত্য করতেই নাকি সে শাসরুদ্ধ করে বাবাকে হত্যা করেছে। সাংবাদিকরা তাদের নিজেদের মতো খবর তৈরি করছে। তাদের দরকার কাটতি। পুলিশের কাজ করা শেষ। সন্দেহভাজন হিসেবে পুত্র, পুত্রবধু এবং পারিবারিকভাবে চলাফেরা আছে এমন কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চ তাদের কাজ করে চলেছে কোন গুজবে কান না দিয়ে। আদালতের কার্যক্রম চলছে এই মার্ডার কেস নিয়ে। জেলের ভিআইপি সেলে বেশ আয়েশে দিনগুলো কেটে যাচ্ছে স্যামের। ইন্সপেক্টর অ্যানা ও এডভোকেট কার্লো তাঁর সাথে প্রায়ই দেখা করতে আসছেন।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ২:০১
৩৬টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×