পাকিস্তান আমলের কথা--একজন ১৪ -১৫ বৎসরের বালক সিনেমাতে অভিনয় করবে এই স্বপ্ন নিয়ে বাড়ী (চাঁদপুর) থেকে পালিয়ে ঢাকার FDC এর গেইটে দাড়িয়ে আছে , সুযোগ খুজছে ভিতরে ঢুকার জন্য , কিন্ত্তু কিছুতেই গেইটের দাড়োয়ানের মন গলানো যাচ্ছে না, অনেক আকুতি মিনতি করার পর ও কাজ হলো না।এই সময় গেইট দিয়ে একজন ভদ্রমহিলা ঢুকার সময় দাড়োয়ন তাকে বললো , “ম্যাডাম দেখেন তো , এই ছেলে বলে সিনেমা করবে , ভিতরে ঢুকতে চায়” ।তখন ভদ্রমহিলা ছেলেটিকে সাথে নিয়ে FDC তে ঢুকলো , তার কাছ থেকে সব শুনে বললো , “আমি একজন অভিনেত্রি, আমার নাম আনোয়ারা ,তুমিতো এখনো ছোট , মেট্রিক পাশের পর আমার সাথে দেখা করো , আমি তোমাকে সিনেমায় চান্স দিব” ।
তিন বছর পর, মেট্রিকের সার্টিফিকেট সহ FDC র গেইটে দাড়িয়ে আছে এক কিশোর , কিন্ত্তু অভিনেত্রি আনোয়ারার আর দেখা নেই , দাড়োয়ান ভিতরে ঢুকতেই দিলোনা। এভাবে প্রতিদিন সকালে FDC র গেইটে দাড়িয়ে থাকে , দু তিন এর মধ্যে বোডিং এ থাকার পয়সা ও প্রায় শেষ । তারপর বিনে পয়সায় রাতে থাকার জন্য বেছে নিল নির্মানধীন মধুমিতা সিনেমা হলের ছাঁদ । রাত ১০টার পর চুপি চুপি গিয়ে সেখানে ঘুমিয়ে থাকতো। তার মত আরো কয়েকজন ও রাতে এখানে থাকতো। এভাবে কিছুদিন থাকার পর খাওয়ার টাকা পয়সাও শেষ পর্যায় ।
একদিন FDC এর গেইটে দাড়িয়ে থাকা মানুষের আলাপ আলোচনা থেকে শুনলো, সিনেমার সাথে জড়িত লোকজন তখনকার নামকরা হোটেল পূর্বানী তে আড্ডা মারতে যায়। তখনই ঠিক করলো হোটেল পূর্বানী তে চাকরি নিবে। খুজে বের করলো দেশী একজন , যার সুপারিশে চাকরিটা হয়ে গেল ওয়েটার হিসাবে। প্রতিদিন সিনেমার পর্দার মানুষজনকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেতো ,আর স্বপ্নোটা আরো বড় হতে লাগলো।
কয়েক বৎসর পর একদিন হোটেল পূর্বানীর বার্ষিক মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পেলো।এভাবে আরো কয়েক বৎসর গেল । বিয়ে করে সংসার ও শুরু করলো। ভাগ্যক্রমে একদিন হোটেল পূর্বানীর বার্ষিক মঞ্চ নাটকের দর্শকের সারিতে চলচ্চিত্র পরিচালক অমল বোস ছিলেন, সেই নাটকে দিলদার সাহেব একটি কৌতুক চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন । নাটক শেষ হওয়ার পর তিনি তাকে ডেকে পাঠালেন, বললেন , “তুই সিনেমায় অভিনয় করবি” সাথে সাথেই উত্তর , জি স্যার , প্রথম ছবি “ কেন এমন হয় “ ছোট্ট একটি চরিত্র—প্রানবন্ত অভিনয়ের জন্য সবার নজড়ে পড়ে গেলেন । তাকে আর কখনোই পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।আমি এতক্ষন যার কথা বললাম উনি আমাদের সবার প্রিয় কৌতুক অভিনেতা “দিলদার”।
মানুষ যদি সৎভাবে , পরিশ্রম করে তার স্বপ্নের পিছনে ছুটে , স্বপ্ন ধরা দিবেই , তার বাস্তব উদাহারন হচ্ছে জনাব দিলদার।
এই জুলাই মাসের ১৩ তারিখ ছিল উনার ১৩তম মৃত্যু বার্ষীকি।
উনি ছিলেন আমার শ্রদ্বেয় শ্বশুড় এবং ফুফা। তাই উনাকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি । খুবই সাধারন জীবন যাপন করতেন, নির্লোভী মানুষ ছিলেন ।
জনাব দিলদার জীবনে প্রায় ৬০০ এর অধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন ।ছয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ।দেশের সীমানা পেরিয়ে কলকাতায় ও উনি সমান জনপ্রিয় ছিলেন ।বাংলাদেশের একমাত্র কৌতুক অভিনেতা ছিলেন যার প্রারিশ্রমিক কোন কোন ক্ষেত্রে নায়কদের চেয়েও বেশি ছিল। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে মোট চলচ্চিত্র নির্মান হয় ৬৩ টি, যার মধ্যে ৫৭টিতেই দিলদার সাহেব অভিনয় করেন । পরিচালকদের অনুরোধে উনাকে একটা গানের জন্য হলেও অভিনয় করতে হয়েছে অনেক চলচ্চিত্রে।
জনাব দিলদার এমন একজন গুনি ,জনপ্রিয় কৌতুক শিল্পী ছিলেন যার মৃত্যূতে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র , কৌতুক শিল্পে বিশাল পিছিয়ে পরেছে , যার অভাব দীর্ঘ ১৩ বৎসরে ও পূরন হয়নি।
সবাই উনার জন্য দোয়া করবেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০১৬ সকাল ১০:২৬